Story image

কিছুদিন আগে পর্যন্ত ‘সুপ্রভা রায়’ নামটি গুগল করলে দেখা যেত, ছবি হোক বা লেখা, কখনো তিনি স্বামীর (সুকুমার রায়) সঙ্গে, কখনো সন্তানের (সত্যজিৎ রায়) সঙ্গে, কখনো আবার পূত্রবধূর (বিজয়া রায়) সঙ্গে। প্রত্যেকেই তাঁর আপনজন, তাঁদের সঙ্গে জুড়ে থাকবেন এ তো স্বাভাবিক ঘটনা। তবুও, তাঁকে নিয়ে আলাদা করে কথা বলার মতো কি কিছুই ছিল না?

 সুপ্রভা রায়, বিজয়া রায় এবং ছোট্ট সন্দীপ রায়ের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়। ১৯৫৮ সালে ‘জলসাঘর’-এর শুটিং চলাকালীন। ছবিসূত্রঃ সত্যজিৎ রায় – দ্য মাস্টার স্টোরিটেলার

সুপ্রভা রায়কে নিয়ে বিশদ লেখা বা বই আগে প্রকাশিত হয়নি ঠিকই, তবে সত্যজিতের ‘যখন ছোটো ছিলাম’ বা অন্যান্য লেখা সূত্রে জানার অবকাশ ছিলই যে, ছোটোবেলায় মায়ের কাছেই প্রথম ‘ব্লু জন গ্যাপ’ আর ‘ব্রেজিলিয়ান ক্যাট’ নামে দু’টি ইংরেজি গল্প শুনেছিলেন। পরে সত্যজিৎ এই দু’টি গল্পই বাংলায় অনুবাদ করেছেন—‘ব্লু জন গহ্বরের বিভীষিকা’ আর ‘ব্রেজিলের কালো বাঘ’। জানা যায়, এক মাসতুতো ভাইয়ের কাছে চামড়ার কাজ শিখেছিলেন সুপ্রভা। মাটির মূর্তি গড়ার কাজ শিখেছিলেন সেসময়ের পরিচিত মৃৎশিল্পী নিতাই পালের কাছে। সুপ্রভার তৈরি বুদ্ধ আর প্রজ্ঞাপারমিতার মূর্তি এখনো রয়েছে রায়পরিবারের সদস্যদের কাছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত ও ব্রহ্মসঙ্গীতেও তাঁর বেশ দখল ছিল। সেসময় অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে একরত্তি শিশুকে নিয়ে কীভাবে শক্তহাতে হাল ধরেছিলেন একা এক নারী, এটা যেমন আলোচ্য বিষয় তেমনই প্রয়োজন ছিল সুপ্রভার ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার দিকগুলো নিয়ে আলোচনা-গবেষণা করা।

১৮৯২ সালে বাংলাদেশের জমিদার কালীচরণ গুপ্ত’র ঘরে জন্ম সুপ্রভা রায়ের। আদরের নাতনিকে আদর-যত্নে ভরিয়ে রেখেছিলেন কালীচরণবাবু। ব্রাহ্ম পরিবেশেই বেড়ে উঠেছিলেন সুপ্রভা। পড়তেন ঢাকার ইডেন গার্লস হাইস্কুলে। সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ তারপর কলকাতায় চলে এসে থাকতে শুরু করলেন মাসির বাড়িতে। তাঁর মেসোমশাই ছিলেন সেসময়ের নামী ডাক্তার প্রাণকৃষ্ণ আচার্য। কলাবিদ্যা নিয়ে পড়তে শুরু করলেন বেথুন কলেজে। এই সময়েই সুকুমার রায়ের সঙ্গে বিয়ে পাকাপাকি এবং ১৯১৩ সালের, ১৩ ডিসেম্বর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। ১৯১৩ থেকে ১৯২৩— দশ বছরের দাম্পত্য জীবন। ১৯২৩ সালে অকালে প্রয়াত হলেন সুকুমার। জীবনে সেই প্রথমবার সম্পূর্ণ এক অচেনা অধ্যায়ের সূচনা হয় সুপ্রভার জীবনে। তখন তিনি কারো সন্তান নন, কারো স্ত্রী নন, সাদা থান পরিহিতা ৩১ বছর বয়সী একা এক যুবতী – এক মা। সুকুমার চলে যাওয়ার পর অকুল পাথারে পড়ে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সনসও’ প্রেস। এহেন অবস্থায় সুপ্রভা চলে আসেন দক্ষিণ কলকাতায়, তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে। না, ভাইয়ের কাছে কোনও অর্থ সাহায্য নিলেন না। সেই সময় একা হাতে তৈরি করলেন স্বনির্ভরতার পাঠ। প্রতিদিন দক্ষিণ কলকাতা থেকে উত্তর কলকাতায় এসে বিদ্যাসাগর বাণী ভবনের (অবলা বসু প্রতিষ্ঠিত) হস্তশিল্প বিভাগের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন।

আনভ্যাঙ্কুইশড’ অর্থাৎ অপরাজিত। সে অর্থে সত্যজিৎ রায়ের অপরাজিত তো সুপ্রভাই। তখনকার দিনে দুবছরের সন্তান কোলে স্বামীকে হারিয়ে শোকে দিশাহারা হয়ে যাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা উন্মুক্ত ছিল, কিন্তু সুপ্রভা হাল ধরলেন শক্ত হাতে। কোনও ধরনের দুর্বলতাকে প্রশয় দেননি আজীবন। দেওর সুবিনয় রায় কি এমনি এমনি তাঁকে ‘বজ্র বৌঠান’ বলে ডাকতেন! শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করতে পাঠানো থেকে শুরু করে ‘পথের পাঁচালি’ বানানো, ছেলের জীবনের প্রতিটা ধাপে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। বাবাহারা ছেলেকে ‘রায়চৌধুরি’ পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরি করে তুলতে নিজের সবটা উৎসর্গ করেছিলেন। কাজ, সূচীশিল্প, মৃৎশিল্প, ‘মানিক’ আর মাঝেমধ্যে নিজের সুকণ্ঠকে ঝালিয়ে নেওয়া – এই ছিল তাঁর জীবন। যে জীবনের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, খোকা যেন মানুষের মতো মানুষ হয়।

এমন বিদূষী যার মা, সে কি মানুষ না হয়ে পারে!                  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.