“ফাঁসির রজ্জু ক্লান্ত আজিকে যাহাদের টুঁটি চেপে…………
১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি। চট্টগ্রাম জেল। সন্ধ্যে ৭ টা। দিন শেষে বন্দীরা ফিরে এসেছে তাদের জন্যে নির্ধারিত কক্ষে। রক্ষীরা দাঁড়িয়ে আছে পাহারায়। প্রতিদিনের মতোই ছন্দবন্ধ অথচ যান্ত্রিকভাবে চলছে জেলের জীবন।
অথচ সেই যান্ত্রিক ছন্দে তাল মেলাতে পারছেনা একটি মাত্র মানুষ। পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন অঙ্ক শিক্ষক। নাম সূর্য সেন। মানুষ তাঁকে চেনে মাস্টারদা নামে। আর মাত্র ৫ ঘন্টা পরেই ফাঁসি হবে তাঁর। বিপ্লবী তিনি‚ আনন্দমঠ পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন দেশের কাজে। জেনেছেন জীবন তুচ্ছ‚ সকলেই ত্যাগ করতে পারে। মা কালীর সামনে গীতা হাতে তিনি শপথ নিয়েছিলেন দেশকে স্বাধীন করার। গীতা পড়েছেন তিনি‚ মৃত্যুভয় তাঁর নেই। কিন্তু তবুও………
কোথায় যেন একটা সুর কাঁটছে মনের ভেতর। তাঁর এত দিনের বিপ্লব প্রচেষ্টা‚ তা কি সফল হবে? দেশের মানুষেরা‚ তাঁর ছাত্ররা‚ সহকর্মীরা‚ সুতীর্থরা কি পারবে তাঁর অবর্তমানে এই বিপ্লব প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে? হাল ছেড়ে দেবে না তো তারা? কখনো অভাব বোধ করবে না তো অনুপ্রেরণার? ভুলে যাবে না তো তাদের নিহত সহযোদ্ধাদের? তাঁর অনুপস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে কোলাহলে লিপ্ত হয়ে লক্ষ্য থেকে পিছু হটে যাবে নাতো তারা?
অবশেষে হাতে কলম তুলে নিলেন সেই মাস্টার। না‚ মৃত্যুর আগে কিছু একটা লিখে যাওয়া উচিৎ তাদের জন্যে। কিছু নির্দেশ দিতে হবে যাতে তাঁরা কোনো ভ্রান্তি বা চক্রান্তে না পড়ে। চিঠি আকারে লিখে ফেললেন তাঁর যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে তাদের নেতার শেষ নির্দেশ।
“আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা।
ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই ত’ সাধনার সময়। বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই ত সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকেও স্মরণ করার এই তো সময়।
কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমার ভাইবোনেরা, তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিএ্যহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙ্গে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহুর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন।
আমার জীবনের এক শুভ মুহুর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করছিল। জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মত সেই স্বপ্নের পিছনে আমি ছুটেছি। জানিনা কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষে পৌছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মত তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি।
আমার বন্ধু্রা- এগিয়ে চল। এগিয়ে চল- কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুন। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশির্বাদ করুন।
১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোন দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলধা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।
আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে- এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভিতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশির্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক
বন্দে মাতরম।”