“যাই বল ভাই, এগুলো কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। এরকম হিন্দু-মুসলিম আলাদা করা কি ঠিক? আমরা তো সবাই ভাই-ভাই বল?” বলতে বলতে তিনটি ছেলে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে। সময়টা সন্ধ্যাবেলা। চারিদিকে বেশ ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। আগামীকাল তাদের গ্রামের মন্দিরের ভূমি পূজা।
“কোনগুলো ঠিক হচ্ছে না ভাই?” বলতে বলতে রাহুল নদীর তীরে সিঁড়িতে গিয়ে বসল।
অমল, সন্দীপ আর রাহুল — তিন বন্ধু এবছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে স্নাতক স্তরে ভর্তি হয়েছে।
রাহুল নীচের একটা সিঁড়িতে বসতে বসতে কাব্যিকভাবে বলে উঠলো, “মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, হুঁ, এই লাইনটাই ভুলে গেছে রে সব।” গলায় যেন হতাশার সুর।
অমল বলল, “আমি তো ভাই একটা কথাই মানি, সব ধর্মই সমান। আমার কালী পূজার বলির পাঁঠা খেতেও যেমন অসুবিধা নেই, ঠিক সেরকম ঈদের কুরবানীর গোশত খেতেও অসুবিধা নেই”।
তার এই কথা শেষ হতেই আচমকা খিলখিল করে কে যেন হেসে উঠলো। বড্ডো মিষ্টি সে হাসির আওয়াজ। তিন জনেই চমকে উঠলো। এরকম নির্জন স্থানে কোনো মেয়ের হাসির আওয়াজ কী’ভাবে? ভয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে, ঠিক সে সময় আবার তীক্ষ্ণ অথচ সুমিষ্ট হাসির আওয়াজ। তারা চমকে পিছন ফিরতেই দেখলো, কোমর ছাপানো ঘন ঢেউ খেলানো চুল, লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে আনুমানিক ২০ বছর বয়সের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মুহুর্তের জন্য তিনজনেই সম্মোহিত হয়ে পড়ল। যেন সূঁচ পড়লেও শব্দ হয়, সময় যেন থমকে গেল খানিকটা। সম্বিত ফিরলো মেয়েটির কথায়, “তোমরা কলেজে পড়ো?” কী ভীষণ গমগমে কন্ঠস্বর!!
মন্ত্রমুগ্ধের মতো তিনজনে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো, “হ্যাঁ”।
“হুউউউউমমম” বলে দূরে গিয়ে একটা সিঁড়িতে বসে পড়ল মেয়েটি। মাটিতে তার লম্বা আঁচল লুটোপুটি খাচ্ছে।
তিনজনে এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে।
“আচ্ছা তোমরা গল্প শুনতে ভালোবাসো?”
সন্দীপ ভয় মিশ্রিত গলায় বলল, “হ্যাঁ”।
“আজ আমি একটা গল্প শোনাবো, শুনবে তোমরা?”
তিনজনে একে অপরের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
ঐ দীপ্ত কন্ঠস্বর আবার শোনা গেল, “বসো সবাই”। এ কন্ঠস্বর অমান্য করার সাহস কারো নেই। তারা চুপচাপ যে যার জায়গায় বসে পড়লো।
“হুম্“, একটু থেমে মেয়েটি শুরু করল, “সালটা তখন ১৯৪৬”, বলে এদিক ফিরে জিজ্ঞেস করল “তোমরা ইতিহাস পড়েছো তো সবাই?”
“হ্যাঁ, ও-ও-ঐ মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে যা যা ছিল”, তোতলাতে তোতলাতে বললো রাহুল।
— “অঅঅঅ”
— “ঠিক আছে”।
— “আচ্ছা তো আরেকটু আগে থেকেই শুরু করি, আমি গার্গী চট্টোপাধ্যায়, বাবা গ্রামের পাঠশালার শিক্ষক, গ্রামের একজন অন্যতম সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। বড্ড রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। ছোটো থেকেই দেখেছি বাড়িতে নিত্যদিন দান-ধ্যান লেগেই থাকতো। আমাদের বাড়ি থেকে কখনও কেউ খালি হাতে ফিরে যায়নি। আমার মা ছিলেন স্বয়ং অন্নপূর্ণা। তাদের একমাত্র মেয়ে ছিলাম আমি। গ্রামের সকলে আমায় বলতো, রূপে মা লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী মেয়ে। আমার মতো মেয়ে পেয়ে নাকি আমার বাবা মা ধন্য। কিন্তু সত্যিটা ছিল, এমন বাবা মা পেয়ে আমিই ধন্য ছিলাম।
বাবা চাইতেন আমি যেন পড়াশোনা করে একটা ভালো কিছু করতে পারি। দেশের নাম উজ্জ্বল করতে পারি। আমার লেখাপড়ার হাতেখড়িও হয় আমার বাবার কাছেই। সেই জন্য বাবার ইচ্ছে এবং নিজের চেষ্টায় ভিক্টোরিয়া কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। ১৪ বছরের পুরোনো কলেজ এবং বাঙ্গালার বাইরেও যথেষ্ট সুনাম আছে এর। দিন ভালোই কাটছিল। পড়াশোনাও পুরোদমে চলছিল। চোখে সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি। মনে অনেক স্বপ্ন।
এমন সময় দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা দিনদিন কেমন যেন বিগড়াতে লাগলো। এতদিন হোস্টেলেই ছিলাম, বাড়ির জন্য মন কেমন করতে লাগলো, সেই জন্য দিন কয়েকের জন্য বাড়ি এসেছিলাম। কিন্তু সারাক্ষণ বাড়িতে থাকলেই তো আর স্বপ্ন পূরণ হবে না। পরীক্ষার প্রস্তুতিও অনেক বাকি। এরই মধ্যে যে দেশের অবস্থা এতো খারাপ হয়ে উঠবে, সেটা বুঝতে পারিনি। ভাবলাম কলেজ থেকে বইপত্র নিয়ে এসে বাড়িতেই পড়াশোনা করব।”
এই বলে একটু থামলো গার্গী, তাকিয়ে দেখলো ছেলে তিনটি একদৃষ্টে চুপচাপ বসে শুনছে। তারপর আবার শুরু করলো, “জানো সেদিন আমার মায়ের শেষ কথা শুনেছিলাম, যা এখনও আমার কানে বাজে, ‘মা রে, ছেড়ে দে, যাস না। হয়তো আর আমাদের দেখতে পাবি না। তারচেয়ে সাথেই থাকি।’ আমি হেসে বলেছিলাম, ‘ধুসসস অযথাই ভয় পাচ্ছো তুমি। আমি যাবো আর আসবো। আর তাছাড়া হোস্টেলে আমার আরও তিনজন বান্ধবী আছে। তারাও আজ বাড়ি যাবে। তারা থাকতে পারলে আমি পারবো না? আর তাছাড়া বিনোদ কাকা তো যাচ্ছে আমার সাথে। তুমি চিন্তা করো না। আমি সুস্থ শরীরেই ফিরে আসবো।’ এই বলে মায়ের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে দুগ্গা নাম জপে বেরিয়ে পড়লাম।
আসার সময় বাবা মা দু’জনেই আমার সাথে বড় রাস্তা অবধি এলো। শেষবারের মতো তাদেরকে প্রণাম করে রাস্তা ধরলাম।
বাড়ি থেকেই শুনছিলাম দেশের হাওয়া গরম। ভেতরে ভেতরে একটা ভয় কাজ করলেও অত আমল দিইনি সেটাকে তখন।
আগে যে মুসলিমরা হিন্দুদের সাথে একসাথে কাজ করত, আজ তারাই পৃথক রাষ্ট্রের দাবির ডাক দিয়েছে। বাইরে বেরিয়ে বুঝলাম, পরিস্থিতি সত্যিই অনুকূল নয়। রাস্তার আশেপাশে দোকান পাট সব ভাঙ্গা। এখানে-ওখানে আগুন জ্বলছে। আর কিছু সংখ্যক ভলান্টিয়ার …লীগের ভলান্টিয়ার লাঠি নিয়ে মার্চ করছে..বৌবাজার মোড় টু হ্যারিসন রোড আর স্লোগান হচ্ছে…’লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান‘, এইটা শুনছি আর শুনতে শুনতে কানে ভেসে এলো, বেলেঘাটাতে দুটো গোয়ালাকে কেটে ফেলেছে …বেলেঘাটা….বেলেঘাটা ব্রীজের ওপারে…সেই শুনে বৌবাজারের রায়ট মানে হিন্দু-মুসলমানের লড়াই শুরু হয়ে গেছে…
কিছুটা আসতেই রাস্তায় একটা আধপোড়া কুকুর দেখলাম। বোধহয় কিছুক্ষণ আগেই জ্বালানো হয়েছে, এখনও আগুন নেভেনি।
উফফফ , মা গো!
আমি তাকাতে পারলাম না, চোখ সরিয়ে নিলাম। চারিদিকে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এখানে সেখানে চাপ চাপ রক্ত।
এবার ভয় হলো ভেতরে।
বিনোদ কাকা বললেন, ‘খুকুমণি আমি বলি কি বাড়ি ফিরে চলো বরং, আর লেখাপড়ায় কাজ নেই।”
আমি মনে সাহস নিয়ে বললাম, ‘ভয় পেও না কাকা। এরকম ভীতুর মতো ফিরে যাবো, তা হয় না। তুমি চলো, একবার কলেজ পৌঁছে গেলে আর কিছু হবে না।’
কাকা আমার কথা মেনে নিয়ে চলতে লাগলেন আমার সাথে।
১৯৪০-এর ২৩ শে মার্চ, জিন্নাহ তার লাহোর প্রস্তাব রাখেন। সেখানে বলা হয় মুসলিমদের জন্য আলাদা বাসস্থানের কথা। অর্থাৎ এবার দেশ ভাগ হবে। এটা যেদিন শুনেছিলাম, সেদিনই ভেতর থেকে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিলাম।
এই বছর মার্চ মাসে যে ক্যাবিনেট মিশন ক্ষমতা হাত বদলের চুক্তি করতে আসে, শর্ত সাপেক্ষে কংগ্রেস সেটা মানলেও মুসলিম লীগ মানে না।
সিক্সটিনথ অগাস্ট ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ যেটা হবে বা হতে চলেছে, তার আগে তিনবার থার্ডটাইম কমিশন এসেছে ইংল্যান্ড থেকে। কমিশন এসে ফিরে গিয়েছে। এরা দেশভাগ করতে রাজী হয়নি। লিডাররা…তারপরে লাস্টে গান্ধীজী ….গান্ধীজীও এর বিরুদ্ধে ছিল। গান্ধীজী রাজি হয়নি দেশভাগ করতে।
বছর দুয়েক আগে তখন নেতাজীর আই.এন.এ. লড়তে লড়তে এখানে এসে পড়েছে, তখন তাঁরা ইম্ফলে।
আশ্বাস দিলেন, ‘তোমরা দেশভাগ করো না। আমি পৌঁছাচ্ছি। আমরা ফাইট করব, লড়ব…’
কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। গান্ধীজীও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন। লেডি মাউন্টব্যাটেন এসে জওহরলালকে রাজী করিয়েছিলেন।
বোম্বে থেকে জিন্নাহ বললেন, ‘১৬ ই আগস্ট মুসলিমরা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন করবে।’
আর সেদিনটা ছিল ১৬ আগস্ট। আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরনীয় দিন।”
আবার গার্গী এদিক ফিরে দেখলো ছেলেগুলো কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। সে একটু চুপ করতেই অমল তড়িঘড়ি বলে উঠলো, “তারপর?”
“তারপর?” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গার্গী আবার শুরু করলো, “আমরা দাঙ্গার ভয়ে বড়ো রাস্তা ছেড়ে একটা পায়ে হাঁটা পথ ধরেছিলাম। এই রাস্তাটায় কয়েকটা দোকানপাট ছাড়া বিশেষ কিছু ছিল না। এদিকটায় লোকজন এর যাতায়াত কম। কলেজ তখন প্রায় পৌঁছে গিয়েছি, আর কয়েক পা হাঁটলেই কলেজের মেইন গেট। এমন সময় একটা শোরগোল কানে এলো। কিছু টুকরো টুকরো কথা বাতাসে ভেসে আসছে , ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বুকের ভেতরটা হিম হয়ে এলো। তার মানে আশেপাশেই কোথাও দাঙ্গা শুরু হয়েছে। আমি কাকার দিকে তাকালাম। দেখলাম কাকাও ভীত।
কাকা বললেন, ‘খুকু আর আগানো বোধহয় ঠিক হবে না।’
পাশে একটা মাংসের দোকান ছিল, সেদিকে দেখিয়ে বললেন, ‘চলো আপাতত এখানে ঠাঁই নাও। তারপর দেখছি কী করা যায়।’
আমরা সেই মতো দোকানের মধ্যে আশ্রয় নিলাম। ছোটো দোকান, সম্ভবত পাঁঠার মাংসের দোকান। কারণ, বিদঘুটে গন্ধ আসছিল।
আমার মনে পড়লো কালি পুজোর দিন আমাদের বাড়িতে পাঁঠা বলি হয়। সেই দিন পুরো গ্রাম উৎসবে যোগ দেয়। রহিম চাচা, আব্দুল চাচা, পরান কাকা, মালতি পিসি সবাই কেমন একসাথে আনন্দ করে ভোগ খেতে বসে আমাদের বাড়িতে।
হঠাৎ একটা আওয়াজে চিন্তার তার কাটলো। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানে মাথার উপরে একটা ছোট্টো ঘুলঘুলি ছিল, দুই পায়ে ভর দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম রাস্তায় বেশ কিছু মানুষ। তাদের মাথার সাদা ফেজ টুপিগুলো নজরে এলো। আর নজরে এলো চকচকে ধাতব কিছু একটা, যাতে বেশ টকটকে লাল রংয়ের কিছু একটা লেগে রয়েছে। ঠিক আমার শাড়ির পাড় টার মতো। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।
ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি, এবারের মতো আর বোধহয় মা’কে দেখা হলো না।
কষ্টটা বেশি হচ্ছে কাকার জন্য। কাকার বাড়িতে একটা অবিবাহিত মেয়ে আছে। কাকার কিছু হয়ে গেলে তার পরিবারের কী হবে?
আমি করুন দৃষ্টিতে কাকার দিকে তাকালাম। কাকা বললেন, ‘খুকু আমার যাই হোক, তোমায় যেন অক্ষত ফেরৎ নিয়ে যেতে পারি।’
আমি আর কিছু বললাম না। বাইরে আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, ‘দেশ টুকড়ে হোকে রেহেগা, ‘জিন্নাহ আলি জিন্দাবাদ‘ — এরকম নানা শ্লোগান।
রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে একটা পানের দোকান ছিল। দেখলাম কয়েকজন মিলে তা ভেঙ্গে লুঠ করে নিল, দোকানের ভেতর থেকে একটা কৃষ্ণের ছবি টেনে বের করে নিয়ে একজন সেটা পা দিয়ে মাড়িয়ে রাস্তায় ফেলে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল। সেটাতে বাকিদের সে কী জান্তব উল্লাস!
তারপর তারা অন্যদিকে চলে গেল। এই রাস্তাটা আপাতত জনমানবহীন। চারিদিকে সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
চোখ টনটন করে উঠলো, দু ফোঁটা জলও বোধহয় গড়িয়ে পড়ল। চোখের সামনে ভেসে উঠলো উঠোনের পাশের চাঁপা গাছটা। আসার সময় দেখে এসেছিলাম তাতে ফুল এসেছে।
কাকার ডাকে সম্বিত ফিরলো, ‘খুকু তুমি একটু দাঁড়াও, বাইরেটা বোধহয় শান্ত হয়েছে, আমি একবার দেখে আসি। এইটুকু রাস্তা পার করে নিতে পারলেই তোমার কলেজ পৌঁছে যাবো।’
আমি মানা করলাম।
কাকা বললেন, ‘এখানেই বা কতক্ষণ এভাবে থাকবো?
এই দিকটা এখন একটু শান্ত মনে হচ্ছে। তুমি বুকে বল নিয়ে একটু অপেক্ষা করো মা, আমি যাবো আর আসবো। তুমি ভালো করে দরজা বন্ধ করে রাখো। আমি না আসা অবধি একদম বেরোবে না।’
এই বলে কাকা ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল।
মন কু গাইলো, ঠিক এভাবেই আমিও আসার সময় মায়ের বারণ শুনে আসিনি। কাকা ভালোয়-ভালোয় ফিরবেন তো?
কতক্ষণ কেটেছে জানি না, হঠাৎ বাইরে প্রচন্ড শোরগোল, চমকে উঠে বাইরে তাকালাম। প্রথমে বুঝতে পারলাম না আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেলাম আমার কলেজের রাস্তা থেকে একটা মাঝ বয়সী লোক ছুটে আসছে, আর তার পিছনে বেশ কিছু লোক হল্লা করতে করতে ছুটে আসছে। তাদের হাতের অস্ত্রের ঝলকানি চোখ এড়ালো না।
বৃদ্ধ মানুষটির পরনে সাদা ধবধবে ধুতি আর সাদা জামা। জামাটা বোধহয় ঈষৎ লাল হয়েছে। মুখটা নজরে আসতেই চোখে যেন অন্ধকার দেখলাম। কাকাআআ করে অস্ফুট একটা আওয়াজ বেরোলো কেবল আমার মুখ দিয়ে।
দোকানের ঠিক আগেটা তে আসা মাত্রই একটা বর্শা মানুষটার বুকে এফোঁড় ওফোঁড় হলো।
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। প্রাণপণে নিজের মুখ চেপে ধরলাম, নিঃশব্দে দেখছি কিন্তু কিচ্ছু করতে পারছি না।
কাকা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে, বর্শাটা মাটিতে ধাক্কা পেয়ে আবার পেছন দিকে ফুঁড়ে উঠলো।
পেছনের দলটা এসে পড়লো। একজন এসেই কাকার হাতে পা দিয়ে চেপে ডলতে লাগলো। শুনতে পাচ্ছি কাকার চিৎকার।
মনে পড়লো আমায় নদীতীরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার সময় কাকা চিৎকার করে বলতো, ‘খুকু বেশি সামনে যাবে না।’ কিন্তু, কিন্তু এই চিৎকার ঐ চিৎকারের চেয়ে অনেক আলাদা।
সাদা জামা আর সাদা নেই। মাটিটাও কেমন জবা ফুলের মতো লাল। আমার চোখের জল বুক অবধি গড়িয়েছে।
একজন বলে উঠলো, ‘এই বুড়ো বল এখানে কী জন্য এসেছিলি?’ চারিদিকে অট্টহাস্যের জন্য আমি এখন আর কাকার বুকফাটা শেষ আর্তনাদটাও শুনতে পাচ্ছি না।
কাকা অস্ফূটস্বরে কিছু বলে উঠলো। আমি শুনতে পেলাম না সেটা। আবার দানবদের উচ্চকন্ঠ শুনলাম, ‘বল তোর সাথে আর কে কে আছে? কোথায় আছে তারা?’
কাকা আস্তে আস্তে কোনোরকমে হাত উঠিয়ে সামনের দিকে ইশারা করল। তারপর ধপ করে হাতটা মাটিতে পড়ে গেল। চোখের সামনে কাকাকে নিস্তেজ হয়ে পড়তে দেখলাম।
যে কাকা আমায় হাঁটতে শিখিয়েছিল, তাকে আমি মরতে দেখছি।
হে ঈশ্বর, এর আগে তুমি আমায় মেরে ফেললে না কেন?
শাড়ির আঁচল দিয়ে প্রাণপণে নিজের মুখ চেপে ধরে আছি।
এরপর কিছুক্ষণ ওরা নিজেদের মধ্যে কী সব আলোচনা করল, তার কয়েকটা কথা শুনতে পেলাম —
১) ‘আজ হেন্দুদের সব ক’টা মা বইনদের তাদের বাপ ভাইয়ের সামনে ভোগ করব।’
২) ‘হ হেন্দুদের মাইয়াগুলান বড়োই ডবকা ডাগর ডোগর হয়। কালকেই একটা বাড়ির তিনজনরে মনের সুখে ভোগ কইরাছি। বাপটা আটকাতে আইসাছিল, জ্যান্ত পুড়াই দিসি।” এই বলে উল্লাস করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।
আর পারলাম না, বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। আমার সামনে কাকার মৃতদেহ। কী জানি কেমনভাবে চোখে আর জল আসছে না তখন। কেমন যন্ত্রের মতো বসলাম কাকার পাশে। বর্শাটা ঠিক বুকের মাঝখান দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়েছে। বুকে গেদে পড়ে যাওয়ায় আবার সেটা পেছন দিকে চলে গেছে। পিঠের ঐ জায়গাটা থেকে গলগল করে রক্ত বার হচ্ছে। আমার চোখের সামনে ভাসছে কালি পুজো, বলি, পাঁঠার রক্ত। কাকার মাথাটা কোলের উপর নিলাম। আর পারলাম না ধরে রাখতে নিজেকে, কাকা গোওওও বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। চোখের জলে কাকার মুখটাও আর দেখতে পাচ্ছি না। এমন সময় মনে হলো যেন কাকা যেন নড়ে উঠলো।
হ্যাঁ তাই তো। কাকা এখনও বেঁচে আছে, আমি একটু আশার আলো দেখলাম। কাকা হাত তোলার চেষ্টা করল, ‘কাকা’ বলে ডেকে উঠলাম।
‘মা এ-এ-এক্ষুণি ক-ক-কলেজের রাস্তা ধরো। ঐ ও-ওদিকটা ফাঁকা। দে-দেরি করো না মা, যাও। আমার মরা মুখের দিকে চে-চেয়ে যাও মা। আ-আ-আমার মৃত্যুকে ব্য-ব্যর্থ হতে দিও না মা। যাও শিগ্গির।’ অনেক কষ্টে তিনি এই ক’টা কথা বলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
আমি গার্গী চট্টোপাধ্যায়, তখন ভিক্টোরিয়া কলেজের সামনে রাস্তার উপর বসে। আমার সামনে আমার পিতা সম মানুষ, যিনি আমায় ছোটো থেকে কোলে-পিঠে মানুষ করেছেন, তার মৃতদেহ পড়ে আছে।
দিনটা ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ সাল। মুসলিম লিগ আলাদা পাকিস্তানের দাবীতে সোচ্চার তখন। আর আমি শুনশান রাস্তায় নিজের পিতৃতুল্য কাকার মৃতদেহ কোলে নিয়ে বসে আছি। কয়েক সেকেন্ড ঐ ভাবেই বিহ্বল হয়ে বসে থাকলাম।
তারপর কী মনে হলো চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালাম। রাস্তাটা এখন শশ্মানের মতো খাঁ খাঁ করছে। কোনোরকমে কাকার মৃতদেহ টেনে রাস্তার পাশে এনে রাখলাম। ‘মা দেখো কাকার আত্মা যেন শান্তি পায়’, এই প্রার্থনা করে কলেজের রাস্তা ধরলাম।
মিনিট খানেক ঘোরের মধ্যে হাঁটার পর দেখতে পেলাম, কলেজের মেইন গেট। তাতে জ্বলজ্বল করছে নামটা, ‘ভিক্টোরিয়া গার্লস কলেজ’।
আমি তখন অবশ প্রায়, সাদা শাড়ি তখন লালে রাঙা। যে কাকা আমায় বড়ো করেছে, তার রক্তে হাত আমার ভর্তি। কোনোরকমে কলেজে ঢুকে আবাসনের দিকে এগোলাম। দেওয়াল হাতড়াতে হাতড়াতে আমাদের রুমের সামনে এলাম। রুমে তখন আমার আরও তিন সহপাঠিনী ছিল।
কোনো রকমে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললাম, “আমি গার্গী।” বলেই দরজার সামনে বসে পড়লাম। আমার পায়ে, শরীরে, মনে কোত্থাও কোনো জোর তখন আর অবশিষ্ট নেই।
চোখের সামনে ভাসছে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কাকার মৃতদেহ, যাতে একটা বর্শা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে আছে। ঐ কাকার বাড়িতে একটা অবিবাহিত মেয়ে আছে, একটা মধ্য বয়স্কা স্ত্রী আছেন। যারা এখনও এ খবরে অবগত নয় যে তাদের বাড়ির মাথা আজ রাস্তার উপর আমার কোলে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
আমি জ্ঞান হারালাম।
এরপর জ্ঞান ফিরতে দেখতে পেলাম, আমি হোস্টেলে আমার বিছানায় শুয়ে আছি। একটা আধো-অন্ধকার ঘর, গায়ের জোরে ঘুরতে থাকা একটা পাখা, একটা খোলা জানলা ব্যাসস..চারপাশে তাকালে শুধু এইটুকুই নজরে আসছে..
এমন হয়ে গিয়েছে যে এখন কাঁদতেও ভুলে গিয়েছি… দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ বোধহয় সমস্তরকম জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, আমিও হারিয়ে ফেলেছি! হেরে গিয়েছি…জীবনে হারের কষ্টটা এতোটাই বেশি লাগছে যে জেতার ইচ্ছে চলে গিয়েছে! উঠে দাঁড়াবো, সেই ক্ষমতাটুকুও আর পাচ্ছি না।
ঘোর কাটতে চোখে পড়ল মহাশ্বেতা আমার পাশে বসে আছে, একটু দূরে জ্ঞানদা একটা জল চৌকিতে বসে রয়েছে। বাম পাশে শিয়রের কাছে মেঘমালা, হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করছে।
আমি চোখ মেলে তাকাতেই তিনজন শশব্যস্ত হয়ে পড়ল। তিনজনের মুখেই চিন্তার ছাপ।
মহাশ্বেতা প্রথম কথা বললো, সে আমতা আমতা করে বলল ,’কী ক্কী কী’ভাবে হলো এসব?’ পুরো ঘর থমথমে।
চারজনেরই হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শোনা যায়, এমন অবস্থা। আমি ইশারা করতে মেঘ আমায় ধরে বসালো।
জ্ঞানদা ইশারায় মহাশ্বেতাকে থামতে বললো। জিজ্ঞেস করলো ,”খাবি কিছু?” খাওয়ার কথা বলতেই আমার চোখ গেল নিজের হাতের দিকে। লাল রক্ত তখন শুকিয়ে গিয়েছে।
আমার গা গুলিয়ে উঠলো। বমি আসতেই মেঘ আমায় ধরে বাথরুমের দিকে নিয়ে গেল। বমি করলাম অনেকটা। ওরা আমার হাত মুখ ধুইয়ে পরিষ্কার করে দিল। আমি রুমে এসে কেমন যন্ত্রের মতো বললাম, ‘চারিদিকের দরজা জানলা লাগিয়ে দাও। ওরা বোধহয় এসে পড়লো বলে।’ তিন জনেরই মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল।
আমাদের রুমটা আবাসনের শেষ প্রান্তে, সেখান থেকে রাস্তার কিছুটা অংশ দেখা যায়। আমরা চারজন সহপাঠিনী ইচ্ছে করেই রাস্তার দিকের দুটো রুম পছন্দ করেছিলাম রাস্তায় মানুষের চলাচল দেখতে পাবো বলে।
আমি আর জ্ঞানদা একটা রুমে আর পাশেরটাতে মহাশ্বেতা আর মেঘ। মেঘ বড্ডো কম কথা বলে। আমরা চারজনেই সায়েন্সের ছাত্রী।
এখন সবাই একটা রুমেই ঠাঁই নিয়েছি। আমি বিছানায় বসে আছি। বেলা তখন আন্দাজ সাড়ে তিনটে চারটে হবে। ওরা তিনজন উন্মুখ হয়ে বসে আছে, আমার এমন অবস্থা কেন সেটা শুনবে বলে।
আমি অস্ফুট স্বরে এটুকুই কোনোরকমে বলে উঠলাম, ‘বিনোদ কাকা আর নেই। রাস্তার পাশে ওনার মৃতদেহ…’ তারা বাকি যা বোঝার বুঝে গেল।
মহাশ্বেতা বললো, ‘১০-১২ দিন আগে তো খবরের কাগজে দেখলাম, মুখ্যমন্ত্রী সোরোয়ার্দি বলেছেন যে আমাদের একমাত্র কাজ হলো পাকিস্তান আদায় করা। জানিনা কী হবে? এ যাত্রা কী আদৌ বাবা-মা’কে আবার দেখতে পাবো?’
জ্ঞানদা বললো, ‘মনে জোর রাখো সবাই। আজ সন্ধ্যায় আমার বাড়ি থেকে গাড়ি আসবে। সবাই একসাথে সেখানেই উঠবো বরং। তারপর বাকি ভাবা যাবে। কোনো রকমে আজকের দিনটা কেটে যাক। গার্গী, তুই বরং কিছু খা, শরীরে জোর আনতে হবে। তুই না সাহসী মেয়ে?’
এদিকে আমার কানে তখন ভাসছে, ‘হেন্দুদের মাইয়াগুলান বড়োই ডবকা আর ডাগর ডোগোর হয়।’
আমি কাউকে কিছু না বলে তড়িঘড়ি পাগলের মতো সব জানলা দরজা বন্ধ করতে লাগলাম।
ওরা আমায় ধরে বিছানায় এনে বসালো।
আমি তখন হাঁপাচ্ছি , ‘ও-ও-ওরা এখানেও আসবে, ঠি-ঠ্-ঠিক আসবে এখানে। আমাদের কাউকে ছাড়বে না।’
সারাদিনে এই প্রথম আমি চিৎকার করে কাঁদবার সুযোগ পেলাম। আছাড় পাছাড় দিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। জ্ঞানদা আমার মুখ চেপে ধরলো। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, ‘একদম আওয়াজ করবি না। পুরো আবাসন ফাঁকা, একটুও আওয়াজ হলে তা বাইরে যাবে।’
এই বলে সে আমাকে মহাশ্বেতার জিম্মায় রেখে ব্যাগ চেক করতে চলে গেল। ঠিক হলো জ্ঞানদার বাড়ি থেকে গাড়ি এলে আমরা সবাই জ্ঞানদার বাড়িতে গিয়ে উঠবো।
বেশ কয়েকবার আবাসনের সামনে দিয়ে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল বেরিয়ে গেল।
চারজনেই আরষ্টের মতো বসে আছি। রাস্তার দিকের জানালাটা সামান্য ফাঁকা রেখেছি, যাতে গাড়ি এলেই বুঝতে পারি।
সময় যেন কাটতেই চায় না। ওভাবেই বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। সূর্য তার শেষ আভার লালিমাটুকু ছড়িয়ে দিয়ে দিগন্তে পাড়ি দিল।
এরই মধ্যে মেঘ ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো, ‘এটা বোধহয় জ্ঞানদা তোদের বাড়ির গাড়ি, দ্যাখ তো।’
জ্ঞানদা পড়িমড়ি করে উঠে জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালো, ‘হ্যাঁ এটা আমাদের বাড়ির গাড়ি, ঐ তো দাদা নামছে। ওরা এসে গিয়েছে। চলো সবাই।’
আমরা যেন বুকে একটু বল পেলাম।
ওরা তিনজন নিজেদের ব্যাগপত্তর হাতে নিল। আমার আর বইপত্তর নেওয়ার কথা মাথায় ছিল না।
মেঘ আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।
করিডোরে এসে দেখলাম দু’জন দারোয়ানের সাথে জ্ঞানদার দাদা আমাদের আবাসনের দিকেই আসছে।
আমরা করিডোর দিয়ে তাড়াতাড়ি করে হাঁটতে লাগলাম। কিছুটা নেমে আসার পরই আচমকা একটা হল্লার শব্দ কানে এলো। নীচে গেটের দিকে তাকাতেই শরীরের রক্ত হিম হয়ে এলো। জনা বাইশেক যুবক হাতে মশাল নিয়ে কলেজের গেট ভেঙ্গে আবাসনের দিকেই আসছে। তাদের পরনে কালো ঝোলা পাঞ্জাবি, দাঁড়ি দেখে চিনতে অসুবিধা হলো না যে এরা শয়তানের দূত। তাদের হাতে বর্শা, তরোয়াল, লোহার শিক, চেইন, বন্দুক, বেয়োনেট।
উন্মত্ত দলটি জ্ঞানদার দাদাকে দেখে প্রথমেই উল্লাসে ফেটে পড়লো। দারোয়ানরা কিছু করার আগেই দু’জন মিলে একজনকে জাপটে ধরল। একজন জ্ঞানদার দাদার হাত পিছমোড়া করে চাতালের উপর নিয়ে গিয়ে ফেলল। আর অপর দারোয়ান কিছু বলার আগেই দেখলাম মাটিতে পড়ে গেল।
তার গলায় ততক্ষণে তরবারি চেপে গিয়েছে। মাছকে ডাঙ্গায় তোলার পর যেমন ছটপট ছটপট করে, ঠিক সেরকমই কিছুক্ষণ ছটপট করতে করতে খানিক পর নিথর হয়ে গেল দেহটা।
আমরা ভয়ে চিৎকার করে করিডোর এর পাশের রুম গুলো খোলার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু বেশিরভাগ রুমই তালাবন্ধ। এর মধ্যে একটা রুম ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। চারজন কোনোরকমে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে ছিটকিনি লাগালাম।
কিন্তু এ ছিটকিনি যে ঐ দামাল দানবদের আটকাতে পারবে না, সে ততক্ষণে বুঝেই গিয়েছি। রুমের মধ্যে একটা চার পায়া বড়ো চৌকি ছিল, আমরা সেটাকে টেনে দরজার আগে ঠেসে ধরলাম।
মিনিট দুই পর দরজায় লাথি মারার আওয়াজ।
— ‘হা ঈশ্বর, শেষ পর্যন্ত কি এই যবনদের কাছে ইজ্জত খোয়াতে হবে?‘
আমরা প্রাণপণে চৌকিটা ঠেসে ধরে রাখতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ওদিক থেকে ততোধিক শক্তিতে লাথি পড়ছিল।
খুব জোর মিনিট চার-পাঁচ লাগলো তাদের দরজা ভেঙে ফেলতে। আমরা সবাই ছিটকে মেঝেতে পড়লাম।
একজন পা দিয়ে লাথি মেরে চৌকি সরিয়ে দিল।
আমাদের শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে।
একজন এসে মহাশ্বেতার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল। আর তিনজন এসে আমার চারপাশে দাঁড়ালো। রুমে তখন জনা বারো দৈত্য দাঁড়িয়ে।
‘উফফফফ সে কী কানফাটা হাসি।'” — এই বলে গার্গী নিজের কান চেপে ধরল।
ছেলেগুলো দেখলো গার্গী থরথর করে কাঁপছে। সন্দীপ তাড়াতাড়ি উঠে গার্গীকে ধরতে গেল। গার্গী হাত তুলে মানা করল। ইশারায় জানালো সে ঠিক আছে।
একটু থেমে সে আবার শুরু করলো।
“মহাশ্বেতার চিৎকারে তাকিয়ে দেখলাম একজন তার হাত পেছনে চেপে ধরেছে আর একজন তার শাড়ির আঁচল ধরে টান দিচ্ছে। নিমেষে খুলে ফেলল শাড়ি।
— ‘উফফফ কী সোন্দর ডবকা মাইয়া। হেন্দুদের মাইয়াগুলারে খায়ে মজা আছে ভাইজান। এ তো মাইয়া লয়, যেন কচি ডাব।’ এই বলে তারা দু’জন মহাশ্বেতার স্তন মর্দন করতে লাগলো।
ঘরের বাকি লোকগুলো ততক্ষণে মেঘ আর জ্ঞানদাকেও অর্ধনগ্ন করে ফেলেছে।
আমি আর দেখতে পারলাম না। চোখ সরিয়ে নিলাম।
‘হা ঈশ্বর, আমাদের কি তাহলে এই পরিণতি ছিল?‘
আমি কাকুতি মিনতি করলাম, ‘আমাদের ছেড়ে দিন‘।
সামনের জনের পায়ে পড়লাম । বললাম ,বললাম, ‘আ-আ-আমাদের কাছে যা টাকা-পয়সা আছে, সব নিয়ে যান, তবু আমাদের এ সর্বনাশ করবেন না। দয়া করুন আমাদের। ছেড়ে দিন আমাদের।’
লোকটা তার হলুদ দাঁত বের করে দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে ব্যাঙ্গ করে হেসে উঠলো। দেখেই আমার সমস্ত শরীর ঘিনিয়ে উঠলো।
— ‘ট্যাকা পয়সা তো লিবই, কিন্তু তোদের ক্যামনে ছাইড়া দিমু? আজ তো আমাদের খুশির দিন। তোদের ন্যাংটো কইরা ভোগ করুম। আজ এইহানের প্রত্যেক জন মিল্যা তদের ভোগ করুম। তরা তো জন্মাইছসই আমাগো ভোগের লইগ্যা।’
— ‘কতদিন স্বপনে হেন্দু মাইয়াদের স্তন পাকা গন্ধবের মতো পেয়ারা গাছের ডালে ঝুলতে দেখি। আজ হাতের কাছে এমন ডাঁসা মাল পাইয়া ছাইড়া দিমু ভাবিস ক্যামনে?‘
আমি দেখতে পাচ্ছি সমগ্র পৃথিবী তখন থরথর করে কাঁপছে। কাঁপতেই হবে, ভূমিকম্পে মাটি, জল, পৃথিবী না কেঁপে পারে না। যা ধ্বংস হবে, সে আগেই টের পায়। আর এরা ধ্বংসের তান্ডব খেলায় মেতেছে।
‘হে ধরিত্রী, দ্বিধা হও মা’ বলে আমি কঁকিয়ে উঠলাম।
চারিদিকে অট্টহাস্যের গমগমানিতে বাকি তিন জনের চিৎকার তখন আর কানে আসছে না। একজন আমার শাড়ির আঁচল ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। সেফটিপিন খুলে ছিঁড়ে গেল। এখন আমার শরীরে কেবল বক্ষবন্ধনী আর নিচে সায়া।
আমি তখনও কাকুতি মিনতি করে যাচ্ছি।
এরই মধ্যে কয়েকজন মিলে জ্ঞানদার দাদাকে ধরে নিয়ে এলো ঘরের মধ্যে।
— ‘ভাইজান এ পোলা বড্ডো বাড় দেখাইতেসিল। এখনও জানে মারি নাই। একেবারেই মাইরা ফ্যালাইমু কি?‘
জ্ঞানদা চিৎকার করে উঠলো, ‘দাদাআআআ!“
জ্ঞানদার শরীরে তখন কেবল সায়া, বক্ষযুগল তখন উন্মুক্ত। দুইজন দুই দিকে হাত টেনে ধরে আছে। একজন জোরে থাপ্পড় মারলো ওর গালে। কষ বেয়ে রক্ত বেরিয়ে আসলো।
ইশশ, মেয়েটা কোনোদিন তার বাবা-মায়ের কাছে বকুনিটুকুও খায়নি। বুদ্ধিমতী বলে সকলে সমীহ করে চলত সব সময়।
— ‘অঅ, এইডা তর বইন? তাইলে এইডাকেই আগে ধর্ষণ করনে লাগবো। আইজ হইছে আমাগো খুশির দিন। মালাউনগো সব কিছু ধ্বংস কইরা এইহানে আইজ ফুর্তি করুম আমরা।”
— ‘আজ হিন্দুস্তানের সামনেই হিন্দুস্তানের ইজ্জত লইমু। দ্যাখরে কাফের, আজ তর সামনে কেমন তর বইনরে গণিমতের মাল বানাই।’
এই বলে বোয়ানেট দিয়ে জ্ঞানদার দাদার থুতনি তুলে ধরল।
‘চোখ খোল, খোল চোখ। এই হাফিজ এই মালাউনটারও কাপড় জামা সব খুইল্যা ফ্যাল। খুইল্যা ঐ চৌকির লগে বাইধ্যা ফ্যাল। যেন ভালো কইর্যা সব দেইখতে পায়। কাফেরগো, মালাউনগো তগো আর কিচ্ছু রাখুম না। সব আমাদের হইব’ — এই বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
‘চলেন মিঞা তাইলে আর দেরি ক্যান? এক এক কইর্যা শুরু করেন। এমন কচি ডাঁসা মাগী অনেকদিন দেখি নাই। বুকে দম লইয়া লাইগ্যা পড়েন।’ এই বলে দুজন আমার দুই উরু চেপে ধরলো। আর একজন আমার হাত বেঁধে দিল।
সামনের জন তার পাজামার দড়ি খুলে উত্থিত পুরুষাঙ্গ বের করে হাসতে হাসতে আমার উপর চেপে বসল।
আমি যন্ত্রণায়, লজ্জায়, ঘেন্নায় চিৎকার করে উঠলাম।
দেখলাম জ্ঞানদার দাদার অসহায় কাতর মুখখানা। সে লজ্জায় অপমানে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। এরা দাদার সমস্ত জামা কাপড় খুলে নিয়ে তা দিয়ে তাকে চৌকির সাথে বেঁধে রেখেছে।
তার মধ্যে যেন সমগ্র হিন্দুস্তানকে হেরে যেতে দেখলাম।
আমি কিছু বোঝার আগেই টের পেলাম যোনিতে প্রবল যন্ত্রণা। লোকটা তার পুরুষাঙ্গ আমার মধ্যে প্রবেশ করাচ্ছে। আমি আরেকবার চিৎকার করে উঠলাম।
শেষবারের মতো মা’কে ডাকলাম।
সেদিন আমাদের চারজনের চিৎকারে পুরো ভিক্টোরিয়া কলেজ কেঁপেছিল।
লোকটি তার পুরুষত্ব ফলালো আমার উপর। আমার যোনিদ্বার ছেদ হয়ে রক্ত গড়াতে লাগলো। লোকটি পাগলের মতো আমায় ভোগ করতে লাগলো।
মা বলেছিল, ‘নারী শরীর ভগবানের সৃষ্ট সমস্ত সুন্দর জিনিসের মধ্যে অন্যতম। একে যার-তার হাতে তুলে দিতে নেই।’
আজ আমাদের সমগ্র শরীর এই যবনদের লালসার শিকার। আমাদের স্তন, নাভী, উরুতে তখন তাদের লকলকে জিভ এবং হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে।
‘আঃ, উফফফ, অনেকদিন পর এমন সুখ পাইলাম। সত্যই হিন্দুদের মাইয়াগুলারে খাইয়া মজা আছে।’ বলে তার বীর্যস্খলন করল।
‘কইরে এটার লগে আর কে আসবি আয়। আমি অন্যগুলারে দেখি।’ এই বলে মুখ মুছতে মুছতে আমার উপর থেকে উঠে গেল।
কোনোরকমে পাশে তাকিয়ে দেখলাম, মেঘ তখন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে আর ওর উপরে জনা ছয়েক পশু একসাথে চড়াও হয়েছে। যে মেয়েটা রক্ত দেখলে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেত, আজ সে রক্তে স্নান করছে। ওর পা, উরু সব রক্তে মাখামাখি। আর পারলাম না, চোখ বন্ধ করলাম। এরপর ওরা পালা করে করে আসতে লাগলো।
একজন জ্ঞান’র দাদার মুখ ধরে বলল, ‘দ্যাখ কেমন তর বইনরে চোদাইছি। দ্যাখ রে মালাউন মুশরিকের বাচ্চা।
এমন কইরা তদের সব মা-বইনগুলাকে চোদাইবো। পুরা হিন্দুস্তানকে চোদাইবো।’
একে একে করে সব আসতে লাগলো। আমাদের চারটে শরীর ক্রমাগত ধর্ষিতা হতে লাগলো।
একজন কয়েকটা দেশলাই জেলে জ্ঞানোর হাতে চেপে ধরল। যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠলো জ্ঞানো। ওর যন্ত্রণা দেখে বাকিরা উল্লাসে ফেটে পড়লো।
কে একজন যেন বলে উঠলো, “আব্দুল এমন কইর্যা কর, দ্যাখ মজা পাবি।”
কে একজন চাকু দিয়ে অমার ঊরু চিরে দিল। আমার মুখ দিয়ে আর আওয়াজ বের হলো না। সমস্ত শরীর তখন অবশ হয়ে এসেছে।
আবদুল বলল, ‘এই মাগী চিৎকার কর। তরা চিৎকার না করলে তদের চোদাইয়াও তেমন মজা আসে না। চিল্লা বলছি।’ আমি চেষ্টা করেও আর চিৎকার করতে পারলাম না।
‘তদের হিন্দু মাগীদের চিল্লানোর আওয়াজ লাগবো? দাঁড়া ব্যবস্থা করতাসি।’ এই বলে একজন মেঘকে টেনে-হিঁচড়ে আমার সামনের দরজায় ঠেসে ধরল। আমি ভালো করে চোখ খোলার আগেই দুইজন দুই পা ফাঁক করে একটা লোহার রড ঢুকিয়ে দিল ওর যোনিতে। ওর চিৎকারে পুরো ভিক্টোরিয়া কলেজ কেঁপেছিল সেদিন।
ওর দুই পা গড়িয়ে রক্তগঙ্গা বইতে লাগলো। মারের চোটে ওর একটা চোখ ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
যে মেঘমণিমালা বরাবর ক্লাসে এক থেকে দশের মধ্যে থাকতো, সে আজ নগ্ন অবস্থায় আমার চোখের সামনে দেওয়ালে ঝুলছে!
একজন রডটা টেনে বার করে নিল। আরেকবার কানফাটা চিৎকার করল মেঘ। তারপর আর সাড়া দিল না। বোধহয় আর নিতে পারলো না ওর শরীর।
এরপর ওরই পরনের শাড়িটা নিয়ে গলায় পেঁচিয়ে জানলার সাথে ওর নিথর নগ্ন দেহটা ওরা ঝুলিয়ে দিল।
— ‘এই দ্যাখ ক্যামন ন্যাংটো হিন্দুস্তানকে ঝোলাইলাম?‘
আমার চোখ দিয়ে শেষ অশ্রুবিন্দুটা গড়িয়ে পড়লো।
মহাশ্বেতার উপর তখনও তিনটে হায়না অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।
অর্ধমৃত জ্ঞানোকে তুলে একজন তরোয়ালের কোপে স্তন কেটে দিল, একটু মুখ খুললো কেবল মেয়েটা, আওয়াজ বের হলো না।
ওরা ছেড়ে দিল জ্ঞানোকে। ধপ করে পড়ে গেল মেয়েটা। একজন চুলের মুঠি ধরে তুলে ওকে মেঘের পাশে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল, ঠিক যেভাবে কসাইখানায় পরপর গরু ঝোলানো থাকে। তারপর বোয়ানেট দিয়ে মৃত শরীরের যত্রতত্র খোঁচাতে লাগলো।
— ‘আসরাফ ভাইজান, এই মালাউনের বাচ্চাটার লগে কী করুম?’
— ‘দ্যাখ হাফিজ কেরোসিন লইয়া আসিছিল, ওইটারে জ্বালাই ফ্যাল।’
— ‘কইরে হাফিজ কেরোসিনটা আন।’
— ‘হ ভাইজান।’
জ্ঞানোর দাদাকে আমার সামনেই কেরোসিন দিয়ে স্নান করানো হলো। আমি যন্ত্রের মতো দেখতে লাগলাম। কেরোসিনের উগ্র গন্ধে পুরো ঘরটা ভরে উঠলো। তারপর একটা দেশলাই কাঠি, ব্যাস!!!
জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলল আমার চোখের সামনে। দাদার চিৎকারের সাথে পাল্লা দিয়ে সবাই হাসতে লাগলো।
সারা ঘরে তখন যেন রক্ত দিয়ে হোলি খেলেছে কেউ। এরপর একজন গরু ঝোলানো একটা লোহার শিক নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো।
শিক দিয়ে আমার গালে আঁচড় কেটে বলল, ‘কী হে রফিক মিঞা, এই মাগীটারে মারার আগে একখান চুম্মা দিব নাকি? বলেই খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলো।’
আমার আর বিশেষ কিছু মনে হলো না। লোকটা তার দুর্গন্ধযুক্ত মুখ নিয়ে আমার ঠোঁট কামড়ে ধরল। কেটে গিয়ে খানিক রক্ত বেরোলো কষ বেয়ে।
— ‘ধ্যার আর মাগী টার পরানে জান নাই। এমন বেজান মাগীরে চুমা খায়ে মজা নাই। তার চেয়ে এবার খেল একেবারে খতম কইর্যা ফেলাই।’
এই বলে সে লোহার শিকটা দিয়ে আমার যৌনাঙ্গে সজোরে আঘাত হানলো। আমার শেষ চিৎকারে সেদিন বোধহয় কলকাতা শহরের প্রতিটা ইঁট কেঁপে উঠেছিল।
ব্যাস সেই ছিল আমার শেষ কান্না। তার পরে কী
হয়েছিল আর জানিনা।
মহাশ্বেতা কে শাবল দিয়ে গেঁথেছিল না লোহার শিক দিয়ে, ওটা আর দেখতে পাইনি। হবে ওরকমই কিছু একটা। আমদের চারটে মেয়ের সমস্ত স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটেছিল সেদিন।” এই বলে থামল গার্গী।
কেমন একটা ঘোরের মতো আচ্ছন্ন হয়ে শুনছিল তিনজন। ক’টা বাজে, কোথায় আছে, কারও কোনো খেয়াল নেই। চারিদিকটা কেমন থম মেরে গেছে। তাকিয়ে দেখলো গার্গীর চোখ অশ্রুসিক্ত। সে নিঃশব্দে কাঁদছে।
তাদের নিজেদের অজান্তেই যে কখন তাদের চোখের জলে তাদের জামা ভিজে উঠেছে, বুঝতেই পারেনি।
রাহুল জিজ্ঞেস করলো, “এই জন্যই বুঝি তুমি ফিরে আসো এখানে? তোমাদের উপর হওয়া এই নৃশংসতা যাতে কেউ ধর্মনিরপেক্ষতার গান গাইতে-গাইতে ভুলে না যায়? যাতে ‘মোরা একই বৃন্তে দুটো কুসুম হিন্দু-মুসলমান’ বলতে বলতে এই নৃশংসতার শিকার আর দ্বিতীয় কেউ না হয়?”
— “কী হলো বলো?“
সন্দীপ এসে রাহুলের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “সে আর নেই রে এখানে।”
রাহুল সামনে তাকিয়ে দেখলো সেখানে কেউ নেই আর। সব ফাঁকা….
শুধু কিছু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর কয়েকটা পেঁচা উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে।
ওরা চাঁদের অবস্থানের পরিবর্তন দেখে বুঝলো যে রাত ভালোই হয়েছে।
রাই মন্ডল (Rai Mandal)