২০০৮ সালের ১লা ডিসেম্বর পি চিদম্বরম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। বেশ তুখোড়, বলিয়ে কইয়ে,সফল আইনজ্ঞ চিদম্বরম তৎকালীন সরকারের বেশ ভরসার লোক ছিলেন।
২৬.১১.২০০৮ এর ভয়ংকর জঙ্গি হামলার পর দেশজুড়ে সরকারের প্রতি যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে চলেছিল তিনি তা প্রশমিত করার উদ্যোগ নিলেন।
দেশ ওই সময়ে একটি অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। কিছু মানুষ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইছিল।
পাকিস্তান তাদের অর্থ ,অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক চোরাপথে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের যুদ্ধের উন্মাদনাকে জিইয়ে রেখেছিল ! দেশজুড়ে ছড়ানো ছিল জঙ্গিদের মডিউল, কাশ্মীরে রোজ গুলিগোলা চলত, মাফিয়াচক্রগুলি সক্রিয় ছিল এবং হাওলায় কালো টাকার লেনদেন অবাধে চলত। দেশের এটিএম গুলি থেকেও জাল টাকা পাবার খবর আসছিল। জাল টাকা মানেই অর্থনৈতিক যুদ্ধ ! এই টাকাগুলো পাকিস্তানে ছাপানো হত ও বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলাগুলি দিয়ে ভারতে ঢোকানো হত।
মানবাধিকার সংগঠনগুলি এইসব নিয়ে কোন কথা বলত না। তাদের কার্যকলাপ দেখে মনে হত তারা যেন জঙ্গিদের প্রতিই সহানুভূতিশীল।
বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান যেমন আল রশিদ, ইকরা, রাবিতা, সাহাবিল আখান, উম্মা রিলিফ,মদীনা ট্রাস্ট ইত্যাদির ওপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নিয়মিত নজর রাখত। এগুলি বিভিন্ন সন্দেহজনক গোষ্ঠীর ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করত।
আমাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই ভারতে নাশকতামূলক কাজের জন্য ওই সময়ে প্রায় ৮৪ কোটি টাকা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে দিয়েছিল। ভারতে অস্থিরতা তৈরীর জন্য তাদের মোট বিনিয়োগ ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। কাঠমান্ডুর পাকিস্তানী দূতাবাস ছিল আই এস আইয়ের বড় ঘাঁটি।
আমাদের মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতবিরোধী কাজের যে তহবিল গঠিত হয়েছিল তার ২৫ % ছিল পাকিস্তানের অনুদান, ১৫ % মাদক চোরাচালানের টাকা, ১০% জাল নোটের কারবারের লভ্যাংশ, ১০% অস্ত্র চোরাচালানের অর্থ, ১০% তোলাবাজির অবদান, ১০% জাকাতের খয়রাত ও বাকি ১০% বিভিন্ন সংগঠনের তহবিল থেকে দান হিসেবে আসত, বাকি অন্যান্য সূত্রে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যূরো বা NCRB আমাদের থেকে তথ্য নিত।
আমাদের কাছে খবর ছিল, করাচীর বেশ কিছু যৌনকর্মীকে পাক আই এস আই প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এদেশে তারা ভূয়ো পরিচয়পত্র পেয়ে গেছে। তারা সেনাবাহিনী ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের অফিসারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে অনেক গোপনীয় তথ্য তাদের থেকে জেনে নিচ্ছে ও তা দেশবিরোধী শক্তির কাছে পাচার করে দিচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলাগুলিকে ভারতের শত্রুরা চোরাচালান, হিউম্যান ট্রাফিকিং ও জাল নোট ভারতে ঢুকিয়ে দেবার বড় করিডোর হিসাবে বরাবর ব্যবহার করে আসছে।
পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সংলগ্ন ও ভারতের নেপাল সংলগ্ন জেলাগুলিতে জনবিন্যাস দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। সেখানে গজিয়ে উঠছিল প্রচুর ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে যে ভারতবিরোধী প্রচার চলে, সে সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ক্রমাগত আমাদের তথ্যপ্রমাণ যোগাড় করে পাঠাত। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার সরকার তাতে কর্ণপাত করত না। উত্তরপ্রদেশ সরকারের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। সিওয়ানের রাজনৈতিক নেতা সাহাবুদ্দিন প্রকাশ্যে দেশবিরোধী শক্তিকে মদত দিত।
কর্ণাটকে ভাটকাল বলে একটি বন্দর শহর আছে। সেখানে ইয়াসিন, রিয়াজ ও ইকবাল নামে তিন ভাই ছিল তিনটি রত্ন। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের নেতা হিসেবে তারা প্রচুর বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে যুক্ত ছিল। দক্ষিন ভারতের এই শহরটি বিশেষভাবে আমাদের নজরে ছিল।
আমরা বুঝতে পারছিলাম, দেশের যা পরিস্থিতি, তাতে পেনাল কোড বা ভারতীয় দন্ডবিধি, পুলিশের ধীরগতির তদন্ত ও নানা সমস্যায় জর্জরিত সাবেকি বিচারব্যবস্থা সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সন্ত্রাসবাদীরা নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করছিল। তাদের সাথে এঁটে ওঠার জন্য প্রচলিত কিছু আইনের সংস্কার ও নতুন আইন প্রণয়ন করার খুব দরকার ছিল।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য কংগ্ৰেস আমলে ছিল টাডা আইন। বাজপেয়ীর আমলে সেটিই হল পোটা। সেই আইনটিকেই আরো আঁটোসাঁটো করে ইউ এ পি এ Unlawful Activities (Prevention) Amendment Act ও জাতীয় তদন্ত সংস্থা আইন বা National Investigation Agency Act আনা হল।
আমাদের দেশে গোয়েন্দা সংস্থার অভাব নেই। প্রতিটি রাজ্য সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ ও সেনাবাহিনী ছাড়াও আধাসামরিক বাহিনী, রেলরক্ষী বাহিনী ও উপকূলরক্ষী বাহিনীর নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ রয়েছে, কিন্তু তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় বড় একটা হয় না। এক সংস্থার তথ্য অন্য সংস্থা জানতে পারে না। একটি নাশকতামূলক কাজ ঘটে যাবার পর আমাদের দপ্তরে যে রিভিউ মিটিংগুলি হত তাতে এই গোয়েন্দাসংস্থাগুলির মধ্যে বোঝাপড়ার অভাবটাই প্রকট হয়ে উঠত।
আমরা বারবার বলতাম যে এমন একটি সংগঠন খুব দরকার যারা বিভিন্ন সংস্থা থেকে ইনপুটস নিয়ে দেশবিরোধী শক্তির মোকাবিলা করবে ও তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দিতে পারবে। একটি জাতীয় সুরক্ষা সংস্থা তৈরি করতেই হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবার এন আই এর বিষয়ে ছাড়পত্র দিয়ে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবিকেই যেন স্বীকৃতি দিলেন।
সিদ্ধান্ত হল, জাতীয় সুরক্ষার সঙ্গে যেসব বিষয় জড়িত, এন আই এ তাই নিয়ে তদন্ত করে আদালতে মামলা চালাবে। এতে সি বি আইএর ওপর অনেকটাই চাপ কমবে।
এই সংক্রান্ত আইনগুলির বিভিন্ন ধারা ও উপধারাকে ঠিকমত সাজিয়ে তুলতে আমরা অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দায়িত্ব ছিল ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি নামক সম্পূর্ণ নতুন একটি সংস্থার জন্ম দিয়ে তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শক্তপোক্ত একটি সাংগঠনিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো। এটিকে এমনভাবে তাকে সাজাতে হবে যাতে এন আই এ অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলির থেকে সর্বোচ্চ সাহায্য পায়, কিন্তু তার কার্যক্ষেত্র ও পরিধি যথাসম্ভব আলাদা থাকে। এটা যথেষ্ট কঠিন কাজ।
আমার মনে আছে, এই কাজগুলি করতে গিয়ে একবার একটানা তিনদিন আমি পর্যাপ্ত ঘুমের সুযোগটুকুও পাইনি। বাড়িতে আমার ছেলের সাথে আমার দেখা হত খুব কম।
আমি দেখেছি,আমাদের দেশের গ্ৰাম্য পোস্ট অফিস থেকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর — সব সরকারী দপ্তরের সাধারণ নিয়ম হল, কোন কর্মী যদি কাজ করতে চান, তবে তার কাজের অভাব হবে না। আমার ওপর সহকর্মীরা ভরসা করতেন আমার স্মৃতিশক্তি ও বিরামহীনভাবে কাজ করে যাওয়ার ক্ষমতার জন্য। আমি তখনও বুঝতে পারিনি আমার এই দিনরাত অফিসে পড়ে থাকা কিছু ক্ষমতাশালী লোক ভাল চোখে দেখছে না।
জঙ্গিবিরোধী আইনগুলির খসড়া তৈরী করে তার কপি আমরা ক্যাবিনেটের কাছে অনুমোদনের জন্য জমা দিয়েছিলাম। এরপর আমাদের খসড়াগুলিকে আরো নিঁখুত করার জন্য চলেছিল আইনমন্ত্রকের অফিসারদের সাথে দীর্ঘ বৈঠক। এই দুটি বিল সংসদে আনা হল ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। ২০শে ডিসেম্বর তা পাশ হল। আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এবার বিলদুটি রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেলেই আনুষ্ঠানিকভাবে আইন হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। আমি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষা দপ্তরের যুগ্ম সচিব এই সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে গেলাম। সেখানকার সেকশন অফিসার আমারই মত একজন তামিল, তিনি আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করলেন। আমাদের মন্ত্রকের তরফ থেকে আমরা বিলের কাগজপত্র বিধিসম্মতভাবে জমা দিলাম। রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করে দিলেই কিছুদিন পরে আবার সব কাগজপত্র নিয়ে মায়াপুরীতে সরকারি প্রিন্টিং ডিভিশনে ছুটতে হবে আমাদের, গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশিত হলেই আইনদুটি সারাদেশে বলবৎ হয়ে যাবে।
রাষ্ট্রপতি ভবনের কাজ শেষ হয়ে গেল। এবার বাড়ি ফেরার পালা। যুগ্ম সচিবকে বিদায় জানিয়ে আমি গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
দ্বারকা মোড়ের টি পয়েন্টের কাছে এসে লক্ষ্য করলাম যে আরোহীসমেত চারটি বাইক আমাকে অনুসরণ করছে। আমার প্রবল অস্বস্তি শুরু হল।
সেক্টর ১৬ বির কাছে একটি পুলিশ চৌকি রয়েছে। আমি তাদের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে কর্তব্যরত পুলিশকর্মী রূঢ়ভাবে আমার লাইসেন্স দেখতে চাইলেন। মানিব্যাগ বার করে লাইসেন্স বের করতে গেলে ঐ পুলিশকর্মী ছোঁ মেরে আমার হাজার টাকা কেড়ে নিলেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে জুটল থাইয়ের ওপর ডান্ডার বাড়ি, নিজের পরিচয় দিয়েও কোন লাভ হল না। পুলিশের কাছে সাহায্য পাবার আশা আর নেই। আমি দেখছিলাম ঐ বাইক আরোহীরা অদূরেই দাঁড়িয়ে। আমি অত্যন্ত দ্রুত গাড়িতে উঠে গাড়িটা স্টার্ট করে ছিলাম। এরপর বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে লাগলাম এমনভাবে যাতে বাইক আরোহীরা আমার গতিবেগের সাথে পাল্লা না দিতে পারে। বিভিন্ন ঘুরপথ ব্যবহার করে বাড়িতে এসে পৌঁছলাম যখন, তখন আমি বিধ্বস্ত। রাতে খাবার সময় বৃদ্ধা মা আমার চেহারা দেখে বললেন, “বাছা, দেখে মনে হচ্ছে ভূতে তোমাকে কষে এক চড় মেরেছে।”
আমি পুলিশি হেনস্থার ঐ ঘটনাটি আমার অফিসে জানিয়েছিলাম ও অভিযোগ দায়ের করেছিলাম। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ই ফেব্রুয়ারি সেক্টর ১৯ এ পুলিশের ডিসির দপ্তরে ঐ ঘটনার সময়ে ডিউটি রোস্টারে যেসব বিট কনস্টেবল ও সাব ইন্সপেক্টরের নাম ছিল তাদের সকলকে আমার সামনে হাজির করানো হয় এবং উক্ত ডিসি অফিসের বারান্দায় একটি টি আই প্যারেড হয়। আমি কিন্তু কাউকে শনাক্ত করতে পারিনি। এরপর প্রায়ই পুলিশের কিছু ইন্সপেক্টরকে আমার কাছে এনকোয়ারির জন্য পাঠানো হত, এবং আমাকে প্রতিবার পুরো ঘটনাটি নতুন করে আবার বিবৃত করতে হত। বিষয়টা একটা বিরক্তিকর পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এক অফিসার প্রায়ই এসে আমাকে কেসটি ক্লোজ করার বিষয়ে সহযোগীতা করতে অনুরোধ করতেন। এটি করাতে পারলে তার বিরুদ্ধে ভিজিলেন্সের তদন্ত বন্ধ হবে ও পদোন্নতির পথে আর বাধা থাকবে না। আমি নিরুপায় হয়ে তাঁর কেস ক্লোজ করার কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে দিই।
মুম্বই হামলার একমাত্র জীবিত জঙ্গি আজমল কাসভ যে আসলে পাকিস্তানের ফরিদকোটের ছেলে, এই পরিচয় প্রকাশ্য হয়ে পড়ছিল। কোন কোন অতি উৎসাহী পাকিস্তানী সাংবাদিক তার গ্ৰামের বাড়ীতে পর্যন্ত চলে গিয়েছিল ! কাসভকে জেরা করে অনেক নতুন তথ্য জানা যাচ্ছিল।
আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের OPS Room একটি বৈঠকের শেষে এক উচ্চপদস্থ অফিসার আমাকে গোপনে জানালেন যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা এজেন্সি আই এস আই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এক বা একাধিক আধিকারিককে অপহরণ করে পণবন্দী করার বিষয়ে ভেবে দেখছে। এই পণবন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে কাসভকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দিতে হবে কোন অজ্ঞাত স্থানে। ১৯৯৯ সালে আই সি ৮১৪ বিমান হাইজ্যাকিং করে আই এস আই এইভাবেই “জৈশ এ মহম্মদ” সংগঠনের প্রধান মৌলানা মাসুদ আজহার সহ অন্যান্য জঙ্গিদের ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল।
আমি পরে ভেবে দেখেছিলাম যে ওই সময় পর্যন্ত পাকিস্তান স্বীকার করেনি যে কাসভের সাথে তাদের কোন যোগ আছে। তাকে কোনভাবে সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সম্ভাবনা শেষ করে দিলেই আর পাকিস্তানের যোগাযোগের কোন প্রমাণ থাকবে না।
আমি বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলাম, ঐদিন যারা আমাকে অনুসরণ করছিল, তারা কারা ? অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও সরকার এই বিষয়ে তদন্ত করছে না কেন ?
২০০৯ সালে কৃতী আই এফ এস অফিসার এইচ. এস. পুরী রাষ্ট্রসংঘে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। সেই সময়ে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গিবিরোধী
তালিকা ( United Nations National Security Council Resolution 1267 list ) তৈরি হচ্ছিল। পুরী সেখানে দাউদ ইব্রাহিমের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জোর প্রচেষ্টা চালান। এতে দাউদের বেআইনি ব্যবসার ওপর মারাত্মক আঘাত হানা সম্ভব হত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের কালো তালিকায় নাম উঠলে দাউদ বেশিরভাগ দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আর ব্যবহার করতে পারবে না, কয়েকটি মহাদেশ জুড়ে তার বেআইনি আর্থিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে এবং তার নেতৃত্বাধীন মাফিয়াচক্রের অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা করার ক্ষেত্রে দুর্লঙ্ঘ আইনি বাধা তৈরী হবে।
অভিজ্ঞ কূটনৈতিক অফিসার পুরীসাহেব ভারত সরকারের তরফে ” রিসার্চ এন্ড এনালিসিস উইং” বা “র” ও আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে এই বিষয়ে অবহিত করেন। “র” এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অফিসাররা নড়েচড়ে বসেন। আমার মনে আছে, আমরা সেসময় খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। এটা ছিল দাউদকে নিস্ক্রিয় করে দেওয়ার এক সুবর্ণসুযোগ।
আমরা “র” এবং ইন্টেলিজেন্স ব্যূরোর থেকে দাউদ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য চেয়ে পাঠালাম। কিন্তু এই দুটি সংগঠন হল গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের কাজ খবর যোগাড় করা, প্রমাণ নয়।
দাউদের অবৈধ কার্যকলাপ সম্পর্কে যদি কোন সরকারী সংস্থা অকাট্য প্রমাণ যোগাড় করতে পারে, যা আন্তর্জাতিক ফোরামে গৃহীত হবে, সেটি হল সিবিআই। সেইসময়ে সিবিআই অফিসাররা এমন ভাব দেখাতেন, যেন তারা দাউদের বিরুদ্ধে যাবতীয় তথ্যপ্রমাণের পাহাড়ের ওপর বসে আছেন !
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পক্ষ থেকে সিবিআইকে দাউদ ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ জমা দিতে বলা হল। আমরা এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবার জন্য মাঝেমাঝেই বৈঠক করতে লাগলাম। সেই বৈঠকে র, আই বি, বিদেশমন্ত্রক ও অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিরা যোগ দিলেও সিবিআই থেকে কেউ আসতেন না। বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদম্বরমকে রিপোর্ট করেও কোন ফল হয়নি। আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফ থেকে সিবিআইকে বারবার “রিমাইন্ডার” পাঠালেও তাদের তরফ থেকে কোন সাড়া না পাওয়ায় এই উদ্যোগটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল।
২০০৮ সালে মুম্বই হামলার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনা ভেস্তে যাবার পর ২০১১ সালের মার্চে আবার তা শুরু হয় দিল্লিতে। ঠিক হয়, দুই দেশের সরকার পরস্পরকে পলাতক অপরাধীদের সম্পর্কে ফাইল ( dossier ) বিনিময় করবে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বিভাগ এর আগে নিঁখুতভাবে ২০০৬, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে এই ধরনের বিস্তারিত নথি তৈরী করেছিল। কিন্তু এবার ঐ ডসিয়ের তৈরীর দায়িত্ব দেওয়া হল চিদম্বরমের প্রিয় এন আই এ কে। সদ্যগঠিত এন আই এর অফিসাররা একটা হামবড়া মনোভাব নিয়ে চলতেন। তারা কারো থেকে সহযোগিতা চাইলেন না। কিন্তু দেখা গেল ঐ ডসিয়েরে দুটি এমন নাম রয়েছে, যাদের পাকিস্তানে পলাতক হিসাবে দেখানো হলেও তাদের সাম্প্রতিক অবস্থান মুম্বইয়ের জেলে ! এই ঘটনার পরে ভারতের তরফে প্রস্তুত নথিগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল।
চিদম্বরম অবশ্য মুম্বই পুলিশ ও আই বির মধ্যে প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করে বিবৃতি দিলেন। দুজন সাব ইন্সপেকটরকে সাসপেন্ড করা হল। ব্যস, এইটুকুই !
আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আপত্তি সত্ত্বেও আল জাজিরা নিউজ চ্যানেলকে ভারতে সম্প্রচারের অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হল। তারা কাশ্মীর ও অন্যান্য সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে একপেশে, অসত্য রিপোর্টিং করত।
আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বড় বড় পরিকল্পনা রূপায়ণের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছিল। উপকূলবর্তী রাজ্যগুলিকে নজরদারির জন্য অত্যাধুনিক বোট দেওয়া হলেও সেটি চালনা করার উপযুক্ত কর্মী দেওয়া হয়নি। রাজ্য সরকারের লোকদের সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে বোটগুলিকে সঠিকভাবে ব্যবহার ও রক্ষনাবেক্ষন করার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। একই অবস্থা ছিল “মেগাসিটি পুলিশ” ও “মরু পুলিশ” প্রকল্পের। প্রচুর ঢক্কানিনাদ সহকারে শুরু হওয়া CCTNS (Crime and Criminal Tracking Network System) , Natgrid ও NCTC র অবস্থাও হয়েছিল শোচনীয়।
২০০৯ সালে মন্ত্রকের পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ নিয়ে তীব্র মতভেদ দেখা গেল। আমরা চেয়েছিলাম দীপক সালভির মত সফল, অভিজ্ঞ ক্রিমিনাল লইয়ারকে, যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণের বেশিরভাগ আসামীদের কনভিকশন করিয়েছেন, এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় দুজনের মৃত্যুদন্ড হয়েছে।
কিন্তু বিস্ময়ের সাথে দেখলাম মন্ত্রী ও বশংবদদের সুপারিশে সিবিআইয়ের আইনজীবী রোহিনী সালিয়ানকে নিযুক্ত করা হল। এই রোহিনী সালিয়ান ২০০৬ সালের মালেগাঁও বিস্ফোরণে মহারাষ্ট্র সন্ত্রাসদমন শাখা ও সিবিআই যে নজন সংখ্যালঘু যুবককে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছিল, তাদের মুক্তির জন্য আদালতে সওয়াল লাগলেন !
এন আই এর ডিরেক্টর জেনারেল নিয়োগ করার সময়ে দপ্তরের দুজন জয়েন্ট সেক্রেটারীর কোন পরামর্শ মন্ত্রী চিদম্বরম নেননি। এই নিয়ে আমাদের মন্ত্রকে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা বাড়তে লাগল।
আমাদের এত উদ্যোগ সত্ত্বেও এন আই এ শেষপর্যন্ত একটি মাথাভারি সরকারী অফিসে পরিণত হল !
আমার কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল। পুরনো অফিসারদের একটু একটু করে নিস্ক্রিয় করে দেওয়া হচ্ছিল। এই সময় একটি ঘটনা ঘটল।
পুলিশ যে জাল নোটগুলো বাজেয়াপ্ত করত, সেগুলির একটি বড় অংশের রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব এক পর্যায়ে আমাদের দপ্তরের ওপর আসত। দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে আমাকে ঐ বাজেয়াপ্ত নোটগুলি মুম্বইতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সদর দপ্তরে জমা দিতে হত। তাঁরা সেগুলি পরীক্ষা করে একটি রিপোর্ট দিতেন, যেটি তদন্তের কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে বিবেচিত হত। এত বিপুল পরিমাণ নোট রাখার জন্য আমার বেশ কিছু আলমারি দরকার ছিল। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিভিশনকে বেশ কিছু আলমারীর রিকুইজিশন দিলাম। কিন্তু ঐ ডিভিশনের ডিরেক্টর নানা কারন দেখিয়ে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখতে লাগলেন। আমি বুঝলাম, পরিকল্পিতভাবে অসহযোগীতা শুরু হয়ে গেছে।
আমার চেম্বারের বাইরে আমার স্টাফরা বসতেন। কিন্তু সেখানে হঠাৎ পুলিশ ট্রেনিং সেকশনকে ঢুকিয়ে অনেকটা পরিসর দখল করে নেওয়া হল। সেকশনের দায়িত্বে ছিলেন একজন মহিলা অফিসার। একদিন সকালে আমার কাছে হাতের লেখার স্পেসিমেন চাওয়া হল। সেই নমুনা জয়েন্ট সেক্রেটারির কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হল। কিছুদিন পরে আমি জানতে পারলাম যে পুলিশ প্রশিক্ষন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই মহিলা অফিসার আমার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছেন। তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে নাকি কন্ডোমের প্যাকেটের সঙ্গে অশ্লীল চিঠি পাওয়া গেছে ! আমার বিরুদ্ধে “বিশাখা গাইডলাইন” অনুযায়ী আভ্যন্তরীণ বিভাগীয় তদন্ত হল। কিন্তু তাতে আমার দোষ কিছুই পাওয়া গেল না। পরবর্তীকালে আ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের এক কর্মী, যে আমার সাথে আগে “উদ্যোগ ভবন”এ কাজ করেছে, চুপিচুপি জানায় যে ঐ যৌন হেনস্থার ব্যাপারটি উচ্চপর্যায়ের কয়েকটি লোকের মস্তিষ্কপ্রসূত ষড়যন্ত্র ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি কর্মক্ষেত্রে ধীরে ধীরে একটি অবাঞ্ছিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছি। তারা আমাকে ওই দপ্তরে আর দেখতে চাইছিল না।
২০১০ সালের জুন মাসে আমাকে আভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বিভাগ (Internal Security Division) থেকে Central Board of Film Certification এ বদলী করে দেওয়া হল।
আমাদের সেক্রেটারি দীপ্তিবিলাসকে আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আমার প্রস্থানের পর আমাদের ডিরেক্টর সাহেবও লম্বা ছুটিতে চলে গেলেন। ঐসময় নাকি তার ছেলের পরীক্ষা চলছিল।
ফিল্ম সেন্সর বোর্ডে কিছুদিন কাজ করার পর আমি নগরোন্নয়ন দপ্তর ও পরে ভূমিরাজস্ব দপ্তরে ডেপুটি ল্যান্ড এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসাবে যোগ দিই।
আমি ভাবলাম এইবার আমি সমস্ত হেনস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছি।
এটি ছিল আমার চরম ভুল ধারনা।
আর. জি. ভি. মণি
“দ্য মিথ অফ হিন্দু টেরর ; এন ইনসাইডার এ্যাকাউন্ট অব মিনিস্ট্রি অফ হোম এ্যাফেয়ার্স ২০০৬ -২০১০)
বিতস্তা পাবলিশিং হাউস
২০১৮
( ক্রমশঃ )