যে কেউ শুনেছে, বিশ্বাস করতে পারেনি, বার বার ভাবছে এ খবর নিশ্চয়ই ভুল। সুষমা স্বরাজের হঠাৎ চলে যাওয়া ভরদুপুরে অন্ধকার। নেমে আসার মতো অবস্থা। এর কারণ হলো শুধুমাত্র ওঁর স্বভাব। ওঁর বিদ্যা, বাচনভঙ্গিতে সারস্বত প্রভাব এবং ওঁর নিরহংকারিতা।
গত ত্রিশ বছর ধরে তাঁকে জানার, তাঁর সঙ্গে কাজ করার ও তার স্নেহ পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। পাঞ্চজন্য পত্রিকার প্রত্যেক অনুষ্ঠানে তার বাড়ি থেকে সরস্বতী মূর্তি আনা হতো এবং পরে ওই মূর্তি তিনি নিয়ে যেতেন। ১৯৯৬-৯৭ সালে লাদাখে যখন সিন্ধু দর্শন ও উৎসবের পরিকল্পনা চলছিল তখন তিনি দূরদর্শন কর্তৃপক্ষকে বলে তাড়াতাড়ি ওই বিষয়ে একটি দশ লাইনের সিন্ধুগাথা তথ্যচিত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন। আসলে সুষমা স্বরাজ সবার জন্য সমান চিন্তা করতেন। পনেরো বছর পূর্বে তিনি একবার অসুস্থ হয়েছিলেন, খুব কষ্ট ছিল, মনের মধ্যে অনেক খেদও ছিল। আমি দেখা করতে গেলে বললেন— ‘তরুণজী ভগবান কৃষ্ণের ইচ্ছাই সব’। সুস্থ হওয়ার পর কয়েক সপ্তাহ বাদে মন্ত্রী হওয়ার পর একই সংযম, সমান শালীনতা দেখা গেল। তিনি বললেন— ‘তরুণজী এটাও কৃষ্ণের কৃপা। তিনি যা চান তাই হয়েছে।’
তিনি কখনও কারও দুঃখ দেখতে পারতেন। । কাউকে আঘাত দিতেন না। কখনও কাউকে কটু কথা, অভদ্র, অশালীন শব্দ ব্যবহার করে লিখতেন না, কারও সম্বন্ধে কটু কথা শুনতেন না। কিছুদিন আগে দেশের মধ্যে খুবই সম্মাননীয় শ্রদ্ধাবান, সন্তান-সম মাঙ্গেরাম গর্গকে শ্রদ্ধা জানানো তাঁর টুইটের বিপরীত টুইট কেউ করেছে, যাতে গর্গজীর মৃত্যু হবারই ছিল, সেখানেও সুষমা এত সুন্দর, ভদ্র ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন, যাতে দেশভর চর্চা হয়েছিল। ভদ্রতা খুবই দুর্লভ গুণ। বড়ো হওয়া সহজ, কিন্তু ভদ্র হওয়া কঠিন। সুষমা ভদ্রতার প্রতিবিম্ব ছিলেন। সেই জন্য তাকে অটলজীর মতোই অজাতশত্রু বলা হতো। জরুরি অবস্থার সময় সংঘর্ষ করেছেন, জে. পি.-র আন্দোলনে সবচেয়ে কম বয়সের যুবা নেত্রী ছিলেন। রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির শিবিরে যাওয়া, সমিতির অধিকারী শান্তা আক্কা, প্রমীলা তাইজীর সঙ্গে সর্বদা সম্পর্ক রাখা, প্রখর হিন্দুধর্মের ধ্বজবাহিকার মতো কাজ করা, সমস্ত উৎসবকে রাষ্ট্রীয় রূপ দেওয়া। এই সমস্ত কাজ দেখে সাধারণ কার্যকর্তারা এমনকী যারা সঙ্ঘ বা বিজেপির সঙ্গে জড়িত নয়, তাদেরও মন জুড়ে যেত।
‘কারোয়া চৌথ’-এর সময় তার ওখানে যে সমাগম ও ব্রত উদযাপন উৎসব হতো, তা ভারতীয় পরম্পরার এক ঐতিহ্যবাহী সমাগমের সমান। একবার রক্ষা বন্ধনের দিনে আমার বোন আমাকে সময়মতো রাখি পরাতে পারেনি। এ খবর শুনে সুষমা তৎক্ষণাৎ বললেন, আমি আছি, আমি রাখি পরাব। একথা আমি জীবনে ভুলতে পারব না।
বিদেশ মন্ত্রণালয় বা কোনো ব্যক্তিগত কাজ থাকলে তিনি নিজে নির্দ্বিধায় অতিথিদের ফোন করে বলতেন, অবশ্যই আসবেন, ভুলবেন না। জগতে এমন কে আছে, এই ফোন পাওয়ার পরও অনুপস্থিত থাকবে। যে কোনো কাজে বিন্দুমাত্র ভুল না করা। অপরের উপর নির্ভরতা কখনও করতেন না। বিভিন্ন দেশের বিদেশ মন্ত্রণালয় বা দুতাবাস অফিসার প্রায়শই ভারতীয়দের প্রতি সংবেদনহীন হয়ে থাকে। সুষমা বিদেশ মন্ত্রণালয়কে বিশ্বব্যাপী স্বদেশ মন্ত্রণালয়ে পরিণত করেছিলেন। যে কোনো ভারতীয় বিশ্বের যে কোনো স্থানে কোনোরকম বিপদে পড়ে যদি সুষমাকে টুইট করে, তৎক্ষণাৎ তার সমাধান হয়ে যেত। এই রকম সহায়তা পেয়ে আফ্রিকা, রাশিয়া, ইউরোপ, আরব, পাকিস্তানে বসে ভারতীয়দের চোখে জল এসে যেত। সুষমা বোন, সুষমাদিদি, আমাদের মা ইত্যাদি। কত মধুর সম্বোধনে তারা দূর থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এরকম কত উদাহরণ— খ্রিস্টান পাদরি, মুসলমান বোন, পাকিস্তানের গীতা, জার্মানির সর্দারজী, আমেরিকাতে বিয়ে হওয়া নববধূযারা সুষমাজীর বিশ্বব্যাপী স্বদেশ মন্ত্রণালয়ের সাহায্য পেয়েছে।
যে কেউ যে কোনো দলের বা মত-পন্থের হতে পারে, সে সুষমাজীর সঙ্গে সরাসরি সহজেই কথা বলতে পারে, যেন মনে হয় অনেকদিনের পরিচিত। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, পুতিন, শি জিন পিং, ওবামা, আরব দেশের শেখ- সবাই সুষমার কাছে মাথা নামিয়ে নমস্কার করেছেন এবং এমন তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল যে বিশ্বের তাবড় নেতারাও সুষমার সামনে অদ্ভুত বিনয়পূর্ণ ব্যবহার ও সম্মানের ভাব প্রকাশ করতেন।
সূচনা প্রসারণ, স্বাস্থ্য, বিদেশ দপ্তরের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় চালাতে গিয়ে নিজের যোগ্যতার ছাপ রেখে গেছেন। ২৫ বছর বয়সে প্রথম মন্ত্রী হয়ে ৬৭ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ ৪২ বছর ভারতীয় রাজনীতির মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো অদ্ভুত গরিমার সাক্ষ্য রেখে গেছেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে এমনই এক আকাশ গঙ্গা ছিলেন যা অনেক উঁচুতে থেকেও সাধারণ মানুষকে শীতল ও সুখকর আত্মীয়তা প্রদান করেছেন। তাঁর জীবনচর্যা, সর্বসাধারণের জন্য এক গুরত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। ভাষার মাধুর্য ও মিষ্টতার জন্য সুষমা স্বরাজ ভারতীয় রাজনীতিতে সরস্বতীর বরপুত্রী ছিলেন। তাঁর কোনো তুলনা নেই, কোনো বিরোধী নেই, নির্ভীক, দৃঢ়। ভাষাতে তার অদ্ভুত দখল ছিল। কর্ণাটকে গিয়ে কন্নড় শিখছেন, গুজরাটে গুজরাটি, তামিনাড়ু গিয়ে তামিল ভাষায় কথা বলেছেন। ওখানকার লোক অবাক। হয়ে যাচ্ছে। আমাকে প্রায়ই বলতেন— তুমি তামিলনাড়ুতে কাজ করছ, আমাকে জানাবে, তামিল সংস্কৃতি খুব বিরাট ও মহান। পূর্ব এশিয়ার ব্যাপারে তার বিশেষ নজর ছিল। লুক ইস্ট’ পলিসিকে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ পরিণত করা তার বিশেষ প্রয়াস ছিল।
দেশে বিদেশে সব সম্প্রদায়ের প্রতি সমভাব, হিন্দুত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, মহিলা জাগৃতি, পরম্পরার প্রতি দিশা, ভাষার সমৃদ্ধি, ভারতের শত্রুদের প্রতি রণচণ্ডী মূর্তি, সমস্ত ভারতীয়র কাছে মাতৃস্বরূপা। এই সুষমা আজ কোথায় ?
তরুণ বিজয়
(লেখক রাজ্যসভার পূর্বতন সাংসদ)
2019-08-17