ভারতবর্ষের গুরু-শিষ্য পরম্পরা এবং ভারতবর্ষ গঠনে এই ঐতিহ্যের ভূমিকা স্মরণ করতেই আজকে আমার এই লেখা।
‘গুরু’ অর্থাৎ যিনি ব্যবহারিক জীবনের শিক্ষার সাথে অন্তর্জগৎ কে অন্বেষণের দীক্ষা দেন।
কোনো ব্যক্তির জীবনের চলার পথ দেখাতে , জ্ঞান চক্ষু উন্মিলীত করতে গুরুর ভূমিকা যেমন আছে ঠিক তেমনি একটি রাষ্ট্রের উত্থানে গুরুর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বললে অত্যুক্তি হবে না।
গুরু-শিষ্যের বাক্যালাপ , প্রশ্নোত্তর থেকেই জন্ম নিলো উপনিষদের তত্ত্ব ; অরণ্য থেকে এলো আরণ্যক , তপোবনেIর শিক্ষাব্যবস্থা আর তা থেকেই বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুরু পরম্পরার প্রসার হয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে।
কিন্তু বিশ্ব গুরু-শিষ্য পরম্পরার অন্তর্নিহিত ভাব নিতে পারে নি , উদারবাদী মানসিকতা , প্রশ্ন করার অধিকার , তর্ক নিতে পারে নি।তাই ইউরোপ ও মধ্য প্রাচ্যে গড়ে উঠলো এমন সংস্কৃতি যেখানে তর্ক কে নিষিদ্ধ করে যুক্তির থেকে প্রাধান্য পেলো আগ্ৰাসন।
গুরু-শিষ্য পরম্পরা জন্ম দিলো যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের তার অনুবাদ হলো , তাকে ভীত করে নির্মিত হলো ইউরোপের বৈভব কিন্তু নিজেদের উন্নতি কে স্বতন্ত্র প্রমাণ করতে ভারতীয় দর্শন কে উপেক্ষা করা হলো।
ছোটোবেলায় আমরা সবাই নীতি শিক্ষামূলক গল্প পড়েছি বা শুনেছি যেখানে বিভিন্ন পশু-পাখি কে চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো।এই গল্পগুলোর উৎস প্রায় ৫০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে সংস্কৃতে লেখা ‘পঞ্চতন্ত্র’।
রাজনীতির কূটতত্ত্ব , বিশ্বস্ত বন্ধু লাভের উপায় , শত্রু চেনার উপায় পঞ্চতন্ত্রের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুবাদ হয়।
গঠনমূলক কূটনীতি শেখালো পঞ্চতন্ত্র , যা এক গুরুর তার শিষ্যদের অতি সহজ-সরল ভাষায় গল্পের মাধ্যমে শিক্ষাদান।সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচালনায় পঞ্চতন্ত্রের অবদান পরোক্ষে ভারতবর্ষের গুরু পরম্পার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
পঞ্চতন্ত্রের কাহিনী গুলি পার্সি ভাষা থেকে আরবী তে অনূদিত হয় প্রায় ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে।এর আগে সংস্কৃত থেকে পার্সি ভাষায় অনুবাদ করা হয় ৫০০ খ্রীষ্টাব্দে। পঞ্চতন্ত্রের অনুবাদ , আমাদের জ্ঞানের প্রবাহের দিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয়।গ্ৰিক ভাষায় পঞ্চতন্ত্রের অনুবাদ হয় ১০৮০ খ্রীষ্টাব্দে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উৎস সম্পর্কে বিভ্রান্ত করা গেলেও পঞ্চতন্ত্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কে অস্বীকার করার উপায় নেই। এখনো ভারতবর্ষের বিভিন্ন মন্দিরের দেওয়ালে পঞ্চতন্ত্রের কাহিনী খোদাই করা আছে।পঞ্চতন্ত্র প্রমাণ করে যে জ্ঞানের প্রবাহ ভারত থেকে পার্সিয়া , পার্সিয়া থেকে আরব এবং আরব থেকে খ্রীষ্টিয় ইউরোপ— এই পথেই হয়েছিল।
পাশ্চাত্যের অহংকারের একটি বিষয় হচ্ছে গণতন্ত্র।
কে বলে গণতন্ত্র ইউরোপের দান ?
ভারতীয় গুরুর মুখে উচ্চারিত ‘একম্ সৎ বিপ্রা বহুধা বদন্তি’ মন্ত্রের থেকে বড় গণতন্ত্রের বাণী আর কি হতে পারে ?
গুরুগৃহে সমস্ত শিষ্য কে সমানভাবে গুরু সেবায় নিয়োজিত হতে হতো।
গুরুগৃহের সাম্য পরবর্তীতে সমাজে বিস্তার লাভ করে।কৃষ্ণ-সুদামার বন্ধুত্বে এই সাম্য নিজেকে গর্বিত করেছে। সাম্যবাদ , ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে নতুন নয়।
শাস্তি দেওয়ার , কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষমতা তখনই থাকে যখন ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হয়। গুরুগৃহে সে সুযোগ ছিল। গুরু-শিষ্যের সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত একসাথে দীনযাপন সেই বন্ধনের জন্ম দিতো যেখানে গুরুর কাছে করা প্রতিজ্ঞা শিষ্য লঙ্ঘন করতে পারতো না।
জ্ঞান গ্ৰহণের আগে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হতো কারণ জ্ঞান থেকে শক্তির জন্ম হয়। অপাত্রে জ্ঞান দান , সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে।
বর্তমানে পরমাণু বোমার তত্ত্ব সবার হাতে নেই। গভীর জ্ঞানের তত্ত্ব এই যুগেও উপলব্ধ নয়।
তাই জ্ঞান দানের আগে যে সংস্কারিত করা প্রয়োজন তা ভারতবর্ষ অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলো এবং গুরু পরম্পার মাধ্যমে তার সুব্যবস্থা করেছিলো।
সমাজের নৈতিকতার উৎস ছিল গুরু গৃহ।
শিষ্য হতে গেলে যেমন গুরু কে পূজার আসনে বসাতে হবে , গুরুকেও তেমন ত্যাগ , নিরপেক্ষতা ও জ্ঞানের জীবন্ত রূপ হতে হবে।
এই গুরু শিষ্য পরম্পরা কে ধ্বংস করলে ভারতবর্ষের মেরুদন্ড যে ভেঙ্গে দেওয়া যায় এটা উপলব্ধি করেছিলো বৈদেশিক শাসকরা।এলো মেকলীয় ব্যবস্থা অর্থাৎ সংস্কারবিহীন সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা।
গুরু-শিষ্য পরম্পরাই ভারতবর্ষ কে বিপদের সময়ে বারবার উদ্ধার করেছে।
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্রের জীবনের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্বাক্ষী গুরু বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র । ভারতবর্ষে গুরু তাই শুধুমাত্র শিক্ষাজীবনের প্রয়োজন নয় ,জীবনে চলার পথে ধ্রুবতারা।
মহাভারতেও আমরা দেখতে পাই ,গুরু দ্রোণাচার্য দিয়েছিলেন অস্ত্রশিক্ষা , কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ‘গীতা’ বোঝালেন অর্জুনের সখা ও গুরু শ্রী কৃষ্ণ।
গুরু চাণক্য থেকে ভারতবর্ষ চন্দ্রগুপ্তকে পেলো আর তারপর ভারতবর্ষের সুবর্ণযুগ ,নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম উৎকর্ষের সময় ।
ভারতবর্ষ কে বিধর্মীদের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে গুরু নানক থেকে শুরু করে গুরু গোবিন্দ সিং এর আত্মবলিদান কি আমরা ভুলতে পারি ?
ভারতবর্ষের সনাতন সংস্কৃতি কে বাঁচাতে গুরু অর্জুন থেকে গুরু তেগবাহাদুরের বলিদান আজো সাংস্কৃতিক আগ্ৰাসনের বিরুদ্ধে আমাদের প্রেরণার উৎস।
শিখ গুরুদের বলিদান পরবর্তীকালে রঞ্জিত সিং এর মুকুটের কোহিনুর হয়ে শোভা পেয়েছে।
গুরু পরম্পরা এখন ব্যক্তি নির্ভর না হয়ে তত্ত্ব নির্ভর হয়ে ত্রুটির সম্ভাবনাকে লোপ করার প্রয়াস দেখা গেলো গুরু গ্ৰন্থসাহেব এর মাধ্যমে।
সমর্থ রামদাস শ্রীনগরে শিখ গুরু হরগোবিন্দ এর সান্নিধ্যে আসেন।শিখ গুরুর প্রেরণা সমর্থ রামদাসের মাধ্যমে মহারাষ্ট্রে পৌঁছাল।গুরু পরম্পরা শিখ থেকে মারাঠা পর্যন্ত এক সুরে ধ্বনিত হয়েছে।মারাঠা কে কেন্দ্র করে ‘হিন্দভী স্বরাজ’ এর শঙ্খধ্বনি বাজালেন ছত্রপতি শিবাজী।
ইংরেজদের শাসনকালে রাজশক্তির আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টায় যুবকদের মনে সনাতন সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দ্বিধা-দ্বন্দের প্রচার হতে লাগলো সনাতন ভারতবর্ষের জাগরণে গুরুদেব শ্রী রামকৃষ্ণের ‘যত মত , তত পথ’ এর আদর্শ প্রচার করলেন শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ।তা শুধু ভারতবর্ষে সীমাবদ্ধ থাকলো না , আলোড়িত হলো পাশ্চাত্য সভ্যতা।
এর আগে বাংলায় সুলতানী আমলে নবদ্বীপের বিশ্বম্ভর মিশ্র টোলে শিক্ষাদানে সীমাবদ্ধ না থেকে হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে সমাজ কে বাঁধতে হয়েছেন শ্রী চৈতন্যদেব।
সারা পৃথিবী কে শ্রী চৈতন্যদেবের দেখানো পথে কৃষ্ণভক্তি ছড়ালেন গুরু ভক্তিবেদান্ত সরস্বতী ঠাকুরের শিষ্য অভয়চরণ দে (শ্রীল প্রভুপাদ)।
শ্রীল প্রভুপাদ পুঁজিবাদ , বামপন্থার দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে কৃষ্ণভক্তি ছড়িয়ে দিলেন আমেরিকা-রাশিয়া তে।
প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের সনাতন সংস্কৃতি কে বাঁচাতে আবির্ভাব হলো গুরুদেব স্বামী প্রণবানন্দের।’ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’ আজ সত্যিই হিন্দু মিলন মন্দির।
ভারতবর্ষের আকাশে যখনই অপসংস্কৃতির কালোমেঘ জমা হয়েছে গুরু পরম্পরা থেকেই সূর্যোদয় ঘটেছে।
ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাএই সাক্ষ্যই দেয় যে ,
গুরু-শিষ্য পরম্পরা সনাতন ভারতবর্ষের রোগ প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক পদ্ধতি অর্থাৎ ‘ইমিউনিটি সিস্টেম’ এবং জ্ঞানবাহী ‘স্নায়ুতন্ত্র’।গুরু একদিকে যেমন ব্রক্ষ্মার মতো সৃষ্টি করবেন , বিষ্ণুর মতো পালন করবেন অন্যদিকে মহেশ্বরের মতোই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তান্ডবের উদ্বোধন করবেন।
সমাজ কে ত্যাগ ও জ্ঞানের পথে চালিত করতে ভারতবর্ষের এক আবিষ্কার গুরু পরম্পরা যা সনাতন শ্বাশ্বত।
ত্যাগ , জ্ঞান ও শক্তির আধার গুরুর গৈরিক বসন।
আজ ভারতবর্ষ কে বিশ্বগুরু তে পরিণত করতে প্রত্যেক শিক্ষক কে ‘গুরু’ তে পরিণত হতে হবে।
শিক্ষার সঙ্গে অর্থের যোগ কে , বৈষয়িক মুনাফার সম্পর্ক কে ছিন্ন করতে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষক সমাজ কে।
গুরুকুলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রতি ত্যাগের দীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে , শিক্ষার সঙ্গে সংস্কার কে যুক্ত করতে হবে।
গুরুকলীয় ব্যবস্থা ভারতবর্ষের জ্ঞান ক্ষেত্র কে আবার উর্বর করতে পারে। বিভিন্ন রাজ্যের গুরুকুল ইতিমধ্যেই আমাদের সে ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে।
আর সবশেষে উল্লেখ করলেও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।জ্ঞান কে রক্ষা করতে এবং তার প্রবাহ সঠিক দিকে বজায় রাখতে প্রয়োজন সমাজের ভেতরের শক্তি। সমাজের সুস্বাস্থ্যের জন্য ভারতীয় সমাজের এই রোগ নির্ণয় করেছিলেন ‘ডাক্তারজী’।
ভারতবর্ষের প্রধান যে দুর্বলতা হিন্দু সমাজের মধ্যেকার অনৈক্য , তা দূর করতে গুরু গৈরিক ধ্বজের ত্যাগ ও শক্তির আদর্শে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ কেশব বলিলাম হেডগেওয়ার ভারতবর্ষের সনাতন ঐতিহ্যবাহী , তেজোদীপ্ত গৈরিক ধ্বজ কে গুরুর আসনে প্রতিষ্ঠিত করে যে ত্যাগব্রতের পথ দেখিয়েছেন তা পরমবৈভবশালী ভারতবর্ষ গঠনের এক অবিকল্প পদ্ধতি যার ফল ইতিমধ্যেই বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে।
তাই গুরু পরম্পরার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ যে বিশ্বগুরুর আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত।
🙏🌸🌺
পিন্টু সান্যাল