বাংলার মাটি পুণ্যতোয়া। এ মাটি চিত্রে সহজিয়া, ভাস্কর্যে কালজয়ী। রঙের টানে চিত্ররেখাডোরে বাঁধা পড়ে, ঘুম ভাঙে সদ্যোজাত শিল্পের, যেন মাথার ভিতরে এক বোধ কাজ করে। গ্রাম বাংলার সহজ মানুষের সহজাত শিল্পচেতনা, গভীর জীবনবোধের রং লেগে কৃষ্টির বুকে ফুটে ওঠে দৃষ্টিসুখের উদ্ভাস। পটুয়া, কুম্ভকারদের হাতে গড়ে ওঠে মাটির পুতুল, প্রতিমা, পট, পাত্র। সে সবই শিল্পবীক্ষার সমস্ত আঙ্গিকে চিরন্তন হয়েও চিরনবীন। বাংলার লোকসংস্কৃতির সুরভি লেগে থাকে শিল্পদ্রব্যগুলির গায়ে, ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেও যে শিল্প অক্লান্ত, লোকশিল্পীরা মুছে যেতে দেননি ঐতিহ্যের আলো।
বাংলার মৃৎশিল্পের ইতিহাস অতি পুরাতন। প্রাচীন বঙ্গের চন্দ্রকেতুগড়, মঙ্গলকোটে মিলেছে তার বহু পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ। সেসব নিদর্শন থেকে ইতিহাসবিদরা খোঁজ পান প্রাচীন সংস্কৃতি, শিল্পের উৎকর্ষবোধ, এমনকী সমাজচিত্রেরও। বিভিন্ন রঙের, আকারের ছোটো মাটির পাত্র, থালা, বাটি, মূর্তিতে যেন লেখা থাকে অচেনা শিল্পীদের নাম। ইতিহাস বর্তমানের কানে কানে কথা বলে যায়। যদি ইতিহাসের স্রোত থেকে বর্তমানের দিকে মুখ ফেরাই, তবে দেখা যাবে বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুরের মাটির কাজ জগৎপ্রসিদ্ধ। যাঁরা এই পেশার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের এককথায় ‘কুম্ভকার’ বলা হয়। তাঁরা নরম মাটি থেকে বিভিন্ন আকারের মাটির পাত্র বানিয়ে, তাতে বিভিন্ন রঙের ছবি আর মোটিফ দিয়ে রঙিন করে তোলেন। অনেক সময় এইসব মাটির পাত্রে শিল্পীরা ওয়ারলি চিত্র বা ওয়ারলি আর্ট (Warli Art) ফুটিয়ে তোলেন।
ওয়ারলি চিত্রকলা ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ শিল্পরীতি। মহারাষ্ট্রের উত্তর সহ্যাদ্রি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের হাতে এই চিত্ররীতির জন্ম বলে কথিত। তা পরে অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার লোকশিল্পীরাও এই চিত্ররীতিতে চুড়ান্ত দক্ষ, তাঁরা বংশপরম্পরায় এই চিত্রকলার অভ্যাস করে আসছেন।
পাত্রগুলি তৈরি করার জন্য মূলত পুকুরের বা নদীগর্ভের নরম মাটি সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে তাকে আকার দেওয়া, রোদে শোকানো, পোড়ানো, রঙে-চিত্রকলায় সাজানো – প্রতিটি ধাপে জুড়ে থাকে অপার যত্ন আর প্রগাঢ় ধৈর্য। এইসমস্ত গ্রামীণ শিল্পীদের জন্যই যেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই পংক্তি- “আকাশী স্বপ্ন সে ছুঁয়েছে তার মাটিতে গড়া দুই হাতে”।
বিভিন্ন হস্তশিল্প মেলায় পাত্রগুলির দেখা মেলে। কলকাতার বেশ কিছু বিপণিতে এই পাত্রগুলি বিক্রি হয়। বিভিন্ন রং, গড়ন আর মোটিফযুক্ত পাত্র পাওয়া যায়। পাত্রগুলিকে ঘর সাজানোর কাজে ব্যছবহার করা যায়, ব্যবহার করা যায় ফুলদানি হিসেবেও। উপহারসামগ্রী হিসেবেও ব্যাবহার করা যায় পাত্রগুলিকে। শিল্পসংগ্রাহকদের কাছেও সমান আকর্ষণীয় এই পাত্রগুলি। কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “কতদিন রঙে পা রাখিনি”। এই পাত্রগুলি ঘরে থাকলে সারা ঘর জুড়ে যেন ছড়িয়ে পড়ে রঙিন আলো।