1938 সাল কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে সুভাষ চন্দ্র বসু মহারাষ্ট্রের নাগপুর পরিদর্শনে গিয়েছেন I হঠাৎ রেলের জানালা থেকে দেখলেন খাঁকি পোশাকধারী সুশৃঙ্খল একদল ভারতীয় যুবক রাস্তা দিয়ে বাদ্য যন্ত্র সহযোগে সেনার ন্যায় মার্চ করতে করতে এগিয়ে চলেছে I উৎসাহী সুভাষ চন্দ্র পাশে বসা স্থানীয় কংগ্রেস কার্যকর্তার কাছে জানতে পারলেন যে সুশৃঙ্খল সংগঠনটির নাম রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ I পরবর্তী কালে সুভাষ চন্দ্র আরও জানতে পারলেন যে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা তাঁরই পূর্ব পরিচিত বিপ্লবী ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার, যিনি ডাক্তারজী নামে পরিচিত I তিনি স্বয়ং ডাক্তারজীর সাথে দেখা করবার জন্যে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন I ইচ্ছা প্রকাশের কারণও ছিল, কারণ আজন্ম বিপ্লবী সুভাষ চন্দ্র গান্ধীজির ন্যায় আবেদন নিবেদনে বিশ্বাসী ছিলেন না I তিনি মারের বদলে মার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন I এর জন্যে দরকার ছিল দেশ মাতৃকার প্রতি নিবেদিত, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, একটি পরিণত সুশৃঙ্খল বাহিনী, যারা ধুর্ত শক্তিমান ইংরেজদের কাছ থেকে শক্তির ভাষাতেই স্বাধীনতা বুঝে নেবে I
RSS এর মধ্যে তিনি এমন রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন Iপ্রকৃত পক্ষে 1928 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের আগেই সুভাষ চন্দ্র হাতে কলমে এমন বাহিনী নির্মাণ করেছিলেন I বেশ কিছু বিপ্লবী সংগঠন বিশেষ করে বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের “মুক্তি সঙ্ঘের” সাথে টগবগে কংগ্রেস কর্মীদের একত্রিত করে তৈরী হয়েছিল বেঙ্গল ভলিন্টিয়ার্স, সংক্ষেপে বি ভি I যাদের কে বিপ্লবী নায়ক মেজর সত্য গুপ্তের নেতৃত্বে কঠোর সামরিক প্রশিক্ষন দেওয়া হত I সুভাষ চন্দ্র ছিলেন বাহিনীর G.O.C অর্থাৎ জেনারেল অফিসার অফ কমান্ডিং I এমন কি মহিলা ব্রিগেডও তৈরী হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল লতিকা বসু I প্রসঙ্গত এই অধিবেশনেই তৎকালীন কংগ্রেস কার্যকর্তা, স্বাধীনতা সংগ্রামী পূজনীয় ডাক্তারজীর সাথে সুভাষ চন্দ্রের পরিচয় হয় Iতারও তিন বছর আগে 1925 সালে ডাক্তারজী প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, অনুশাসন বদ্ধ সংগঠন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের I ডাক্তারজী যখন নেতাজীকে জানালেন যে তিনিও এমন একটি সংগঠন স্থাপন করেছেন, তখন নেতাজী বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করে বলেছিলেন.. “জাতীয় পুনর্নির্মাণে এর ধরণের সংগঠনই কেবল কাজের হতে পারে” Iযাইহোক বি ভি বাহিনীর নিয়মিত কুচকাওয়াজ, সুশৃঙ্খল আচরণ, বিশেষ করে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি মতিলাল নেহেরুকে যেভাবে সামরিক কায়দায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল তা সর্বস্থানে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল I চারিদিকে ধন্য ধন্য রব উঠল I জাতীয় সংবাদপত্র গুলি বি ভি র প্রশংসায় পঞ্চমুখ I
এমন বাহিনীই ত চাই আজকের দিনে ! সুভাষ দেখালে বটে ! শুধু এক জনেরই তা সহ্য হল না I তিনি মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী I তিনি অহিংসার ঘোরতর পূজারী তার কংগ্রেসে কিনা এমন যুদ্ধ যুদ্ধ আয়োজন ! কংগ্রেস তপোবনে সুভাষ বাহিনীর এ কেমন ঘোরতর উৎপাত ? তিনি প্রকাশ্যেই ব্যঙ্গ করে বললেন ” এ হল পার্ক সার্কাসের সার্কাস “!! ব্যাস শুরু হল গান্ধী ব্রিগেডের ক্রমাগত আক্রমণ I সুভাষ চন্দ্র সাময়িক ভাবে পিছিয়ে এলেন I এবারের ক্ষেত্রেও তাই হল, তিনি ডাক্তারজীর সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব তাঁকে বাধা দেয় ফলে সাক্ষাৎ অধরা থেকে যায় I সম্ভবত তৎকালীন অস্থির বিশ্বে প্রতি আক্রমণ জর্জরিত ব্রিটিশ শক্তি উৎপাটনে শৃঙ্খলাবদ্ধ RSS কে কিভাবে কাজে লাগান যেতে পারে এমন চিন্তা তাঁর মাথায় এসেছিল I যাইহোক এরপর 1939 সালে সুভাষ কংগ্রেস থেকে বহিস্কৃত হলে, মুক্ত সুভাষ পুনরায় পূজনীয় ডাক্তারজীর সাথে দূত মারফত যোগাযোগ করেন এবং ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে তাঁর মতামত জানতে চান I ডাক্তারজী জানান সশস্ত্র সংগ্রাম আন্দোলনে সাফল্যের ক্ষেত্রে অন্ততঃ পঞ্চাশ শতাংশ নিশ্চিত না থাকলে কখনই কাজে নেমে পড়া উচিত নয়, সেক্ষেত্রে যেটুকু বা প্রস্তুতি হয়েছে, সেটাও শাসকের পদতলে পিষ্ট হয়ে নিশ্চিন্হ হয়ে যাবে I RSS ক্ষেত্রেও তিনি একই কৌশল নিয়েছেন , অর্থাৎ প্রথমে অজেয় শক্তি নির্মাণ, তারপর মহা সংগ্রাম Iএরপরেও নেতাজির সাথে ডাক্তারজীর সাক্ষাতের মহা সন্ধিক্ষণ এসে ছিল 20 শে জুন 1940 I নেতাজী তাঁরই সৃষ্ট সংগঠন ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা রামভাউ রুইকর কে সাথে নিয়ে কোন পরামর্শের জন্যে নাগপুরে আসেনI পূজনীয় ডাক্তারজী তখন মৃত্যু শয্যায়, 103°-104° জ্বর I নিদ্রাহীন কয়েক রাতের পর সবে একটু তন্দ্রাচ্ছন হয়েছেন I সব জেনে নেতাজী ডাক্তারজী কে জাগাতে বারণ করলেন I দূর থেকে নমস্কার জানিয়ে তিনি চলে যান I ডাক্তারজী যখন জানতে পারলেন তখন প্রায় চেতনাহীন অবস্থায় অস্ফুটে কয়েকবার ” সুভাষ ” উচ্চারণ করেন Iপরদিনই 21 শে জুন পূজনীয় ডাক্তারজী ইহলোক ত্যাগ করেন Iঅন্যদিকে সশস্ত্র সংগঠন স্বপ্নে বিভোর সুভাষও ভারত ত্যাগ করে জার্মানি হয়ে জাপানে এসে মহাবিপ্লবী রাস বিহারী বসু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ, পরবর্তী কালের আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নিলেন I হলেন সকলের প্ৰিয় নেতাজী I আজন্ম লালিত সশস্ত্র, সুশৃঙ্খল বাহিনীর স্বপ্ন সার্থক হল I ব্রিটিশ সিংহের হৃদয়ে কাঁপুনি ধরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে Iসে এক অন্য ইতিহাস I
মন্দার গোস্বামী