“স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে আমার ডিরেক্টর ছিলেন একজন মার্কামারা নীরস আমলা। তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে আকর্ষণীয় কিছুই ছিল না। পদোন্নতি পেয়ে জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসাবে তাঁর নাম প্যানেলভুক্ত হলেও পোস্টিং পাননি বলে মেজাজটা সবসময় তিক্ত হয়েই থাকত।
একবার আমার সাথে তাঁর ভালোমত মনোমালিন্য হল। তিনি আমাকে একটা শিক্ষা দিতে চাইলেন। তাঁর সুপারিশে আমি বদলি হয়ে গেলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষা ( Internal Security ) বিভাগে। আমি আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে সেখানে নিযুক্ত হলাম।
যেদিন আমি নতুন অফিসে গিয়ে কার্যভার গ্ৰহণ করি, সেদিন আমার পূর্বসূরী আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি বহুদিন ধরে চেষ্টা করছিলেন এই অফিস থেকে বদলী নেবার। অতি দ্রুত তল্পিতল্পা গুটিয়ে যেভাবে অফিস থেকে প্রস্থান করলেন, দেখে মনে হচ্ছিল যেন ঐ জায়গাটা ত্যাগ করে বেঁচে গেলেন। প্রটোকল অনুযায়ী আমাকে চার্জটুকু পর্যন্ত বুঝিয়ে দেবার কথা তাঁর মনে ছিল না !
আমার কাজটা ছিল পরিশ্রমসাধ্য। ভুলত্রুটি দেখিয়ে দেবার মত কেউ ছিল না। আমি নতুন অফিসে এসে নিজের চেষ্টায় যথাসম্ভব কাজ শিখে নেবার চেষ্টা করছিলাম।
সংসদে দুধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, একটি তারকাচিহ্নিত, অপরটি অচিহ্নিত। তারকাচিহ্নিত প্রশ্নের লিখিত উত্তর দেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী। নানা নথিপত্র ঘেঁটে সেই প্রশ্নের উত্তর তৈরী করে দেবার দায়িত্ব মন্ত্রকের আধিকারিকদের। সংসদীয় রাজনীতিতে এইসব প্রতিবেদন হয়ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আই এ এসরা ব্যঙ্গ করে এর নাম দিয়েছিলেন “জবাব ফেঁকনা” ! ( উত্তর ছুঁড়ে মারা )
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে আমাকে লোকসভা ও রাজ্যসভার question, motion ও calling attention notice এর জবাব তৈরী করে দিতে হত। সংসদের অধিবেশন চলাকালীন প্রায় রোজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সংক্রান্ত অগণিত প্রশ্ন সংসদের অফিস থেকে আমাদের পাঠানো হত।
কয়েকদিন আগেই ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে জঙ্গি হামলা হয়ে গিয়েছিল। সংসদ এই ইস্যুতে তখন সরগরম, বিরোধী দলের প্রচুর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছিল সরকারকে। এই সূত্রে আমাদের কাজ বাড়ছিল।
ইতিমধ্যে বেনারসের সংকটমোচন মন্দির ও ক্যান্টনমেন্টে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। আমি রাজ্য সরকারের কাছ থেকে তথ্যসংগ্ৰহ করে একটি বয়ান প্রস্তুত করি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক হিসেবে । স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর নিন্দাসূচক বিবৃতিতে আমার দেওয়া কিছু তথ্য ব্যবহার করেছিলেন, তা মনে আছে।
২০০৬ সাল থেকেই একের পর এক জঙ্গি আক্রমণ ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়তে থাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
দিল্লীতে তিনটি বিস্ফোরণ ঘটার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে বিবৃতি দিলেন, সেখানে কেবল স্থান, সময় আর হতাহতের সংখ্যাটুকু বসিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকিটা হুবহু আগের বিবৃতির অনুকরণ। “পাইওনিয়ার” পত্রিকা বিষয়টি সর্বপ্রথম আলোকপাত করেছিল। তারা কটাক্ষ করে লিখেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি আগে থেকেই লিখিত বয়ান ছাপিয়ে রেখেছেন এবং কোথাও জঙ্গি হামলা হলেই তা সাংবাদিক সম্মেলনে পড়ে শোনাচ্ছেন !
ওই বছরেই ঔরঙ্গাবাদে উদ্ধার হল প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক। কয়েকজন ধরা পড়ল। তাদের উদ্দ্যেশ্য ছিল, মহারাষ্ট্রের কয়েকটি জায়গায় আঘাত হানা এবং নাগপুরে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদর দপ্তর আক্রমণ করে সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে খুন করা । এসব করলে দেশজুড়ে অস্থিরতা তৈরী হবে।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ক্রমাগত যে খবর পাচ্ছিল তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে মহারাষ্ট্র জঙ্গিদের একটি খুব বড় লক্ষ্যবস্তু হতে চলেছে। ২০০৬ সালে নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দপ্তরে হামলা আমরা খবর পেয়েও ঠেকাতে পারিনি। তিনজন জঙ্গি সংগঠনের সদর দপ্তরে ঢুকতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
ঐ বছরের গ্ৰীষ্মে আমাদের মন্ত্রকের প্রায় সব বড় অফিসারই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নিতে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। সেইসময় আমি একদিন নর্থ ব্লকের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে কফি খাচ্ছিলাম। আমাদের মন্ত্রকের এক কর্মী হঠাৎ আমার সামনে হাজির হলেন। তিনি আমাকে এসে জানালেন যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অতিরিক্ত সচিব আমাকে খুঁজছেন। সচিবের অফিস ঐ বিল্ডিংয়েই। তাঁর সাথে দেখা করলে তিনি বললেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি বিশেষ দরকারে এক্ষুনি ডেকে পাঠিয়েছেন আমাকে। উক্ত সচিব আমার বিশেষ পরিচিত, আগে ডেপুটেশনে লোকসভা সেক্রেটারিয়েটে একসাথে কাজ করেছিলাম দুজনে।
আমি মন্ত্রীর ঘরে গিয়ে দেখলাম মন্ত্রী শিবরাজ পাটিল ছাড়াও আরো দুজন রয়েছেন। একজন হলেন মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিংহ। আরেকজনের কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গী দেখে তাঁকে পুলিশ অফিসার বলেই মনে হল। তিনি সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলা ও বিস্ফোরণ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চাইলেন। যেসব সংগঠন এসবের পেছনে জড়িত বলে রিপোর্টে লেখা রয়েছে, আমি তাদের নাম করলাম।
ওঁরা বারবার কিছু বিশেষ মতাদর্শের সংগঠনের জড়িত থাকার বিষয়ে কথা বলছিলেন। আমি বললাম এইসব সংগঠনের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষা দপ্তর কোন তথ্যভান্ডার তৈরী করে না। এই দায়িত্বে আছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের “Human Rights and National Integration” বিভাগ। তাদের দপ্তর দিল্লির খান মার্কেটে।
আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আধিকারিক, আমরা নিজেরা কোন তদন্ত করি না। বিভিন্ন নিরাপত্তা এজেন্সি, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পুলিশবাহিনী থেকে যেসব তথ্য পাই, তা দিয়েই আমাদের প্রতিবেদন তৈরী হয়। তাদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী আমরা ফাইল তৈরী করি। সেই ফাইলের ভিত্তিতে এইসব জঙ্গি হামলার পেছনে যেসব সংগঠন রয়েছে, তাদের নাম বললাম। একটি শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে ডিস্টেবিলাইজ করতে চাইছে। তারাই কিছু মানুষকে উসকে নাশকতামূলক কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই হামলাগুলি করাচ্ছে।
আমার জবাব শুনে ঘরে উপস্থিত কেউ তেমন খুশি হয়েছেন বলে মনে হল না।
ওই প্রশ্নকর্তা ব্যক্তিটির পরিচয় আমি পরে পেয়েছিলাম। সত্যিই তিনি একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক ছিলেন। পরবর্তীকালে ২৬/১১/২০০৮ এ মুম্বইয়ের সেই বিখ্যাত জঙ্গি হামলায় তিনি আততায়ীর গুলিতে মারা যান। তাঁর নাম ছিল হেমন্ত কারকরে।
২০০৬ এর জুলাই মাসে মুম্বাইয়ের ট্রেনে সাতটি বিস্ফোরণ হয়। এতে ১৮৭ জন মারা যান, ৮৭২ জন আহত হন।
৮ই সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওতে চারটি বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ৩১ জন মারা যান ও ৩২১ জন আহত হন। এই ঘটনাটি ঘটার পর আমি নাসিকের সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশের ( গ্ৰামীন ) থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়ে পাঠাই। স্থানীয় পুলিশের তদন্তে স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া বা সিমির লোকজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ এ সমঝোতা এক্সপ্রেসে তীব্র বিস্ফোরণ ঘটে। এতে নিহতের সংখ্যা ছিল ৬৮। পাকিস্তানের একটি করাচীভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন এর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছিল। এই বিষয়ে আমি পানিপথের সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ ( রেলওয়েজ এন্ড ক্রাইম ) এর থেকে তথ্যসংগ্ৰহ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করি।
১৮ই মে মক্কা মসজিদের বিস্ফোরণে ৯ জন মারা যান ও ৫৮ জন আহত হন। আমাদের তদন্তকারী সংস্থাগুলি লস্কর ই তৈবা ও জয়েশ এ মহম্মদের স্লিপার সেলগুলিকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। এই বিষয়ে তারা প্রমাণ সংগ্রহ করতে শুরু করে। দেশজুড়ে অভিযান চালিয়ে অনেককে আটক করা হয়েছিল। সমঝোতা এক্সপ্রেস ও মক্কা মসজিদের বিস্ফোরণ, উভয় ক্ষেত্রেই ৬ ভোল্টের ব্যাটারি ও কাস্ট আয়রনের পাইপ ব্যবহৃত হয়েছিল।
২৫ শে আগষ্ট, ২০০৭ হায়দ্রাবাদের লুম্বিনি পার্ক ও গোকুল চাট ভান্ডারে বিস্ফোরণ হয়। প্রথমোক্ত স্থানে ১২ জন ও দ্বিতীয় জায়গায় ৩১ জন মারা যান। এই ঘটনার সাথে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন হুজির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে বলে পুলিশের রিপোর্টে লেখা হয়।
১ .১. ২০০৮ এ রামপুরে সি আর পি এফ ক্যাম্প আক্রমণ করে লস্কর ই তৈবা জঙ্গিরা। আটজন মারা গিয়েছিল এতে।
দিল্লির ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল যারা, পুলিশ তদন্ত করে দেখেছিল এর পেছনে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ের একটি উগ্ৰ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। দিল্লী পুলিশের একটি দল সন্দেহভাজন জঙ্গিদের খোঁজে শাহীনবাগের কাছে ঘনবসতিপূর্ণ জামিয়ানগরে বাটলা হাউস নামে একটি বাড়িতে অভিযান চালায়। সংঘর্ষে বেশ কিছু সন্দেহভাজন তরুণ মারা যায়, এক ইন্সপেক্টরও গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনার পরে আমি খবরের কাগজে দেখেছিলাম কংগ্ৰেসের দিগ্বিজয় সিংহ এটিকে “ফেক এনকাউন্টার” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, পুলিশ বিশেষ উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নিরীহ ছেলেদের মেরে ফেলেছে।
২০০৮ সালের পর থেকেই মহারাষ্ট্র এটিএস বা সন্ত্রাস দমন শাখা মালেগাঁও বিস্ফোরণের তদন্তের দায়িত্ব হাতে পায়। সংবিধানের সপ্তম তফশিল অনুযায়ী কোন রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা হল রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়। এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কোন ভূমিকা নেই। এই এটিএসের দায়িত্বে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘরে আমার দেখা সেই অফিসার, হেমন্ত কারকরে।
কারকরের টিম তদন্তে আসার পরেই আমার মনে হয়েছিল যে তদন্তের অভিমুখ সম্পূর্ণভাবে বদলে যাচ্ছে । মিডিয়ায় এই প্রথম একটি বাক্য শোনা যেতে লাগল — ” হিন্দু সন্ত্রাস”।
সাধ্বী প্রজ্ঞা, শিবনারায়ণ কালসাঙ্গরা, স্বামী অসীমানন্দ ও একজন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্ণেল শ্রীকান্ত পুরোহিতকে গ্ৰেপ্তার করা হল। আমার স্পষ্ট মনে আছে মালেগাঁও বিস্ফোরণে ফিল্ড লেভেলে যে সব অফিসার তদন্ত করেছিলেন, তাঁদের চার্জশিটে “আহলে হাদিস” নামে একটি সংগঠনকে দায়ী করা হয়েছিল।
কিন্তু ঘটনা ঘটার দুবছর পরে নতুন তথ্যসূত্র পেয়ে কারকরের টিম ওই পূর্বোক্ত সংগঠনের ভূমিকাকে কোন গুরুত্ব দিতে চাইলেন না। কিন্তু তিনি তদন্তকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাতে নানান প্রশ্নের জন্ম হচ্ছিল। এই কেসটি সর্বভারতীয় মিডিয়ায় তুমুল প্রচার পেয়ে গেল, বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক চাপান উতোরও কম হল না।
২০০৮ সালের ২৬শে নভেম্বর দিনটি কেউ কখনও ভুলতে পারবে না। অনেকের মত আমার জীবনকেও তা ওলটপালট করে দিয়েছিল।
সেদিন সন্ধ্যায় আমি বাড়িতে টিভি দেখছিলাম। সেখানে দেখলাম মুম্বইতে বড় ধরনের জঙ্গি হামলা হচ্ছে। সব খবরের চ্যানেলগুলিতেই বলা হতে লাগল ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস, দুটি বড় হোটেল, একটি ক্যাফে এবং একটি আবাসনে ভয়ংকর সব কান্ড ঘটে চলেছে। প্রায় বারোটি জায়গা আক্রান্ত।
১৫ মিনিটের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কন্ট্রোল রুম থেকে আমার তলব চলে এল। সেইসময়ে আমাদের প্রায় সব উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা সরকারি কাজে পাকিস্তানে। দুদেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠকের বিষয় ; সন্ত্রাসদমন।
কন্ট্রোল রুমে পৌঁছে দেখলাম সেখানে তুমুল ব্যস্ততা। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বিদেশ দপ্তর, ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েট, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে প্রচুর কল আসতে শুরু করে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে দুজন জয়েন্ট সেক্রেটারি কন্ট্রোল রুমে চলে এলেন। আমরা যন্ত্রের মত একটানা কাজ করে যেতে লাগলাম।
কিভাবে এন এস জি কমান্ডোদের দিল্লি থেকে মুম্বাইয়ে নিয়ে আসা যায়, তাই নিয়ে প্রচুর সরকারি বার্তালাপ চলল। এসব কাজে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই গোটা পর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অত্যন্ত নিরাসক্ত বলে মনে হয়েছিল আমার। ওইসময়ে মুম্বইয়ে সেনাবাহিনীর মেরিন কমান্ডোর একটি দল প্রশিক্ষণের জন্য ঘটনাচক্রে ছিল। তাঁরা স্বরাষ্ট্র নয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে। তাঁদের দিয়ে তাজ হোটেলে অভিযান চালিয়েও তেমন লাভ হল না। পরের ঘটনাগুলো সকলের জানা।
হোম সেক্রেটারি পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পরেই ক্যাবিনেট সেক্রেটারীর আহুত একটি আপৎকালীন বৈঠকে যোগ দিতে চলে গেলেন। আমি তাঁর ব্যক্তিগত সচিবের কাছে আমার রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলাম।
একটি বিষয় যা অনেকেই জানেন না, তা হল — তাজ হোটেলে ঢুকে জঙ্গিরা যখন একে একে মানুষ খুন করছিল, সেই সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রবিভাগের অতিরিক্ত সেক্রেটারি চিৎকলা জুৎশী। তিনি ওই পাঁচতারা হোটেলে একটি ব্যক্তিগত নৈশভোজে যোগ দিতে গিয়েছিলেন।
আমার অবাক লাগে যে কয়েকদিন আগে থেকেই মহারাষ্ট্র সরকারকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পক্ষ থেকে ক্রমাগত সতর্কবার্তা পাঠানো হচ্ছিল আসন্ন জঙ্গিহামলা সম্পর্কে। সমুদ্র সংলগ্ন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, হোটেল, মন্ত্রালয়, মাতোশ্রী এবং ভি আই পি আবাসনগুলি বা অন্যান্য “হাই ভ্যালু টার্গেট”গুলির সুরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করার পরামর্শ সেখানে দেওয়া হয়েছে। এই রিপোর্ট নিশ্চিতভাবে চীফ সেক্রেটারি মারফত অতিরিক্ত সচিবের টেবিলেও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে চলে গিয়েছে। জঙ্গি হামলার আশঙ্কা সত্ত্বেও তিনি কেন ওই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাটিতে চলে গিয়েছিলেন,তা আজও ভেবে পাই না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কন্ট্রোল রুমে যারা কাজ করেন, তারা অধিকাংশই কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীর সদস্য। পিটার নামে এক সি আর পি এফের আ্যাসিস্টেন্ট কমান্ডান্ট সেসময় কন্ট্রোল রুমে মোতায়েন ছিল। সে পরে আমাকে হাসতে হাসতে বলেছিল, “স্যার, উনি কি সেদিন সেই জঙ্গি হামলার উদ্বোধন করতে ওই হোটেলে গিয়েছিলেন ?”
তাজ হোটেলে যে সব জঙ্গি হত্যালীলা চালাচ্ছিল, তাদের সাথে তাদের পাকিস্তানী হ্যান্ডলারদের নিয়মিত কথা হয়ে চলেছিল স্যাটেলাইট ফোন মারফৎ। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেই কলগুলি ইন্টারসেপ্ট করে রেকর্ড করে রাখছিল। এই সংক্রান্ত ট্রান্সক্রিপ্টগুলি পরবর্তীকালে আদালতে প্রমাণ হিসাবে নথিভুক্ত হয়।
সেই রকমই একটি কথোপকথনে শোনা যায় —
“হ্যান্ডলার : আসসালামুয়ালাইকুম। তোমাদের হোটেলে তিনজন মন্ত্রী (ওয়াজির ) আর একজন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি রয়েছে। কিন্তু কোন ঘরে তারা রয়েছে সেটা বলতে পারছি না।
জঙ্গি ; আরে, এতো দারুন ব্যাপার।
হ্যান্ডলার ; ঐ তিনচারজনকে খুঁজে বের করে পণবন্দী কর। তাহলে ভারত সরকারের থেকে যা চাইবে পেয়ে যাবে।”
তাজ হোটেলে সেই সময়ে উপস্থিত এই “হাই ভ্যালু আ্যাসেট” সম্পর্কে পাকিস্তানে খবর চলে গেল কি করে ?
ঐ জঙ্গিরা সমুদ্রপথ দিয়ে ভারতের জলসীমায় প্রবেশ করে। “কুবের” নামে একটি মাছধরা ট্রলার ছিনতাই করে তার টান্ডেল ( সারেং) কে মেরে তারা কোলাবায় আসে। তারপর রবাবের ডিঙিতে চড়ে মচ্ছিমার কলোনিতে নামে। হাঁটতে হাঁটতে তারা বাধওয়ার পার্কে চলে আসে। তারপর তারা মুম্বইয়ের শহরাঞ্চলে ঢুকে পড়ে নির্বিচারে হত্যালীলা চালায়। ঘটনার এতদিন পরেও এইগুলো শুনতে রূপকথার মত লাগে।
আমি যতদূর জানি, মুম্বই উপকূলের মৎস্যজীবিদের এলাকায় অচেনা কেউ ঢুকলেই তারা সচকিত হয়ে যায়। সেখানে এরা দৃষ্টি আকর্ষণ না করে হাঁটতে হাঁটতে নিরুদ্বেগে শহরের অভ্যন্তরে হানা দিল,এটা বিশ্বাস করা কঠিন। কোন শক্তিশালী লোকাল নেটওয়ার্ক ছাড়া এই কাজ সম্ভব নয়। কিন্তু এই নিয়ে সঠিকভাবে তদন্ত হল কোথায় ?
২৬.১১.২০০৮ এর বীভৎস জঙ্গি হামলার পর আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অফিসারদের জীবনটাই যেন বদলে গিয়েছিল। উত্তাল সংসদে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, আর রুটিনমাফিক তার জবাবী নোট তৈরি করে দিতে দিতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম। আমাদের তৈরী করা নোটের ওপর ভিত্তি করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরোধীদল ও মিডিয়াকে মোকাবিলা করতেন। তবে তিনি যেভাবে কথা বলতেন, তাতে দেশবাসীর কাছে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছিল।
সারা দেশজুড়ে কেন্দ্রীয় পুলিশবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক যেন অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
আমি বুঝতে পারতাম ক্যাবিনেট সেক্রেটারি, হোম সেক্রেটারি ও বিভিন্ন উচ্চস্তরের আমলাদের নিয়ে যে রুদ্ধদ্বার বৈঠকগুলি হচ্ছে, তাতে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সেই সময়ে অনেক নথি আর ফাইল টেনে টেনে আবার বার করা হতে লাগল। এইসূত্রে বিশেষভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটি বিষয়। আমাদের দেশের বাইরে বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা “র” ও আভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা “আই বি” নিরন্তর কাজ করে চলেছে। রিপোর্ট পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায় যে এই গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ঘটনার আগেই সমুদ্রপথে জঙ্গি অনুপ্রবেশ ও আক্রমনের পূর্বাভাস দিয়েছে।
তাদের গোপন রিপোর্টে সেই জঙ্গিদের আসার একটা রুটম্যাপ পর্যন্ত দেওয়া আছে ! পরবর্তীকালে এও দেখা যাচ্ছে যে জঙ্গিরা মোটামুটি সেই রুটটিই ব্যবহার করেছিল। গোয়েন্দা সতর্কবার্তা পেয়ে আমাদের উপকূলরক্ষী বাহিনী ( Coast Guard ) স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই রুটে নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এই কাজকে সমর্থন তো দূরে থাক, উচ্চতম প্রশাসনিক মহল থেকে নির্দেশ এসেছিল, এ ব্যাপারে “সংযম” ( restraint ) রক্ষা করার। এই অনভিপ্রেত ঘটনাটি না ঘটলে মুম্বইয়ের নাশকতায় ১৬৬ জনের মৃত্যু হত না।
আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর মধ্যে আন্তরিকতা ও পেশাদারীত্বের অভাব নেই। কিন্তু বিভিন্ন কারনে শাসনক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের ফলে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না।
উত্তরপ্রদেশে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট চত্বরে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় এলাহাবাদ হাইকোর্টে একটি সুয়ো মোটো কেসের জবাবে ( ৫ই জানুয়ারি,২০০৮) যে এফিডেভিট আমি মন্ত্রকের তরফ থেকে দাখিল করেছিলাম, তাতে এই পর্যবেক্ষণের কথা আমি লিখে দিয়েছিলাম।
আমি বিস্ময়ের সাথে এও লক্ষ্য করলাম, দেশের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী এ আর আন্তুলে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বললেন যে এই মুম্বই হামলা গৈরিক সন্ত্রাসবাদীদের কাজ। হেমন্ত কারকরে মালেগাঁও বিস্ফোরণের তদন্ত করতে গিয়ে একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের রাঘববোয়ালদের প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছিলেন বলেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল। কমলনাথ ও দিগ্বিজয় সিংহ তাঁকে সমর্থন করলেন। পাকিস্তানে সংবাদ চ্যানেলগুলিতে এই হামলা “হিন্দু জিওনিস্ট”দের ষড়যন্ত্র বলে প্রচারিত হতে লাগল। এদেশের বেশ কিছু উর্দু সংবাদপত্র ও সোসাল একটিভিস্টরাও একথা প্রচার করতে শুরু করলেন। এই নিয়ে কয়েকটি বইও বেরোল।
দীর্ঘদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকার পর আমি একটি পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাই। সেইসময়ে অফিস থেকে জরুরি ফোন পেয়ে আমার কর্মক্ষেত্রে গিয়ে দেখি, সেখানে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক এসে ইতিমধ্যেই হাজির হয়েছেন। সকলের মুখ বেশ থমথমে। কিছুক্ষণ পরে ঘোষণা হল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করছেন।
আর. ভি. এস. মণি
“দ্য মিথ অফ হিন্দু টেরর ; এন ইনসাইডার এ্যাকাউন্ট অব মিনিস্ট্রি অফ হোম এ্যাফেয়ার্স ২০০৬ -২০১০)
বিতস্তা পাবলিশিং হাউস
২০১৮
( ক্রমশঃ )