১৮৫০-এর মাঝামাঝি। ভারতে তখন পুরোদস্তুর ব্রিটিশ শাসন। লন্ডনের পরেই তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল কলকাতা। শহরের মধ্যে তখন স্কটিশদের রমরমা। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কী ভাবে নিজেদের কাজকারবার আরও বাড়ানো যায়, সেই চিন্তাতেই মগ্ন তারা। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পশ্চিম স্কটল্যান্ডের আর্গিল কাউন্টির দুই বাল্যবন্ধু, উইলিয়াম ম্যাকিনন এবং রবার্ট ম্যাকেঞ্জি। কলকাতায় এসেই দুই বন্ধু বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে সমুদ্রপথে পণ্য রপ্তানির ব্যবসা শুরু করলেন। গড়ে উঠল ম্যাকিনন, ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানি।
১৮৫৩ নাগাদ দক্ষিণ বর্মায় (বর্তমান মায়ানমার) আধিপত্য কায়েম করল ব্রিটিশরা। ম্যাকিনন এবং ম্যাকেঞ্জির বয়স তখন ত্রিশের কোঠায়। ব্যবসা বাড়ানোর এমন সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন এই যুগল। কে জানত, সেই সুযোগ শুধু যে তাঁদের বহুজাতিক ব্যবসা বিস্তারের পথ প্রশস্ত করবে, তাই নয়, বদলে দেবে পৃথিবীব্যাপী মানুষ এবং পণ্য পরিবহনের ধারণাও!
বছর দুয়েকের মধ্যেই দক্ষিণ বর্মার উপকূলীয় এলাকা এবং ইরাওয়াদি নদীর ব-দ্বীপের নিম্নভাগ চলে এল ব্রিটিশদের দখলে। কলকাতা থেকে রেঙ্গুন নিয়মিত স্টিমার ফেরি সার্ভিস শুরু করার জন্য টেন্ডার ডাকল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ভাগ্যক্রমে সেই বরাত পেলেন ম্যাকেঞ্জি আর ম্যাকিননের জুটি। ১৮৫৬ সালে যাত্রা শুরু হলো ‘ক্যালকাটা অ্যান্ড বর্মা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি’-র।
গুটিকতক স্টিমার এবং দু’টি জাহাজ নিয়ে শুরু হল কোম্পানির পথচলা। জাহাজগুলি মাসে দু’বার কলকাতা থেকে যেত আকিয়াব, রেঙ্গুন এবং মৌলমেন। পণ্য, যাত্রী এবং চিঠিপত্র নিয়ে প্রথমবার কলকাতা থেকে রেঙ্গুন রওনা হল ‘দ্য কেপ অব গুড হোপ’ নামের জাহাজটি।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল ভারতবর্ষ। শুরু হলো সিপাহী বিদ্রোহ। তখন কলম্বো থেকে কলকাতায় সেনাবাহিনী নিয়ে আসার কাজে লাগানো হলো ‘দ্য কেপ অফ গুড হোপ’-কে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কলকাতা-রেঙ্গুন রুটে দ্য কেপ অফ গুড হোপের সঙ্গে যাতায়াত করতে শুরু করল সমপরিমাণ যাত্রী এবং পণ্য বহনে সক্ষম আরও একটি নতুন জাহাজ, বাল্টিক।
খুব তাড়াতাড়িই শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে শুরু করল দুই বন্ধুর কলকাতা থেকে রেঙ্গুন যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনের ব্যবসার। পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করল রেঙ্গুনের গুরুত্ব। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ার অফিসার ডেভিড জে মিশেলের লেখা থেকে জানা যায়, রবিবার বাদে সপ্তাহের বাকি প্রতিদিন অন্তত একটি করে জাহাজ কলকাতা থেকে রেঙ্গুন যেত। সমুদ্রপথে চিঠি এবং যাত্রী পরিবহণের জন্য ৮টি আলাদা পরিষেবা চালু ছিল।
শুধুই ফেরি পরিষেবা নয়, জাহাজে করে আসা জিনিসপত্র এবং ভারতীয় শ্রমিকদের হাত ধরে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হতে লাগল রেঙ্গুন শহরেরও। ব্রিটিশরা বর্মা দখল করার ৩০ বছরেরও কম সময়ে বর্মার জনসংখ্যা ৩০,০০০ থেকে বেড়ে হয়ে দাঁড়ালো ১৫০,০০০। উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে উঠে এলো রেঙ্গুন। শিক্ষাবিদ উমাশঙ্কর সিং-এর লেখা থেকে জানা যায়, ভারত ও বর্মার মধ্যে নিয়মিত ফেরি পরিষেবার ফলে সে দেশে ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে, ফলশ্রুতিতে সে দেশে নতুন বাসস্থানের চাহিদাও আকাশ-ছোঁয়া হয়ে ওঠে…
১৮৫৭ সালের যুদ্ধে সাহায্য করার পর থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নেকনজরে চলে আসে ক্যালকাটা এন্ড বর্মা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি। পুরস্কার হিসেবে ১৮৬১ সালে ম্যাকিনননের প্রতিষ্ঠা করা কোম্পানিকে নিজেদের আওতাধীন করে নেয় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি। ব্রিটিশদের অন্যান্য উপনিবেশেও নিয়মিত সৈন্যবাহিনী পৌঁছে দেওয়ার বরাত পেতে শুরু করে তারা। কলকাতা এবং রেঙ্গুন থেকে নিয়মিত ব্রিটিশ সেনাদের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেছে ম্যাকেঞ্জি এবং ম্যাকিননের কোম্পানি। এমনকি, ১৮৬০ সালের মাওরি যুদ্ধের সময় সুদূর নিউজিল্যান্ডেও ব্রিটিশ সেনাদের পৌঁছে দিয়েছে এই কোম্পানি।
১৮৭০ সালের মধ্যেই পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌ-পরিবহন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে কলকাতা। বঙ্গোপসাগর থেকে একাধিক নতুন যাত্রাপথে শুরু হয় পরিবহন পরিষেবা। সপ্তাহে চারবার কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ার এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কামার্তা হয়ে রেঙ্গুন পাড়ি দিত কোম্পানির জাহাজ। এমনকি, কলকাতা থেকে রেঙ্গুন হয়ে মাসে দু’বার পেনং এবং সিঙ্গাপুরের উদ্দেশেও রওনা হতো জাহাজগুলি।
পরিবহন পরিষেবার হাত ধরেই ক্রমশ ফুলে-ফেঁপে উঠতে লাগলো বর্মার অর্থনীতি। কর্মসংস্থানও বাড়তে লাগল ক্রমশ। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষেরই অংশ ছিল বর্মা। ফলে যে সমস্ত ভারতীয় সে সময় বর্মায় অস্থায়ী কিংবা পাকাপাকি ভাবে বাস করতে চাইতেন, তাঁদের জন্য নিয়মের বেড়াজালও তেমন ছিল না। ফলত, বিপুল সংখ্যক বাঙালি অভিবাসী হিসাবে বর্মায় চলে যেতে শুরু করলেন। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ থেকে জানা যায়, ১৮৮১সালে বর্মায় বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে ৩০ শতাংশই ছিলেন বাঙালি।
ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসে ১৯৮০ সালে প্রকাশিত উমাশঙ্কর সিং-এর লেখা থেকে জানা যায়, বর্মার বাঙালি অভিবাসীদের মধ্যে ৪০ শতাংশই এসেছিলেন অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রাম থেকে আকিয়াব পর্যন্ত ১৫ দিন অন্তর ফেরি পরিষেবা খুবই জনপ্রিয় ছিল বাঙালি অভিবাসীদের মধ্যে। বিভিন্ন ছোট বন্দর ছুঁয়ে কক্সবাজার হয়ে বর্মায় পৌঁছাত জাহাজ।
রেঙ্গুনে ভারতীয় অভিবাসীদের চাহিদা এতটাই বেশি ছিল, যে, মাদ্রাজ থেকেও ফেরি পরিষেবা চালু হয়। বিশাখাপত্তনম-সহ ভারতের পূর্ব প্রান্তের অন্যান্য বন্দর থেকেও বর্মায় ভারতীয় অভিবাসীদের নিয়ে যেত জাহাজগুলি। শুধু তাই নয়, ভারতীয় অভিবাসীদের বর্মা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ফেরি পরিষেবা দেওয়া কম্পানিগুলিকে ভর্তুকিও দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ফলশ্রুতিতে, উনিশ এবং কুড়ি শতকে রেঙ্গুনের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই ছিলেন ভারতীয়রা। এবং তাঁরা সে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রীতিমতো সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
১৯৩২ সালে ইংরেজ-বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন ব্রিটিশদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠে। এই সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, সর্বপরি রাজনৈতিক অবস্থা কঠিন হয়ে উঠেছিল। তার থেকে রেঙ্গুনের অবস্থা অন্যরকম ছিল। ভারতের যে সমস্ত মানুষের কাজ করতে, বিজনেস করতে , চাকরি করতে অথবা সহিংস স্বাধীনতা বিপ্লব করতে চাইতেন তারা রেঙ্গুনে আসতেন।
রেঙ্গুন নামটি বাংলা ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত। বহু সাহিত্যিকের অমর রচনাতে রেঙ্গুন অত্যন্ত সুন্দর রোমান্টিক আর রোগশোকের শহর হিসেবে স্থান পেয়েছে।
১৮৫২ সালে ভারতের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বিতীয় অ্যাঙ্গলো-বার্মা যুদ্ধের পর যখন রেঙ্গুন শহর তৈরি করা শুরু করে তখন থেকেই ভারতের দক্ষিণের, বিশেষ করে বাংলার মানুষ রেঙ্গুনে যাওয়া শুরু করে। পরে ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে এবং বার্মায় পাকাপোক্ত হলে দিল্লি থেকেই বার্মা শাসিত হতো।
এই আন্দোলনে জাপান প্রবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, জাপান-চীন প্রবাসী হেরাম্বলাল গুপ্ত, রাজামহেন্দ্র প্রতাপ এবং আমেরিকা-ক্যানাডা প্রবাসীদের প্রতিষ্ঠিত গদর পার্টির সক্রিয় কর্মতৎপরতা ভারতবর্ষে বিপ্লবীদের প্রধান প্রেরণাদাতা।
কাজেই ব্রিটিশ সরকার সুযোগ খুঁজছিল কিভাবে পলাতক বিপ্লবী বিশেষ করে রাসবিহারী বসু, হেরাম্বলাল গুপ্তকে গ্রেপ্তার করা যায়। রাসবিহারী বসু জাপানে বিয়ে করে জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করার ফলে সে সুযোগ নস্যাৎ হয়ে যান।
১৯৩৭ সালে রাসবিহারী বসু কর্তৃক প্রতিষ্টিত ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ। তৎকালীন সময়ে রাসবিহারী বসু ছিলেন অসাধারণ যুক্তিবাদী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সশস্ত্র বিপ্লব বা অস্ত্র ব্যবহার ছাড়া ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা যাবে না। তাই বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন।
১৮৭০ সাল থেকে বর্মায় ভারতীয় শ্রমিকদের চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকে, যার জেরে মাদ্রাজ থেকে রেঙ্গুনে ফেরি পরিষেবা চালু করতে বাধ্য হয় সরকার। ১৯ শতকের শেষদিকে মধ্যেই রেঙ্গুনে ভারতীয় জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই ছিল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি থেকে আসা লোকজন, এমনটাই জানা যায় মাইকেল অ্যাডাসের লেখা থেকে।
বিশ শতকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল কলকাতা-রেঙ্গুন ফেরি পরিষেবা। সে সময়ে বিশ্বজুড়ে পরিবহণ ব্যবসায় ধস নামলেও রেঙ্গুন-কলকাতা রুট তখনও মুনাফাজনক ছিল। ১৯৩০ সালের মধ্যে এই রুটে সপ্তাহে ১০ বার পরিষেবা চালু হয়ে গিয়েছিল। সময়ানুবর্তিতাই এই রুটের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ বলে জানা যায়। কলকাতা থেকে রেঙ্গুন পৌঁছতে সময় লাগত দু’দিন। রেঙ্গুনে পৌঁছানোর পর আড়াইদিন ধরে চলত জাহাজি মাল তোলা এবং খালাস করা। তার পরেই আবার কলকাতার উদ্দেশে রওনা হত জাহাজগুলি।
ব্রিটেন ও বর্মার মধ্যে চিঠি চালাচালির প্রধান মাধ্যম ছিল এই পরিষেবা। বর্মা পৌঁছনোর জন্য চিঠিগুলি প্রথমে সমুদ্রপথে এসে পৌঁছত বোম্বেতে। সেখান থেকে ট্রেনে করে কলকাতা। কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার হয়ে রেঙ্গুনগামী জাহাজে পৌঁছে যেত সেইসব চিঠি। ১৯৪২ সালে বর্মায় জাপানি আক্রমণের আগে পর্যন্ত এভাবেই চিঠিপত্র পৌঁছে যেত রেঙ্গুনে। বর্মায় জাপানি আক্রমণের ফলশ্রুতিতে বন্ধ হয়ে যায় এই পরিষেবা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আবার চালু হয় এই পরিষেবা। ১৯৪৭ এবং ১৯৪৮ সালে যথাক্রমে ভারত এবং বর্মা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে। দেশগুলির স্বাধীনতা লাভের পরেও চালু ছিল পরিষেবাটি। আস্তে আস্তে জলপথের বদলে ব্রিটেন থেকে বর্মায় চিঠি আদান প্রদান প্রক্রিয়ার মাধ্যম হয়ে ওঠে বিমান পরিষেবা। আর তা জনপ্রিয় হতে শুরু হওয়ার পর থেকেই গুরুত্ব হারাতে শুরু করে ফেরি পরিষেবা। কবে নাগাদ কলকাতা-রেঙ্গুন ফেরি পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়, তা সঠিক ভাবে জানা যায়নি। তবে রেঙ্গুনে YMCA-র এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মীর কথা থেকে জানা যায়, ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি নিয়মিত ফেরির মাধ্যমে রেঙ্গুন থেকে কলকাতায় যাতায়াত করেছেন। তাঁর বিবরণ থেকেই জানা যায়, জাহাজের ডেকে বিপুল সংখ্যক মরসুমি শ্রমিক যাতায়াত করতেন। অন্য দিকে, প্রথম শ্রেণি বরাদ্দ ছিল ব্রিটিশ আধিকারিক এবং ব্যবসায়ীদের জন্য।
১৯৫৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল অশোক কুমার এবং মধুবালা অভিনীত হিন্দি ছবি ‘হাওড়া ব্রিজ’। সেই ছবিতে রেঙ্গুন থেকে কলকাতায় আসার জন্য ফেরি পরিষেবা নিতে দেখা গিয়েছিল ছবির নায়ক-নায়িকাকে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, স্টিমার থেকে ডায়মন্ড হারবারে নামছেন অশোক কুমার, সেখানেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির সই দেখা গিয়েছিল, যা থেকে স্পষ্ট, পাঁচের দশকের শেষদিক পর্যন্ত চালু ছিল দুই শহরের মধ্যে ফেরি পরিষেবা।
১৯৬২ সালে বর্মার নেতা জেনারেল নে-উইন বর্মা থেকে সমস্ত ভারতীয়দের বিতাড়িত করেন। মনে করা হয়, সেই সময় থেকেই ফেরি পরিষেবা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬০ সালে চায়ের দোকান,পানের দোকান এবং সেলুনে কর্মরত ভারতীয় ছাড়া প্রায় ৩০০,০০০ ভারতীয়কে বর্মা থেকে বিতাড়িত করা হয়। ভারত সরকারের তরফ থেকে বর্মা থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ ফেরি এবং প্লেনের বন্দোবস্ত করা হয়।
২০১৪ সালে চেন্নাই(মাদ্রাজ) থেকে ইয়াংগন(রেঙ্গুন) পর্যন্ত একটিমাত্র মালবাহী ফেরি পরিষেবা চালু করে শিপিং করপোরেশন অফ ইন্ডিয়া। যদিও, ভারত ও মায়ানমারের মধ্যে যাত্রীবাহী ফেরি পরিষেবা চালু করার বিষয়ে কোনও কথা হয়নি আর। বরং, মণিপুর থেকে মায়ানমার বাস পরিষেবা চালু করার ব্যাপারে উৎসাহী হয় দুই দেশের সরকার। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে মান্দালয়-ইম্ফল বাস পরিষেবা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেছে এই উদ্যোগ।
তবে, মায়ানমার এবং ভারতের মধ্যে যাত্রীবাহী ফেরি পরিষেবা আবার চালু হলে তা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, পর্যটন এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের পথ আরও সুগম করবে বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের।
তো এহেন রেঙ্গুন থেকে সমৃদ্ধশালী “বাঙ্গালীর বর্মা নিষ্ক্রমণ ” কেমন ছিল ? তা নিয়ে স্মৃতির পাতা থেকে লিখেছেন সুব্রত শঙ্কর ভদ্র –
আজ থেকে আশি বছর আগে, — ২৯ এপ্রিল— দেড় মাসের দুঃসহ যাত্রার শেষে আমার বাবা পা রেখেছিলেন ইম্ফলে। সঙ্গে মা, তিন বোন, আর দিদিমা। আজকের মায়ানমার, তখনকার বর্মার জঙ্গল-ভরা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে তাঁদের দুঃস্বপ্নের পথ চলা শেষ হয়েছিল উদ্বাস্তু শিবিরে। আমার মা তখন পূর্ণ গর্ভবতী, কী করে খাড়া পাহাড়, সরু গিরিপথে হেঁটেছিলেন, বৃদ্ধা মাকে পার করিয়েছিলেন সে সব পথ, সর্বোপরি, পথশ্রমে, বিনা চিকিৎসায় মৃত এক কন্যাসন্তানের শোক কী করে বহন করেছিলেন, আজ কল্পনা করাও দুষ্কর। জাপানের বর্মা আক্রমণের জেরে ১৯৪২ সালে কয়েক লক্ষ বাঙালির বর্মা নিষ্ক্রমণ কী করে ভুলবে বাঙালি, কেনই বা ভুলবে?
সুবোধ কুমার ভদ্র, আমার বাবা, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে বর্মা গিয়েছিলেন এক সহপাঠীর আহ্বানে। তাঁরা দু’জনে মান্দালয়ে একটা ডিস্পেনসারি খুলেছিলেন, পরে বাবাই সেটা চালাতেন। প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন লিউ শহরে। ইরাবতী নদীর ধারে তাঁদের কাঠের বাড়ি, চারিদিকে দামি টিক গাছের বন। এই বাড়িতেই তাঁর চার কন্যাসন্তান জন্মায়। শান্ত সংসার জীবনে আগুনের আঁচ লাগল ১৯৪০ সালে, যখন জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিল। ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৪১ রেঙ্গুনে প্রথম বোমা ফেলল জাপানি বিমান। সেই সঙ্গে, এক শ্রেণির স্থানীয় মানুষ বহু দিনের বিদ্বেষ চরিতার্থ করতে হিংস্র হয়ে উঠল শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত ভারতীয়দের উপর। পরবর্তী আট মাসে জাহাজে বা পায়ে হেঁটে ছ’লক্ষ ভারতীয় বর্মা ছাড়লেন।
বাবা জনপ্রিয় ডাক্তার ছিলেন বলে গোড়ায় নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি। কিন্তু ক্রমশ কেরোসিন, খাবার, সবেতেই টান পড়ল। দেশে ফেরার জাহাজে স্থান অকুলান। এয়ার সাইরেন বাজলেই সকলে লুকোতেন আরও নিরাপদ একটা বাড়িতে, সেখানেও চপার হাতে লোকেদের ঘোরাফেরা দেখা গেল। আট বছরের বর্মাবাস গুটিয়ে ফেরার তোড়জোড় শুরু হল।
১৪ মার্চ, ১৯৪২ সারা রাত জেগে ছিলেন বাবা। পর দিন ভোরে উঠে স্নান করে, গরু-বাছুরদের বেশি করে খাইয়ে সেগুলির দড়ি খুলে ছেড়ে দিলেন। সকলে সজল চোখে প্রার্থনা করলেন, যেন ওরা ভাল থাকে। যাত্রা শুরু করেও সকলে ফিরে ফিরে দেখছিলেন নিজেদের কাঠের বাড়িটার দিকে। পথের যা কিছু সুবিধে, খাবার থেকে গাড়ি, সবই দখল করেছে পলায়নরত ব্রিটিশ বাহিনী এবং ইউরোপীয়রা। তাদের তল্পিতল্পা, এমনকি পিয়ানো পর্যন্ত বইতে গাড়ি বরাদ্দ করল ব্রিটিশ সরকার, ভারতীয়দের দিল না। পিছনে জাপানি সেনা, সামনে লুটপাটরত দুর্বৃত্তের দল। জঙ্গলে বুনো শুয়োর, সাপ, হাতি। পোকাক্কু জেলার ১৯৫ কিলোমিটার জংলি পথের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘মরণের পথ’। সঙ্গের খাবার ফুরিয়েছে, ট্রানজ়িট ক্যাম্প থেকে পাওয়া চাল-ডালে একবেলাও চলে না। পথশ্রমে আধমরা মানুষগুলি এক নাগাড়ে এক মাসেরও বেশি হেঁটে ১৭ এপ্রিল পৌঁছলেন ভারত সীমান্তে টামু গ্রামে। সেখান থেকে নাগা পাহাড় পেরিয়ে ঢুকতে হবে ইম্ফলে। সে-ও এক ভয়ানক কঠিন যাত্রা, খাড়াই পথ, বহু জায়গায় রাস্তা অত্যন্ত সরু, জঙ্গলে ভরা।
আট জনের দলটি থেকে প্রথমে হারিয়ে গেলেন কম্পাউন্ডার প্রসন্নবাবু— এক দিন বিশ্রামের জন্য থামলেন, পরে আর তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল না। তার পর প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেল সব চাইতে ছোট কন্যাসন্তানটি। রাস্তার দু’ধারে বহু পরিত্যক্ত শিশুকে দেখেছিলেন বাবা-মা, দেখেছেন বহু দেহ। কোনওটায় পচন ধরেছে, কোনওটা খেয়ে গিয়েছে জঙ্গলের জন্তুরা। একটি হিসাবে আশি হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন বর্মা থেকে নিষ্ক্রমণের পথে।
শেষ অবধি যে দিন মণিপুরের সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে মোরে-তে পা রাখল উদ্বাস্তুদের দল, অনেকে দেশের মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, চোখে আনন্দের অশ্রু। সেখান থেকে ইম্ফলের রিফিউজি ক্যাম্প, এখানে আমার মা জন্ম দিলেন এক কন্যাসন্তানের। আর এক কন্যাকে হারানোর শোক বুকে নিয়েই নবজাতককে বুকে তুলে নিলেন তিনি। আটশো কিলোমিটারেরও বেশি যাত্রা করেছেন তাঁরা দেশে পৌঁছতে।
তার পরেও বাকি ছিল ইম্ফল থেকে ডিমাপুর আসার কঠিন যাত্রা। শেষ অবধি অসমে দেখা হয় আমার কাকা সতীশচন্দ্রের সঙ্গে। কাকা অনেক দিন ধরে রিফিউজি ক্যাম্পে বাবাদের খুঁজছিলেন। তাঁকে দেখে মা, দিদিমা কান্নায় ভেঙে পড়েন। অসম থেকে ফরিদপুরের মানিকদহে পৈতৃক বাড়িতে পৌঁছে সে যাত্রা শেষ হয়। যদিও সেই ‘লং মার্চ’ বাবার সারা জীবনের উপর ছাপ রেখে গিয়েছিল। সম্পন্ন, জনপ্রিয় চিকিৎসক হিসেবে যিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন, তিনি কপর্দকহীন, কর্মহীন, সন্তানশোকে সন্তপ্ত এক মানুষ হয়ে যাত্রা শেষ করলেন। অর্থাভাব তাঁকে বেশ কিছু বছর তাড়িয়ে ফিরেছে। এমন নানা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আখ্যানেই বেঁচে রয়েছে আশি বছর আগে বাঙ্গালীদের বর্মা থেকে মহানিষ্ক্রমণের কাহিনি। তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও লেখা হয়নি।
সুব্রত শঙ্কর ভদ্র