হুমায়ুন আজাদ এর মতো বলিষ্ঠ লেখনী!গণপ্রজাতান্ত্রিক ইসলামিক আমিরাতের স্বপন

হুমায়ুন আজাদ এর মতো বলিষ্ঠ লেখনী!
গণপ্রজাতান্ত্রিক ইসলামিক আমিরাতের স্বপ্ন
………………………………………………..
পাশের বাড়ির আশরাফ চাচা আমাদের উঠোনের দেয়ালের ওপাশ থেকে গলা তুলে আব্বার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠলেন, আল্লাহ আকবর!

আব্বা দৌড়ে উঠনে এসে প্রতি উত্তরে একইভাবে ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি তুলল আশরাফ চাচার প্রতি। কিন্তু দূরের মটারের শব্দ, মেশিনগানের শব্দ আব্বার গলার স্বর ঢেকে দিলো। মুজাহিদরা এখন শহরের সর্বত্র অবস্থান নিয়েছে। শহর দখল করার পর এখন ট্র্যাঙ্ক থেকে ফাঁকা গোলা বারুদ আর বন্দুকের গুলি আকাশে ছুড়ে বিজয় উদযাপন করা হচ্ছে।

টেলিভিশনে একটু পর পর সংবাদ পাঠক ঘোষণা করছে, হিন্দুদের তাবেদার শিরকি সরকার ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে ইসলামিক আমিরাত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সরকার গঠনের ঘোষণা আসছে…।

এক মাস আগে থেকে টেলিভিশনগুলি বদলে যেতে শুরু করে। টিভি পর্দায় আর নারীদের দেখানো হত না। সমস্ত বিজ্ঞাপন থেকেও নারীদের বাদ দেয়া হয়েছিলো। আমার খুব মজা লাগছিলো এটা দেখে যে যারা এতকাল নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবী করত তারাই এই বিষয়টাকে সমর্থন করে এখন বলছে এটা ভালো উদ্যোগ, আমরাও চাই নারীকে যেন পণ্য বানানো না হয়…। এসব দেখে কী যে হাসি আসে। একদিন যাদেরকে ‘জঙ্গি দল’ বলা হত তাদেরকেই এই বুদ্ধিজীবীরা বলছে ভারতের পুতুল সরকার থেকে দেশকে রক্ষা করতে যে কোন দেশপ্রেমিকের অধিকার আছে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার। বিবিসি থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, কিন্তু এই দলটি তো নারীদের কোন অধিকারকে মানে না। তারা শরীয়া আইন পাশ করবে বলছে। এই বিষয়টি কেন আপনারা মাথায় আনছেন না? একজন বুদ্ধিজীবী যিনি পাঁচ বছর আগেও ‘জাতির পিতা’ এই নামে একটি আবেগপূর্ণ লেখা প্রকাশ করে দেশের সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি পেয়েছিলেন, তিনি আজকে বললেন, আমাদের দেখতে হবে যারা দেশকে হিন্দুস্থানের অঙ্গরাজ্য বানাতে দিল্লির পুতুল সরকার হিসেবে দেশের স্বার্থ ধূলিত্সাত করতে দ্বিধা করেনি তাদের হটিয়ে যারা লড়াই করছে তাদের মৌলবাদী কিংবা ইসলামিক বলে তকমায় না ফেলে এটাকে দিল্লির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিসেনাদের উত্থান বলা উচিত…।

আশরাফ চাচা আমাদের উঠোনে এসে আব্বার সঙ্গে কুলাকুলি করলেন। তারপর বললেন, শহরের সিনেমা হলগুলিতে সাময়িকভাবে বিচার কার্যের জন্য ব্যবহারের ঘোষণা আসছে। দুইজন অভিনেত্রী, একজন নারী অধিকার কর্মী, একজন নারী উদ্যোক্তা যারা আমাদের দলের রাষ্ট্র ক্ষমতায় চলে আসলে কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেরকম কুত্সা রটনায় জড়িত ছিলো তাদের প্রত্যেকে আজকে আমাদের শহরের সবচেয়ে পুরোনো সিনেমা হলটিতে ফাঁসি দেয়া হবে। সাধারণ ক্ষমার আওতায় তারা বিবেচিত হবে না। ‘চেতনায় ৭১’ নামের একটা টেলিভিশন সবার আগে সেই ফাঁসি কার্যকর লাইভ দেখানোর ঘোষণা দিয়ে আমাদের প্রতি একাত্বতা জানিয়েছে।

একটু পরে বাড়ির বাইরে গেইটে একটা খোলা জিপ এসে থামল। জিপ থেকে মাথায় পাগরি বাধা, পাঞ্জাবীর উপর হাতখোলা সেরওয়ানী ও কাবলি পায়জামা পরা কয়েকজন মুজাহিদ নেমে এলেন। সকলের হাতে একেফরটি সেভেন। মুখে তাদের প্রসস্ত হাসি। এসে আব্বার সঙ্গে কোলাকুলি করলেন। তারপর বললেন, হযরতকে একবার কষ্ট করে অস্থায়ী ক্যাম্পে যেতে হবে।

আব্বা হাসি মুখে জানতে চাইলেন, কি ব্যাপার?

-হযরত, প্রচুর গণিমের মাল হাতে এসেছে। মুজাহিদদের মধ্যে বিলিয়েও এখন যা আছে সেগুলি তাদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হবে যারা মাল দিয়ে এই জিহাদকে বিজয়ী করে তুলেছিলেন। এটি তাদের আল্লাতালার কাছ থেকে পাওনা।

আব্বা গায়ে নতুন পাঞ্জাবী চড়িয়ে জিপে উঠে গণিমতের মাল আনতে চলে গেলেন। এদিকে আমাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত তরুণদের ঢল থামতেই চায় না। কারণ এই শহরে আমাকে পাঁচ বছর আগে ‘বিপুল পরিমাণ গোলা বারুদ ও জঙ্গিবাদী বইসহ’ গ্রেফতার করা হয়েছিলো। সেটি ছিলো এই ছোট্ট শহরে বেশ চাঞ্চল্যকর একটি ঘটনা। তারপর থেকে জামিনে বের হয়ে আন্ডারগাউন্ডে চলে যাই। আমাদের পরিবারকে বিশেষ নজরে দেখা হয় তখন থেকে। আব্বার ধান চালের ব্যবসা। এক বছর আগে কৃত্রিমভাবে সিন্ডিকেট করে পুরো দেশের চালের দাম এমন করে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো যে মানুষ চাল কিনতে হিমশিম খেয়েছিলো। সরকারের কিছু মন্ত্রীকে হাত করে মূল সিন্ডিকেটের যে চার পাঁচজন ছিলেন তার মধ্যে আমার আব্বা একজন। উদ্দেশ্যই ছিলো সরকারকে অজনপ্রিয় করে তুলে সাধারণ জনগণকে একটা পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে রাখা। সে কারণেই আব্বাকে মুজাহিদরা বিশেষ সন্মানের চোখে দেখে। আব্বার বানানো মাদ্রাসায় লেখাপড়া করার সময়ই আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম। তখন প্রশাসন থেকে মাদ্রাসা বন্ধের চেষ্টা করা হলেও আব্বা ধর্মীয়ভাবে সেটা মোকাবিলা করে রক্ষা করেছেন।

আব্বা চলে যাবার পর আমার দলবল নিয়ে ‘হিন্দু পাড়ায়’ একটা টহল দিতে গেলাম। আমার পরনে হাতাওয়ালা সেন্ড গেঞ্জি (যা মাদ্রাসার ছাত্ররা পাঞ্জাবীর নিচে পরে) আর কাবলী পায়জামা। আমার মুখের দাড়ি লম্বা ও বিশৃঙ্খল। খুব বেশি দাড়িকে সৌন্দর্য করে স্টাইল করে রাখাটার কোন দলিল হাদিসে নেই। অল্প বয়স থেকে নামাজ পড়তে পড়তে আমার কপালের কালো দাগটা অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। আজকেও মনে হয় অনেক দূর থেকে আমার কপালের দাগটা দেখতে পেয়েছিলো আলপনা। দেখেই ঘরের মধ্যে ছুট! হিন্দু পাড়ায় ঘুরে ঘুরে চক্কর দিয়ে চলে এলাম। কাউকে কিচ্ছু বললাম না। পাড়া মনে হয় এরিমধ্যে থালি হয়ে গেছে। আলপনারা এখনো কোথাও যায়নি। হিন্দুরা তাগুদ শক্তির পক্ষে শেষ পর্যন্ত সহযোগীতা করে গেছে। তাদের এই গাদ্দারীর একটা ফয়সালা নিশ্চয় কেন্দ্র থেকে দেয়া হবে।

আলপনাকে তার আগে নিজের করে নিতে হবে। এটা মুজাহিদ ভাইরা সকলেই জানে। পাঁচ বছর আগে আলপনা যখন স্কুলে পড়ত তখন তাকে সরাসরি বিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সে না তো করেছেই উল্টো কপালের দাগ নিয়ে কটুক্তি করেছিলো। আলপনার দিন শেষ হয়ে আসছে…। আলপনার নতুন নাম আমি ঠিক করে রেখেছি। ওর নতুন নাম হবে “জান্নাতুল আয়েশা”।

দুপুরের পর আব্বা সুন্দরী একটা দাসি নিয়ে এলেন আর সঙ্গে বেশ কিছু টাকা পয়সা। দাসিটি আব্বাকে দেয়া হয়েছে গণিমত হিসেবে। এই কথা শুনে আম্মা ঘরে থেকে ঝাড়ু নিয়ে যেই বেরিয়ে আসছেন আব্বাকে ঝাড়ুপেটা করতে ওমনি থমকে গেলেন চৌকাঠের আগেই। আম্মার মনে পড়ল তালিমের আপারা বলে দিয়েছে গণিমত হিসেবে যা পাওয়া হয় সবই হালাল। এগুলো আল্লাতালা থেকে মুমিনদের জন্য উপহার। কাজেই দাসি নিয়ে যখন স্বামী ঘরে ঢুকবে তাতে স্ত্রীর অসুখি হওয়া মানে আল্লার বিধানের প্রতি অসন্তুষ্ঠ হওয়া…।

অগত্যা আম্মা সব মেনে নিলেন। আমি তো মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়েছি কাজেই এসব আমার কাছে খারাপ লাগল না। যারা তাগুদের জালে বন্দি, পশ্চিমা জায়নবাদীদের শিক্ষা ও প্রচারণায় বিভ্রান্ত তারাই এসবকে খারাপ চোখে দেখবে। তাদের ভেতরে তো ইলম নেই। এখন থেকে দেশে সেই ইলমের ব্যবস্থা চালু হলে এক দশকের মধ্যে ইনশাল্লাহ সবাই এসবে অভস্থ হয়ে যাবে।

শহরের যত মূর্তি ভাস্কর্য ছিলো সব কিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশনা দিলাম। দলে দলে ভাগ হয়ে মাদ্রাসার ছাত্ররা মূর্তিগুলি ভেঙ্গে ফেলল। শহরের কিছু নাট্যকার, লেখক, কবি, কন্ঠশিল্পী ছিলো তাদের হত্যারা নির্দেশ ছিলো। তাদের নামের লিস্ট টাঙ্গিয়ে দেয়া হলো শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতে। এরাও সাধারণ ক্ষমতার বাইরে ছিলো। লাইব্রেরিটির সমস্ত বই পুড়িয়ে ফেলা হলো কারণ ওখানে নাস্তিক্যবাদী বইপত্র থাকতে পারে। সেসব বাছাই সময় সাপেক্ষ তাই সমস্ত পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ বাস্তবায়ন করা হলো।

নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। বিকেল গড়িয়ে রাত নামল। হিন্দু পাড়ায় আমার দল নিয়ে অভিযান চালালাম। শায়েখকে বললাম, আলপনাকে আমার ভাগে…

সুরমা চোখের কালো পাগরির শায়েখ চোখ টিপে স্মিত হেসে আশ্বস্ত করলেন।

হিন্দু পাড়ায় আগুন দেয়া হলো। প্রচুর সোনাদানা গণিমত হিসেবে পাওয়া গেলো। কান্না চিত্কারের মধ্যে আলপনার হাত ধরে টানতে টানতে উঠোন পেরিয়ে যেই রাস্তায় উঠেছি ওমনি আলপনা তার দাঁত বসালো আমার হাতে! …

উফ বলে চিত্কার করতেই দেখি সকালের রোদ জানালা দিয়ে এসে মুখে পড়েছে। স্বপ্ন দেখছিলাম! হাতের দিকে তাকালাম। জায়গাটা লাল হয়ে আছে। পিঁপড়া কামড় বসিয়েছে মনে হয়…। সকালের রোদের সুন্দর এই সকালবেলাতে কিছুতে আর স্বপ্নটাকে সম্ভব মনে হচ্ছে না। কিন্তু নিজেকে স্বপ্নে যে ভিন্ন চেহারায় দেখেছি তাতেই প্রকাশ্য দিবালোকে লজ্জ্বায় লুটিয়ে পড়ছি…।

-সুষুপ্ত পাঠক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.