“হিন্দু সন্ত্রাস” শব্দবন্ধটি ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীরা অকাতরে ব্যবহার করতেন। মিডিয়ায় এটি একটি বহুল প্রচলিত শব্দে পরিণত হয়। প্রগতিশীল ও মানবাধিকার কর্মীরা এই বিষয় নিয়ে তুমুল উৎসাহে লেখালেখি, সেমিনার ও পুস্তিকা প্রকাশ করতে থাকে।
২০.০৬.২০০৬ তারিখে পুণার নিকটবর্তী নান্দেড় শহরে একটি বিস্ফোরণে দুজন মারা যায়।
সেই প্রথম সরকারী নথিতে ” হিন্দু সন্ত্রাস” কথাটি স্থান পেয়েছিল। মহারাষ্ট্র পুলিশের সন্ত্রাসদমন শাখা থেকে এই কেসটি সিবিআইয়ের হাতে চলে আসে। কিন্তু সিবিআই তদন্ত করে সরকারের মর্জিমত রিপোর্ট দিতে অস্বীকার করে। এতে সিবিআইয়ের এক দক্ষ অফিসার, যিনি হয়ত পরবর্তীকালে সংস্থার ডিরেক্টর পর্যন্ত হতে পারতেন, সরকারের কোপে পড়েন। তাঁর আভ্যন্তরীণ মূল্যায়ণের রিপোর্টে নেতিবাচক কথা লিখে প্রাপ্য পদোন্নতির পথ রুদ্ধ করা হয়।
এরপর একে একে আজমের, মালেগাঁও, হায়দ্রাবাদ, সমঝোতা এক্সপ্রেস, গোয়া ইত্যাদি জায়গায় যেসব বিস্ফোরণ হয়, তার সাথে এই “গৈরিক” বা “হিন্দু সন্ত্রাস”এর বিষয়টা জড়িয়ে দেওয়া হতে থাকে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে যাদের আততায়ী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাদের নাম মুছে ফেলে নতুন নাম ঢোকানো হয়।
যাদের গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের এক অফিসার ছিলেন। অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, প্রায় তিরিশ দিনে তাঁর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছিল। সাধারণ বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে চার্জ গঠন করতে যেখানে মাস পাঁচেক লাগে, সেখানে এই স্পর্শকাতর বিষয়ে তাড়াহুড়ো করে কাগজপত্র জমা করা আমার স্বাভাবিক মনে হয়নি।
২০১০ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদম্বরম ভারতের সব রাজ্যের পুলিশ প্রধানদের একটি বৈঠকে “গৈরিক সন্ত্রাস” এর মারাত্মক বিপদ সম্পর্কে উপস্থিত সকলকে সতর্ক করেন। এই শব্দবন্ধে আপত্তি জানিয়ে জন্মুর এক সাধু আদালতে মামলা করেন। এরপর কংগ্রেসের তরফে জনার্দন দ্বিবেদী বিবৃতি দিয়ে বলেন, ” কালো ছাড়া সন্ত্রাসবাদের কোন রং হয় না।” ( টাইমস নিউজ নেটওয়ার্ক, ২৮ আগষ্ট, ২০১০)
অফিসার্স ট্রেনিংয়ের সময় একটি কথা আমাদের খুব ভাল করে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেটি হল এই যে, সংসদে উত্থাপিত লিখিত প্রশ্নের উত্তরে কখনও এমন কিছু লেখা যাবে না, যার পেছনে কোন নথির সমর্থন নেই। কারণ এই নিয়ে পরবর্তীকালে কোন বিতর্ক হলে, পুরো দায়িত্বটি অফিসারের ঘাড়ে চলে আসবে। এবং সংসদের নিজস্ব বিচারের ক্ষমতা রয়েছে যেখানে আদালত পর্যন্ত মাথা গলাতে পারে না। অফিসার ফেঁসে গেলে তাকে কেউ দেখার নেই। অসত্য ভাষণের বা সংসদকে বিভ্রান্ত করার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা বেশ কড়া।
মজার কথা, ওই সময়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা নিয়ে সংসদে যতগুলি প্রশ্ন করা হয়,তার সবকটিতে সরকারের তরফ থেকে উত্তর দেওয়া হয়েছে যে প্রত্যেকটি সন্ত্রাসবাদী হামলার পেছনেই হিন্দু সন্ত্রাস নয়, পাক আই এস আইয়ের মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হাত রয়েছে। ( “Pakistan / Pok based ISI sponsored groups have been found responsible for …… so and so ……. terror attack.”) । সংসদীয় নথিতে আজো তা জ্বলজ্বল করছে !
এর মানে হল, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যাই বলুন না কেন, সেইসময়ে দপ্তরের সংশিষ্ট অফিসাররা কেউ নেতাদের প্রিয়পাত্র হবার জন্য অসত্য ভাষ্য লিখে বিপদের মুখে পড়তে চাননি !
আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে বাজপেয়ীর আমলের জঙ্গিদমন আইন পোটা রিপিল অর্ডিন্যান্স (২১. ৯. ২০০৪ ) পাশ করার পর থেকেই তৎকালীন ইউ পি এ সরকার সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অভিযুক্ত ও অন্তরীণ ব্যক্তিদের জামিন ( bail ) করিয়ে দেবার জন্য অতিমাত্রায় ব্যগ্ৰ।
২০০৪ সালের ১৫ জুন গুজরাট পুলিশের ডিটেকশন অফ ক্রাইম ব্রাঞ্চ ও কেন্দ্রীয় সরকারের সাবসিডিয়ারি ইন্টেলিজেন্স ব্যূরোর সাথে একটি সংঘর্ষের ঘটনায় আহমেদাবাদের শহরতলীতে চারজন মারা যায়। মৃতরা হল ইশরাত জাহান নামে বছর উনিশের এক কলেজ ছাত্রী, জাভেদ শেখ, জিশান জোহর ও আমজাদ আলি রাণা — এরা লস্কর ই তৈবার স্লিপার সেলের সদস্য ছিল। প্রাণেশ পিল্লাই নামে কেরালার এক যুবক ধর্মান্তরিত হয়ে জাভেদ শেখ নাম নিয়েছিল। সে জঙ্গিদের হয়ে স্থানীয় নেটওয়ার্ক তৈরীর দায়িত্বে ছিল। শেষের দুজন ছিল পাকিস্তানী।
ইশরাত জাহানের মা শামিমা কৌসর এই ঘটনায় পুলিশী হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ জানিয়ে আদালতে মামলা করেছিলেন। প্রাণেশ পিল্লাইয়ের বাবাও সুপ্রিম কোর্টে অনুরূপ মামলা করেছিলেন।
২০০৯ সালের জুলাই মাসে গুজরাট হাইকোর্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে কেসটির “factual position” জানিয়ে একটি হলফনামা দাখিল করতে নির্দেশ দেয়। আমি বিস্তর নথিপত্র ঘেঁটে একটি হলফনামা প্রস্তুত করি ও সেটি আমাদের মন্ত্রকের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর ও জয়েন্ট সেক্রেটারি
অনুমোদন করেন। পরবর্তীতে এটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সেক্রেটারি মারফত মন্ত্রী চিদম্বরমের কাছে যায় ও অনুমোদিত হয়। এরপর এটি আইনমন্ত্রকের সেক্রেটারির অনুমোদন লাভ করে।
আমি এই হলফনামা গুজরাট হাইকোর্টে জমা করি ০৬. ০৮. ২০০৯ তারিখে।
কিন্তু এরপর বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ঘনীভূত হতে থাকে। কয়েকটি সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে কোর্টের নির্দেশে মৃতদেহগুলি কবর থেকে তোলা হয় এবং আবার সুরতহাল বা “ইনকোয়েস্ট” প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করা হয়। এস পি তামাং নামে এক জুডিশিয়াল অফিসারের রিপোর্টে পুলিশ আধিকারিকদের অভিযুক্ত করা হয়। এরপর
গুজরাট হাইকোর্টের নির্দেশে একটি স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা সিট এই মৃত্যুর তদন্তের দায়িত্ব পেল।
বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক চাপান উতোর যখন তুঙ্গে ওঠে, তখন গুজরাটের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আমার দায়ের করা হলফনামাটির উল্লেখ করে বলেন কেন্দ্রীয় সরকার রাজনৈতিক স্বার্থের নিহতদের পক্ষ সমর্থন করলেও তাদের হলফনামায় সম্পূর্ণ বিপরীত কথা লেখা রয়েছে। উক্ত হলফনামায় তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যান্য অফিসারদের স্বাক্ষর রয়েছে !
এতে মন্ত্রী চিদম্বরম ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি ওই হলফনামাটি চেয়ে পাঠান। সেটি সরকারী হেফাজত থেকে নিঁখোজ হয়ে যায়।
এরপর আইনজ্ঞ চিদম্বরম আরেকজন প্রভাবশালী উকিলের সহায়তায় আরেকটি হলফনামা তৈরী করেন। আইনগতভাবে তাকে ” সাপ্লিমেন্টারি এফিডেভিট” বলায় অসুবিধা থাকায় ঐ নথির নাম দেওয়া হয় ” further affidavit “. এই এফিডেভিটে নিহতদের জঙ্গি যোগের সমস্ত উল্লেখ মুছে ফেলা হয়।
এই এফিডেভিটটি আদালতে ফাইল করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আমি সিভিল সার্ভিস রুলস এর ৩০ সি ধারা অনুযায়ী, এই নির্দেশ মানতে বাধ্য। তাই আমি তা পালন করি। ওইসময় আমাকে কড়া পুলিশি নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছিল। এই কেসটি নিয়ে তদন্ত করছিল আদালত নিযুক্ত বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট।
আদালতে তদন্তকারী পুলিশ অফিসার সতীশ ভার্মা এফিডেভিট জমা দিলেন, লেখা হল, ‘পারপোর্টেড এনকাউন্টার’, — ‘জেনুইন’ নয়। গুজরাটের বহু পুলিশ অফিসার এই তত্ত্ব মানতে চাইলেন না। এবার সিবিআইয়ের ডাক পড়ল তদন্তের জন্য। সিবিআই রিপোর্ট দিল, প্রত্যেকটা হত্যা হয়েছে পুলিশ হেফাজতে, ক্লোজ রেঞ্জ থেকে গুলি করা হয়েছে, লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে ‘লোকেশনে’, মৃতদেহের হাতে অস্ত্র গুঁজে দেওয়া হয়েছে তার পরে। ২০ জন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে খুন, কিডন্যাপিং, ক্রিমিনাল কনস্পিরেসি-সহ নানা অভিযোগ আনা হল।
সিবিআইয়ের তদন্তে এও বলা হল, ঘটনার কথা আগাম জানতেন, এবং তাতে অনুমোদন ছিল তৎকালীন গুজরাট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর !
আমার সুদীর্ঘ চাকরিজীবনে রাজিন্দর কুমারের মত সৎ ও দক্ষ অফিসার কমই দেখেছি। তিনি একসময়ে আই বির পাকিস্তান ডেস্কে কর্মরত ছিলেন। পরে এস আই বিতে বদলী হন। তাঁর সোর্স নেটওয়ার্ক ছিল নিঁখুত। ২০১০ সালের পর থেকে তিনি জঙ্গিদের বহু স্লিপার সেল ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এই স্লিপার সেল অতি ভয়ংকর বস্তু। এখানে তরুণ যুবক ও যুবতী, যাদের কোন পুলিশ রেকর্ড নেই, তাদের বাছা হয়। তারপর তাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক দিয়ে নাশকতা চালাবার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ইশরাত জাহান এনকাউন্টার কেসে তিনি যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, তাতে আমি কোন অসঙ্গতি দেখিনি। আমি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে, স্বইচ্ছায় সেই তথ্যগুলির সাহায্যে নিজের নথিপত্র প্রস্তুত করেছি।
আসলে রাজিন্দর কুমারের মত অফিসারদের কার্যকলাপের ফলে আই এস আইএর বহু পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছিল। তারা প্রত্যাঘাতের সুযোগ খুঁজছিল।
পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর ভরত প্যাটেলকে সিবিআই চাপ দিয়ে কুমারের বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট দিতে বাধ্য করে। ৩০শে জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে একটি বেশ মোটা ফাইল সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয় যাতে রাজিন্দর কুমারের বিরুদ্ধে কেস সাজাতে সুবিধা হয়।
ডি জি বানজারা নামে গুজরাট পুলিশের যে অফিসার এই অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁকেও হেনস্থা করা হচ্ছিল।
সোহরাবুদ্দিন এনকাউন্টার কেসে তাঁকে অভিযুক্ত করে আট বছর কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এই সোহরাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে ৬০টি ফৌজদারি কেস ছিল। এই কেসে তৎকালীন গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গ্ৰেপ্তার হয়ে গিয়েছিলেন।
এছাড়াও প্রচুর পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা চলতে থাকায় পুলিশবাহিনীর মনোবল তলানিতে এসে ঠেকেছিল।
২১.৬. ২০১৩ সালে আহমেদাবাদের সিবিআইএর স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমের তরফে আমাকে জানানো হয় যে পরদিন অর্থাৎ ২২.৬.২০১৩ তারিখে আমেদাবাদে তাদের সামনে হাজির হয়ে আমাকে স্টেটমেন্ট রেকর্ড করতে হবে। এই টিমটি ইশরাত জাহান কেসের তদন্তের দায়িত্বে ছিল। আমি তাদের বলি এই আবেদনটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রাখতে। সিবিআই টিম তা পালন করে আমাকে ভোরের ফ্লাইটে আমেদাবাদের টিকিট করিয়ে দেয়।
সিবিআই দপ্তরে আমি যে চেম্বারে অপেক্ষা করছিলাম তার লাগোয়া একটি ঘরেই গুজরাটের আমেদাবাদ সিটি পুলিশের এক মহিলা আধিকারিক, পি সি গুর্জরকে চরম হেনস্থা করা হচ্ছিল। ইশরাত জাহান কেসের এফ আই আরে তার সই ছিল, এবং সেখানে সেটিকে “এনকাউন্টার” হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়েছিল। ভারতীয় আইন অনুযায়ী, এসব কেসে প্রাথমিক রিপোর্টের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আমি স্পষ্ট দেখলাম আরেকটি ঘরে সিবিআই এর জিজ্ঞাসাবাদকারী দলের এক সদস্য একটি লোককে সজোরে চড় মারল। লোকটি মনোজ সিধপুরা, একটি গ্যারাজের মালিক, এই মামলার অন্যতম সাক্ষী।
ইশরত, জাভেদ শেখ এবং দুই পাকিস্তানী নাগরিক নাসিক থেকে সুরাত অবধি এসেছিল। তাদের গন্তব্য ছিল আমেদাবাদ। সুরাতে তাদের গাড়ি বিকল হয়ে যাওয়ায় তারা মনোজের শক্তি গ্যারাজে তা মেরামত করায়। রাত নটায় সুরাত থেকে রওনা হয়ে ২৭০ কিমি যাত্রা করে ভোরে আমেদাবাদের উপকন্ঠে আসার পর পুলিশের দলটি তাদের আটকায়। সেখানেই গুলিবিনিময় হয় ও গোটা দলটি মারা পড়ে। তদন্তকারী অফিসার সতীশ শর্মা সেদিন আমার সঙ্গে অত্যন্ত নির্মম ব্যবহার করেন। আমাকে চার পাঁচ ঘন্টা জল খেতে দেওয়া হয় না, নোংরা গালাগালি দেওয়া হয় ও জলন্ত সিগারেট থাইয়ে চেপে দেওয়া হয়। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকি। ওই দগ্ধ ট্রাউজার আমি আজও নিদর্শন হিসেবে রেখে দিয়েছি।
সতীশ কুমার জেরার সময়ে আমাকে কিছু অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে এই গুজরাতের সাদা দাড়ি আর কালো দাড়িকে তিনি গারদের ভিতরে পুরেই ছাড়বেন ! উনি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। সেইসময়ে জাতীয় রাজনীতিতে ওঁদের গুরুত্ব বাড়ছিল।
তিনি আরো বললেন যে ১৩. ১২. ২০০১ এ পার্লামেন্টে জঙ্গি হামলা ও ২৬.১১.২০০৮ এর মুম্বই হামলা সংগঠিত হয়েছে তৎকালীন ক্ষমতায় থাকা সরকারের মদতে। জঙ্গি বিরোধী আইন আনার অজুহাত হিসেবে এই হামলাগুলিকে সরকার ব্যবহার করেছে। সংসদে হামলার পর পোটা আইন আসে, এবং মুম্বই হামলার পর ইউ এ পি এ আইনকে সংশোধন করা হয়। এখন কারো পকেটে দশ টাকা থাকলেও তা জঙ্গি কার্যকলাপে ব্যবহার করার জন্য বলে বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া যায় এবং অভিযুক্তকে সারাজীবনের জন্য জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় !
অশেষ হেনস্থার পর সিবিআই আমাকে এয়ারপোর্টে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। লাঞ্ছিত, বিধ্বস্ত আমি তখনও ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ২৪.৬.২০১৩ তারিখে আমি আমার ঊর্ধ্বতন অফিসার অর্থাৎ সেক্রেটারি, ( নগরোন্নয়ন ) কে চিঠি লিখে সব জানাই।
এই ঘটনার পর আমি কার্যতঃ একঘরে হয়ে গেলাম। কেউ আমার সাথে মিশত না, আমাকে মোবাইলে কেউ ফোন করত না আড়িপাতার ভয়ে, অজ্ঞাতপরিচয় কিছু লোক প্রায়ই আমাকে অনুসরণ করত এবং আমার দপ্তরের একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি, এম আহমেদ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাকে উত্যক্ত করতে শুরু করলেন। তাঁর সমবেদনা ইশরাত ও তার দলবলের প্রতি ছিল।
অফিসের বিভিন্ন কাজে আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে দেওয়া হত, যেখানে খুব সহজেই আমাকে দুর্নীতির মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া যায়। ওই সময়ে আমার দপ্তরের কিছু লোকের যোগসাজশে ৭ নং রেসকোর্স রোডের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ জমি এক অনাবাসী ভারতীয়র কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় নিয়মবহির্ভূতভাবে। এই দুষ্কর্মের সাথে আমাকে জড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়। আমি অতিকষ্টে সামাল দিই সেই পরিস্থিতি। আমার ওপরওয়ালা আমেদ এবং মন্ত্রী কমল নাথের ব্যক্তিগত সচিব খালিদ বিন জামা আমাকে নানাভাবে দিনের পর দিন চূড়ান্ত কষ্ট দিয়েছে।
এরপর আবার শুরু হল নতুন উৎপাত।
সিবিআইয়ের একজন ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট জয়ন্ত কাশ্মিরী প্রায়ই আমার অফিসে এসে নানা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে সময়ের অপচয় করতে লাগল। অবস্থা এমন হল, যে প্রতি বুধবার দুপুরে আমার অফিসে হানা দেওয়াটা একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়াল। ঐ দিন আমাদের দপ্তরের পাবলিক গ্ৰিভান্স রিড্রেসাল থাকত। উনি আমার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে থাকতেন, এবং আমাকে ঠিকভাবে কাজ করতে দিতেন না।
আমার ছেলে এম বি এ পাশ করে চেন্নাইতে একটি চাকরী পেয়েছিল। একদিন সে খুব বিমর্ষ হয়ে বাড়িতে ফোন করল। তার কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট তাকে ইস্তফা দিতে বলেছে। পরে জানা গিয়েছিল সিবিআই থেকে কোম্পানির লোকজনকে ওর বিষয়ে ভয় দেখানো হয়েছিল।
ডিসেম্বর মাসে ঐ জয়ন্ত কাশ্মিরী নামে সিবিআইয়ের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট সকালে আমাদের বাড়িতে এসে যাচ্ছেতাই সব কান্ড করতে লাগল। তার সাথে যারা এসেছিল, তাদের চেহারা গুন্ডার মত। আমাদের বসার ঘরের সব জিনিপত্র তারা আছড়ে ভেঙ্গে ফেলছিল। আমার ৮৭ বছরের বৃদ্ধা মার ওপর এর অভিঘাত হল মারাত্মক। আতঙ্কগ্ৰস্ত, কম্পমান মাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর আর তিনি ফিরে আসেননি।
২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচন। বর্তমান সরকারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তারা আমার চাপ আরো বাড়াতে লাগল। আমি গুজরাট হাইকোর্টে যে এফিডেভিটটি দাখিল করেছি, তা জয়েন্ট ডিরেক্টর ( এস আই বি ) রাজিন্দর কুমার আমাকে দিয়ে জোর করে সই করিয়ে নিয়েছে, তা লিখিতভাবে স্বীকার করানোর জন্য নানাভাবে চাপ দেওয়া হতে লাগল।
আমি একটি বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। উপযুক্ত কাগজপত্র ছাড়া এক পাও এগোব না।
আমি আমার নির্যাতনকারীদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলাম যে তাদের কথামত আমি কাজ করব, যদি স্বরাষ্ট্রদপ্তর বা সিবিআই আমাকে এমন কোন নথি দেখায় যেখানে তারা স্বীকার করেছে যে সেদিন কোন এনকাউন্টার হয়নি। বলাই বাহুল্য, এই ধরনের নথি সৃষ্টি
করা তাদের সাধ্যের বাইরে ছিল।
২০০৪ সালে পাকিস্তানের জামাত উদ দাওয়া ইশরাত জাহানকে তাঁদের মুখপত্র “গাজওয়া টাইমস”এ “ফিদায়ীন” (আত্মঘাতী) বলে প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে হৈ চৈ হওয়ায় তারা সতর্ক হয়ে এই বিবৃতিটি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
ক্রমাগত হেনস্থার ফলে উত্যক্ত হতে হতে আমি আর পারছিলাম না। একদিন গোপনে চেন্নাই হয়ে কুম্ভকোনম গিয়ে কিছুদিন নিরুপদ্রবে থাকতে সমর্থ হই।
১৫ই মে, ২০১৪ সালে দেশজুড়ে নির্বাচনের ফল ঘোষণা হয়। সরকার পরিবর্তন হয়ে যায়। কিন্তু মজার কথা, আমার জীবনে “আচ্ছে দিন” আর আসেনি। আসলে প্রশাসনের অভ্যন্তরে সবসময়ই কিছু ধ্বংসাত্মক মানসিকতার লোক থাকে। তাদের কেউ সরাতে পারে না।
ডিসেম্বর ২০১৩, এক অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার এন কে আমিন সুপ্রিম কোর্টে একটি ক্রিমিনাল রীট পিটিশন দায়ের করেন। (নং ১২৮/২০১৩)
এই সূত্রে সুপ্রিম কোর্ট আমাকে একটি নোটিশ পাঠায়। আমি কোর্টে হাজির হয়ে যথোপযুক্ত জবাব দিই।
এর কয়েকদিন পরে আমার উকিলের অফিসে একটি “ফতোয়া” র চিঠি আসে, যেখানে আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এই “ফতোয়া” আমার বাবাকে এত আতঙ্কগ্ৰস্ত করে তোলে যে, তিনি চরম অবসাদের শিকার হন। বাবার অসুস্থতা এত বাড়ে যে শেষপর্যন্ত তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। অবশেষে, আমার বাবার পরিনতিও ঠিক আমার মায়ের মতোই হল।
আমি প্রায়ই দেখতাম অফিসের পার্কিং লটে আমার গাড়ির চারটি চাকার নাটবল্টু কারা যেন খুলে রেখে যায় ! মানুষকে যে কতভাবে ছুটিয়ে মারা যায় !
একদিন বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় একটি ডাম্পার উল্টোদিক থেকে এসে আমার গাড়িতে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সামনের অংশের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করল। আমি আয়ুর জোরে বেঁচে গেলাম সেদিন।
তবে অবস্থার সামান্য হলেও পরিবর্তন হচ্ছিল।
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অফিসাররা মুখ খুলতে শুরু করেছিলেন। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব জি কে পিল্লাই ও রাজিন্দর কুমার ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়া শুরু করেছিলেন। আমার সাথেও “টাইমস নাও” খবরের চ্যানেল যোগাযোগ করতে শুরু করে, এরপর একে একে অন্যরা। আমার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হয় টাইমস নাও চ্যানেলে, ১লা মার্চ,২০১৬।
এতে আমার শত্রুরা আমার ওপর ভীষণ রেগে যায়। আমি এপ্রিল মাসে মুম্বাইতে সরকারী কাজের সূত্রে গিয়ে প্রভাদেবীর টেক্সটাইল কমিটি গেস্ট হাউসে উঠেছিলাম। সেখানে ২২.৪.২০১৭ তারিখে আমার ওপর আবার একটি প্রাণঘাতী হামলা হয়। আমি ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাই ও যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি দিল্লী ফিরে আসি।
এবার আমি ঠিক করি, অনেক হয়েছে, স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটাব। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো। আমি আমার দীর্ঘ পেশাগতকে জীবনকে বিদায় জানাই।
এতদিন সরকারী চাকরী করে আমার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান হল এই – যুদ্ধ মানে সীমান্তে গুলিগোলা নয়, যে সব ক্ষমতাশালী লোকরা আমাদের নয়াদিল্লির নর্থ ব্লকের বিরুদ্ধে সাউথ ব্লককে লড়িয়ে দিচ্ছে, সিবিআইকে দিয়ে আইবি ও রাজ্য পুলিশের অফিসারদের অনর্থকভাবে হেনস্থা, মামলা ও গ্ৰেপ্তার করাচ্ছে, তাদের সংগ্ৰাম আসলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই ।
আমি চিরকাল সাধারণ ভাবে জীবনযাপন করেছি। শ্রীমদ্ভাগবতগীতা পাঠ করেছি যখনই সময় পেয়েছি। সেই আদর্শে চলার চেষ্টা করেছি। “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী” এই নীতিতে মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করেছি।
আমি এই বইতে যা লিখেছি, তার প্রত্যেকটি কথার সমর্থন পাওয়া যাবে আদালতের হলফনামা ও নথিতে , সেক্রেটারিয়েটের রিপোর্টে, থানার কেস ডায়েরি ও চার্জশিটে, আর টি আইএর কাগজপত্র, সরকারি ফাইল ও সংবাদপত্রে।
প্রতিজ্ঞা করেছিলাম চাপের কাছে নতিস্বীকার না করার। যখন আমি ভীষণ ভেঙ্গে পড়তাম, আমার মা বলতেন, “তুমি আমার সাহসী ছেলে।”
আপ্রাণ চেষ্টা করেছি মায়ের এই কথা যাতে মিথ্যা না হয়।
আর. এস. ভি. মণি
“দ্য মিথ অফ হিন্দু টেরর ; এন ইনসাইডার এ্যাকাউন্ট অব মিনিস্ট্রি অফ হোম এ্যাফেয়ার্স ২০০৬ -২০১০)
বিতস্তা পাবলিশিং