১৯০৫ সালের ৪ আগস্ট উত্তর কলকাতায় মাতুলালয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম হয়। তার পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র ও মা ছিলেন সরলাবালা দেবী। পরবর্তীকালে ঠাকুমা যোগমায়া দেবীর কেনা ৭, রামধন মিত্র লেনে উঠে আসেন তার পরিবারবর্গ। কালীকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন বহুভাষাবিদ। তিনি ১৪টি ভাষা জানতেন। নিম্ন আদালতে দোভাষীর কাজ করতেন তিনি। পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যের জগতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক পরিচিত ব্যক্তিত্ব। কালীকৃষ্ণ পুলিশ কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী কালীচরণ ঘোষের দ্বিতীয় সন্তান সরলাবালা দেবীকে বিবাহ করেন। ১৯২৭ সালে তিনি “রায়বাহাদুর” খেতাব পান। কালীকৃষ্ণের দুই পুত্র জন্মায় – ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ১৯২৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯২৮ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ একাধিক ধ্রুপদি কাহিনিকে বেতার নাট্যের রূপ দেন। ১৯৩০-এর দশকে তিনি যোগ দেন অল ইন্ডিয়া রেডিওয়। এই সময় থেকেই দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেবী দুর্গার পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে দুই ঘণ্টার সঙ্গীতালেখ্য মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এই অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা করেছিলেন বাণীকুমার ভট্টাচার্য এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ করেন। আজও দুর্গাপূজা শুরু হয় এই অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মেস নং ৪৯ সহ একাধিক নাটক রচনা করেন। বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গোলাম উপন্যাসটিকে তিনি মঞ্চায়িত করেছিলেন।১৯৫২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সুবর্ণ গোলক গল্পটিকে তিনি নাট্যায়িত করেন।
১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে All India Radio Medium Wave প্রচার তরঙ্গে এই অনুষ্ঠানের সূচনা। শুরু হয়েছিল নিছক একটি experiment হিসেবেই, হয়ে গেল কিংবদন্তী। কোন বেতার তরঙ্গে নিয়ম করে এতদিন ধরে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে একটি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হওয়া, সারা বিশ্বে এমন নজির কোথাও নেই। আপামর বাঙ্গালিদের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরকালের জন্য অমর হয়ে রইল বাণীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরারোপিত এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র দ্বারা উচ্চারিত শ্রীশ্রীচণ্ডীর শ্লোকসমূহ।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৩৪ সালে দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় প্রচারিত হয় দেবী মাহাত্ম্য বিষয়ক এক সঙ্গীত আলেখ্য। এটি প্রচারিত হবার পর অবিভক্ত বাংলায় ব্যাপক সাড়া ফেলে। তারপরই জন্ম নেয় আজকের “মহিষাসুরমর্দিনী।” প্রথমদিকে রেকর্ডিঙের ব্যবস্থা না থাকায় মহালয়ার ভোরে সব শিল্পীদের নিয়ে আকাশবাণীর গারস্টিন প্লেসের পুরাতন স্টুডিও থেকে এটি সরাসরি সম্প্রচারিত হত। রাশভারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে তখনকার দিনের তাবড় তাবড় শিল্পী ও কলাকুশলীরা সকলেই ভয় ও সমীহ করে চলতেন। তাঁর নির্দেশে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, শিপ্রা বসু, মানবেন্দ্র ইত্যাদি সঙ্গিত মহলের বিশিষ্ট নক্ষত্ররা রাত ৩টের মধ্যেই স্টুডিওতে এসে হাজির হয়ে যেতেন। ঠিক ৪টে থেকে শুরু হত অনুষ্ঠানটি।
সত্তরের দশকে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের এই “মহিষাসুরমর্দিনী” বাতিল করে মহানায়ক উত্তমকুমারকে দিয়ে ভাষ্যপাঠ করিয়ে নবরূপে এই অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠান শেষে ভয়ংকর জনরোষ দেখা দেয়। কর্তৃপক্ষের কাছে অজস্র চিঠি আসতে থাকে। খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা মহানায়ককেও বিপুল তিরস্কার হজম করতে হয়েছিল এই দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। শোনা যায়, উত্তমকুমার নিজে গিয়ে এর জন্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কাছে ক্ষমা চেয়ে এসেছিলেন। আকাশবাণী দ্বিতীয়বার আর উত্তমকুমারের সেই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করার সাহস করেনি। পরের বছর হতে পুনরায় “মহিষাসুরমর্দিনী” ফিরে আসে, আজও যা নতুন, আজও যা হ্রদয়গ্রাহী। পূজা এলেই যেন হৃদয়তন্ত্রীতে আপনেই বেজে ওঠে সেই চিরপরিচিত সুর-
“রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিশো জহি………… “