আলিপুরে ভেঙে ফেলা হল বিজি প্রেসের প্রাচীন ভবন। নেটমাধ্যমে তার ছবি আসতেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। এই প্রাচীন ছাপাখানা এবে আলিপুরের তিনটি জেলভবন ভেঙে তৈরি হবে আধুনিক আবাসন।
লেখক-গবেষক-শিল্পী ব্রায়ান পল বাখ, থেকে কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন ডিজি তথা বরিষ্ঠ স্থপিত-বাস্তুকার দীপঙ্কর সিনহা শনিবার আলিপুরের বিজি প্রেসের ছবি ফেসবুকে দিয়ে লিখেছেন, একটা অধ্যায় হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিক্রিয়ায়ও আসছে এই সব পোস্টে।
অতি সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী লিখেছেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকার আলিপুর সংশোধনাগার ও চার পাশের এলাকার রূপান্তরের এক বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটি বিতর্কিত; সেই বিতর্ক এখানে আলোচ্য নয়। তবে বলা হয়েছে, প্রকল্পের একাংশ থাকবে সংগ্রহশালার জন্য,
স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে, হয়তো অন্য বিষয়েও। আরও ঘোষণা, অদূরে সরকারি মুদ্রণশালা (বি জি প্রেস) এই প্রকল্পের অংশ হবে, তার জমি নিলামের তোড়জোড় চলছে।
বি জি প্রেস এবং অন্যান্য সরকারি ছাপাখানা মুদ্রণযন্ত্র ও আনুষঙ্গিক সামগ্রীর অমূল্য আকর। সেগুলিও কি নিলাম হবে? যদি হয়, ভারতীয় মুদ্রণের ইতিহাসের উপাদান রক্ষার শেষ সম্ভাবনা অন্তর্হিত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সারা বিশ্ব। যন্ত্রগুলি এখনও সরকারের হাতে। সরকারি আদেশ ও আবেদনে অবশ্যই আরও নানা সামগ্রী এখনও বিলুপ্তি থেকে উদ্ধার করা সম্ভব। সেগুলি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের উপযুক্ত স্থান ওই চত্বরেই মজুত, একই প্রকল্পের অংশ হিসাবে। এমন সুবর্ণ সমাপতন বড় হয় না। সর্বভারতীয় স্তরে যা সম্ভব হল না, রাজ্য স্তরে তার অন্তত কিছুটা বাস্তবায়িত করার এই শেষ সুযোগ দু’হাতে গ্রহণ করা জরুরি। এই কাজের উপযুক্ত অনেক উৎসাহী প্রশিক্ষিত তরুণ কর্মী ও গবেষক এই রাজ্যে আছেন। তাঁদের কিছু করতে দিন, গড়তে দিন। বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষা ও তার বিস্তার আজ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বীকৃত কর্মসূচি। এই অমূল্য
সংযোজনটি যেন তাতে যোগ্য মর্যাদার সঙ্গে গৃহীত হয়। সঠিক জায়গায় সঠিক সামগ্রী ঘটনাক্রমে মজুত হয়েই আছে, কেবল সাজিয়ে তুলে ধরার অপেক্ষায় আছে তারা।
“আমাদের অনেক সম্পদের মতো এটাও কিন্তু হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। গত শতকের শেষেও এমন ছাপাখানা বাংলা জুড়ে বেশ কিছু ছিল, একে একে বাতিল হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির তাগিদে। যন্ত্র, টাইপ ইত্যাদি ওজনদরে বিক্রি হচ্ছে। বছর পনেরো আগে চন্দননগরে এক রীতিমতো প্রাচীন কাঠের প্রেস দেখেছিলাম, শিল্প-পুরাতত্ত্বের নিরিখে অসাধারণ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠগবেষণা কেন্দ্রের তরফে সেটি সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলাম। শুনলাম, মালিকরা বাংলারই একটি সংগ্রহশালায় সেটি দান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বেশ কিছু ঐতিহাসিক যন্ত্র দরদ দিয়ে সংরক্ষণ করেছেন মুদ্রণের দীর্ঘ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী জয়ন্ত বাগচী মহাশয়। এগুলি বিরল ব্যতিক্রম, অধিকাংশ প্রেস বিকোচ্ছে লোহার দরে।
“প্রসঙ্গটা ব্যক্তিতর্পণ নয়, বৌদ্ধিক ও ঐতিহাসিক চর্চা। ছাপা বইয়ের দিন ফুরিয়ে যায়নি, ডিজিটাল যুগেও তার বিস্তার বাড়ছে। কিন্তু বই ছাপার আদি পদ্ধতি, হাতে টাইপ সাজিয়ে হাতে-টানা যন্ত্রের সাহায্যে কাগজে তার ছাপ তোলা, আজ লুপ্তপ্রায়। কলকাতা সম্ভবত বিশ্বের শেষ কেন্দ্র, যেখানে এই প্রযুক্তি এখনও কিছুমাত্রায় টিকে আছে, অভিজাত শিল্পকর্ম হিসাবে নয়, আটপৌরে চাহিদা মেটাতে, প্রধানত হরেক রকম ‘জব প্রিন্টিং’-এর কেজো তাগিদে। এটা শহরের ঢিলেঢালা অনগ্রসর চরিত্রের লক্ষণ হতে পারে, কিন্তু অন্য বিচারে এটাও শহরের এক কৌতূহলকর পরিচয়। এই বিস্মৃতপ্রায় প্রযুক্তি এক সাংস্কৃতিক সম্পদ, যার সদ্ব্যবহার করলে অন্যান্য উপকার ছাড়াও অর্থনৈতিক লাভ হতে পারে।“
অশোক সেনগুপ্ত