পর্ব_১

জিজাবাই পথ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে গর্ভ যন্ত্রনায় কেঁদে উঠলেন। দীর্ঘ পথ অশ্বারোহন করে চলার কারনে দেহ অশক্ত হয়ে পড়ে। বেশি দূর এই ভাবে চললে পথ কষ্টে গর্ভে আসা সাতমাস বয়সী ভ্রূণের ক্ষতি হতে পারে। ফলত , জিজাবাই আর বিজাপুরের দিকে এগোতে চান না। ওই দিকে বিজাপুর যাওয়া কূটনৈতিক দিক থেকে একান্তই জরুরী… তাই পথি মধ্যে জিজামাতার দায় একশত অশ্বারোহী সৈন্যের উপর দিয়ে , জিজামাতাকে পরিত্যাগ করে শাহাজী , জ্যেষ্ঠ পুত্র শাম্ভজী দ্রুত বিজপুরের দিকে অগ্রসর হন।

শাহাজী গর্ভবতী জিজামাতাকে পথের ধুলায় পরিত্যাগ করে চলে গেলেন। পরদিবসের ভৈরবী প্রাতে জিজাবাইয়ের পিতা লুখজী জাধব মুঘল সৈনিক সমেত সেখানে আগমন করলেন। পূর্ব দিনই লুখজী মেয়ে ও জামাতাকে বন্দী করার জন্য পশ্চাৎ ধাবন করেছিলেন। সে এক বিশাল জ্ঞাতি শত্রুতা। সে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। সে অন্য একদিন বলব খনে….যা হোক পথের মাঝে অসুস্থ ও অশক্ত জিজাকে পেয়ে প্রথমে তাঁর দায় নিয়ে অস্বীকার করলেন। কিন্তু একে রাজরক্ত তায় সনাতনী …জিজাবাই অতীব পবিত্র মহিলা …জিজাকে দেখে মুঘল সৈনিকদের লোলুপ দৃষ্টি লুখজীর চোখ এড়াল না। পাছে কন্যার উপর ওইসব ম্লেচ্ছ সৈনিক গুলো অত্যাচার করে , হাজার হোক নিজের অপত্য তো! এইসব ভয়ে দ্রুত কন্যাকে বন্দিনী করে #সিউনারী দুর্গে প্রেরণ করলেন।

সিউনারী পুনা থেকে প্রায় ২৫ ক্রোশ উত্তরে অবস্থিত। এরই সংলগ্ন নগরের নাম ছিল জুন্নর। দুর্গটি সিউনারী নামে অভিহিত …

জিজাবাই বড় ব্যথিত হলে পিতার ব্যবহারে । একবার কন্যা বলে কাছে নিলেন না পিতা। তাঁর হৃদয় কষ্টে আন্দোলিত হতে লাগল। যুদ্ধের লোমহর্ষক স্থান হতে ঈশ্বর কৃপায় তাঁর প্রাণ , মান ও গর্ভের সন্তান রক্ষিত হয়েছে। প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়তর পতি কর্তৃক পরিত্যক্তা ও প্রবল রাজনৈতিকবাত্যাবিপর্যস্ত হয়ে সিউনারী দুর্গে বন্দিনী ,সঙ্কটাপণ্ন অবস্থাতে জিজামাতা নিজের আত্মসংযমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন।

অভিমান, বিদ্বেষ, হিংসা, ক্রোধ ইত্যাদি নিম্ন বৃত্তিকে ধীরভাবে দমন করে সর্বনিয়ন্তা পরমেশ্বরের উপর আত্মসমর্পন করেন। জিজাবাই শিশুকাল হতেই যুদ্ধের নানা আলোচনা ,তোপ , রণবাদ্য ইত্যাদি শুনে অভ্যস্ত ছিলেন। বিবাহ হয়েছিল যখন তখন তিনি খুবই ছোট। তাই বিবাহের পরও অবস্থার পরিবর্তন না হয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি দুবার যে গর্ভ ধারণ করেন , কর্ণের ন্যায় তাঁর গর্ভস্থ সন্তানরাও যুদ্ধের কথা শুনে শুনে বোধয় মহান যোদ্ধায় পরিনত হয়েছিল। দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে আসার সঙ্গে যুদ্ধজাত পরিস্থিতি আরো গভীর হয়। ফলত যুদ্ধ ও কূটনৈতিক আলোচনা , স্থান হতে স্থানান্তরে গমন করতে করতে তাঁকে দিবারজনী অতিবাহিত করতে হত। যথাসময়ে খাদ্য পেতেন না, বিশ্রাম পেতেন না। অনেক সময় বুভুক্ষ অবস্থায় দিন যাপন করতে হত। কখনো তিনি বিজয় সংবাদ পেয়ে আনন্দিত হতেন , কখনো পরাজয়ের গ্লানি তাঁর হৃদয়কে বিদীর্ণ করত। ফলে , তাঁর গর্ভের দ্বিতীয় সন্তান গর্ভের মধ্য হতে মানবজীবনের নানা প্রকার অবস্থা ভোগ করতেন।

সিউনারী দুর্গে আগমন করে জিজামাতা দুর্গাধিষ্ঠাত্রী শিবাইদেবীর মন্দিরে পূজাঅর্চনা করে দিনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করতেন। ভগবতীএ নিকট বীরকুলতিলক একটি সন্তানরত্ন কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতেন। সন্তান প্রসূত হলে ভগবতীর নামানুসারে তাঁর নামকরণ করবেন এইরূপ মানস করে তিনি সর্বদা ব্রাহ্মনগনের পূজা ,দান, ধ্যান, উপবাস ও ব্রতানুষ্ঠানে নিযুক্তা থাকতেন।

একরাত্রিতে তিনি দেবীর নিকট ধ্যান করতে করতে সেখানেই নিদ্রামগ্না হলেন।এমন কিংবদন্তি শোনা যায় যে তিনি সে সময় নীলকন্ঠ মহাদেবের দর্শন পান। মহাদেব তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন , ” জিজা। তোমার নিষ্ঠা ও আচরণে আমি খুবই প্রসন্ন হয়েছি। আমি তোমাকে নিজের মাতা রূপে গ্রহণ করলাম। আমি তোমার সন্তান রূপে জন্ম নেব ও নানা প্রকার অলৌকিক কার্য সম্পন্ন করব। দ্বাদশ বৎসর বয়স পর্যন্ত আমাকে তুমি চক্ষুর অন্তরালে করো না। তদনন্তর আমাকে যদৃচ্ছাক্রমে যথা তথা ভ্রমন করতে দেবে।”

জিজাবাই প্রাতঃকালে গাত্রোত্থানপূর্বক স্বপ্নের কথা চিন্তন করে যারপরনাই খুশি হলেন। তিনি দরিদ্র ও ব্রাহ্মন গণকে দান ধ্যান , ভোজন করিয়ে ,পূজা অর্চনায় সেইদিন যাপন করলেন। এইরূপে কিছুকাল অতিক্রান্ত হল।

যথা সময়ে জিজাবাই এক অপরূপ সুন্দর, গুণসম্পন্ন পুত্রের জন্মদান করলেন। ১৫৪৯ শকে অর্থাৎ ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে , প্রভব নামক সম্বৎসরে বৈশাখী শুক্লা দ্বিতীয়ায় বৃহস্পতিবারে বন্দিনী মাতার ক্রোড়ে ,সিউনারী দুর্গে সেই অসম্ভব শক্তি ও গুণসম্পন্ন পুত্র আঁধারকে আলোকিত করে ভূমিষ্ঠ হলেন।দুর্গাধিষ্ঠাত্রী শিবাই দেবীর নামানুসারে পুত্রের নামকরণ রক্ষিত হল #শিবাজী।

শিবাজীর জন্মতিথি নিয়ে কোনো কোনো স্থানে মতভেদ আছে। মহ্লার রাও বলেছেন যে , সেই উত্তম পুরুষ শিবাজীর জন্মকালে ছয়টি গ্রহ উত্তম স্থানে ছিল। সভাসদের হিসাবের পরিশিষ্টে কোষ্ঠী ছিল নিম্ন লিখিত –
মিথুন লগ্ন, মেষে রবি ও বুধ, বৃষে চন্দ্র ও শুক্র ,কৰ্কে বৃহস্পতি, সিংহে রাহু, বৃশ্চিকে শনি, মকরে মঙ্গল ও কুম্ভে কেতু।

শিবাজীর ভূমিষ্ঠ হবার সংবাদ বার্তাবাহক কর্তৃক শাহাজী নিকট পৌঁছলে তিনি সকল রাগ অভিমান বিস্মৃত হলেন। দূতকে সুবর্ন বলয় এবং ব্রাহ্মন , দরিদ্রদের প্রচুর অর্থ ,ভোজ্য প্রদান করলেন।

শাহাজী হৃদিঅন্দরে কেবল বদ্ধমূল ধারণা উপলব্ধি করতে লাগলেন যে, তাঁদের বংশে যে মহাপুরুষ জন্মগ্রহণের ভবিষ্যৎ বাণী আছে …এই সর্বস্ব সুন্দর ও গুন সম্পন্ন, সুলক্ষণ যুক্ত বালকই সেই মহাপুরুষ।

ক্রমশঃ

দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ছত্রপতি মহারাজ শিবাজীর জীবন চরিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.