রামায়ণ অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্রের কাহিনী। সেই কাহিনী গ্রন্থে অর্থাৎ গল্পের বইতে দর্শন? আসলে মহাভারতের যুদ্ধের পরে কলিযুগের আরম্ভে ঋষিরা মানুষের মেধা এবং ধর্মের প্রতি মানুষের অনুরক্তির হ্রাসের কথা চিন্তা করে সমস্ত তত্ত্ব ও দর্শনকে সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচার করার উদ্দেশ্যে জীবনের গভীর তত্ত্বগুলিকে কাহিনীর আকারে প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেন। এই মহান্ জ্ঞানসত্র অনুষ্ঠিত হয়েছিল নৈমিষারণ্যে। ভারতবর্ষের প্রতি কোণ থেকে সশিষ্য ঋষি, মুনি, আচার্যরা মহর্ষি শৌনকের আশ্রমে একত্রিত হন। ১২ বছর যাবৎ ৮৮০০০ জ্ঞানোপাসকের বিপুল গবেষণা এবং সাধনার পরে মহর্ষি বেদব্যাস বিরচিত পুরাণগুলিকে জনৈক রাখালকে শেখানো হয়। তাঁর নাম সূত। অর্থাৎ সমাজের অন্তিম পংক্তিতে স্থিত ব্যক্তির মাধ্যমে তত্ত্বের প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়।
এর পরে এই জ্ঞানসাধকরা পুনরায় নিজ নিজ স্থানে ফিরে গিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষে এই জ্ঞানপরম্পরাকে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তত্ত্বকথাকে কাহিনীর মধ্যে দিয়ে প্রচার করার এই পরম্পরা দীর্ঘকাল যাবৎ প্রচলিত থাকে। অধ্যাত্ম রামায়ণ থেকে শুরু করে শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত তারই নিদর্শন।
অধ্যাত্ম রামায়ণের রচয়িতা
অধ্যাত্ম রামায়ণ ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের অন্তর্গত বলে একটি দৃঢ়তর মত প্রচলিত আছে। প্রায়শঃ মুদ্রিত পুস্তকগুলিতে তেমনটিই উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনকি পুরাতন পাণ্ডুলিপিগুলিতেও তেমন উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের প্রচলিত সংস্করণে এই অংশটি কোথাও পাওয়া যায় না। অধ্যাত্মরামায়ণে রাবণ, বালি, সুগ্রীব, হনুমান প্রমুখের জন্মকাহিনী এবং পূর্বজীবনের বর্ণনা পাওয়া গেলেও অধ্যাত্ম রামায়ণ এই পুরাণে দেখা যায় না। সম্ভবতঃ, অধ্যাত্ম রামায়ণ একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ, কোন পুরাণের অন্তর্গত নয়। প্রয়াগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রী রঘুবর মিট্ঠুলাল The Authorship of The Adhyātmarāmāyaṇa নামক গবেষণা প্রবন্ধে প্রতিপাদন করেছিলেন যে, রামানন্দী সম্প্রদায়ের প্রবক্তা শ্রীরামানন্দাচার্যই অধ্যাত্মরামায়ণের রচয়িতা। (প্রবন্ধটি গঙ্গানাথ ঝা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জার্নালে ১৯৪৩-৪৪ বর্ষের ফেব্রুয়ারি মাসের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল) কিন্তু তিনি ভবিষ্যপুরাণের কিছু শ্লোকের আধারে এই অনুমান করেছিলেন। মহর্ষি বেদব্যাস রচিত ভবিষ্যপুরাণে পরবর্তীকালে বহু প্রক্ষেপ হয় বলে স্পষ্টই বোঝা যায়। এই পুরাণের চারটি সংস্করণও পাওয়া যায়। সুতরাং, ভবিষ্যপুরাণের আধারে এই ধরণের অনুমান খুব একটা প্রামাণিক বলে ধরা যায় না। উপরন্তু, ভবিষ্যপুরাণে অধ্যাত্মরামায়ণের রচয়িতা শ্রীরামশর্মা বলে বলা হয়েছে। অধ্যাপক মিট্ঠুলাল এই রামশর্মা এবং রামানন্দাচার্যকে একই ব্যক্তি বলে ধরেছেন। কিন্তু ভবিষ্যপুরাণেরই অন্যত্র রামশর্মা এবং রামানন্দাচার্য পৃথক বলে উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং, অধ্যাপক মিট্ঠুলালের কথাকে পণ্ডিতমহলে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
অধুনা মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত রীবা রাজ্যের রাজা মহারাজ বিশ্বনাথ সিংহ জূদেও অধ্যাত্মরামায়ণের একটি টীকা রচনা করেন। এই টীকাটির সম্পাদনাকার শ্রী প্রভাত শাস্ত্রী অধ্যাত্মরামায়ণের ভাষা, অধ্যাত্মরামায়ণের পাণ্ডুলিপির প্রাপ্তিস্থান, অধ্যাত্মরামায়ণে ভক্তিবর্ণনার প্রাচুর্য, দক্ষিণামূর্তির স্তুতি প্রভৃতি বিভিন্ন চিহ্নকে আধার করে অধ্যাত্মরামায়ণের রচয়িতা কোন কর্ণাটকীয় পণ্ডিত বলে অনুমান করেছেন।
যাই হোক, টীকাকাররা সকলেই প্রায় এটিকে ব্রহ্মাণ্ডপুরাণের অন্তর্গত বলে উল্লেখ করেছেন। সম্ভবতঃ, বর্তমানে প্রাপ্ত ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ অসম্পূর্ণ। প্রাচীন কালে হয়ত ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে এই অংশটি ছিল। কালক্রমে বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডপুরাণটি কালগর্ভে বিলুপ্ত হয় এবং বর্তমানে প্রাপ্ত ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ তার সংক্ষিপ্ত রূপ।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে সম্প্রদায়ের প্রতি আস্থাশীল পণ্ডিতবর্গ এটিকে ব্রহ্মাণ্ডপুরাণের অন্তর্গত বলে মনে করেন। কেউ কেউ আবার এটিকে বেদব্যাস বিরচিত একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ বলেও মনে করেন। শ্রীমধ্বাচার্য বিরচিত পূর্ণপ্রজ্ঞভাষ্যে এবং তাঁর অন্যান্য গ্রন্থেও অধ্যাত্মরামায়ণ থেকে বহু শ্লোকের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। সুতরাং গ্রন্থটি যদি বেদব্যাস রচিত নাও হয়, তথাপি অন্ততঃ মধ্বাচার্যের (একাদশ শতাব্দী) পূর্বকালিক বলে ধারণা করা যেতে পারে।
অধ্যাত্মরামায়ণের বৈশিষ্ট্য
অধ্যাত্মরামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের দিব্য চরিত্রের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। বাল্মীকীয় রামায়ণের মতই এই রামায়ণও সাতটি কাণ্ডে নিবদ্ধ। এই রামায়ণ শ্রী মহাদেব কর্তৃক দেবী পার্বতীর উদ্দেশ্যে উপদিষ্ট হয়েছে বলে গ্রন্থের শুরুতে পাওয়া যায়।
রাবণের অত্যাচার এবং রাক্ষসদের দুরাচারে ভারাক্রান্ত পৃথিবী দেবী অন্য দেবতাদের সঙ্গে ব্রহ্মার নিকট গমন করেন। ব্রহ্মার উপদেশে তাঁরা শ্রী বিষ্ণুর স্তুতি করলে ভগবান বিষ্ণু প্রকট হয়ে দশরথের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করার কথা জানিয়ে দেন। এর পরে বাল্মীকীয় রামায়ণের কাহিনীর সঙ্গে অধ্যাত্মরামায়ণের কাহিনীর বিশেষ পার্থক্য নেই। কেবলমাত্র অরণ্যকাণ্ডে সীতাহরণের পূর্ববর্তী ঘটনায় দেখা যায় যে, রাবণ স্বর্ণবর্ণ মৃগের রূপ ধারণ করে রামচন্দ্রকে বঞ্চনা করার জন্য মারীচকে আদেশ করলে শ্রীরামচন্দ্র সেই ঘটনা টের পেয়ে যান এবং তিনি মাতা সীতাকে বলেন কুটীরের যজ্ঞাগ্নিতে অন্তর্লীন হয়ে থাকতে। সেই মত মাতা সীতা অগ্নিতে লুক্কায়িত হন এবং একজন মায়াসীতার আবির্ভাব ঘটে। এই মায়াসীতা অগ্নিপরীক্ষার সময়ে অগ্নিতে প্রবেশ করেন এবং দেবী সীতা প্রকট হন। বাল্মীকীয়রামায়ণের মতই অধ্যাত্মরামায়ণেও লক্ষ্মণ কর্তৃক আশ্রমের বাইরে গণ্ডি বা লক্ষ্মণরেখা রচনার উল্লেখ পাওয়া যায় না।
বাল্মীকীয়রামায়ণ এবং অধ্যাত্মরামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের দিব্যচরিত বর্ণনার একটি সুপ্রকট ভেদ বর্তমান। মহর্ষি বাল্মীকি দেবর্ষি নারদের পরামর্শে নিজ কবিত্বশক্তির দ্বারা লোককল্যাণের আকাঙ্ক্ষায় লোকোত্তর চরিত্রের কোন ‘মানুষের’ চরিত্র বর্ণনা করতে উদ্যোগী হন। সেজন্য বাল্মীকির রামচন্দ্রের চরিত্রের বর্ণনায় অলৌকিকতার বিশেষ বিবরণ দেননি। কেবলমাত্র শ্রীরামচন্দ্রের পাদস্পর্শে অহল্যার শাপমুক্তিতেই শ্রীরামচন্দ্রের অলৌকিক মহিমার উল্লেখ বাল্মীকীয় রামায়ণে পাওয়া যায়। কিন্তু অধ্যাত্মরামায়ণের প্রতি ছত্রে শ্রীরামচন্দ্রের অলৌকিকত্ব প্রকটিত। এক মুহূর্তের জন্যও অধ্যাত্মরামায়ণের পাঠককে শ্রীরামচন্দ্র এবং মাতা সীতা ভুলতে দেন না যে, তাঁরা পরমপুরুষ এবং পরমা প্রকৃতি। গ্রন্থের শুরুতেই সীতাদেবী হনুমানের উদ্দেশ্যে তাঁর এবং রামচন্দ্রের স্বরূপের উপদেশ করেছেন। (বালকাণ্ডে প্রথম অধ্যায়ে ৩০-৪২ শ্লোক) সেখানে তিনি অত্যন্ত সংক্ষেপে সম্পূর্ণ রামায়ণের কাহিনীটি বিধৃত করার পরে বলেছেন–
এবমাদীনি কর্মাণি ময়ৈবাচরিতান্যপি।
আরোপয়ন্তি রামেস্মিন্ নির্বিকারেখিলাত্মনি।।
(এই সমস্ত কিছু আমিই করেছি, কিন্তু নির্বিকার, অখিলাত্মা রামে এই সমস্ত কর্মের আরোপ করা হয় মাত্র)।
রামো ন গচ্ছতি ন তিষ্ঠতি নানুশোচ-
ত্যাকাঙ্ক্ষতে ত্যজতি নো ন করোতি কিঞ্চিৎ।
আনন্দমূর্তিরচলঃ পরিণামহীনো
মায়াগুণান্ অনুগতো হি তথা বিভাতি।।
(রাম যায় না, থামে না, অনুশোচনা করে না, ত্যাগ করে না, এমনকি কিছুই করে না। সে আনন্দমূর্তি, অচল, পরিণামরহিত হলেও মায়ার গুণ সমূহ তাঁতে প্রতিফলিত হয়।)
এর পরে শ্রীরামচন্দ্রও হনুমানকে উপদেশ দিয়েছেন। সেখানে তিনি আত্মা, অনাত্মা এবং পরাত্মা– এই তিনটি তত্ত্বের বর্ণনা করেছেন।
বাল্মীকীয় রামায়ণের সঙ্গে অধ্যাত্ম রামায়ণের আরও একটি বিলক্ষণতা হল এই যে, অধ্যাত্ম রামায়ণের ছত্রে ছত্রে ঈশ্বরের স্তুতিগান বর্তমান যেগুলি ভাষা এবং ভাবে অত্যন্ত মনোরম এবং গভীর।
প্রথমেই বলা হয়েছিল যে, এই গ্রন্থটি দুরূহ দার্শনিক তত্ত্বে পরিপূর্ণ। বাল্মীকীয় রামায়ণও দার্শনিক বিচার বহুল, তবে সেখানে কাহিনীর ভিতরে দর্শন অন্তর্নিহিত। অধ্যাত্ম রামায়ণ তেমন নয়। এখানে দর্শন কাহিনীর বাইরে আলাদা ভাবেই বিচারিত। এবং সেই বিচার দুইভাবে পাওয়া যায়– স্তুতির ভিতরে অথবা উপদেশ রূপে। অধ্যাত্ম রামায়ণে অদ্বৈত তত্ত্ব প্রবল ভাবে উপদিষ্ট। এর উত্তরকাণ্ডে শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক লক্ষ্মণের নিকট প্রদত্ত অদ্বৈত তত্ত্বের উপদেশ অত্যন্ত সারগর্ভ। এই অংশটি ‘রামগীতা’ নামে পরিচিত। সাধারণ ভাবে অদ্বৈত দর্শনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়ার জন্য এই রামগীতা অত্যন্ত উপযোগী।
এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে উপদেশের আকারে ঈশ্বরোপাসনার পদ্ধতি, যোগ অভ্যাসের সূক্ষ্ম বিধি, পূজাপদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়গুলিও এই গ্রন্থে বিশদে চর্চিত হয়েছে। এককথায় জিজ্ঞাসু, সাধক, ভক্ত সকলেরই জন্য গ্রন্থটি উপযোগী।
অধ্যাত্মরামায়ণের প্রথম শ্লোকে বলা হয়েছে–
যঃ পৃথ্বীভরবারণায় দিবিজৈঃ সম্প্রার্থিতশ্চিন্ময়ঃ
সঞ্জাতঃ পৃথিবীতলে রবিকুলে মায়ামনুষ্যোব্যয়ঃ।
নিশ্চক্রং হতরাক্ষসঃ পুনরগাদ্ ব্রহ্মত্বম্ আদ্যং স্থিরাং
কীর্তিং পাপহরাং বিধায় জগতাং তং জানকীশং ভজে।।
(দেবতাদের প্রার্থনায় পৃথিবীর ভার হরণ করার জন্য পৃথিবীতলে সূর্যবংশে মায়াকে আশ্রয় করে মানুষ রূপে জন্ম নিয়ে যে চিন্ময়, অব্যয় পুরুষ সমস্ত রাক্ষসকুলকে ধ্বংস করে এবং পাপনাশক কীর্তি স্থাপন করে পুনরায় স্থির ব্রহ্মত্বে প্রতিষ্ঠিত হন, সেই জানকীশকে ভজনা করি।)
এই শ্লোকে একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। রামচন্দ্রের কীর্তি পাপহরা। অর্থাৎ তাঁর যশোগান, তাঁর চরিত সঙ্কীর্তনে পাপ নষ্ট হয়– পাঠক, শ্রোতা, বিচারকর্তার চিত্ত পবিত্র হয়।
অধ্যাত্মরামায়ণের অপর একটি অনুপম বৈশিষ্ট্য হল এখানে অদ্বৈত এবং বিশিষ্টাদ্বৈত উভয় তত্ত্বেরই প্রভূত সিদ্ধান্তের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেজন্য উভয় সম্প্রদায়েই এই গ্রন্থটি সমাদৃত। এছাড়াও অধ্যাত্মরামায়ণ রামানন্দীয় সম্প্রদায়ের একটি প্রধানতম আকর গ্রন্থ রূপে স্বীকৃত।
ভাষা, ভাব, সমস্ত দিক দিয়েই গ্রন্থটি অত্যন্ত রুচিকর তাতে সন্দেহ নেই। অধ্যাত্মরামায়ণ ভারতীয় অধ্যাত্ম শাস্ত্রের একটি অনুপম রত্ন।
রাকেশ দাশ (Rakesh Das)