১৯৬৫’র কোন এক সময়। উত্তর ২৪ পরগনার অশোক নগর উদবাস্তু কলোনির মেঠো রাস্তায় ছিন্নমূল মানুষের মিছিলের পিছনে হাফপ্যান্ট পরা খালি গা আর পায়ে চলেছে একটি ৮-১০ বছরের ছোট্ট ছেলে। ঘুনসি’র দড়ি দিয়ে বাঁধা প্যান্ট’টিকে একহাত দিয়ে তুলতে তুলতে আরেক হাতে উদ্যত রক্তরাঙা কাস্তে-হাতুড়ি-তারা নিশান উঁচিয়ে বড়দের তালে তালে স্লোগান দিয়ে চলেছে…
“ভুলতে পারি বাবার নাম,
ভুলবো না কো ভিয়েতনাম।
তোমার নাম – আমার নাম
ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম..”।।
মিছিলের অতগুলো ভারি গলার স্বরের মাঝে চিকন গলার ডাকটি কেবলি ডুবে যাচ্ছে বারবার। নাঃ, এই ভাবে পরাজয় সে মানবে না কিছুতেই। তার গলার স্বর ছাপিয়ে যাবে সব কিছু। এমনকি হিমালয় হলে… তাও!
নইলে মিছিল শেষে শ্রীলঙ্কা’র মতো আকৃতি’র একটা গোটা সিঙ্গাড়া পাওয়া যাবে কি ভাবে? নিবু কাকা আবার বলেছে, প্রত্যেকের জন্য বোঁদেও নাকি আজ ওর্ডার করেছে শিবু দাদু। কিন্তু তার পরিমান কত, সেটা অবশ্য জানা হয়নি তার। তবু কিছু একটা তো খেতে পাওয়া যাবে; এতেই সে খুশি।
কিন্তু খটকা তার আরেক জায়গায়। এই – ভিয়েতনাম জিনিসটা কি? খায় না গায়ে দেয়? নাকী মাখে মাথায়?
জিজ্ঞেস করে উত্তর পায় – সে এক বহুদূরের দেশের নাম, যেখানে আমেরিকার অত্যাচারে সব শেষ!
অথচ,ঢাকার রমনা কালী বাড়ির ১৬ আনা আর ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ১০ আনা অংশীদারিত্বের মালিকানা সূত্রের কারণে, সে শুধু ঢাকার নামই জানে! আর পালিয়ে এ দেশে ঠাঁই নিয়ে প্রাণ বাঁচানো বাপ-দাদার মুখে মুখে শুনে অবশ্য মুখস্থ হয়েছে ফরিদপুর, যশোর-খুলনা আর নোয়াখালীর নাম। কিন্তু কৈ, সে তালিকায় তো ভিয়েতনাম নেই! তবে??
শেষে কৌতূহল আর চাপতে না পেরে একসময়ে সরল শিশুমনে জিজ্ঞাসাই করে বসে সিধু জ্যাঠাকে,… “আচ্ছা জ্যাঠা আপনারা তো এতো ভিয়েৎনামের নাম নিচ্ছেন, অথচ কিছু বছর আগেই পিছনে ফেলে আসা ঢাকা – বরিশাল, ফরিদপুর কিংবা নোয়াখালীর নাম কেন বলেন না? নাকি ভিয়েতনামে আমাদের কেউ থাকে আজও, যে কিনা পালাতে পারেনি আমাদের মতো? সে গল্প কিন্তু আজ আপনাকে বলতেই হবে জ্যাঠা”।
বলাই বহুল্য, তার উত্তর সেই বালকের আর সেদিন জানা হয়নি বটে; তবে পরবর্তীকালে কলকাতা পুলিশের একজন সফল ইন্সপেক্টর পদে কর্মাবসানের পর আজও জীবনসায়াহ্নে এসে সেই একই প্রশ্ন তাকে কুরে কুরে খায়।
নিজের মনেই নিজে স্লোগান দিতে থাকেন…
“ভুলতে পারি বাবার নাম,
ভুলবো না কো ঢাকার নাম।
তোমার নাম – আমার নাম
লাহোর থেকে চট্টগ্রাম..”।।
রাজা দেবনাথ