আর্থিক উন্নয়ন ও যত্নশীল সমাজ তৈরি করাই ২০২০-২১ অর্থবর্ষের বাজেটের প্রধান লক্ষ্য| দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বপ্নপূরণ করাই লক্ষ্যেই বাজেট| শনিবার কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করার সময় এমনই মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ| বাজেটে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কেন্দ্রীয় সরকার| ২০২৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা সম্পূর্ণ নির্মূল করতে চাই, এই ঘোষণাও করেছেন অর্থমন্ত্রী| শনিবার নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে দ্বিতীয়বার কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ| অর্থমন্ত্রী এদিন বলেছেন, আমাদের দেশবাসীর জন্য লাভজনকভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা উচিত, আমাদের ব্যবসা আশাব্যাঞ্জক হতে হবে, সমস্ত সংখ্যালঘু, মহিলা এবং এসসি, এসটি প্রত্যেকের আশা-আকাঙ্খা পূরণ করার লক্ষ্যেই এই বাজেট| প্রয়াত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মলা সীতারমণ বলেছেন, গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (জিএসটি)-এর প্রধান প্রতিষ্ঠাতা, দূরদর্শি নেতা অরুণ জেটলির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি| কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে জিএসটি সবচেয়ে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ| জিএসটি ধীরে ধীরে এমন একটি করের পরিপক্ক হয়ে উঠেছে যা দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সংহত করছে| জিএসটি-র সৌজন্যে ইন্সপেক্টর রাজ বিনাশ হয়েছে, ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি শিল্প (এমএসএমই) উপকৃত হয়েছে| জিএসটি-র দ্বারা গ্রাহকরা বার্ষিক ১ লক্ষ কোটি টাকার সুবিধা পেয়েছেন| ৪০ কোটি করদাতাদের মধ্যে ৬০ লক্ষই নতুন করদাতা| কর দেওয়ার পদ্ধতি এখন সরল হয়েছে বলে দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী|কৃষক-স্বার্থে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ বলেছেন, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কেন্দ্রীয় সরকার| এই লক্ষ্যেই সরকার এগোচ্ছে| বাজেটের প্রধান তিনটি বিষয় হল-অনুপ্রেরণামূলক ভারত, সকলের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং একটি যত্নশীল সমাজ তৈরি করা| অর্থমন্ত্রীর কথায়, বাজেট ২০২০-২১-এর লক্ষ হল দেশবাসীর আয় বৃদ্ধি করা এবং তাঁদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো| ২০ লক্ষ কৃষককে স্ট্যান্ডলোন সোলার পাম্প স্থাপনে সহায়তা প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী কিষাণ উর্জা সুরক্ষা আভেম উত্থান মহাভিয়ান সম্প্রসারিত করা হবে|অর্থমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, ‘সাগরমিত্র’ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে মত্স্যচাষে গ্রামের যুবকদের যুক্ত করা হবে| কৃষিপণ্য মজুতে আরও হিমঘর তৈরি করা হবে| উত্তর-পূর্বে চালু হবে কিষাণ-রেল| অনলাইনে কৃষিপণ্য বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে| অর্থমন্ত্রী এদিন জানিয়েছেন, আর্থিক বৃদ্ধিতে সর্বাধিক জোর দিয়েছে সরকার| মহিলারা যাতে নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে পারেন, সেটাই সরকারের মূল লক্ষ্য| গরিবের হাতে যাতে সরাসরি টাকা পৌঁছয়, সেই উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্র| ২৭ কোটি মানুষকে দরিদ্রসীমার উপরে আনা গিয়েছে বলে দাবি নির্মলার| আর্থিক মন্দা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দা চলছে| আমরা বাইরের ঝড় সামলে উঠেছি| এ দেশে ২৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলবারের বিনিয়োগ হয়েছে| ১২টি রোগ নির্মূল করতে ‘মিশন ইন্দ্রধনুষ’ সংসদে ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী| নির্মলা আরও জানিয়েছেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য শীঘ্রই নতুন শিক্ষানীতি তৈরি করা হবে| জাতীয় ফরেন্সিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব রেখেছেন অর্থমন্ত্রী| চাকরিভিত্তিক শিক্ষায় জোর দেওয়া হবে| স্যাট-এ বসতে পারবেন এশিয়া-অফ্রিকার পড়ুয়ারা| স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে শিক্ষা-ঋণ বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে বাজেটে|অর্থমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা সম্পূর্ণ নির্মূল করতে চাই| প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনায় জোর দেওয়া হবে| আয়ুষ্মান ভারতের অন্তর্গত হাসপাতাল পিপিপি মডেলে তৈরি করা হবে| স্বচ্ছ ভারত অভিযানে বরাদ্দ ১২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা| ৩ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ জলজীবন প্রকল্পে| ইনভেসমেন্ট ক্লিয়ারেন্স সেল চালু করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী| প্রতিটি জেলায় এক্সপার্ট হাব তৈরি করা হবে| পরিকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ করা হয়েছে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা| পর্যটনে বরাদ্দ করা হয়েছে ২৫০০ কোটি টাকা| অর্থমন্ত্রী এদিন জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৬ হাজার কিলোমিটার জাতীয় সড়ক তৈরি করা হবে| রেলের খালি জমিতে গড়ে তোলা হবে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র| পর্যটকদের পছন্দের জায়গায় তেজসের মতো আরও সুপারস্পিড ট্রেন চালু করা হবে|
প্রতিটি জেলায় রফতানি হাব তৈরির লক্ষ্য| রফতানির জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা হবে| শিল্প-বাণিজ্য উন্নয়নে ২৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা|অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আমরা ৩ বছরের মধ্যে প্রি-পেড স্মার্ট মিটার প্রতিটি বাড়িতে নিয়ে আসতে চাই| উপভোক্তা কার কাছে বিদ্যুৎ কিনবেন, তা বেছে নিতে পারবেন| এর জন্য ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হল| দেশি মোবাইল ফোন উত্পাদনে জোর দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী| ন্যাশনাল টেক্সটাইল মিশন প্রকল্প চালুর প্রস্তাব| ২০২৪-এর মধ্যে ১০০টি নতুন বিমানবন্দর তৈরি করা হবে| সেই সঙ্গে নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম| ১ লক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েতে অপটিক্যাল ফাইবার| ২০১৩-র মধ্যে দিল্লি-মুম্বই এক্সপ্রেস হাইওয়ে| আহমেদাবাদ-বেঙ্গালুরু নতুন রেল প্রকল্প| পরিবহণ কাঠামোয় বরাদ্দ করা হয়েছে ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা|
নির্মলার বাজেটে মহিলাদের উন্নয়নেও বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে| অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, মহিলাদের উন্নয়নে ২৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে| ১০ কোটি অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা| জনজাতিদের উন্নয়নে ৫৩ হাজার কোটি টাকা| প্রবীণ নাগরিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য ৯০০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ| অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, কলকাতায় জাতীয় সংগ্রহালয়ের সংস্কার করা হবে| সে জন্য বাড়তি বরাদ্দ করা হয়েছে| সেই সঙ্গে দেশের আরও চারটি সংগ্রহালয়ের সংস্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী|হরিয়ানা, তামিলনাড়ু, অসম, গুজরাট ও উত্তর প্রদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হবে| ঝাড়খণ্ডে আদিবাসী মিউজিয়াম গড়ে তোলা হবে| পরিবেশকে স্বচ্ছ রাখতে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে|
করদাতাদের হেনস্থা বন্ধ করতে আইন আনছে মোদী সরকার| সরকার চায় না, করদাতারা নাজেহাল হোক বা কোনও ভাবে তাঁদের বিব্রত করা হোক, করদাতাকে নাজেহাল করা ফৌজদারি অপরাধ| তা ঠেকাতে আইন তৈরি করবে সরকার| জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র| জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ, লাদাখে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা| অর্থমন্ত্রী আরও ঘোষণা করেছেন, ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি ১ লক্ষ থেকে বেড়ে দাঁড়াল ৫ লক্ষ টাকা| এবার থেকে ব্যাঙ্ক বন্ধ হলে ৫ লক্ষ টাকা বিমান সুবিধা দেওয়া হবে| বিমা হিসেবে সেই টাকা পাবেন গ্রাহকরা| ব্যাঙ্কগুলিতে চাঙ্গা করতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা|
বিলগ্নিকরণের পথে এলআইসি| শেয়ার বেচবে সরকার| দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থা এলআইসি-র অংশীদারিত্বের একাংশ বিক্রি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারতীয় জীবন বিমা (এলআইসি)-র অংশীদারিত্ব বিক্রি করবে সরকার| অর্থমন্ত্রীর কথায়, গত বছর আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩.৮ শতাংশ| সেই ঘাটতির পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যেই এলআইসি-কে আংশিকভাবে বেসরকারি হাতেই দিতে চলেছে সরকার|অর্থমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, আইডিবিআই ব্যাঙ্কেও নিজেদের শেয়ার বিক্রি করবে সরকার| আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ স্থির করা হয়েছে| আগামী অর্থবর্ষে ২২ লক্ষ ৪৬ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা|
আয়কর আরও সহজ করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী| ১৫ লক্ষ পর্যন্ত আয়কর কমিয়ে, ছাড় তুলে নিলেন নির্মলা| নির্মলার বাজেটে ঘোষণা, নতুন কর ব্যবস্থায় বছরে ২.৫ লক্ষ টাকা থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ| বছরে ৫ লক্ষ টাকা থেকে ৭.৫ লক্ষ টাকা আয়ের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর দিতে হবে| বছরে ৭.৫ লক্ষ টাকা থেকে ১০ লক্ষ টাকা আয়ের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর| বছরে ১০ লক্ষ টাকা থেকে ১২.৫ টাকা আয়ের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ কর| বছরে ১২.৫ লক্ষ টাকা থেকে ১৫ টাকা আয়ের ক্ষেত্রে কর কমে ২৫ শতাংশ| বছরে ১৫ লক্ষ টাকা বেশি আয়ের ক্ষেত্রে কর আগের মতোই ৩০ শতাংশ|
নতুন কর কাঠামোয় নতুন নিয়মের প্রস্তাব বাজেটে| নয়া কাঠামোয় আগের সুবিধা পাবেন না করদাতা| নতুন হারে আয়কর দিলে মিলবে না করছাড়| পুরনো হারে আয়করে ছাড়ের সুবিধা| তবে, নতুন হারে কর দিলে মিলবে না আয়কর ছাড়ের সুবিধা| তবে, করদাতা বেছে নিতে পারবেন তিনি নতুন হারে আয়কর দেবেন না পুরনো হারেই কর দেবেন| অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আমরা নতুন একটি প্রক্রিয়া চালু করব, যাতে করদাতা আবেদনের সঙ্গে সঙ্গে আধার কার্ড ও প্যাক কার্ড পেতে পারেন| অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, জিএসটি-তে আরও সংস্কার করা হবে| এর আওতায় আয়কর জমা দেওয়া আরও সহজ হবে| নতুন ব্যবস্থা চলতি মাস থেকেই চালু করা হবে| চিকিত্সা সরঞ্জাম আমদানিতে স্বাস্থ্য সেস আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী|
2020-02-01