যখন কলকারখানা গড়ে ওঠেনি, তখনও কিন্তু মানুষের বসতবাড়ি থেকে রাজপ্রাসাদ, বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপত্য তৈরি হয়েছে। তখন ছিল না সিমেন্ট। তখন ছিল চুন-সুরকির গাঁথনি। আর এই চুন তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন একদল মানুষ, যাঁরা পরিচিত ছিলেন “চুনারু” নামে।
রাঢ়-বাংলার বিভিন্ন স্থানে একসময় ছিল চুনারুদের চুন তৈরির কারবার। সাধারণত চার প্রকার চুন তৈরি হতো সে সময়—
১) চুনা পাথর বা ঘুটিং পাথর পুড়িয়ে তৈরি পাথুরে চুন। গাঁথুনি ও পলেস্তারার কাজে ব্যবহৃত হতো এই পাথুরে চুন। নদীর ধারে পাওয়া যেতো এই ঘুটিং পাথর। সেগুলি কুড়িয়ে একটি চুল্লিতে আগুনে পোড়ানো হতো। তারপর ঠাণ্ডা জল দিলেই তৈরি হয়ে যেতো সাদা ধবধবে পাথুরে চুন।
২) শামুক, গুগলির খোলা পুড়িয়ে তৈরি হতো বাখারি চুন। সিলিং ও দেওয়ালে গালা করার জন্য এই বাখারি চুনের ব্যবহার ছিল।
৩) শাঁখের টুকরো পুড়িয়ে পঙ্ক চুন এবং
৪) শাঁখের টুকরো পুড়িয়ে পান খাবার জন্য কলিচুন তৈরি।
একসময় রাজা-মহারাজারা নিজেদের ইমারত তৈরির প্রয়োজনে চুনারুদের এনে বসাতেন। এজন্য তাদের জমিও বরাদ্দ করা হতো।
বৌদ্ধ যুগে বিভিন্ন বিহার সঙ্ঘারাম তৈরির জন্য এবং পরবর্তীতে পাল-সেন যুগে প্রাসাদ ও ধর্মীয় স্থাপত্য নির্মাণের কাজে এই চুনারুদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও অর্বাচীন ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও চুনারু জাতির উল্লেখ নেই। মনে করা হয়, শঙ্খকারদের সঙ্গে চুনারুদের একসঙ্গে গণ্য করা হয়েছিল।
সিমেন্ট কারখানা গড়ে ওঠা এবং বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ভেঙে চুনাপাথর পুড়িয়ে চুন তৈরির বহু ছোট-বড়ো কারখানা তৈরির পর চুনারুদের জীবিকা সংকট দেখা দেয় এবং তখন তাঁরা বৃত্তি বদল করতে বাধ্য হোন। তবে কিছু চুনারু পান খাবার কলিচুন তৈরি ও বিক্রি করে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করে চলেছেন এখনও।
রাঢ়-বাংলায় চুনারুদের দুটি থাকের খোঁজ পাওয়া যায়—মান্দারণ্যা ও বর্ধমেনা। এদের মধ্যে অন্তর্বিবাহ প্রথা চালু আছে। উন্নত হিন্দু জাতিগুলির মতোই চুনারুদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। চুনারুদের কুলদেবতা হলেন অগস্ত্য মুনি। এজন্য ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন তাঁরা অগস্ত্য মুনির পুজো করেন। আগে অগস্ত্য মুনির প্রতিমা তৈরি করে পুজো হতো। এখন আর্থিক কারণে তা সম্ভব হয় না। তবে চুন তৈরির যন্ত্রপাতিগুলি অগস্ত্য মুনির প্রতীক হিসেবে পুজো করা হয়। এজন্য ঘরের ভেতরে দেওয়াল ঘেঁষে যন্ত্রপাতিগুলি রেখে তার ওপরে দেওয়ালে একটি ছাতা আঁকা হয়। পুজোর সময় নৈবেদ্য হিসেবে দিতে হয় বাতাপি লেবু।
চুনারুদের মধ্যে প্রচলিত পদবি ও গোত্রগুলি হলো:
পদবি // গোত্র
১) দাস: শাণ্ডিল্য
২) মিত্র: শাণ্ডিল্য
৩) বারিক: মৌদগল্য
৪) দে: কাশ্যপ
৫) দে: পরাশর
৬) দত্ত: পরাশর
৭) দত্ত: কাশ্যপ
৮) ঘটক: মৌদগল্য
৯) ঘটক: শাণ্ডিল্য
১০) খাঁ: পরাশর
১১) পাত্র: মৌদগল্য
১২) পাত্র: কাশ্যপ।
প্রাচীন স্থাপত্যের দিকে তাকালেই দেখা যায় চুন-সুরকির গাঁথুনি আর তখনই চুনারুদের দক্ষতার কথা উঠে আসে। গবেষক ড: মানিকলাল সিংহের মতে, রাঢ়-বাংলায় দু’তিনশোর বেশি চুনারু পরিবারের খোঁজ পাওয়া যায় না। তাঁরা হারিয়ে গিয়েছেন, নয়তো বৃত্তি হারিয়ে অন্য বৃত্তি বেছে নিয়েছেন। আর কোথাও আবার স্থানীয় অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁরাও মিশে গিয়ে নিজেদের আলাদা অস্তিত্ব হারিয়েছেন।
তথ্যসূত্র:
রাঢ়ের জাতি ও কৃষ্টি, দ্বিতীয় খণ্ড: মানিকলাল সিংহ।