বাঙ্গলার তাঁতের শাড়ি খুব ভালবাসতেন সুষমা স্বরাজ। আসলে শাড়ির ব্যাপারে ওঁর ছিল এক বিশেষ আগ্রহ। নানা রাজ্যের নানা ধরনের শাড়ি। শাড়ি নিয়ে ওঁর সঙ্গে আমার অনেক আলোচনা হতো। সুষমা বলতেন, শাড়ি হলো এক অখণ্ড ভারতেরই প্রতীক। বাঙ্গলার তাঁতের শাড়ি, তামিলনাড়ুর পোচমপল্লি, রাজস্থানের কোটা, সম্বলপুরী, ভাগলপুরের তসর—বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। আসলে সুষমার মধ্যে সব সময়ই বিরাজ করত এক ট্রাডিশনাল ভারতীয় নারী। কপালে লাল টিপ, মাথায় চওড়া সিঁদুর। একটু হাইহিল জুতো পরতেন। নিঃসংকোচে বলতেন, ‘আমি ছোটোখাটো মানুষ তো’। মঞ্চেও যখন বক্তৃতা দিতে যেতেন তখন তার জন্য একটা ছোটো কিন্তু উঁচু প্ল্যাটফর্ম দেওয়া হতো। সুষমা তার উপর দাঁড়িয়ে বক্তব্য পেশ করতেন। তার বক্তৃতা যখন শুরু করতেন তখন ওর ছোটোখাটো শরীর থেকে যেন তেজ প্রকাশ পেত। মনে হতো তিনি এক অন্য মানুষ। হিন্দি, সংস্কৃত, ইংরাজি তিনটি ভাষাতেই তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন। তবে হিন্দিটা শুনতে সবচেয়ে ভালো লাগত। আজ থেকে ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়। যখন ৮৭ সালে প্রথম দিল্লি আসি তখন আমার হিন্দি স্বভাবতই এখনকার চেয়েও আরও খারাপ। তখন ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলেই নতুন নতুন কিছু হিন্দি শব্দ শিখতাম। লালকৃষ্ণ আদবানীর মাতৃভাষা হিন্দি ছিল না, তাঁর মাতৃভাষা ছিল সিন্ধি। কিন্তু আদবানী বলতেন, করাচিতে আরএসএসের শাখা করতে গিয়ে আমি হিন্দি শিখেছি। সুষমা তো কখনও আরএসএস করেননি কিন্তু তিনি কলেজ জীবন থেকেছিলেন ডিবেটার। চণ্ডিগড় হরিয়ানায় তার বিতর্ক শুনে রাজনীতি নিরপেক্ষ ভাবে মানুষ মুগ্ধ হয়ে যেতেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই লোকদল থেকে এসে সুষমা বিজেপি আরএসএস তথা সঙ্ পরিবারের সংস্কৃতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। প্রিয়পাত্রী হয়ে ওঠেন সকলের।
লালকৃষ্ণ আদবানীই তাকে দলে নিয়ে আসেন। জহুরি জহর চেনেন। সুষমার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় পাণ্ডারা পার্কে আদবানীজীর পুরনো বাড়িটাতে। তারপর ক্রমশ সম্পর্ক বাড়তে থাকল। আলাপ হলো ওঁর স্বামী স্বরাজ কৌশলের সঙ্গে। স্বরাজ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী। অনেক সময় সংসদের সেন্ট্রাল হলে মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় স্বরাজ সেখানে চলে আসতেন। দুজনে মিলে মধ্যাহ্ন ভোজন সারতেন। কখনও কখনও এই ‘পেটুক বামুন’-ও সেখানে জুটে যেত। সুষমা নিরামিষাশী ছিলেন কিন্তু ছুঁতমার্গ ছিল না। আমাকে বলতেন, বাঙ্গালি তুমি কেন নিরামিষ খাবে? ফিশফ্রাইয়ের অর্ডার দিয়ে বলতেন, বাঙ্গালি মাছ খাবে না সেটা কীভাবে সম্ভব? পশ্চিমবঙ্গ নিয়েও সুষমার উৎসাহ খুব প্রবল ছিল। একবার মজা করে বলেছিলেন, জানোতো ছোটো বেলায় যখন শরৎচন্দ্রর শ্রীকান্ত হিন্দিতে পড়েছিলাম, তখন ভেবেছিলাম শরৎচন্দ্র সম্ভবত হিন্দিভাষী, হিন্দি বলয়ের মানুষ। পরে জানলাম তিনি ছিলেন বাঙ্গালি। এরপর রবীন্দ্রনাথ থেকে শরৎচন্দ্র হিন্দিতে অনুবাদ পড়তে শুরু করলাম। খুব আনন্দ পেতাম। প্রেমচন্দ্র আরশরৎচন্দ্র একসঙ্গেই পড়তাম। আমি বললাম, শরৎচন্দ্রর বই হিন্দিতে এত । বেশি অনুবাদ হয়েছে, এত হিন্দি ছবি হয়েছে। যে এই ধারণাটা হিন্দি বলয়ে একটা জনপ্রিয় ভুল ধারণা। একবার তো এলাহাবাদে একজনের সঙ্গে আমরা রীতিমতো ঝগড়া হয়ে যায়। তিনি কিছুতেই মানতে রাজি নন। যে শরৎচন্দ্র বাঙ্গালি। তিনি প্রায় ওকে এলাহাবাদী বলেই ঘোষণা করলেন। আমার এ অভিজ্ঞতার কাহিনি সুষমার এতটাই ভালো লেগেছিল যে এর পর আর ও অনেককে তিনি এ কাহিনি জনে জনে বলতেন।
আদবানীর স্ত্রী কমলাদেবী সুষমাকে খুব ভালোবাসতেন। সুষমা জীবনের শেষ দিন। পর্যন্তই ছিলেন আদবানী পরিবারের এক সদস্যা। পুত্র জয়ন্ত এবং কন্যা প্রতিভাও ওকে মনে করতেন যেন এক জন। অভিভাবক। হয়তো বাবাকে কোনও কথা বলা যাচ্ছে না, প্রতিভা সেটা গিয়ে বলত সুষমাকে। ওদের বাড়িতে আদবানীর জন্মদিন, কমলাজীর জন্মদিন অথবা ওদের বিবাহবার্ষিকীতে পিছনের লনে পার্টি হতো। তাছাড়া আদবানীজী ফিল্ম দেখতে ভালোবাসতেন, কত হিন্দি বলিউডের ছবি যে মহাদেব রোডের অডিটোরিয়াম বা সিরিফোর্ট অডিটোরিয়ামে দেখিয়েছেন তার কোনও হিসেব নেই। আদবানীর বাড়ির এমন কোনও অনুষ্ঠান বা সামাজিক পারিবারিক গেটটুগেদার হয়নি যেখানে সুষমা আসেননি। সবচেয়ে মজা হতো দোলের দিন। তখন আদবানীর বাড়িতে এক অসাধারণ দোল খেলা হতো। শুকনো নয়, গিলা হোলি। প্রথমে আবির দিয়ে শুরু হতো, তারপর বিরাট বাথটবে রং গুলে সেই জলে কার্যত স্নান। বাথটবটা হাওয়া দিয়ে ফোলানো বিশাল প্লাস্টিকের। কমলাজী-আদবানীও খেলতেন। সেসব কী আনন্দের দিন ছিল। সুষমা আসতেন খুব সকাল সকাল যাতে ওঁকে রং মাখানো না হয়। আবির দিয়ে আদবানীকে আর কমলাজীকে প্রণাম করে তিনি পালাতে চাইতেন। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে, তাড়াতাড়ি পালানোর সময় হঠাৎ প্রতিভা পিছন থেকে এসে ওর গায়ে ঢেলে দিল এক বালতি রং। সুষমাকে দেখে তখন সবাই হাসছে। সুষমাও হাসতে হাসতে প্রতিভাকে জড়িয়ে ধরে আবির মাখাতে লাগল তার হাতে রাখা স্টক থেকে।
সুষমার সফদরজং রোডের বাসভবনে যেতাম, বাজপেয়ী যে বাড়িটিতে থাকতেন তার পাশ দিয়েই সুষমার বাড়িতে যেতে হতো। ওই বাড়িতেই সুষমার শরীরটা প্রথম খারাপ হতে থাকে। সুগারটা ক্রমশ বাড়তে লাগল। এমন একটা অবস্থা হলো যে ইনসুলিন দেওয়া হতে লাগল। মেয়ে বাঁশরি তখন লন্ডনে অক্সফোর্ডে পড়ছে। বাড়ি ফিরে যতই ক্লান্ত হয়ে পড়ুন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন, পরের দিকে তো স্কাইপও করতেন সুষমা। পরে বাঁশরি দিল্লি ফিরে এসে যখন সুপ্রিম কোর্টে প্রাকটিস করতে শুরু করলেন তখন সুষমা এক গর্বিত মা। তবে কখনই কোনও রাজনৈতিক গেট টুগেদারে আমি বাঁশরিকে দেখতাম না। এ ব্যাপারে বোধহয় সুষমার সচেতন কোনো পরামর্শ ছিল।
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সুষমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিন্তু চিরকাল খুব ভালো ছিল। বরং বলব, প্রমোদ মহাজনের সঙ্গে সুষমা ও মোদীর দূরত্ব বেশি ছিল। আমি বিজেপির জাতীয় কর্ম সমিতির বৈঠক কভার করতে তখন নিয়মিত যেতাম। এখন সময়ের অভাবে বেশিরভাগ বৈঠক দিল্লিতে হয়। তখন কিন্তু তা ছিল না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একবার এক একটি মেট্রোপলিটন শহরে বৈঠক হতো। কখনও ইন্দোর, কখনও মুম্বই, কখনও কেরল। এসব বৈঠকগুলিতে গেলে সব নেতা-নেত্রী একই হোটেলে একই সঙ্গে থাকতেন। বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় অসাধারণ আড্ডা হতো। তখনই দেখতাম অনেক সময় নরেন্দ্র মোদীর ঘরে সুষমা আসতেন। চা-পকোড়া সহযোগে সেসব সান্ধ্য আড্ডা ছিল অতুলনীয়।
এবার ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে ভোপালে বিজেপির রাজ্য কর্মর্সমিতির বৈঠক বসল টিকিট বণ্টন নিয়ে। তার আগেই সুষমা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে এবার আর ভোটে দাঁড়াবেন না। কিডনি প্রতিস্থাপনের পর তিনি ভালোই ছিলেন কিন্তু বিদেশমন্ত্রী হিসেবে এত সফর দেখে চিকিৎসকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন। সুষমা। বলেছিলেন আমার তো একটা দেশ থেকে ফিরতে না ফিরতেই অন্য আর একটা দেশে ছুটতে হয়। আমি বলি একটা জেট ল্যাগ থেকে আর একটা জেট ল্যাগে দৌড়চ্ছি বলে মনে হয়। আমি বললাম আমরা বিদেশ যাত্রার সুযোগ পেলেই মনে হয় যাই যাই। আর আপনি ক্লান্ত।
মোদী কিছু বলার আগেই সুষমাই তাকে বলেন এবার ছুটি চাই। আর ভোটে দাঁড়াব না। মন্ত্রীও হতে চাইনা। মোদী আর সুষমার বয়সের ব্যবধান মাত্র এক বছর। মোদী সুষমার চেয়ে এক বছর বড়ো, ৬৮ বছর বয়স। আর অরুণ জেটলি সুষমার চেয়ে এক বছরের ছোটো। মোদী তখনই সুষমাকে বলেছিলেন ভোটে লড়বেন না ঠিক আছে। কিন্তু আপনাকে আমার প্রয়োজন। কী দায়িত্ব তাকে এবার দেবেন মোদী এই নিয়ে গবেষণা চলছিল। কেউ বলছিল, রাজ্যপাল হবেন। সুষমা। কেউ বলছিলেন, সুষমা বাগ্মী, তাকে। রাজ্যসভায় আনতে আগ্রহী মোদী। হঠাৎসব গবেষণারই অবসান ঘটিয়ে তিনি বললেন, আলবিদা। চললাম।
জয়ন্ত ঘোষাল
(লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক)
2019-08-17