শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ডাউন রেললাইন চলে গেছে নামখানা পর্যন্ত। তার পূর্বদিকে গেলে পড়ে মজিলপুর। সুন্দরবন অঞ্চলের আদিগঙ্গার প্রবাহপথে রয়েছে মজিলপুর শহর। আদিগঙ্গার মজাগর্ভে অবস্থিত হওয়ার জন‍্য এর নাম হয়েছে মজিলপুর। ১৭ শতকে এই এলাকায় জনবসতির গোড়াপত্তন হয়। ঐতিহাসিক এই অঞ্চল বিখ‍্যাত তার পুতুলশিল্পের জন্য। বাংলার সবাই একডাকে চেনে মজিলপুরের মাটির পুতুল (Majilpur clay doll)-কে। এখন সেই পুতুলের খ্যাতি বাংলা ছাড়িয়ে ভূ-ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে, তার সুনাম পৌঁছে গেছে অন্যান্য দেশেও।

বাংলার গর্ব তার ঐতিহ্যশালী লোকায়ত শিল্প, কুটিরশিল্প। সেসবের মধ‍্যে বোধহয় সবথেকে‍ বিখ্যাত বাংলার পুতুলশিল্প। বাংলার বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছেন অগুনতি পুতুলশিল্পী, ‍প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব ঘরানা। তাদের মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য হল- বিষ্ণুপুর-এর ফৌজদার পরিবারের মহিলাদের তৈরি হিঙ্গুল পুতুল, হাওড়া ও হুগলি জেলার শেওড়াফুলির রানি পুতুল ইত‍্যাদি। মুর্শিদাবাদের কাঁঠালিয়া, নদিয়ার নবদ্বীপ, বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া- সব পুতুলের রয়েছে আপন ঘরানা, ঐতিহ্য, যা বাংলার সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে সারা পৃথিবীর কাছে। তাদের মধ‍্যেই অতুলনীয় কৃষ্টিতে ভাস্বর মজিলপুরের পুতুল (Majilpur Dolls)। মজিলপুরের পুতুলশিল্পের ইতিহাস বহু পুরোনো। এই ইতিহাসের শুরু প্রায় দুই শতক আগে, যখন যশোহরের জমিদারেরা মজিলপুরে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের একজন পেয়াদা ছিলেন, যাঁর নাম ছিল কালীচরণ। তিনি মাটি দিয়ে দেবদেবীদের নয়নাভিরাম মূর্তি বানাতেন। তাঁর পুতুলগুলির নাম ছিল টেপা পুতুল। মজিলপুরের টেপা পুতুলের খ‍্যাতি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। পরে কালীচরণের ছেলে জানকীনাথ দাসের হাত ধরে কৃষ্টি আর শিল্পশৈলীর ঘরানা গড়ে ওঠে। তারপর জানকীনাথের উত্তরসূরী মন্মথনাথের হাত ধরে সারা বাংলার কাছে পরিচিতি পায় মজিলপুরের পুতুল।।।

বর্তমান সময়ে মন্মথনাথের সুযোগ‍্য নাতি শম্ভুনাথ দাস বহন করছেন এই সুমহান ঐতিহ্যকে। বর্তমান সময়ে মজিলপুরের পুতুলের বৈশিষ্ট্য হলো পুতুল তৈরিতে এক-খোল এবং দু-খোল ছাঁচের ব‍্যবহার। এছাড়াও বিনা ছাঁচে, শুধুমাত্র হাত দিয়েও অনেক পুতুল গড়া হয়। হাতে বানানো পুতুলগুলির মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মানিকপির, আটেশ্বর, দক্ষিণেশ্বর, পঞ্চানন ইত্যাদি। শম্ভুবাবু কয়েকবছর ধরে শুরু করেছেন মজিলপুরের দুর্গা পুতুল বানানোর কাজ, যার চাহিদা আকাশ ছুঁয়েছে শুরুর দিন থেকে।

মজিলপুরের পুতুলের বিবিধতা অনেক। মজিলপুরের আহ্লাদ-আহ্লাদী, কলসি কাঁধে মেয়ে, গ্রামের মেয়ে, বেনেবউ, বিভিন্ন পশুপাখি, সাহেব-মেম পুতুলগুলি চেনে না, বা নাম শোনেনি, বাংলাতে এমন মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলার বাবুদের কৃত্রিমতা, ঔদ্ধত্যকে কটাক্ষ করে বানানো শুরু হয়েছিলো মজিলপুরের বাবু পুতুল, যা এখনও সমানভাবে জনপ্রিয়। রয়েছে পৌরাণিক দেবদেবীদের পুতুলও- রাধাকৃষ্ণ, কালীয়দমন, জগদ্ধাত্রী, গণেশজননী। সুন্দরবনের নিজস্ব লৌকিক দেবতাদের পুতুলের মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য হলো দক্ষিণরায়, বনবিবি, বারা ঠাকুরের পুতুল। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.