সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে পরের উটটাও একই জায়গায় এসে দাঁড়ায়, যেমন ভাবে বাঙালী নোয়াখালি থেকে এসে দাঁড়িয়েছিল দেগঙ্গা, ধুলাগড় আর বসিরহাটে…

কোরবানির ভিডিও দেখছিলাম, এমনিই। আমি মাংসাশী মানুষ, মাংস বাজার থেকে কিনে আনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাটিয়ে নিই। কখনও তাড়াহুড়োয় ভালো পিস না করতে পারলে দোকানিকে বলি গোটাটাই দিয়ে দিতে। বাড়িতে ছুরি দিয়ে পিসপিস করে নিই ইচ্ছেমত। একটা মুরগী আনলে অনেকটা মাংস হয় একদিনে। নিজের ইচ্ছে মত কিছুটা ঝোল কিছুটা কষা কিছুটা বোনলেস পিস দিয়ে রুটির সাথে রোলের মত করে চালিয়ে দিই তিনবেলাই। কবছর আগে হালাল হারাম মাংস জানতাম না। তবে স্কুলের ফিস্টে মুর্শেদ আলম মাংস খেতনা কেন বুঝতাম না, অবশ্য ও ঈদেরছুটি খুললে মাংস আনত আমার জন্যে। ফিস্টে মাংস খাওয়া নিয়ে ও বলেছিল, তোরা কিভাবে কি মাংস আনিস না জেনে তো খাওয়া যায় না! এখন জানি ও কেন খেতনা।

আজ কিন্তু মুরগী বা মুর্শেদের কথা নয়, বলছি কোরবানির কথা। উটের কোরবানি কিভাবে দেয় সেটাই দেখলাম বেশী করে। উট খুব উঁচু প্রাণী। আমাদের সমাজের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মতই। তবে বড়ই অসাম্প্রদায়িক। সার সার কোরবানি দেওয়া উটের মাঝে আরেকটা নতুন উট দিব্যি চলে এসে দাঁড়িয়ে যায়। কোরবানির কসাই তার গলায় হাত বুলোতে থাকে, মরা উটেদের পাশ কাটিয়ে উট চলে যায় আদর খেতে খেতে, যারা এ দৃশ্য দেখেননি তারা যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সী চত্বরে গেলেই খানিকটা বুঝে যাবেন। তো যা বলছিলাম, উট চলে যায়। খানিকটা জায়গা রেখে কসাইয়ের হেল্পাররা সামনের একটি পা ভাঁজ করিয়ে বেঁধে দেয় আলতো করে। উট খুব একটা উচ্চবাচ্য করেনা। অথচ কষে লাথালেই হেল্পারের মুণ্ডু মধুপুরে উড়ে যাবে সেই সময়। কিন্তু উট অসাম্প্রদায়িক, লিবারাল। সামান্য এইটুকু অত্যাচার ভেবে পা বাঁধা সহ্য করে নেয়। ঘুঙুর বেজে ওঠে চার পায়ে। লিবারাল ঘুঙুরের শব্দ, যেমন শোনা যায় – সমাজতন্ত্র দিচ্ছে ডাক, শোষণযন্ত্র নিপাত যাক। ধীরেধীরে পেছনের দুটি পা খুঁটিতে বাঁধা হয়ে যায়। কোন কোন উট ডেকে ওঠে বিশ্রী ভাবে দুএকবার। কিন্তু পাছে কেউ সাম্প্রদায়িক বলে দেগে দেয়, তাই চুপ করে থাকে। কসাইয়ের হাতের ছোরা চকচক করে ওঠে, হাত বুলিয়ে জুগুলার ভেন খুঁজে নেয় সে। উট তখনও এদিকওদিক তাকায়, আওয়াজ করেনা। জাঁ পল সার্ত্র, সাইমন বলিভার, চে গ্যেভেরা পড়তে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিসমিল্লাহ বলে ছুরি নেমে আসে গলার ওপর। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে, বৈজ্ঞানিক মৃত্যু আসার আগে রক্তে পিছলে পড়ে তার ক্ষুর, অদ্ভুত চোখে তাকায় কসাইয়ের দিকে, দু এক কদম পিছিয়েও যায় এক একটা। কিন্তু রক্ত ফুরোতে থাকে দ্রুত। মস্তিষ্কের স্মৃতি মিলিয়ে যায়, মুছে যায় সাইমন বলিভার, সার্ত্র কিংবা চে। অর্থনীতি, বিকাশ, মানবাধিকার, মানচিত্র মানিনা সব ছাপিয়ে একবার জোড়া পায়ের লাথি মারতে ইচ্ছে করে উটটার। কিন্তু পেশী নির্জীব হয়ে এলিয়ে পড়ে সে ধীরেধীরে। একটি অসাম্প্রদায়িক জীবন শেষ হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে পরের উটটাও একই জায়গায় এসে দাঁড়ায়, যেমন ভাবে বাঙালী নোয়াখালি থেকে এসে দাঁড়িয়েছিল দেগঙ্গা, ধুলাগড় আর বসিরহাটে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.