‘স্বচ্ছ ভারত’ কেন্দ্রীয় সরকারের সব থেকে বেশি আলোচিত ও প্রচারিত প্রকল্প। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর গান্ধী জয়ন্তীর দিন দিল্লির রাজঘাটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। স্বাধীনতার পর পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া এটাই সব থেকে বড় কর্মসূচি।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মতো ২০১৯-এর ২ অক্টোবর, মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মজয়ন্তীতে দেশকে প্রকাশ্যে মলত্যাগমুক্ত করে তুলতে হবে। এজন্য দেশের গ্রামাঞ্চলে ১ কোটি ২০ লক্ষ শৌচাগার নির্মাণ করা হবে ১.৯৬ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ে। এই সুবৃহৎ কর্মসূচি রূপায়ণে অর্থ অবশ্যই প্রয়োজন। দেশের নিজস্ব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের পাশাপাশি পাওয়া গেছে বিদেশের সহায়তাও। এই প্রকল্পে অর্থ যুগিয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাঙ্কও।
মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর সেই ঐতিহাসিক সংগ্রামের দিনগুলোতেই পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। ট্রান্সভাল-এ হীরের খনির শ্রমিকদের মধ্যে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার খবর পেয়ে চার অনুরাগী সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে ছুটে যান গান্ধীজি। আক্রান্তদের অধিকাংশই আফ্রিকার হলেও তাঁদের মধ্যে ছিলেন ২৩ জন ভারতীয় শ্রমিক। এদের সেবা-শুশ্রূষা করার ফাঁকেই তিনি উপলব্ধি করেন যে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অনুন্নত স্বাস্থ্যবিধি প্রভৃতি কারণে রোগ ছড়িয়েছে। এরপর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টাকে তিনি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতেন। ১৯০১ সালে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের সময় প্রথমবার কলকাতায় থাকাকালীন গান্ধীজিকে সব থেকে যেটা পীড়া দিয়েছিল, তা হল শৌচাগারের অপরিচ্ছন্নতা। কংগ্রেস অধিবেশন চলাকালীন গান্ধীজি সে সময় নিজে থেকেই কংগ্রেসের নানা ধরনের কেরানীসুলভ কাজকর্মও করে দিতেন আর সেই নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলেই হাজার ইচ্ছে সত্ত্বেও শৌচাগারগুলির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুনিশ্চিত করতে পারেননি। কেবল নিজে যেটি ব্যবহার করতেন, সেটি স্বহস্তে পরিষ্কার করতেন। উপস্থিত নেতৃবৃন্দের অনেকের এ সম্পর্কে উদাসীনতাও তাঁকে বিস্মিত করেছিল। পরবর্তীকালে পুনের ইয়েরবেদা জেলে থাকাকালীন গান্ধীজি নিজের হাতে সকলের ব্যবহৃত মলপাত্র পরিষ্কার করতেন, পত্নী কস্তুরবার আপত্তি সত্ত্বেও তাঁকেও ওই কাজে বাধ্য করেছিলেন, কারণ তাঁর মতে, পরিচ্ছন্নতা-ই হ’ল ঈশ্বরলাভের শ্রেষ্ঠ উপায়।
মহাত্মা গান্ধীর সেই দৃষ্টিভঙ্গী স্বাধীন ভারতে হয়তো যথোচিত গুরুত্ব পেত যদি না স্বাধীনতা লাভের পাঁচ মাসের মধ্যেই তাঁর মর্মান্তিক জীবনাবসান ঘটত।
প্রকৃতপক্ষে পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচ ইত্যাদির সম্পর্কে আমরা বরাবরই বেশ উদাসীন। ইংরেজ আমলে এসব নিয়ে যেটুকু গুরুত্ব দেওয়া হ’ত, স্বাধীনতার পর কলকাতা সহ বিভিন্ন শহরের পৌর-ব্যবস্থায় সেদিকে আদৌ নজর দিতেন না নেতারা। সেযুগে নিকাশি ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ছিল বরাবরই বিরোধী পক্ষের প্রধান অস্ত্র। ১৯৮০ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলের মাত্র ১ শতাংশ ছিল স্বাস্থ্যস্মমত শৌচ ব্যবস্থার আওতায়। এই হার বেড়ে ৩১ শতাংশে পৌঁছয় ২০০৮ সালে। স্বাস্থ্যসম্মত শৌচ ব্যবস্থার সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে উন্নত জল সরবরাহ ব্যবস্থার। এদেশের জনসংখ্যার মাত্র ৭২ শতাংশ ১৯৯০ সালে উন্নত জল সরবরাহ ব্যবস্থার সুযোগ পেতেন। ২০০৮ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮ শতাংশে। কিন্তু ২০১০ সালেও রাষ্ট্রসঙ্ঘের দেওয়া পরিসংখ্যানে জানানো হয় যে, ভারতে অন্তত সাড়ে ৫২ কোটি মানুষ প্রকাশ্যে মলত্যাগে অভ্যস্ত।
অথচ, এই ভারতেই সেই প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার কালেই উন্নত নগর ব্যবস্থার প্রমাণ মিলেছে। হরপ্পা, মহোঞ্জোদড়ো থেকে শুরু করে গুজরাটের ধোলাভিরা পর্যন্ত যেসব নগরের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গেছে, তার প্রতিটিতেই ছিল উন্নতমানের শৌচাগার, এমনকি আজকের ফ্ল্যাশ টয়লেটও!
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার পর থেকেই পরিচ্ছন্নতার প্রতি সকলের দৃষ্টি ফিরেছে। মোদী ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্প ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন ক্ষেত্রের ১২ জন জনপ্রিয়তম ব্যক্তিত্বকে এই প্রকল্পের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার ঘোষণা করায় তাঁরাও পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। সেই থেকে ধীরে ধীরে প্রচারের আলো এই কর্মসূচির ওপর বেশি করে পড়তে থাকে। ক্রমেই আরও বেশি সংখ্যক তারকা ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন। চলচ্চিত্র জগৎ, ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলা, সঙ্গীত, সাহিত্য ও শিল্প-ভাস্কর্য প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রের কৃতীরা পরিচ্ছন্নতার প্রসারে প্রধানমন্ত্রীর নজিরবিহীন উদ্যোগে সামিল হন।
‘স্বচ্ছ ভারত’ কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে এসেছে ‘স্বচ্ছ সর্বেক্ষণ সমীক্ষা’, যা এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিচ্ছন্নতা সমীক্ষা হিসাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। গত ৪ জানুয়ারি এ বছরের ‘স্বচ্ছ সর্বেক্ষণ সমীক্ষা’ শুরু হয়েছে। দেশের ৪,০৪১টি শহর-নগরে এই সমীক্ষা চলবে আগামী মাসের শেষ পর্যন্ত। প্রায় ৪০ কোটি মানুষ এবার এই সমীক্ষার আওতায় আসবেন বলে জানিয়েছেন আবাসন ও নগর বিষয়ক দপ্তরের ‘স্বচ্ছ ভারত মিশন’-এর অধিকর্তা ভি কে জিন্দাল। এবার সমীক্ষার মূল্যায়নে ‘নেগেটিভ মার্কিং’-এরও ব্যবস্থা থাকছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ভুয়ো তথ্য দিলে শাস্তি হিসাবে এই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শহর-নগরের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক সংস্থাগুলি যেমন পরিচ্ছন্নতার ওপর বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে, এই কর্মসূচিকে উৎসাহিত করতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিটি দপ্তরের পক্ষ থেকে তেমনই জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে ‘স্বচ্ছ ভারত পক্ষ’ পালন শুরু হয়েছে গত বছর থেকে। নিজেদের দপ্তর ও তার আশেপাশের পরিবেশ কলুষমুক্ত রাখতেই এই উদ্যোগ। কলকাতার কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরগুলির অধিকাংশই নানাভাবে ‘স্বচ্ছ ভারত পক্ষ’ পালন করে মহানগরীর পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে বিশেষ প্রয়াস নিয়েছে। পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব রেল এবং মেট্রো রেল-এর পক্ষ থেকে স্টেশনগুলি ও তার আশপাশের এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখতে এই ক’দিনে বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেন্ট্রাল এক্সাইজের কলকাতা-২ কমিশনারেটের পক্ষ থেকে ব্যাম্বু ভিলা সহ তার আশেপাশের এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখতে বিশেষ অভিযান চলে। পলিথিন প্রতিরোধী সচেতনতা অভিযান চালানো হয় বাবুঘাটের গঙ্গাসাগর তীর্থযাত্রীদের অস্থায়ী শিবিরে এবং ব্যাম্বু ভিলার আশেপাশে বেনিয়াপুকুর এলাকায়। বিভিন্ন অফিস প্রাঙ্গণে বৃক্ষরোপণ-ও করা হয় এই উপলক্ষে। পরিচ্ছন্নতা একটা অভ্যাস আর এই অভ্যাস বজায় রাখলে অন্যরাও যে তার প্রতি গুরুত্ব দেন, প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি) দপ্তরেও সেটা আরও একবার প্রমাণিত হ’ল। দপ্তরের প্রবেশপথে পিআইবি এবং ডিএভিপি’র যৌথ উদ্যোগে পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়, তারই ফলে সম্পূর্ণ প্রবেশপথটি যেন এক নতুন রূপ ধারণ করে। আগে ওই এলাকায় ইতস্তত জঞ্জাল পড়ে থাকতে দেখা যেত। কিন্তু প্রদর্শনী শুরু হওয়ার পর থেকে গোটা প্রবেশ-পথটি ঝকঝক করছিল। এ সবই হ’ল ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর দরুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সুফল।
২০১৬’তে দেশের প্রথম ‘স্বচ্ছ সর্বেক্ষণ সমীক্ষা’য় যোগ দিয়েছিল ৭৩টি শহর-নগর। কর্নাটকের মহীশূর সেবার দেশের পরিচ্ছন্নতম নগরের মর্যাদা পায়। ২০১৭’তে ৪৩৪টি নগরীকে নিয়ে করা সমীক্ষায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পায় মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর। এবারে এই শীর্ষস্থান কে পাবে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ৪,০৪১টি নগরীর মধ্যে। তবে, বিনা খবরে মূল্যায়নের পরিবর্তে তিনদিন আগে থেকে জানিয়ে-শুনিয়ে পরীক্ষা করতে আসায় মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, কেননা অনেকেই বলছেন খবর পাওয়ার পর তিনদিন ধরে সাফ-সাফাই হচ্ছে, আর তার ওপরেই দেওয়া হচ্ছে নম্বর। ফলে, সারা বছরের পরিচ্ছন্নতার চালচিত্র এতে মিলবে না! সে যাই হোক, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে যে মানুষের দৃষ্টি ফিরেছে, এ নিয়ে নানা মহলে আলাপ-আলোচনা চলছে, এটাই বড় কথা। কারণ, মানসিকতার পরিবর্তন হলে তবেই আমরা দেশকে আর পাঁচটা উন্নত দেশের মতো পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারব, নচেৎ নয়।