বর্তমান ইতিহাস তথা কাহিনী লেখার ক্ষেত্রে একটি বিষয় বারংবার যেনতেন প্রকারেণ একটি তত্ত্ব প্রচার বা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা নজরে আসে। আর সেটি হল এদেশে নাকি বরাবরই হিন্দু কর্তৃত্ব রয়েছে এবং তা হিন্দু শাসকরা অরাজকতার মাধ্যমেই তা অন্য সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দিয়েছে! এই সব গল্পগাথা প্রচার করে মানুষগুলি বেশ ‘যশস্বী ভবঃ‘ আশীর্বাদ লাভ করে একটি বিশেষ ইন্টেলেকচুয়াল শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। ইতিহাস বইয়ের বড় বড় পাবলিশাররা এঁদের কাছে ধর্না দেয়, আর এঁদের লেখা এই ইতিহাসের বইগুলি পড়ে তা বেদবাক্য মনে করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কিছু আকাট আঁতেলের উৎপত্তি হয়! গবেষণা ক্ষেত্রেও গবেষকদের দশা আরো শোচনীয়। একেবারে শাঁখের করাত যাকে বলে! গাইড যতটুকু সীমানা নির্ধারণ করে দেবেন তার এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে কোনও প্রশ্ন তুলেছ কি মরেছ! এ যেন ঠিক সদ্যোজাতকে ঝিনুকে দুধ খাওয়ানোর মতো ব্যাপার! ফলতঃ নিদিষ্ট রীতি মেনেই গবেষকদের একটা গণ্ডিতেই ঘোরাঘুরি করতে হয়! বাড়তি জেনে বা জানিয়ে হবেটা কী! নামের আগে “Dr.” বসানো নিয়ে কাজ! আর তাই চেতনা, বুদ্ধিমত্তা সব কিছু গাইডের পদযুগলে সমর্পণ করতে দুমিনিটও না ভাবাই তাঁদের পক্ষে শ্রেয়।
সম্প্রতি ইতিহাসের একটি ফেসবুক গ্রুপে একদল গবেষক একটি তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া যে, আরবীয়দের আক্রমণের ফলে তথা মুসলিম আক্রমনের জেরে নাকি এদেশ নানা ভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। এই বিষয়ে একটি পোস্টে আশ্চর্যজনক ভাবে কয়েক লাখ গবেষক সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। তথ্য বলতে তাঁরা যা কিছু ব্যবহার করেছেন সবই আলবেরুনীর “তহকিক-ই-হিন্দ” এবং হুসেইন ফিরদৌসীর গ্রন্থ সাপেক্ষে। বারবার তারা গাজনীর সুলতান মাহমুদকে মহিমান্বিত (Glorify) করে একথা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন যে, মাহমুদ কখনই “দার-উল-হারাব“কে তথা অ-ইসলামিক দেশকে “দার-উল-ইসলাম” করতে চায়নি।
এই স্বনামধন্য গবেষকদের কয়েকটি ন্যারেটিভ দিতে চাই। প্রথমে আরবদের এদেশ আক্রমণ সম্পর্কে বলব। আরব আক্রমন সংক্রান্ত প্রমাণ্য গ্রন্থ হল মহম্মদ আল হামিদ আবু বকর কুফীর “চাচনামা“। এই গ্রন্থটি যদি সঠিক ভাবে অনুধাবন করা হয়, দেখা যাবে এতে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে আরব আক্রমণ ও শোষণের ইতিহাস। অন্যদিকে প্রতিহার-রাজ মিহির ভোজের গোয়ালিয়র লেখ থেকেও বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।
আরবদের ভারত অভিযানের পূর্ববাহু ৬৫০খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এশিয়ার অক্ষু নদ ও হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত প্রসারিত হয়, যার ফলস্বরূপ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আরবরা বারবার আক্রমণ করতে সক্ষম হয়েছিল। উঃপঃ সীমান্তে হিরাট আরবদের অধিকারে এলে এই পথ দিয়েই ভারত আক্রমণ চালাতে থাকে তারা। এই সময় পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতে ঢোকার তিনটিমাত্র পথ ছিল, খাইবার, বোলান ও মাকরানের উপকূল।
৬৩২খ্রীঃ এ হজরত মুহাম্মদ মারা যাবার পর থেকেই ইসলামে দীক্ষিত হয়ে আরবজাতি নব উন্মাদনায় অন্যান্য জাতিকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করে দেয়।
এবার ধরে ধরে প্রত্যেক খলিফা কীভাবে আক্রমণ করে তার বর্ণনায় আসি।
হজরত মুহাম্মদ মারা যাবার পর খলিফা ওমর-এর আমলে তিনটি নৌ আভিযান এদেশ আক্রমনের উদ্দেশ্যে চালানো হয়। আরবরা এসময় বোম্বাইয়ের থানা, ভারুচ বন্দর ও সিন্ধুর দেবল বন্দর আক্রমণ করে। যদিও এই আক্রমণ সফল হয়নি। ওমর আরবিয়দের কাবুলের পথ ধরে ভারত আক্রমণের নির্দেশ দেন।
পরের খলিফা অল ওয়ালিদ-এর আমলে ইরাকের শাসন কর্তা হজ্জাজ ৭০৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় সিন্ধু প্রদেশ আক্রমনের উদ্দেশ্যে অভিযান চালায়। “চাচনামা”-তে এই বিষয়গুলি সম্পূর্ণরূপে বর্ণিত আছে। Cambridge Historian উলসি হেগ একে “জলদস্যুদের দ্বারা পরিচালিত ভারত আক্রমণ” বলে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তবও বলেছেন, এই আক্রমনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল অ-ইসলামিক জাতিকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা।
৭১২ খ্রিস্টাব্দে হজ্জাজ তার জামাতা মহম্মদ-বিন-কাশেমকে পাঠিয়েছিলেন আর এক অভিযানে। সিন্ধু নদ পার হয়ে রাওর নামক স্থানে কাশেম পৌঁছালে তাকে সেখানে বাধা দেন সিন্ধুরাজা দাহির। দাহির ছিলেন দ্বিতীয় সাহসির ব্রাহ্মণ মন্ত্রী চাচের কনিষ্ঠ পুত্র। দাহির বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেন ও বীরগতি প্রাপ্ত হন। দাহিরের পত্নী রানীবাঈ রাওর দুর্গ রক্ষায় ব্যর্থ হলে জহরব্রত পালন করে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দেন। দাহিরের দুই কন্যা সূর্যদেবী ও পরমলদেবীর মর্যাদাহানিরও চেষ্টা করেছিল কাশেম। দাহিরের পুত্র জয় সিংহকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়।
এরপর আসি মাহমুদের প্রসঙ্গে। ইসলামিক ঐতিহাসিকরা বরাবরই এই ক্ষেত্রটা ধামাচাপা দিতে অন্যভাবে একে ব্যাখ্যা করার নিরলস চেষ্টা করেন। ইরফান হাবিব তো বেশ গৌরবের সঙ্গে লিখেছেন, “Mahmud has no missionary, conversion was not his object.”। এই প্রসঙ্গে একটি দুর্দান্ত যুক্তি দেন অধ্যাপক হ্যাভেল। তিনি এই কথার সূত্র ধরে জবাব দেন, মাহমুদ যেভাবে কনৌজ, মথুরা ও সোমনাথ মন্দির লুঠ করেছিল সেই ভাবে বাগদাদ দখল করে লুঠ করেনি কেন? এর থেকে এই বিষয়টা তো পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কেবল মাত্র লুন্ঠন নয়, ইসলামে ধর্মান্তরিত করার লক্ষ্যও ছিল।
ঐতিহাসিক Clifford Edmund Bosworth-এর মতে সুলতান মাহমুদের সেনাদলে ১০হাজার গাজী ছিল। গাজী হল জেহাদে উন্মত্ত অবৈতনিক সৈনিক। ১০০০খ্রি-১০২৭খ্রি পর্যন্ত লাগাতার ১৭বার ভয়াবহ লুন্ঠন চালিয়েছিল মাহমুদ।
প্রথম অভিযানে লাহোরের জয়পালকে বন্দী করে। ২৫টি হাতি ও ৩লক্ষ দিনা মুক্তি পণ দিয়ে জয়পাল মুক্ত হন।
১০০৫খ্রীঃ সে পাঞ্জাবের ভেরা রাজ্য আক্রমণ করে, মুলতান অভিযানের সময় শাহী আনন্দপাল তাকে বাধা দিলে তিনিও মাহমুদের হাতে পরাস্ত হন।
১০১৪খ্রীঃ মাহমুদ থানেশ্বরের চক্রস্বামী মন্দির লুঠ করে। এর থেকে যে বিপুল ধন রত্ন লুঠ করে তার সঠিক পরিসংখ্যান Bosworth-এর লেখায় পাওয়া যায়। মথুরার রাজা কুলচাঁদকে পরাস্ত করে ২০দিন ধরে মথুরা লুঠ করে।
রেফারেন্স:-Dr. J.L Mehta—“Advanced History of Medieval India “, H. Elliott —–” History of India as told by its own Historian (vol-ll)“.
১০১৯খ্রীঃ চান্দেল রাজ্য লুঠ করে মাহমুদের বাহিনী।১০১৪- ১০২৫খ্রী লাগাতার গুজরাটের কাথিয়াওয়াড়ের সমুদ্রতীরে অবস্থিত সোমনাথ মন্দিরে লুঠতরাজ চালায়। বিগ্রহের ওপর মহামূল্যবান হীরা, রত্নখচিত চন্দ্রাতপ, ঘন্টা বাজানোর সোনার শিকল লুঠ করে বিগ্রহটি সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করে যায়। আবার ১০২৭খ্রীঃ জাঠদের বিরুদ্ধে অভিযান করে বহু জাঠ নরনারীকে হত্যা করে।
তবে এই বিকৃত তথ্য তুলে ধরা গবেষকদের লেখায় যে এইসব ঘটনা ধরা পড়বে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে একথা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি যে যতদিন তাঁরা ওই ভুল গল্প অবলম্বনে ইতিহাস নির্মাণ করার চেষ্টা করবেন ততবারই সঠিক তথ্য সহযোগে ইতিহাস তুলে ধরে যাব । মানুষের যদি বিবেচনা করার সামান্যতম ক্ষমতা থাকে তাহলে তাঁরা, আশা করি, কোনটা ছেলে ভুলানো গল্প আর কোনটা ইতিহাস তা নির্ধারণ করতে সক্ষম হবেন।
লেখক: শ্রীমতি রিয়া রায়, M.A. ,B.Ed (ইতিহাস),
কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়
Source:
1) ভারতের ইতিহাস পরিক্রমা—–প্রভাতাংশু মাইতি, অসিতকুমার মন্ডল,
2)”Later Ghazanavids:splendour and Decay, the Dynasty in Afghanistan“—Clifford Edmund Bosworth
3) The Legacy of Islam–Clifford Edmund Bosworth
4)”Advance History of Medieval India “:Dr J.L Mehta
5)” History of India as told by its own Historian “(vol-ll) —H.Elliott
6)”Cambridge History of India“–E.J.Rapson