পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক তোষন শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গের সরকার এবং এই তোষনের বিরুদ্ধে লড়াইটাও কিন্তু রাজনৈতিকভাবেই হওয়া উচিত

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের সাথে একটি জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম, সেটি হল বাঙালি হিন্দু কে বাঁচানোর উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু মানুষের তৎপর হওয়া। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রদত্ত হিন্দু ভোটের প্রায় ৭৩.২১% হিন্দু কিন্তু বিজেপিকেই ভোট দিয়েছেন অর্থাৎ প্রাদেশিক মানসিকতার বেড়া ভেঙে, আলাদা করে বাঙালি হিন্দু বলে কোনো পরিচয় না রেখে বাঙালি হিন্দু কিন্তু শুধুমাত্র হিন্দু হিসেবেই নিজেদের পরিচয় বজায় রাখতে চাইছেন।

এখন, প্রশ্ন হচ্ছে বাঙালি হিন্দু কারা? ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে যত হিন্দু বসবাস করছেন, পদবি নির্বিশেষে, তারা প্রত্যেকেই বাঙালি হিন্দু।তাহলে বাংলাদেশে বর্তমানে অবশিষ্ট যে হিন্দু সম্প্রদায় ইসলামিক আগ্রাসনের হাত থেকে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে, তারা কি বাঙালি হিন্দু নয়? আমার কাছে উত্তরটা খুব সহজ, আমি প্রথম ভারতীয় এবং তারপরে একজন বাঙালি, ঠিক তেমনই আমার মনে হয় বাংলাদেশের বর্তমান হিন্দুরাও প্রথমে বাংলাদেশি তারপরে বাঙালি। তাই শুধুমাত্র ঐতিহাসিক এবং ভাষাগত সাদৃশ্যতা থাকার কারণে দুইটি পৃথক দেশের মানুষের বর্তমান পরিচয় মিশিয়ে ফেলা ঠিক হবে না।

একথা অনস্বীকার্য যে দেশভাগের সময় অবিভক্ত বাংলা এবং পাঞ্জাবের মানুষকে যে ভয়ানক দাঙ্গার সম্মুখিন হতে হয়েছিল তা ভারতবর্ষের অন্য কোন প্রান্তের মানুষকে প্রত্যক্ষ করতে হয়নি এবং দেশভাগের পরেও তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে হিন্দু গণহত্যা হওয়ার কারণেই শরণার্থী হিসেবে বহু হিন্দুকে পশ্চিমবঙ্গ চলে আসতে হয়েছিল। দেশভাগের সময় দুই দেশের দায়িত্ব ছিল তাদের নিজেদের সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষকে রক্ষা করা। এই কথা ভেবে আমাদের গর্ব বোধ করা উচিত যে বাস্তবে ভারতবর্ষ শুধুমাত্র সেই দায়িত্ব পালন করে এসেছে।স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা করার সময় সেকুলারিজম শব্দ কিন্তু সংবিধানে ছিল না, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীজির আমলে সেই শব্দ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।সংবিধানের সেই শব্দ অন্তর্ভুক্তির আগেও ভারতবর্ষ সেক্যুলার ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে – কারণ ভারতবর্ষের সেক্যুলারিজমের মূল ভিত্তি হলো হিন্দুত্ব। সেই কারণেই স্বামীজি বলেছিলেন – “জাতিবিশেষ এর জীবন কোন নির্দিষ্ট ভাবের মধ্যে থাকে, সেখানেই সেই জাতির জাতীয়ত্ব। যতদিন না তাহাতে আঘাত লাগে ততদিন সেই জাতির মৃত্যু নাই। বর্বর জাতির আক্রমণ তরঙ্গ বারবার আমাদের এই জাতির মস্তকের উপর দিয়া চলিয়া গিয়াছে, শত শত বৎসর ধরিয়া আল্লাহ্ আকবার রবে ভারত গগন মুখরিত হইয়াছে এবং এমন হিন্দু কেউ ছিলনা যে প্রতি মুহূর্তে নিজের বিনাশ আশঙ্কা না করিয়াছে। জগতের ইতিহাস প্রসিদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে ভারতবর্ষ সর্বাপেক্ষা বেশি অত্যাচার ও নিগ্রহ সহ্য করিয়াছে। তথাপি আমরা পূর্বে যেরূপ ছিলাম, এখনো সেইরুপ আছি, এখনো আমরা নূতন বিপদের সম্মুখীন হতে প্রস্তুত; শুধু তাই নয়, আমরা শুধু যে নিজেরাই অক্ষত তাহা নহে, সম্প্রতি আমরা বাহিরে যাইয়াও অপরকে আমাদের ভাব দিতে প্রস্তুত- তাহার চিহ্ন দেখিতে পাইতেছি।”

আমার ধর্মের উপর আঘাত এলে আমাকে প্রতিরোধ করতে হবে কিন্তু আমার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য অপর ধর্মের মানুষের প্রতি আক্রমন করা অন্তত হিন্দুধর্মের কোথাও বলা নেই। দুদিন আগে মোহন ভাগবত জি শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মের এই সহজ-সাধারণ ভিত্তি টুকুই মনে করিয়ে দিয়েছেন। এবার একটু ভাবুন যারা বাঙালি হিন্দুর অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল, কেন তারা বর্তমানে মোহন জি কেও গালাগাল দিতে পিছু হটছে না ?

ধর্মীয় প্রতিহিংসা দেশকে শুধুমাত্র গৃহযুদ্ধের পথ দেখাতে পারে, তার বেশি কিছু না। শরণার্থী হিসেবে কিভাবে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসতে হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতার কথা ক্যানাডা তে থাকা আমার এক বন্ধুর থেকে শুনেছিলাম। শরণার্থীদের যন্ত্রণার প্রতি আমরা প্রত্যেকেই সমব্যথী, এবং ইতিহাস চর্চা সেই কারণেই করা প্রয়োজন যাতে ভবিষ্যতে সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। কিন্তু শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানোর জন্য অন্য ধর্মের প্রতি আক্রমণ করা বা সেই মানসিকতা পোষণ করা কখনোই সমর্থন করা যায় না। তাই মোহন জীর কথা মেনে নিতে যাদের কষ্ট হচ্ছে তাদের মানসিক চিকিৎসালয়ে যাওয়া উচিত।

পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক তোষন শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গের সরকার এবং এই তোষনের বিরুদ্ধে লড়াইটাও কিন্তু রাজনৈতিকভাবেই হওয়া উচিত। এই রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গে অন্তত বিজেপির বিকল্প কিছু নেই। তাহলে হিন্দু ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে বাঙালি হিন্দুর অস্তিত্ব রক্ষাকারীরা আসলে কাদের সুবিধা করে দিতে চাইছে ?

রুদ্র প্রসন্ন ব্যানার্জি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.