জ্যোতি বসুর আমলে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের অভ্যন্তরীণ অবস্থা..

সালটা বোধহয় ১৯৯০, আমি দিল্লী থেকে কলকাতায় এসেছি একটি মাইক্রোফিল্ম রিডার প্রিন্টার মেশিন ইনস্টল করব বলে। আমি তখন একটি নামী রিপ্রোগ্রফিক কোম্পানির টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট, দিল্লী নিবাসী, সারা ভারতে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেওয়ার দায়িত্বে আছি। ইনস্টলেশন হবে ডালহৌসি চত্বরে একটি ব্রিটিশ কোম্পানি যাঁরা “টি” প্রসেসিং মেশিন ম্যানুফ্যাকচারিং করেন।

এঁদের ডিজাইন আর ড্রয়িং বিদেশ থেকে মাইক্রোফিল্ম এর মাধ্যমে আসত। আর আমি যে মেশিনটি ইনস্টল করতে এসেছি সেটিও একটি ব্রিটিশ মেশিন। খুব খাতির করে কোম্পানির এমডি নিজের ঘরে বসালেন। ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হল। উনি নিজে চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার, লিভারপুলে পড়াশুনো আর চাকরি করে এখানে আছেন প্রায় বছর দশেক। ভালো চা খাওয়ালেন, একটু গল্পও হল।

মেশিন এসেছে দেরাদুন ফ্যাক্টরি থেকে, তিনটে ক্রেট করে। আমি দাঁড়িয়ে থেকে ক্রেট খোলালাম। মাইক্রোফিল্ম মানেই খুব হাই প্রিসিশন ইলেকট্রো অপটিক্যাল সিস্টেম, একটু এদিক ওদিক হলেই গন্ডগোল।

মেশিন তিন টুকরো অবস্থায় উঠলো স্পেশাল টেবিলে। এরপর একে জুড়তে হবে আমায়। তারপর অপারেশন, টেস্টিং ও ট্রেনিং। প্রায় দু তিন দিনের কাজ।

মেশিন এর ভিউয়ার অংশটি একটি কম্পিউটার মনিটরের মতন দেখতে। তবে অনেক বড়, A2 সাইজের। কয়েকজন অফিসের লোকজন উঁকিঝুঁকি মারছেন। আমি আস্তে আস্তে কাজ এগোচ্ছি এরকম সময়, তিনজন লোক এলেন। একজন একটু কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন – এটা কি কম্পিউটার? আমি বললাম – না, এটা অন্য মেশিন। সেই লোকটি বলল যে এই তো কম্পিউটারের স্ক্রিন, আপনি আমাদের ভুল বলছেন, বিভ্রান্ত করছেন।

এর মধ্যে “বিভ্রান্ত” কথাটা খট করে কানে লাগল। এই সব টার্ম সাধারন কর্মচারীরা ব্যবহার করেন না। আমি বেশ বিরক্ত হলাম, সামনে গাদা কাজ, আমি কি এদের সাথেই বকবক করব নাকি? তখন বয়স অল্প, মাথা ঠাণ্ডা করে বললাম, আমায় আমার কাজ করতে দিন, মেশিনের নাম এখানে লেখা আছে, দেখে নিন।

এই বলে ইউজার ম্যানুয়ালটা হাতে ধরিয়ে দিলাম। সেই লোক ম্যানুয়ালটা নামিয়ে রাখল টেবিলে, খুলেও দেখল না, তারপর যেরকম এসেছিল সেরকম বেরিয়ে গেল। আমি আমার কাজ করতে লাগলাম।

মজা শুরু হল তার মিনিট পনের পর থেকে। একজন আমায় এসে বললেন যে এমডি আমায় ডাকছেন। আমি ওঁর ঘরে গেলাম। সেখানে দেখি আরো জনা দশেক লোক দাঁড়িয়ে এবং তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বেশ আক্রমাত্মক। এমডি আমায় বললেন – মিস্টার সোম, আপনাকে কাজ থেকে ডাকার জন্য দুঃখিত। এঁরা আমাদের এখনকার কর্মী ইউনিয়নের লোক, এঁদের ধারনা আমরা এখানে চুপিচুপি কম্পিউটার বসাচ্ছি। আর তার জন্য এঁদের চাকরির সমস্যা হবে। আপনি এঁদের একটু বোঝান যে ওটা একটা অন্য মেশিন, কম্পিউটার নয়।

আমি বুঝলাম যে ব্যাপার বেশ গুরুতর। আমি দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের বোঝানো শুরু করলাম। কিন্তু প্রায় আধা ঘন্টা পন্ডশ্রম করার পর শীতকালে আমার কপালে ঘাম বেরিয়ে গেল কিন্তু আমি একবিন্দু বোঝাতে সক্ষম হলাম না। যে বুঝতেই চায় না তাদের বোঝানো অসম্ভব।

বাঙ্গালরা “ঘাউরা” বলে একটা শব্দ ব্যবহার করে। এরা শুধু ঘাউরা নয়, বিশ্ব-ঘাউরা। তার সাথে সমান অসভ্য। প্রত্যেকটি কথার মধ্যে ছিল অসম্মান আর চাপা হুমকি। এর মধ্যেই বার তিনেক জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে আমি কোথায় কলকাতার কোন জায়গায় থাকি, বাবা কি করেন ইত্যাদি।

আমি যখন বললাম আমি দিল্লীতে থাকি, তখন একজন ফুট কাটল এই বলে যে দিল্লীতে তো ভালোই ছিলেন, এখানে কি করতে আসলেন এবার আমার মাথা একটু গরম হয়ে গেল বললাম – কেন পশ্চিমবঙ্গ কি ভারতের মধ্যে নয়? আমার দেশ আমি যেখানে খুশি যেতে পারি!

আলটিমেটলি কিছু হল না। আমার পর এমডি ভদ্রভাবে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। এর মধ্যে ঘরে আরো লোক বেড়েছে। এমডি কে যথেষ্ট দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হচ্ছিল। এত সিনিয়র মানুষ, আমার ওঁর জন্য খারাপ লাগছিল।

শেষমেষ আমরা দুজনে ঘেরাও হয়ে গেলাম। এমডির ঘরের দরজার সামনে জনা দশেক লোক বসে পড়ল। আমরা আটক, আর বেরোতে দেওয়া হবে না, যতক্ষন এমডি ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা না লিখে দিচ্ছেন। অবাক হয়ে দেখলাম যে এর মধ্যেই পোস্টার লেখা হয়ে গেছে ” অফিসে কম্পিউটার ঢুকতে দিচ্ছি না, দেব না”! এদের বিচক্ষণতা আর এফিসিয়েন্সি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

এমডি ইন্টারকমে সেক্রেটারীকে বললেন যে হেয়ার স্ট্রিট থানাকে একটা খবর দিতে। সেক্রেটারী একটু পরে জানালেন যে অফিসের ফোনের লাইন ইত্যাদি কেটে রাখা আছে, তাই ফোন করা গেল না।

টেবিলে এক জাগ জল আর দুটি গ্লাস রাখা ছিল, এটলিস্ট জল টা পাওয়া যাবে। খাবার ছাড়া কাটিয়ে দেওয়া যাবে কিন্তু জল ছাড়া অসুবিধে হত। কিন্তু সমস্যা হল আর কিছুক্ষন পরে। এমডির টয়লেট ঠিক ওঁর ঘরের পাশেই। কিন্তু অবরোধকারীরা কাউকেই ঘর থেকে বেরোতে দেবে না। বয়স্ক মানুষ, টয়লেট আর কতক্ষন চেপে রাখবেন? উনি হাত জোড় করে অনুরোধ করলেন, কিন্তু কোন লাভই হল না, উল্টে উড়ে এল কিছু কটু কথা।

আমার ওঁকে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ফর্সা মানুষ, মুখ লাল হয়ে গেছে, আর চেপে রাখতে পারছেন না। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল, আমি জাগ এর জলটা দুটো গ্লাসে ঢেলে, বাকি জলটা ঘরের কোণে ফেলে দিলাম। তারপর ফাঁকা জাগটা ওঁর হাতে ধরিয়ে বললাম – স্যার আপনি এটায় রিলিভড হোন, লজ্জা করবেন না, আমি মুখ ঘুরিয়ে রাখছি।

এরপর কি হয়েছিল, আমরা কিভাবে রাত দশটায় ঘেরাও থেকে ছাড়া পেলাম সেটা আরেক কাহিনী। কিন্তু এই গল্পটা ইম্পর্ট্যান্ট।

আজকের প্রজন্মের অনেকেই জানেন না যে একসময় বামপন্থা, মিলিট্যান্ট ট্রেড ইউনিয়ন এই রাজ্যের কি হাল করে ছেড়েছে। কেন পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে সব ইন্ডাস্ট্রি পালিয়েছে। কেন ব্যাঙ্গালোর তৈরি হয়েছে। তাঁরা এগুলো জানুন। আরো কত শত ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে সেই সময়।

Shantanu Som

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.