সংক্ষিপ্তসার
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৪-১৮৮৩) মহান বিপ্লবী এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। বৈদিক পরম্পরার অনুসারী উন্নত মানদণ্ড এবং প্রয়োজনীয় বার্তাগুলিকে কাল ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য তিনি আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর্য সমাজ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত ভারতীয় সমাজে নানা সংস্কার আনতে সক্ষম হয়েছিল। তিনিই প্রথমবার ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘স্বরাজ’-এর ধারণাটিকে ‘ভারত ভারতীয়দের জন্য’ এই রূপে উপস্থাপিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে লোকমান্য তিলক এবং অন্যান্য সমকালিক স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই ধারণাটিকে স্বীকার করে নেন। স্বামী দয়ানন্দ বৈদিক বিচারধারাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা করেছিলেন। মনুষ্য জীবনকে সর্বতো রূপে সুখী করার জন্য বেদে উপদিষ্ট জ্ঞানের পীযূষধারা সমগ্র মানব জাতির সামনে প্রস্তুত করাই ছিল তাঁর প্রমুখ উদ্দেশ্য।
মুখ্য বিন্দু
১. গোমাতা
গোরক্ষা আন্দোলনের প্রথম প্রবক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি গোকরুণানিধি নামক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে গোহত্যার বিপুল বিরোধিতা করা হয়।
২. আর্য আক্রমণ তত্ত্ব এবং জাতিব্যবস্থার বিরোধিতা
আর্যদের মূল ভূমি ছিল তিব্বত সংলগ্ন এলাকা। আর্যদের পূর্বে এই দেশের কোন নামকরণ হয়নি। আর্যদের পূর্বে এই ভূমিতে অন্য কোন মূলনিবাসী জাতি ছিল না। সৃষ্টির আদিতে সমস্ত মানুষ একই শ্রেণীর ছিলেন। পরবর্তীকালে মানবজাতিকে দুইটি শ্রেণীতে বিভাজিত করা হয়– ভাল এবং মন্দ। ভাল মানুষদের আর্য এবং মন্দদের দস্যু বলা হত। ঋগ্বেদের মতে মানুষ দুইটি শ্রেণীতে বিভাজিত– আর্য এবং দস্যু। ভাল এবং পণ্ডিতগণকে দেব বলা হত, অজ্ঞানী এবং দুষ্টদেরকে (ডাকাত প্রভৃতি) অসুর বলা হত। আর্যদের চারটি বর্ণে বর্গীকরণ করা হয়। যথা– ব্রাহ্মণ (শিক্ষক), ক্ষত্রিয় (শাসক বা রক্ষাকর্তা), বৈশ্য (ব্যবসায়ী), শূদ্র (শ্রমজীবী)। প্রথম তিনটি বর্গের মানুষ শিক্ষিত এবং উন্নত চরিত্রের ছিলেন। তাঁদেরকে দ্বিজ বলা হত। দ্বিজ অর্থাৎ দুই বার জন্ম প্রাপ্ত। একটি জন্ম জৈবিক অপরটি সংস্কার ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে। চতুর্থ বর্ণের মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞান কম ছিল বলে তাদেরকে অনার্যও বলা হত। (এটি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর নিজস্ব মত। শূদ্র বর্ণ হিন্দু সমাজের চতুর্বর্ণের আওতাতেই পড়ত। সুতরাং তারা সকলেই আর্য বলেই স্বীকৃত)
৩. সম্প্রদায় পরিবর্তন
খ্রীষ্টীয় বা ইসলাম মতে পরাবর্তিত হওয়ার থেকে অনগ্রসর শ্রেণীর হিন্দুদেরকে আটকানো এবং তারা যে হিন্দু সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সেই কথাটি সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আর্য সমাজ শুদ্ধি আন্দোলন আরম্ভ করে। শুদ্ধি আন্দোলনের ভাবনা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর স্বতন্ত্র ভাবনা। শুদ্ধি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে পবিত্র করা। শুদ্ধি আন্দোলনের প্রসঙ্গে এই শব্দটিকে তিনটি অর্থে ব্যবহার করা হয়– ক) বৈদেশিক মতে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে হিন্দুত্বের পথে নিয়ে আসা, খ) যারা সদ্য অথবা পূর্বকালে কোন কারণ বশতঃ বিদেশী সম্প্রদায়কে স্বীকার করেছেন তাঁদের পুনঃপরিবর্তন, গ) শোষিত শ্রেণীর উন্নতি।
বিভিন্ন কালখণ্ডে হিন্দু সমাজে আগত বিকৃতিগুলিকে দূর করে বৈদিক মত পুনঃস্থাপনার মাধ্যমে আর্য মতকে শুদ্ধ রূপে প্রতিষ্ঠা করা এবং ঔপনিবেশিক খ্রীষ্ট্রীয় শক্তির আক্রমণকে সমাজকে রক্ষা করা।
স্বামী দয়ানন্দ বিধবাদের পুনর্বিবাহ, মহিলা শিক্ষা, পর্দা প্রথার নির্মূলকরণ এবং বাল্য বিবাহ নিষেধের সমর্থক ছিলেন।
প্রাথমিক জীবন
দয়ানন্দ সরস্বতী ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮২৪ খ্রী. গুজরাতের টঙ্কারাতে কর্পূরীলালজী এবং যশোদাবাঈয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশবের নাম ছিল মূলশঙ্কর। মূলশঙ্করের সচ্ছল এবং প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল ভগবান শিবের প্রবল ভক্ত। অত্যন্ত ধার্মিক পারিবারিক পরিবেশের কারণে মূলশঙ্কর বাল্যকাল থেকেই বিবিধ ধর্মীয় কর্মকাণ্ড, ধর্মপরায়ণতা, পবিত্রতা, উপবাস প্রভৃতির গুরুত্ব সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করেছিলেন। অষ্টম বর্ষে আড়ম্বরের সঙ্গে তাঁর উপনয়ন সংস্কার হয়। এই বয়সেই তাঁর ঔপচারিক শিক্ষায় প্রবেশ ঘটে। এই সময়েই তাঁকে শিবপূজার পদ্ধতি এবং বিভিন্ন ব্রতের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়।
কিন্তু ছোট বোন এবং কাকার মৃত্যুতে গভীর ধাক্কা খেয়ে মূলশঙ্কর জীবন ও মৃত্যু সম্বন্ধে গভীর চিন্তা শুরু করেন। মাতা-পিতাকে এই বিষয়ে নানা প্রশ্ন করার কারণে পিতা-মাতা অত্যন্ত চিন্তায় পড়ে যান। কৈশোরেই তাঁর বিবাহ নিশ্চিত করা হয় কিন্তু মূলশঙ্কর সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি কখনও বিবাহ করবেন না। ১৮৪৬ খ্রী. প্রব্রজ্যা স্বীকার করে গৃহত্যাগী হন।
তপস্বী
দয়ানন্দ সরস্বতী সত্যের অন্বেষণে ১৮৪৫ থেকে ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে প্রায় ২৫ বছর পরিব্রাজক জীবন যাপন করেন। তিনি ঐহিক সুখভোগ ত্যাগ করে সন্ন্যাসীর জীবন স্বীকার করেন। সত্যের অন্বেষণে তিনি অরণ্যে বসবাস শুরু করেন, হিমালয় সহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন তীর্থে তাঁর জীবন ব্যতীত হতে থাকে। এই সময়ে তিনি যোগ অভ্যাস করেন। বিরজানন্দ দণ্ডীশ নামক জনৈক সন্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন দয়ানন্দ। বিরাজনন্দজীর নিকট দয়ানন্দ সঙ্কল্প করেন যে, তিনি হিন্দু সমাজে বেদের হৃত স্থান পুনঃস্থাপিত করার কাজে জীবন সমর্পণ করবেন।
আর্য সমাজ
৭ এপ্রিল ১৮৭৫ দয়ানন্দ সরস্বতী মুম্বাই শহরে আর্য সমাজ স্থাপন করলেন। এটি ছিল আসলে একটি সংস্কার আন্দোলন। ‘আর্য সমাজ’ শব্দবন্ধের অর্থ হল ‘সজ্জনদের সমূহ’। আর্য সমাজের প্রমুখ দশটি সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ–
১. সমস্ত শক্তি এবং জ্ঞানের উৎস ঈশ্বর।
২. ঈশ্বরই সনাতন সত্য, সর্বব্যাপী, পবিত্র, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান এবং সৃষ্টির কারণ। কেবল তাঁরই পূজা হওয়া উচিত।
৩. বেদই সত্য জ্ঞানের গ্রন্থ। সেজন্য বেদ পড়া এবং অন্যদের পড়ানো সমস্ত আর্যের পরম ধর্ম।
৪. সত্য গ্রহণ এবং অসত্য বর্জনের জন্য সর্বদা তৎপর থাকতে হবে।
৫. যে কোন কাজ করার আগে ঔচিত্য-অনৌচিত্য বিচার করতে হবে।
৬. প্রত্যেক মানুষকেই শারীরিক, সামাজিক এবং আত্মিক উন্নতির জন্য কাজ করতে হবে।
৭. সকলের প্রতি ন্যায়, প্রেম এবং তার যোগ্যতা অনুসারে ব্যবহার করতে হবে।
৮. জ্ঞানের প্রকাশ ছড়িয়ে অন্ধকার দূর করতে হবে।
৯. কেবল নিজের উন্নতিতে সন্তুষ্ট না থেকে অপরের উন্নতির প্রয়াস করতে হবে।
১০. সমাজের মঙ্গলের জন্য, সমাজের উন্নতির জন্য নিজের মত এবং ব্যক্তিগত আহ্লাদ পরিত্যাগ করতে হবে।
আর্য সমাজের সদস্যদের পূজা, পবিত্র নদীতে তীর্থভ্রমণ এবং স্নান, পশু বলি, মন্দিরে দান, পৌরোহিত্যের আয়োজন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের নিন্দা করার নির্দেশ দিয়ে থাকে। আর্য সমাজ কেবল ভারতীয় মানসের আধ্যাত্মিক পুনর্নির্মাণই নয়, বরং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা দূরীকরণের জন্যও কাজ করেছে। এর মধ্যে অত্যন্ত প্রমুখ কাজ হল বিধবাদের পুনর্বিবাহ এবং নারী শিক্ষা। আর্য সমাজ ঊনবিংশ শতকের আশির দশকে বিধবাদের পুনর্বিবাহের কার্যক্রমের সূচনা করে। মহর্ষি দয়ানন্দ কন্যাদির শিক্ষার গুরুত্ব প্রচার করেন এবং বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করেন।
শিক্ষায় সংস্কার
মহর্ষি দয়ানন্দ বিশ্বাস করতেন যে, হিন্দু সমাজে বিকৃতির মুখ্য কারণ হল হিন্দু সমাজে বৈদিক জ্ঞানের অভাব। তিনি নিজের অনুসারীদের বেদ পড়া এবং বৈদিক জ্ঞানকে সর্বত্র প্রসারিত করার জন্য গুরুকুল স্থাপন করেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় তাঁর শিষ্যরা তাঁর মৃত্যর (১৮৮৩ খ্রী.) পরে ‘দয়ানন্দ এংলো বৈদিক কলেজ ট্রাস্ট এণ্ড ম্যানেজমেণ্ট সোসাইটি’ স্থাপন করেন। প্রথম DAV উচ্চ বিদ্যালয় ১ জুন ১৮৮৬ খ্রী. লাহোর স্থাপিত হয়। লালা হংসরাজ এই বিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য ছিলেন।
বিচার বিশ্লেষণ
স্বামী দয়ানন্দ খ্রীষ্ট মত এবং ইসলাম মত সহ বিভিন্ন ভারতীয় সম্প্রদায় যেমন বৌদ্ধ, জৈন, শিখ প্রভৃতির যুক্তিনির্ভর, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করেছেন। ফলে তাঁর উপদেশগুলি সমস্ত প্রাণিকুলের জন্য সার্বভৌমিকতার বার্তা বহন করে। কোন বিশেষ সম্প্রদায়, আস্থা, সমূহ কিংবা রাষ্ট্রের মধ্যে সেই উপদেশাবলী সীমিত নয়।
আর্য সমাজ মূর্তিপূজা, পশুবলি, তীর্থভ্রমণ, পৌরোহিত্য, মন্দিরে প্রসাদ নিবেদন, জাতিপ্রথা, বাল্যবিবাহ, আমিষ ভক্ষণ এবং মহিলাদের প্রতি বৈষম্যের নিন্দা করে থাকে।
হত্যা
প্রখর বুদ্ধি এবং সামাজিক সমস্যার বিষয়ে স্পষ্ট দৃষ্টিকোণের কারণে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর বহু শত্রু ছিল। ১৮৮৩ খ্রী. দীপাবলীর সময়ে যোধপুরের মহারাজ দ্বিতীয় যশবন্ত সিংহ গুরুর আশীর্বাদ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে মহর্ষি দয়ানন্দকে রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
দয়ানন্দ সরস্বতী রাজদরবারে নৃত্যপ্রদর্শন বন্ধ করে ধর্মশিক্ষার নিরীখে জীবন যাপনের উপদেশ দেন তখন রাজদরবারের নর্তকী স্বামী দয়ানন্দের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। সেই নর্তকী রাজপ্রাসাদের পাচকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে দয়ানন্দজীর পানীয় দুধে কাচের গুঁড়ো মিশিয়ে দেন। দয়ানন্দজী সেই দুধ পান করে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতর হয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন। ৩০ অক্টোবর ১৮৮৩ খ্রী. মৃত্যুর পূর্বে তিনি সেই পাচককে ক্ষমা করে দিয়ে যান।
পরম্পরা ও উত্তরাধিকার
বর্তমানে আর্য সমাজ কেবল ভারতেই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ত্রিনিদাদ, মেক্সিকো, ব্রিটেন, নেদারল্যাণ্ড, কেনিয়া, তানজানিয়া, উগাণ্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, মলাওই, মরিশাস, পাকিস্তান, মায়ানমাল, থাইল্যাণ্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশেও নিজের কার্য বিস্তার করেছে।
মহর্ষি দয়ানন্দ এবং আর্য সমাজ কদাপি সরাসরি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি, কিন্তু লালা লাজপত রাঈ, বিনায়ক দামোদর সাভারকর, ম্যাডাম কামা, রামপ্রসাদ বিসমিল, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, মদনলাল ধিংড়া, সুভাষ চন্দ্র বসু প্রভৃতি বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনে দয়ানন্দজীর উপদেশের গভীর প্রভাব ছিল। হুতাত্মা ভগৎ সিং লাহোরের DAV উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।
দয়ানন্দজী ষাটের বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার মধ্যে ১৬ খণ্ডে ছয় বেদাঙ্গের ব্যাখ্যা, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের উপর টীকা (অপূর্ণ), নীতি ও নৈতিকতা, বৈদিক অনুষ্ঠান ও সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে বহু পুস্তিকা এবং বিরোধী মত খণ্ডন বিষয়ে একটি ছোট গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। তাঁর সত্যার্থ প্রকাশ, সত্যার্থ ভূমিকা, সংস্কারবিধি, বেদ ভাষ্য ভূমিকা, ঋগ্বেদ ভাষ্য (৭/৬১/২ পর্যন্ত), যজুর্বেদ ভাষ্য প্রভৃতি গ্রন্থও উল্লেখযোগ্য।