কলকাতা শহরের বুকে হিন্দুদের নিরাপদ একটি ঠিকানা তৈরির কারিগরটির নাম “গোপাল পাঁঠা”

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্টের ভোরে পাকিস্তান তৈরির জন্য মুসলিম লীগ প্রত‍্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিলে শহর কলকাতা জুড়ে শুরু হয়ে যায় হিন্দু গণহত্যা। নেহেরু তখন দিল্লিতে অন্তর্বর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী। আর অখণ্ড বাংলার শাসনের দায়িত্ব পেয়েছিল মুসলিম লীগ এবং মুখ‍্যমন্ত্রী ছিলেন সুরাবর্দি।
সুরাবর্দির নির্দেশেই কলকাতায় শুরু হয় এই হিন্দু গণহত্যা। কলকাতায় ছিল মহড়া, আর পুরো উদ্দেশ্যটি কার্যকর করা হয় নোয়াখালীতে। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ৩১.৭০ শতাংশ ছিল বাইরের রাজ‍্য থেকে আসা এবং ৩০ শতাংশ ছিল কলকাতার বাইরের জেলাগুলি থেকে আসা লোকজন। ৬০ লক্ষ মানুষের বাস কলকাতায় ছিল ১২০০ জনের পুলিশ বাহিনী, এর মধ্যে মুসলমান ৬৩ জন। এছাড়া ডেপুটি কমিশনার ও একজন ও.সি ছিলেন মুসলমান।

মুসলমান দাঙ্গাবাজদের বেশির ভাগ ছিল গ্রাম থেকে আসা লোক। এর মধ্যে ছিল মুসলমান শ্রমিক, কষাই, খালাসি, ছ‍্যাকড়া গাড়ির চালক। অন্যদিকে, মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে ভূমিকা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষিত যুবক, ছাত্র সমাজ ও মধ্যবিত্তদের।
১৯৪৬-এর ১৬ আগস্টের সকালে মুসলিম লীগ যখন অ্যাকশান শুরু করে, তখনও পর্যন্ত কলকাতার হিন্দুরা বিষয়টা বুঝে উঠতে পারে নি। কারণ, ওই দিন বিকেলে কলকাতার তথাকথিত প্রগতিশীল “ধর্মনিরপেক্ষ” হিন্দুরা ময়দানে মনুমেন্টের তলায় মুসলিম লীগ ও ভারতের কম‍্যুনিষ্ট পার্টির যৌথ মিটিং শুনতে গিয়েছিল। ওই মিটিং মঞ্চে হাজির ছিলেন কমরেড জ‍্যোতি বসু, হোসেন সুরাবর্দি ও খাজা নাজিম উদ্দিন। সেই মঞ্চে একসঙ্গে বাঁধা ছিল মুসলিম লীগের চাঁদ তারা মার্কা ও কম‍্যুনিষ্টদের লাল পতাকা।
ওই মঞ্চ থেকে কম‍্যুনিষ্ট নেতারা শ্লোগান দিলেন, “আগে পাকিস্তান দিতে হবে, তবেই ভারত স্বাধীন হবে।”
ওইদিনই বিকেলে মিটিং থেকে ফেরার পথে মুসলিম লীগের গুণ্ডাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো ধর্মতলায় হিন্দু জনসাধারণ ও হিন্দুদের দোকানের ওপর।
১৯৪৬-এর ১৬, ১৭, ১৮ আগস্ট তিন দিন ধরে সারা কলকাতা জুড়ে চললো মুসলিম লীগের পরিকল্পিত গণহত্যা। সুরাবর্দি লালবাজার কণ্ট্রোল রুমে বসে নিষ্ক্রিয় করে রাখলেন পুলিশকে। এই সুযোগে কলকাতায় তাণ্ডব চালালো নিউ মার্কেট এলাকার বোম্বাইয়া, কর্ণওয়ালিশ বস্তির মিনা পাঞ্জাবী ও হ‍্যারিসন রোডের মুন্না চৌধুরীর মতো মুসলিম লীগের গুণ্ডারা।
calcutta killings retreating muslim league and veer gopal patha
এই দাঙ্গার বিষয়ে ইংরেজি দৈনিক “দ‍্য স্টেটসম‍্যান” লিখলো, “দ‍্য গ্রেট ক‍্যালকাটা কিলিং”, অন্যান্যরা লিখলো, “উইক অব্ লং নাইভস্।”
ওই সময় কলকাতায় ছিলেন এক বিদেশি সাংবাদিক, নাম— ফিলিপ ট‍্যালবট্। তিনি “ইনস্টিটিউট অব্ কারেন্ট ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স” -এর প্রধান ওয়াল্টার রজার্সকে লিখলেন,
“ভারতের বৃহত্তম এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরটা (কলকাতা) যেন লিপ্ত রয়েছে নিজেকে নরখাদকে পরিণত করতে। শহরের সমস্ত রাস্তার দোকানগুলির একটিরও দেওয়াল বা দরজা আস্ত নেই। লুঠ হয়েছে সব দোকান। আর গুণ্ডারা যেগুলোকে লুঠ করতে পারে নি, সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রাস্তায়। আর চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে মানুষের লাশ। টাটকা লাশ, গরমে পচা লাশ, অঙ্গহীন লাশ, থেঁতলে যাওয়া লাশ, ঠেলা গাড়িতে জড়ো করা লাশ, নর্দমায় লাশ, খালি জায়গায় গাদা হয়ে থাকা লাশ, শুধু লাশ আর লাশ।
শুধু ৩৫০০ লাশ সংগ্রহ করে গোনা হয়েছে, আর কত লাশ যে হুগলি নদীতে ভেসে গেছে, কত হাইড্রেনে আটকে আছে, কত লাশ যে ১২০০ জায়গায় দাঙ্গার আগুনে পুড়ে গেছে, কত লাশ যে তাদের আত্মীয়রা তুলে নিয়ে গিয়ে সৎকার করেছে, এর সংখ্যা বলতে পারবে না কেউই।” তিন দিন পর শহরে সেনা নামানো হয়। ৭, ০০০ থেকে ১০, ০০০ লোক এই দাঙ্গায় খুন হয়েছে বলে সেনাবাহিনীর অনুমান।
calcutta killings retreating muslim league and veer gopal patha
মুসলিম লীগের গুণ্ডাবাহিনীর হাতে হিন্দুদের বাঁচাতে এগিয়ে এলেন কলকাতা বৌবাজারের এক ডাকসাইটে হিন্দু যুবক কুস্তিগীর গোপাল মুখোপাধ্যায়। পরিচয়ে বিপ্লবী অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভাগ্নে। কলকাতা বৌবাজারের মলঙ্গা লেনে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ ই সেপ্টেম্বর গোপালের জন্ম।
কলকাতায় তাঁদের একটি বুচার শপ অর্থাৎ পাঁঠা কাটার পারিবারিক দোকান ছিল। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উল্টোদিকে কলেজ স্ট্রিটে সে দোকান এখনো রয়েছে, নাম— “অনুকূল মুখার্জীর পাঁঠা কাটার দোকান।” পাঁঠা কাটার এই পারিবারিক ব‍্যবসার সূত্রে লোকমুখে গোপাল মুখোপাধ্যায়ের নাম হয়ে যায় “গোপাল পাঁঠা।”
হিন্দুদের বাঁচাতে গোপাল জোগাড় করলেন ২৪ পয়েন্ট বোরের রাইফেল এবং সেগুলি জোগাড় হলো ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় ঘাঁটি গেড়ে থাকা মার্কিন সৈন্যদের কাছ থেকে। এক বোতল হুইস্কি কিংবা সামান্য কিছু টাকা দিলেই তখন সেগুলো পাওয়া যেতো।
ছোট থেকেই গোপালের আদর্শ ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। “ভারতীয় জাতীয় বাহিনী” নামে একটি ছোট্ট সংগঠন পরিচালনা করতেন গোপাল। গোপালের সঙ্গে যোগ দিলেন যুগলকিশোর ঘোষ, কলকাতায় বসবাসকারী শিখ ও গোয়ালা সম্প্রদায়ের মানুষজন এবং এতে ছিল শ‍্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সমর্থন। গোপালের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশি ছিলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়।
calcutta killings retreating muslim league and veer gopal patha
গোপাল পাঁঠার নেতৃত্বে মারমুখী হিন্দুরা এবার পাল্টা মার দিতে শুরু করলো। মার খেতে লাগলো মুসলিম লীগের দলবল। তখন সুরাবর্দি ইংরেজ সরকারকে অনুরোধ করে সেনা নামালেন।
অমনি হাজির হলেন গান্ধী। গোপালকে বললেন, তাঁর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে।
গোপাল জানিয়ে দিলেন, যতক্ষণ পযর্ন্ত হিন্দুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি একটি সূঁচ বা পেরেকও দেবেন না। দরকার হলে তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্রের পায়ে তাঁর অস্ত্র সমর্পণ করবেন, কিন্তু গান্ধীর কাছে নয়।
অবস্থা বেগতিক দেখে এরপর মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের প্রধান জিজি আজমিরি এবং মুসলিম ন‍্যাশনাল গার্ডের সদস্য শেখ মুজিবর রহমান (পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) হাত জোড় করে এই আক্রমণ বন্ধ করতে কাতর অনুরোধ জানালে গোপাল পাঁঠা থামেন। গোপাল একদিনেই আটশো হিন্দু ও শিখ যুবককে সঙ্গে নিয়ে পাল্টা মার দিয়েছিলেন।

শেষ জীবনে গোপাল একজন সমাজকর্মী হিসেবে “ন‍্যাশনাল রিলিফ সেণ্টার ফর্ ডেসটিটিউটস্” নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালাতেন।
এলাকায় বিশাল আকারে শুরু করেছিলেন কালীপুজো। বহু বিশিষ্টজনেরা এই কালীপুজোয় এসেছেন।
২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার এই বীর গোপাল পাঁঠার মৃত্যু হয়।

কলকাতা শহরের বুকে হিন্দুদের নিরাপদ একটি ঠিকানা তৈরির কারিগরটির নাম “গোপাল পাঁঠা।”

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তখন ইহজীবনের ‘ অন্ত্যলীলা’ করছেন কাশীপুরের বাগানবাড়িতে। সেই সময় ঠাণ্ডা লেগে ঠাকুরের সর্দি কাশি বেড়ে গেল। ডাক্তার নির্দেশ দিলেন পাঁঠার মাংসের সুরুয়া খাওয়ার জন্য। ঠাকুর বললেন, ‘ যে দোকানে কালিমূর্তি আছে, সেখান থেকে মাংস আনবি।’ ঠাকুরের অন্ত্যলীলা’ শেষ হয়েছিল ১৮৮৬ র ১৬ আগস্ট। আর ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ‘ গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ রুখে ছিলেন যিনি সেই গোপাল মুখোপাধ্যায়েরও পাঁঠার মাংসের দোকান ছিল। যে কারণে গোপাল পাঁঠা নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আর সেই মাংসের দোকান আজও কলকাতার অন্যতম সেরা মাংসের দোকান, আর তার পরতে পরতে জড়িয়ে কলকাতার ইতিহাস।

গোপাল পাঁঠার মাংসের দোকানের ভোজনরসিকদের কাছে কদর ‘ বেঙ্গল গোট’ পাওয়া যায় বলে। একবার যিনি এই দোকানের মাংস খেয়েছেন তিনি অন্য কোথাও যাবেন না। একমাত্র এঁরাই আজও বুক ঠুকে বলেন, ‘ এখানে বেঙ্গল গোট’ পাওয়া যায়। আর গোপাল মুখোপাধ্যায়ও কালিভক্ত ছিলেন। তাঁর এলাকায় প্রতি বছর তিনি কালিপুজো শুরু করেন। দোকানে আজও মা কালির উপস্থিতি। এবার ইতিহাস, বিপ্লবী অনুকূল চন্দ্রের ভাগ্নে ছিলেন গোপাল মুখোপাধ্যায়। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা সূত্রেই ওই পাঁঠার মাংসের দোকান। সেই সূত্রে তাঁর পরিচিতি গোপাল পাঁঠা। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লিগের নেতৃত্বে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ শুরু হলে রুখে দাঁড়ান গোপাল মুখোপাধ্যায় ও তাঁর ভারতীয় জাতীয় বাহিনী। মূলত একার হাতেই সেদিন কলকাতাকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। প্রবাদ হয়ে গিয়েছে গোপাল ছিলেন বলে টালা ট্যাঙ্ক আছে, শিয়ালদা স্টেশন আছে, আপনি, আমি রয়েছি। আর সেই প্রবাদের সঙ্গে জড়িয়ে আজও রয়েছে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উল্টোদিকে এক চিলতে মাংসের দোকান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.