দক্ষতার অভিশাপ

দক্ষ মানুষজনেরা সাধারণের চাইতে একটু আলাদা। এঁরা কাজ শেষ করে ফেলেন অনায়াসে, অন্যের যা করতে দু দিন লাগে, সেটা এঁরা হয়ত অনায়াসে কয়েক ঘন্টায় সেরে ফেলেন। কাজ করেন একেবারে মসৃণ ভাবে, আওয়াজ না করে। আর কে না জানে সেই “কেলভিনেটর ফ্রিজের” সেই বিজ্ঞাপনের মতন এদের আওয়াজ এত কম যে – ফ্রিজ ব্যবহারকারী মহিলাটি কমপ্লেইন করেই ফেললেন – “আওয়াজই নেহি করতা” বলে। কিন্তু দক্ষ মানুষটি কি পান তার এই গুণের বিনিময়ে? হয়ত এরা প্রফেশনালি সাকসেসফুল, টাকা পয়সার অভাব হয়না, কিন্তু এর বেশি আর কিছু?

দক্ষ মানুষদের হাতে অনেক বেশি সময় থাকে। দক্ষ বলেই অনেক সময় বাঁচিয়ে ফেলেন এঁরা। আর এরা সাধারণত অন্যকে বলতে “আমি ব্যস্ত” এই কথাটি বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন। তার ফল হয় বেশ অন্যরকম। আশেপাশের সবাই, এমনকি ঘনিষ্ঠ মানুষজন পর্য্যন্ত ভেবে নেন, এই লোককে সেরকম ব্যস্ত থাকতে দেখিনা, উফ্ কি ভীষন পরিশ্রম গেল বলে ঘাম মুছতে দেখিনি কখনো তার মানে এ ব্যাটা সেরকম কোন কাজ করে না। যা সাফল্য দেখি, সেটা নিশ্চই কপালজোর। এর মানে এর হাতে দেদার সময়। এরপর যেটা শুরু হয় সেটা হল এই “দেদার সময়কে” টেকন ফর গ্র্যান্টেড” নেওয়া। এটা প্রথমে শুধু “সময়” দিয়ে শুরু হয়, শেষে এই বৃত্তে যাঁর সময়, সেই মানুষটিও যে কি করে সামিল হয়ে যান, সেটাও ঠিক বোঝা যায়না।

এরা লম্বা জার্নি করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে গেলেও, সবচাইতে কাছের মানুষটিও খোঁজ নিতে ভুলে যান যে পথে কোন অসুবিধে হল কিনা, ঠিক সময় পৌঁছলেন কিনা। কারণ যতই যাই হোক উনি “এফিশিয়েন্ট”, ঠিক পৌঁছে যাবেন। এর আগেও বহুবার গেছেন, তাই নো চিন্তা। অথচ, মানুষটি হয়ত কারুর টেলিফোনের অপেক্ষায় ছিলেন, যেটা তাকে জিজ্ঞেস করত – “পথে কোন অসুবিধে হয়নি তো? তুমি ঠিক আছো?” যেটা আর কোনদিনই আসে না।

এঁদের সাধারণত কোন “অসুবিধে” হয় না। শরীর খারাপ করলেও এরা সেটা চেপে, ঢাকা দিয়ে চলেন।

সময় থাকলেও এদের একেবারে শেষ মুহূর্তেই “ডাকা” হয়, কারণ এরা সময়টা ঠিক “ম্যানেজ” করে নেন। প্রয়োজন যাইই হোক না কেন। এটা মাথাতেই আসে না যে এদের আগে থাকতে কোন কাজের প্ল্যান করা থাকতে পারে, কোন সময় অন্য কাজের জন্যও বরাদ্দ হয়ে থাকতে পারে।

এঁদের বন্ধুর সংখ্যা হাতে গোনা যায়। এরা বন্ধুত্ব করতে চাইলেও এদের স্বভাবের জন্য এরা কিছুদিন পরেই বন্ধু থেকে “কাজের মানুষটি” হয়ে পড়েন। আর কাজের মানুষের সাথে তো কাজের কথাই হয়, তাই না? ঠাট্টা তামাশা, মজার কথা সে সব তো অন্যদের জন্যে বরাদ্দ থাকে। কাজের তারিফ তো দূরের কথা, কাজে একটু ভুলচুক হলেও জোটে সমালোচনা। যাঁরা সব সময় নিখুঁত কাজ করেন, তাদের ভুলচুক একটু বেশি করেই বাজে, ধবধবে সাদা কাগজে একটা ছোট্ট কালির দাগ যেভাবে দৃষ্টিকটু লাগে সেইভাবে।

এদিকে যে দক্ষ নয়, বা হবার চেষ্টাও কোনদিন করে নি, সে দিব্যি আছে। তার সময়ের দাম আছে, কারণ তার আউটপুট যাই হোক না কেন সে সারাটিক্ষণ ব্যস্তই থাকে। তাকে ছোট খাটো কাজে লোকজন কমই বিরক্ত করে থাকে। সে বাইরে গেলে সবাই ফোন করে জিজ্ঞেস ঠিকমতন পৌঁছল কি না, খাবার খেয়েছে কি না, সর্দি জ্বর বাঁধালে ডজন খানেক ফোন আসে, তার সাথে দেখা করার সময় লোকজন পনের মিনিট আগেই পৌঁছে গিয়ে থাকে। কোন কাজ করে দিলে শোনা যায়, কেউ গর্বিত ভাবে বলছে – অমুক আমার এই কাজটা করে দিয়েছে জানো, এত ব্যস্ততার মধ্যেও!

তবে এরাও অন্য সবার মতই কষ্ট পান। হয়ত মুখ ফুটে কখনো কিছু বলেন না। বিশেষ করে, কাছের লোকেরা এমনটি করলে একটু কষ্ট তো হয়ই।

তবে কাছের মানুষ বলে কি আদৌ কিছু হয়? সবাই বোধয় দূরেরই হয়। কেউ একটু বেশি দূরের আর কেউ কম দূরের। এটুকুই যা তফাৎ।

সঞ্জয় সোম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.