শিয়ালপোকা

আবার শিয়ালপোকা উনার মাথায় নড়াচড়া করতে শুরু করেছে। বুঝতে পারছি না, উনি বাংলা ও বাঙ্গালির সব ঐতিহ্য এভাবে নষ্ট করে দিতে চাইছেন কেন ? পশ্চিমবঙ্গ নামের সাথে বাঙ্গালির যে আত্মত্যাগ,যে আবেগ, যে সংগ্রাম তাঁর ঐতিহ্য ভুলিয়ে দেবার জন্য উনি এত তৎপর কেন ? বাংলার কর্মহীনতা, বেকারত্ব নিয়ে উনার চিন্তা কোথায় ? যাইহোক, পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন নিয়ে আমার ভাবনা; সাপ্তাহিক স্বস্তিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ৫ নভেম্বর ২০১৮। বিষয়টা দেখছি এখনও ভীষণ প্রাসঙ্গিক, তাই সম্পূর্ণ লেখাটি আবার পোস্ট করলাম।

নাম বদল নিয়ে রাজ্য সরকারের ঘ্যানঘ্যানানি ।

সম্প্রতি সংবাদসূত্রে প্রকাশ, পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের
স্বরাস্ট্রমন্ত্রক থেকে কেন্দ্রীয় বিদেশ মন্ত্রকে কিছু সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে
যে বিষয়গুলি বাংলাদেশ ও ভারতের পারস্পরিক সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট | এরই সাথে
পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কিত | তাই সমগ্র বিষয়টি পুনরাবলোকন
করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না | এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ,পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলের
উদ্দেশ্যে রাজ্য বিধানসভায় আবার একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে । বিজেপি বাদে সমস্ত
দল প্রস্তাবটি সমর্থন করেছে । প্রস্তাবে রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গের বদলে ‘ বাংলা “
রাখার কথা বলা হয়েছে । এই নিয়ে চারবার –একবার বাম সরকারের সময় এবং
তিনবার তৃণমূল সরকারের সময়ে –এই প্রস্তাব করা হয়েছে এবং এটি কেন্দ্রীয়
অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে । যথাক্রমে ১৯৯৯,২০১১, ২০১৬ এবং ২০১৮
তে এই প্রস্তাব বিধানসভায় পাশ এবং কেন্দ্রের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে । এই
নিয়ে চতুর্থবার । প্রাসঙ্গিক বিষয়টির “ যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো “ নিয়ে একটু
‘ঘ্যানঘ্যান’ করা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না ।গত ২ আগস্ট, ২০১৬ এবং আবার
২৬ জুলাই ২০১৮ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্য মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করেছে, ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটি পরিবর্তন করে রাজ্যের নাম করা হবে “বাংলা” , এবং
বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন নাম নয়, একটিই নাম সব ভাষায় ।আর, তাতেই বাঙালি
আবার বিভক্ত ।এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে , গত ২০১১ সালে
এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই প্রথম তৃণমূল সরকার বিধানসভায় একটি সর্বদলীয় ,
সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে সেটি কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছিল অনুমোদনের জন্য । তাতে
রাজ্যের নাম সব ভাষাতেই “পশ্চিমবঙ্গ” করার প্রস্তাব করা হয়েছিল ।তখন কেন্দ্রে
কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউ পি এ -২ র সরকার ছিল । সেটি কেন গৃহীত হয়নি ?
রাজ্য কি কেন্দ্রের কাছে কোন তদ্বির করেছিল ? না করে থাকলে কেন করেনি ?

এর উত্তরগুলি কিন্তু ভীষণ জরুরী ।একই তৃণমূল সরকারের একই মুখ্যমন্ত্রী পাঁচ বছর
পরে , ২০১৬ সালে অন্যরকম আবার ২০১৮ সালে এসে আরও অন্যরকম সিদ্ধান্ত
কেন গ্রহণ করলেন ? রহস্যটা কি ?
যাইহোক , যুক্তি-তক্কো-আর গপ্পোর গপ্পোটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা যাক ।
২০১৬ সালের প্রস্তাবে রাজ্যের নাম “বঙ্গ” বা “বাংলা” করার প্রস্তাব করা হয়েছিল
।এ প্রসঙ্গে বলা যায় , ‘বঙ্গ’ নামটি প্রাচীন হলেও ভূগোলের দৃষ্টিতে সমগ্র বাংলা
কখনোই “বঙ্গ” নামে পরিচিত ছিল না । বঙ্গ নামটি প্রথম পাওয়া যায় ঐতরেয়
আরণ্যকে —“ইমাঃ প্রজাস্তিস্রা অত্যায়ামায়ো স্তানিমানি বয়াংসি ।বঙ্গাবগধাশচেব
পাদান্যন্যা অর্কমভিতঃ বিবিস্র ইতি ।। রামায়ণে অযোধ্যাকাণ্ডের ১০ অধ্যায়
,মহাভারতের সভাপর্বের ২৫ এবং ৩০ অধ্যায়েও ‘বঙ্গের’ উল্লেখ আছে ।মনু-সংহিতায়
তৎকালীন ভারতের পূর্বসীমার উল্লেখ করে বলা হয়েছে “ অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গেষূ সৌরাষ্ট্র
মগধেষূ চ । তীর্থযাত্রাং বিনা গচ্ছন পুনঃ সমস্কারং অর্হতি ।। এ ছাড়াও বর্তমান
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ নিয়ে যে অখণ্ড বাংলা ছিল , সেই বাংলার বিভিন্ন অংশ ,
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল ।বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অংশ তখন
“পুণ্ড্রবর্ধন” ,গঙ্গারিডই, উড়ুম্বর বা টাণ্ডা, গৌড়, রাঁড় ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল ।
আর, বাংলার পূর্ব অংশ বিভিন্ন সময়ে ‘সমতট’, ‘হরিকেল’, চন্দ্রদ্বীপ’ বঙ্গ ইত্যাদি
বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল ।যদিও,তখন ‘বঙ্গ’ বলতে ঢাকা ও তার আশপাশের
অঞ্চলগুলিকেই বোঝাত ।পরবর্তীকালে সমতট,বঙ্গ ইত্যাদি অংশ ’বাঙ্গালা’(Bengala) নামে
অভিহিত হয় । ২০১৬ সালে ‘হার্ভার্ডের’ ইতিহাসের অধ্যাপক ডঃ সুগত বসু এক
সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন জে,’বাঙ্গালা’ বা বাংলা নামটি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইলিয়াস
শাহের সময় থেকে প্রচলিত হয়েছে।কিন্তু অন্যান্য আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে
সহমত নন।বাংলাদেশের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আব্দুল করিম লিখেছহেন,”এখানে উল্লেখ
করা প্রয়োজন যে ,প্রাক-মুসলমান আমলেও বঙ্গ বা বাঙ্গালা নামের প্রচলন ছিল ।“
( বাংলার ইতিহাস– সুলতানি আমল)। মুসলমানদের আগমনের অনেক আগেই
‘বাংলা’ নামের উৎপত্তি হয়েছে।রাজেন্দ্র চোলের ‘তিরুমলয়’ শিলালিপিতে প্রথম ‘বাংলা’
নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।এই শিলালিপিটি মুসলিম বিজয়ের আগেকার ।কালক্রমে,এই
‘বাঙ্গালা’ শব্দটিই পর্তুগীজ বনিকরা গ্রহণ করে এবং ক্রমান্বয়ে অন্যান্য ইউরোপীয়

বনিকগণ গ্রহণ করে । নামটি ইংরেজিতে দাঁড়ায় ‘Bengal’। কিন্তু , এই ভৌগোলিক
(Geographical ) অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালিরা এ অঞ্চলকে ‘বাংলা’ অথবা ‘বাংলাদেশ’
নামেই উল্লেখ করে থাকে ।বাঙালি কবি,সাহিত্যিক,নাট্যকার,ঐতিহাসিক তাঁদের লেখায়
এ অঞ্চলকে ‘বঙ্গ’, ‘বাংলা’ অথবা ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করেছেন
।রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র,বঙ্কিমচন্দ্র,ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার,রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়,অমলেন্দু
দে এবং অন্যান্য কবি, সাহিত্যিক,ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবীগণ তাঁদের লেখায় ‘বঙ্গ’,
‘বাংলা’, ‘বাংলাদেশ’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন। ইংরাজ সরকারও তাঁদের বিভিন্ন
বাংলা বিজ্ঞপ্তিতে ‘বাংলাদেশ’ই ব্যবহার করেছে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান,” আজি
বাংলাদেশের হৃদয় হতে ‘ এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। আবার, ‘পূর্ববঙ্গ’ বা
‘পূর্ববাংলা’ এবং ‘পশ্চিমবঙ্গ’ বা ‘পশ্চিমবাংলা’ শব্দদুটিও ১৯৪৭ সালে বিভক্ত হয়ে
দেশ স্বাধীন হবার অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল এবং আছে মৌখিক আর লিখিত
দুইভাবেই। শতাধিক বৎসরেরও আগে লেখা দুর্গাচন্দ্র সান্যালের ‘বাংলার সামাজিক
ইতিহাস’এ বাংলার দুটি অংশকে ‘পূর্ববাংলা’ এবং ‘পশ্চিমবাংলা’ বলে অভিহিত করা
হয়েছে।
হাসান শাহিদ সুরাওয়ারদি, শরৎচন্দ্র বসু,আবুল হাশেম,কিরণশঙ্কর রায় প্রভৃতি
নেতাগণ ‘সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ’ গঠন প্রচেষ্টাপর্বে তাঁদের
আলোচনায়,প্রস্তাবে,প্রচারিত বক্তব্যে বাংলার পশ্চিম অংশকে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ বলেই অভিহিত
করেছেন । স্বাধীন হবার সময় থেকে এ রাজ্যের নাম সরকারীভাবেই ‘পশ্চিমবঙ্গ’
হিসেবে স্বীকৃত হয়, আর ইংরাজিতে West Bengal . এইভাবে, এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক
‘বিবর্তনের’ মাধ্যমে রাজ্যটি ‘পশ্চিমবঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।
এবার ‘তক্কো’তে আসা যাক ।তক্কোটা হল, কেন্দ্রের বিভিন্ন সভাসমিতিতে নাকি
পশ্চিমবঙ্গের ইংরাজি নামের West Bengal এর আদ্যক্ষর W এর কল্যাণে মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য
প্রতিনিধি শেষে বলার সুযোগ পান, ফলে তার আর বেশি বলার সুযোগই থাকে না।
সুতরাং, রাজ্যের নাম পাল্টে ‘বঙ্গ’ বা ‘বাংলা’ করলেই রাজ্য প্রতিনিধি অর্থাৎ
মুখ্যমন্ত্রী বেশি বলার সুযোগ পাবেন।এ অনুযোগটি একেবারে নতুন। এর আগে ডঃ
বিধানচন্দ্র রায় বা জ্যোতি বসুর রাজ্যের কথা বলতে অসুবিধা হয়েছে বলে শুনিনি।
রাজ্যের যা কিছু উন্নয়ন তা তো বিধান রায়ের সময়ই হয়েছে; তাঁর কোন অসুবিধা

হয়েছিল বলে তো কখনো শুনিনি । তামিলনাডু বা উত্তরপ্রদেশের ও কোন অসুবিধা
হয়নি । ওরাও তো শেষেই বক্তব্য রাখার সুযোগ পায় ! অভিযোগ তো শুনিনি ।
শুধু বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষেত্রেই অসুবিধাটা হয়েছে কি? পাঁচ
বছর আগের পাঠানো প্রস্তাবটাই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কাছে তদ্বির করে পাশ
করে নিলেই তো হত ।নাম সব ভাষাতেই এক হয়।ইংরাজি এবং হিন্দিতেও পশ্চিমবঙ্গ
করিয়ে নিলেই তো হত । উত্তরপ্রদেশ,মধ্যপ্রদেশ বা মহারাষ্ট্রের নাম তো অন্যভাষায়
অনূদিত করে বলা বা লেখা হয়না। পশ্চিমবঙ্গই বা অন্যভাষায় অনূদিত করে বলা
হবে কেন? ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পশ্চিমবঙ্গেই থাকলে মুখ্যমন্ত্রীও অনেক আগেই বলার সুযোগ
পান আর বাঙ্গালির ভাবাবেগও আহত হয়না ।
কিন্তু না, রাজ্যের নাম পরিবর্তন করতে হবে।একই মুখ্যমন্ত্রী , একই দলের সরকার
পাঁচ বছর আগের সিদ্ধান্ত থেকে পশ্চাদবসরণ করেছে । ২০১৬ সালে শিক্ষামন্ত্রী ডঃ
পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন ,সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে
বাংলায় ‘বঙ্গ’ অথবা ‘বাংলা’,ইংরাজিতে ‘Bengal’ আর হিন্দিতে ‘বংগাল’ করা হবে
।এরকম একটা অবাস্তব প্রস্তাব তিনি দিতে পেরেছিলেন । ভাবলে অবাক হতে হয় !
সেই প্রস্তাব মাঠে মারা যেতেই উনারা আবার প্রস্তাব করেছেন, সব ভাষাতেই ‘বাংলা’
করা হবে। বাংলাই কেন ? গৌড়, রাঁড়, পুণ্ড্রবর্ধনই বা নয় কেন ? বাংলার পশ্চিম
অংশের নাম তো এগুলিই ছিল । তাম্রলিপ্তও দেওয়া যেতে পারে।আদিতে ‘বঙ্গ’ বা
‘বাংলা’ বলতে পূর্ববঙ্গের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলকেই বোঝাত । ইতিহাসের বিবর্তনের
অপলাপই যদি করতে হয় তাহলে ‘পুণ্ড্রবর্ধন’ই সঠিক নাম।যদিও,ভারতের কিছু রাজ্য
সঠিক , সচেতনভাবেই ইতিহাসের বিবর্তনকে স্বীকার করে ‘ বিহার’, ‘ওড়িশা’, বা
অসমে পরিণত হয়েছে ; মগধ,কলিঙ্গ অথবা কামরূপে থেমে থাকেনি ।
ইতিহাসের ‘বিবর্তনের’ গতিকে পিছন দিকে ‘এগিয়ে’ দেবার পক্ষে নানা
যুক্তিজাল বিস্তার করা হচ্ছে এই পশ্চিমবঙ্গে। যেমন,পূর্ববঙ্গই তো আর নেই, সে অংশ
তো পূর্ব পাকিস্থান থেকে এখন’বাংলাদেশ’। হ্যা, তা হয়েছে। সেটাও কিন্তু ইতিহাসের
এক বিরাট অপলাপ। অংশ নিয়ে নিল পূর্ণের নাম; পূর্ববাংলা হয়ে গেল সম্পূর্ণ
‘বাংলাদেশ’। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এবং ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’এর লেখক ডঃ রমেশচন্দ্র
মজুমদার এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন । আর, ‘পশ্চিম’ থাকলেই ‘পূর্ব’ থাকতে

হবে এরকম একটা অর্বাচীন যুক্তিও দেবার চেষ্টা হয়েছে।কিন্তু এ যুক্তি ধোপে টেকেনা
। উত্তরপ্রদেশ , মধ্যপ্রদেশ আছে; কিন্তু পূর্বপ্রদেশ,দক্ষিণপ্রদেশ অথবা পশ্চিমপ্রদেশ
নেই।দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আছে কিন্তু উত্তর-পশ্চিম এশিয়া নেই। সুতরাং ‘পশ্চিমবঙ্গ’
থাকলেই ‘পূর্ববঙ্গ’ থাকতে হবে এটা অর্বাচীনের যুক্তি । অনেকে আবার
ঔপনিবেশিকতার মোহজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি ।তাঁরা একই রাজ্যের
একটা ইংরাজি নামও চাইছেন ।তামিলনাড়ু,কর্ণাটক,মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের
নাগরিকদের এ প্রয়োজন না থাকলেও আমাদের রাজ্যের এই সব কর্তাভজা বাবুদের
আছে।আবার শ্রীমতী কৃষ্ণা বসু (প্রাক্তন এম পি এবং ইংরাজি সাহিত্যের প্রাক্তন
অধ্যাপিকা)বলেছেন, “ পশ্চিমবঙ্গ নামটার সাথে এক দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে;
সুতরাং এ নাম বিদায় নিক”। অনেকটা একই ধরণের কথা বলেছেন চিত্রপরিচালক
গৌতম ঘোষ। তিনি বলেছেন, ‘ পশ্চিমবঙ্গ’ নামটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশভাগের
স্মৃতি। এটা স্মরণে আনে উদ্বাসনের সেই দুঃখজনক স্মৃতি,ফিরিয়ে আনে ফেলে আসা
বাড়ি, সম্পত্তি,জন্মস্থান আর সেখানে বেড়ে উঠার স্মৃতি।“ তিনি আরও বলেছেন,
রাজ্যের নতুন নাম সেই স্মৃতি পেছনে ফেলে আসবে।তিনি বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সেই কথা ভুলে গেছেন , “ যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে, স্বপনে ।“ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এঁরাও প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন
; কিন্তু বাস্তবে সেই বৈতসী বৃত্তি অবলম্বন করেছেন । এরা ‘কেবল পালিয়ে বেড়ায়,
দৃষ্টি এড়ায়”। কিন্তু মজা হচ্ছে , এঁরাই ঘটা করে ‘হিরোশিমা’ দিবস,’বাবরি
ধ্বংস’দিবস ইত্যাদি পালন করে থাকেন ।এগুলি কিসের স্মৃতি বহন করে ? অবাক
লাগে, কোন ইতিহাস সচেতন মানুষ এসব উচ্চারণ করতে পারেন ? কলকাতা নামের
সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বীভৎস,নারকীয়, গত শতকের জঘন্যতম
দাঙ্গা, The Great Calcutta Killings,1946 এর সেই ভয়াবহ স্মৃতি। শ্রীমতী বসু আর গৌতম
ঘোষের যুক্তি মানলে কলকাতার নাম বদলে দিতে হয় । কথায় আছে, অতীত খুঁড়লে
এক চোখ হারাতে হয়; কিন্তু অতীত ভুললে দুচোখ হারায়।
পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির সাথে , এ নামের সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাস
বিবর্তনের,অনেক সংগ্রামের,ত্যাগের ,আন্দোলনের,ধর্ষণ ,গনহত্যা,আর পৃথিবীর
মানবসমাজের ইতিহাসে বৃহত্তম ‘উদ্বাসনের’ নিষ্ঠুর ইতিহাস।পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির সাথে
জড়িয়ে ছিলেন বিংশ শতাব্দীর বাঙালি মনীষার বিভিন্ন বিষয়ের দিকপাল, প্রতিভায়

ভাস্বর ব্যক্তিগণ ।হাসান শাহিদ সুরাওয়ারদি,আবুল কাশেম,শরৎচন্দ্র বসু প্রমুখ
কয়েকজন মুসলিম লীগেরই ‘প্রক্সি-প্লান’, ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে এক “স্বাধীন
সার্বভৌম বাংলাদেশ” গঠনের প্রস্তাব করে যা’ বাস্তবে হিন্দু বাঙ্গালিকে ধ্বংস করার
পরিকল্পনা, পুরো বাংলাকেই পাকিস্তানে ঢুকিয়ে দেবার পরিকল্পনা । প্রস্তাবটি কোন
অংশেরই সমর্থন পায়নি। ফলে প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হতে পারেনি । আর প্রস্তাবের
প্রবক্তারাও বাংলার রাজনীতিতে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হন। মুসলিম লীগের এই
ছলচাতুরী, গণহত্যা,দাঙ্গার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ভারতের মধ্যেই এক
আলাদা রাজ্য, ‘পশ্চিমবঙ্গের’ জন্য সংগঠিত হন ।‘পশ্চিমবঙ্গ’ গঠনের জন্য
ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক,ভাষাবিদ প্রভৃতি সেই সময়কার সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ
মানুষ এগিয়ে আসেন।সেই সময়কার সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া লর্ড
লিস্টওয়েলের কাছে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ গঠনের জন্য ৭ মে,১৯৪৭ তারবার্তা প্রেরণ করেন
বাংলার পাঁচজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ — ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার,ডঃ
রমেশচন্দ্র মজুমদার,বৈজ্ঞানিক ডঃ মেঘনাদ সাহা,ডঃ শিশির মিত্র এবং ভাষাবিদ ডঃ
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তারবার্তায় তাঁরা লেখেন,”Education, trade and industry
in Bengal have almost collapsed owing to recurrent riots, causing
insecurity of life and property.The present communal Ministry(of
H.S.Surawardy) is totally incapable of maintaining law and order. We
strongly support the immediate formation of a separate West Bengal
province guaranteeing under a non-communal Ministry safety of life and
unhindered progress in education,industry and commerce, with continuance
and development of Calcutta—a vital part of West Bengal, as a
moral,intellectual, social and economic centre.” একই তারবার্তা তাঁরা Sir
Stafford Cripps এবং Sir John Anderson কেউ পাঠান ।আর, সর্বোপরি, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ
মুখোপাধ্যায় রাজনৈতিকভাবে একক ও নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যান মুসলিম লীগ ও
তার দোসর ‘স্বাধীন,সার্বভৌম,স্বতন্ত্র বাংলাদেশ’ গঠনের প্রবক্তাদের হাত থেকে
হিন্দু বাঙালির বাসস্থান ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ছিনিয়ে আনতে । পূর্বোক্ত পাঁচজন বাঙালি বুদ্ধিজীবী
ছাড়াও এ ব্যাপারে তিনি সাহায্য ও সহযোগিতা পান ঐতিহাসিক ডঃ সুরেন্দ্রনাথ
সেন,কবি ডঃ অমিয় চক্রবর্তি( এক সময়ে কবি রবীন্দ্রনাথের সচিব ছিলেন),বেঙ্গল

প্রভিনশিয়াল ডিপ্রেসড ক্লাস লীগের সম্পাদক আর দাস, আইনবিদ ণীহারেণ্ডূ
দত্তমজুমদার,ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী,বিমলচন্দ্র সিংহ, হিন্দু মহাসভার নেতা ব্যারিস্টার
নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়(মার্ক্সবাদী নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পিতা),মেজর জেনারেল
এ সি চট্টোপাধ্যায়, কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ , ঋষি শ্রী অরবিন্দ,কলকাতার
তৎকালীন মেয়র এস সি রায়চৌধুরী প্রভৃতি তৎকালীন বাংলার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের।পূর্ব
ও উত্তরবঙ্গের হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলো পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত করার ব্যাপারে বিশেষভাবে চেষ্টা
করেন ঐতিহাসিকদ্বয় —–স্যার যদুনাথ সরকার এবং ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ।
তৎকালীন বাংলার কিছু বৃহৎ জমিদারগণও ‘পশ্চিমবঙ্গ’ সৃষ্টিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন –
—-যেমন, বর্ধমানের মহারাজা স্যার উদয়চাঁদ মহতাব,কাশিমবাজারের মহারাজা
শ্রীশচন্দ্র নন্দী,মহারাজা প্রবেন্দ্রমোহন ঠাকুর,মহারাজকুমার শীতাংশুকান্ত
আচার্যচৌধুরী(সিপিএম নেতা স্নেহাংশু আচার্যের পিতৃদেব)।
এই ভাবে মূলতঃ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নিরলস প্রচেষ্টা ও অন্যান্য
বিশিষ্টজনের সহায়তায় ‘পশ্চিমবঙ্গ’ রাজ্য গঠিত হয়।বিশিষ্ট সাংবাদিক শঙ্কর ঘোষ
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের তিন শ্রেষ্ঠ বাঙালি রাজনীতিকদের মধ্যে প্রথম স্থানে
রেখেছেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদকে । তিনি লিখেছেন, “ শ্যামাপ্রসাদ যখন শ্রীনগরে
বন্দিদশায় মারা যান তখন তাঁর বয়স ৫২ ।ওই বয়সে বিধানচন্দ্র রাজ্যস্তরের নেতা,
জ্যোতি বসু অনেক কম্যুনিস্ট নেতার একজন”( হস্তান্তর—১ম খণ্ড)।
এইভাবে, এত ত্যাগ, আন্দোলন, গণহত্যা,দেশান্তর,ধর্মান্তর,উদ্বাসন,আর তৎকালীন
রাজনৈতিক নেতাগণ,সামাজিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন ও নিরন্তর প্রচেষ্টার
ফলে যে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ গঠিত হয়েছে তার ইতিহাস ভুলিয়ে দেবার, এই বাংলার সৃষ্টিকর্তা
ডঃ শ্যামাপ্রসাদের অবদান ভুলিয়ে দেবার এক দুরভিসন্ধিমুলক চেষ্টা শুরু হয়েছে ।
বাঙালি বুদ্ধিজীবী যারা বিদেশ থেকে এসে মাঝে মাঝে ‘বাণী’ বিতরণ করেন এবং
যারা রাজ্যে থেকেও কেবলমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা চালিত হন –তাঁরা ‘বৈতসী’ বৃত্তি
অবলম্বন করেছেন। কিন্তু,এ রাজ্যের বিবেকবান,সমাজ সচেতন সাহিত্যিক তিলোত্তমা
মজুমদার, ঐতিহাসিকদ্বয় রজতকান্ত রায় (বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন
উপাচার্য) এবং সুরঞ্জন দাস ( যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য)রাজ্যের নাম
পরিবর্তনের বিপক্ষে ও ঐতিহ্য রক্ষার স্বপক্ষে তাঁদের মত ব্যক্ত করেছিলেন ২০১৬ তে

। রাজ্যবাসী বাঙালি নাগরিকগণও রাজ্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভুলিয়ে দেবার বিপক্ষে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সম্প্রতি বর্তমান বাংলাদেশের কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা বিধানসভায়
পাশ হওয়া এই প্রস্তাবের বিপক্ষে তাঁদের মতামত জানিয়ে এই নামকরণ থেকে বিরত
থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে।আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনও আছে এ
ব্যাপারে ।নাম পরিবর্তন নিয়ে রাজ্য সরকারের এই ‘ঘ্যানঘ্যানানি’ তাঁরা আর চাইছে
না ।তাঁরা চায়, রাজ্যের নাম ‘পশ্চিমবঙ্গই’ থাকুক এবং অনূদিত নয়, সব ভাষাতেই
রাজ্যের নাম হোক “ পশ্চিমবঙ্গ” । আমরাও চাই, পশ্চিমবঙ্গ থাকুক পশ্চিমবঙ্গেই ।

লেখক প্রাক্তন ব্যাংক আধিকারিক এবং ইতিহাস গবেষক ।

বিনয়ভূষণ দাশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.