রাষ্ট্র হিসেবে ভারত তার কৃষ্টি, সভ্যতা, ঐতিহ্য, নৈতিকতাকে এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক কর্তব্যকে যে পুরুষের মাধ্যমে রূপায়িত হতে দোখেছে আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে তিনি আর কেউই নন, মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম। আজকের যে ভারতকে আমরা দেখি, যে অখণ্ড ভারতের ছবি আঁকি– তার প্রথম রূপকার রামচন্দ্র। তাই রামচন্দ্র ও রামায়ণের ব্যাখ্যায় রবি ঠাকুর পেয়েছিলেন এক নিষ্কলঙ্ক ভারতীয়তের আস্বাদ। কবি লিখেছেন, “যাঁহারা পরিপূর্ণ পরিণামের মধ্যে সমস্ত খণ্ডতার সুষমা- সমস্ত বিরোধের শাস্তি উপলব্ধি করিবার জন্য সাধনা করিয়াছেন, তাহাদেরও ঋণ কোনোকালে পরিশোধ হইবার নহে।”

রামচন্দ্র চরিত্রে শৌর্যে বীর্যে ন্যায়ে ত্যাগে ভক্তিতে সেই মহাসমুদ্রের ঠিকানা দিয়েছেন— যা ভারত কল্পনার আদর্শ চিত্রবাহী। রাজধর্ম গার্হস্থাধর্ম একযোগে যা ভারতের চিরন্তন সাধনা ও তার রূপলেখা জেগে ওঠে একটি মাত্র চরিত্রে – রামচন্দ্র। একজন পুরুষের মধ্যে রমণীয়তা ও সৌভাত্রের মেদুরতা আমাদের দেশ ব্যতীত আর কোথাও কি পূজিত হয়। সেই রূপ তরণীও রামচন্দ্র।

বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য- এই তো আমাদের ভারতবর্ষ। রামচন্দ্র এমন এক চরিত্র যে বাল্মীকিতে আবদ্ধ থাকেননি। এ কে রামানুজন তাঁর “Three Hundred Ramayanas : Five Examples and Three thoughts on Translation ” প্রবন্ধে দেখিয়েছেন প্রতি একজন আঞ্চলিক রামচন্দ্র চরিত্রের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রামায়ণ জন্ম নিয়েছে। আন্নামী, বাংলা, তিব্বতি, থাই, বালি, কম্বোডিয়া, সংস্কৃত, সাঁওতালি, সিঙ্খলি, তামিল, তেলুগু আরও কত শত ভাষায় এবং লৌকিক রূপে এক ন্যায়নিষ্ঠ চরিত্র হয়েছেন রাম। ভারত এবং বৃহত্তর ভারতের আদর্শ চরিত্র জাতিকে আবদ্ধ রেখেছে। সমন্বয় ও সভাব যদি ভারতের আদর্শ হয় তবে তার প্রয়োগ হয়েছে রাম চরিত্রের মধ্যেই। রামচন্দ্র অখণ্ড ভারত হিসেবে ভৌগোলিক রূপকোণের দর্শন দিয়েছেন হিন্দু সমাজকে – জনকপুরী (যা আজ নেপালে) থেকে অযোধ্যা, অযোধ্যা হয়ে প্রয়াগ যা অতিক্রম করে রাম-লক্ষ্মণ বোনবাস শুরু করেন। সেখান থেকে চিত্রকুট, তারপর দণ্ডকারণ্য (যা আজকের ছত্তিশগড় ওড়িশা মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের মধ্যবর্তী সম্মিলিত অংশ), কিভিক্ষা (যা আজকের হাম্পি), তুঙ্গভদ্রার তীরে রামের অরণ্যকাণ্ড এবং ভিডিতা কাও, রামচন্দ্র যাত্রা করলেন পঞ্চবটীতে (বর্তমানে নাসিক ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল)। এখান থেকে সীতাহরণ, অযোধ্যা থেকে ২৭০০ কিলোমিটার দূরের রামেশ্বরম রামচন্দ্রের পদাধিত, অন্ধ্রপ্রদেশের লেপাক্ষি, যেখানে রাবণ-জটায়ুর যুদ্ধ চলেছিল। তারপর সিংহল, আসমুদ্রহিমাচলের সঙ্গে রামচন্দ্রের পরিভ্রমণে পরিচয় হয়। তাই তো স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনায় রামচন্দ্র বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে, ‘রাম ও সীতা ভারতবাসীর আদর্শ।’


“রামো বিগ্রহবান্ ধর্ম “। যেন ধর্ম স্বয়ং একটি বিগ্রহ ধারণ করে অবতীর্ণ হয়েছেন।


রাজ্য শাসন বা প্রশাসনের একটি আদর্শ রূপের নাম দেওয়া হল রামরাজ্য। রামরাজ্যকে যথার্থ ভাবেই হিন্দুরাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থার আদর্শ বলে তুলে ধরা চলে। কী এই রামরাজ্য? কী তার বৈশিষ্ট্য? বাল্মীকি রামায়ণে কয়েকটি শ্লোকের মাধ্যমে সূত্রাকারে এই রামরাজ্যের রূপটি তুলে ধরেছেন।
রামরাজ্যের এই বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ–

ন পর্যদেবন্ বিধবাঃ – বিধবারা দুঃখ করতেন না। বর্তমান প্রসঙ্গে বিধবা শব্দটি সমাজের অনাথ শ্রেণীর উপলক্ষণ। স্বয়ং নিজেদের ভরণ পোষণে সমর্থ নয় এমন ব্যক্তিগণ রামচন্দ্রের রাজ্যে দুঃখ করতেন না। অর্থাৎ সমাজে তাদের কোন দুঃখ কষ্ট ছিল না।

ন চ ব্যালকৃতং ভয়ম্ – বন্যপ্রাণীদের (ব্যাল=হস্তী/সর্প) থেকে ভয় ছিল না। অরণ্য সুসংরক্ষিত ছিল। বন্যপ্রাণিগণ গ্রামে বা জনপদে এসে উৎপাত করত না। তাদের প্রয়োজন অরণ্যেই পূর্ণ হত। অপর দিকে নাগরিক ও গ্রামীণ মানুষ অরণ্যে অনুপ্রবেশ করত না। রামায়ণের সূক্ষ্ম অধ্যয়নে দেখা যায় যে, রাবণের রাজত্বকালে অরণ্যগুলি ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছিল। খর, দূষণ, শূর্পণখা প্রমুখ রাবণের অনুচরদের অত্যাচারে অরণ্যবাসী পশুপক্ষী, অরণ্যবাসী বনবন্ধু (বানর, ঋক্ষ, নিষাদ), তপোবনবাসী ঋষিরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। বাস্তবে গ্রাম ও নগর সংলগ্ন অরণ্যের অংশগুলিতে ত্যাগ ও বৈরাগ্যের প্রতিমূর্তি স্বরূপ ঋষিরা নিজেদের আশ্রমে সমাজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অধ্যয়ন, অধ্যাপন, সাধনা, যজ্ঞ প্রভৃতিতে রত থাকতেন। এই অনাসক্ত বিরক্ত ঋষি ও তাদের মার্গদর্শনে শিক্ষালাভকারী ব্রহ্মচারীদের থেকে প্রকৃতির কোন ভয় ছিল না। অপর দিকে ভোগে আসক্ত নাগরিক ও গ্রামীণদের অনুচিত লোভ ও লালসার হাত থেকে অরণ্যগুলিকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল বনবাসী বানর, ঋক্ষ, নিষাদ প্রভৃতি জনগোষ্ঠীগুলির। এরা অরণ্যেই নিজেদের জীবন যাপন করত এবং অরণ্য থেকেই নিজেদের সমস্ত প্রয়োজন পূরণ করত। রামচন্দ্র রাবণকে বধ করার পরে অরণ্যে গুহকের নেতৃত্বাধীন নিষাদ, সুগ্রীবের নেতৃত্বাধীন বানর প্রভৃতিদের যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে অরণ্য সুরক্ষিত করেছিলেন। অরণ্যকে মনুষ্যের লালসার থেকে এবং অরণ্যের পশুদের হাত থেকে নগর ও গ্রামকে সুরক্ষিত করেছিলেন।

ন ব্যাধিজং ভয়ম্ – রোগ ব্যাধির থেকে ভয় ছিল না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চমৎকার ছিল। পরিবেশ এবং মানুষের জীবন শৈলী সুন্দর ও পবিত্র হওয়ার কারণে কঠিন রোগের প্রকোপ বিশেষ ছিল না। মূলতঃ দুইটি কারণে রোগ মানুষের ভয়ের কারণ হতে পারেনি। প্রথমতঃ, কোন রোগের মহামারীর আকার ধারণ করার কোন সম্ভাবনা ছিল না। দ্বিতীয়তঃ, রোগের চিকিৎসার সুব্যবস্থা ছিল। চিকিৎসা বাণিজ্যের সাধন ছিল না। চিকিৎসকদের সেবাপরায়ণতা এবং সদিচ্ছার মাধ্যমে প্রতি ব্যক্তিই যথাযথ চিকিৎসা লাভ করত। সেখানে ধনী দরিদ্র বৈষম্যের প্রশ্ন ছিল না। চিকিৎসার ক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগ ছিল। সেজন্যই রোগ ব্যাধি মানুষের ভয়ের কারণ হত না।

নির্দস্যুঃ অভবৎ লোকঃ – রাজ্যে দস্যুদের ভয় ছিল না। দস্যুবৃত্তির দুইটি কারণ – অভাব ও দুষ্ট ব্যক্তির লুণ্ঠন প্রবৃত্তি। সমাজে অভাব ছিল না। দুষ্ট লুণ্ঠনকারীদের কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে। প্রশাসনের উপর যথেষ্ট নজরদারীর কারণে উৎকোচ গ্রহণকারী ও প্রজা পীড়নকারী সরকারী অধিকারী রূপী দস্যুদেরও অত্যাচার সমাজে ছিল না। এই ব্যবস্থাটিকেই একাত্ম মানব দর্শনে অর্থের অভাব ও প্রভাব মুক্ত ব্যবস্থা বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

ন অনর্থঃ কঞ্চিৎ অস্পৃশৎ, বৃদ্ধা বালানাং প্রেতকার্যাণি ন কুর্বতে – কাউকে কোন অনর্থ স্পর্শ করত না। বৃদ্ধরা বালকদের শ্রাদ্ধ কার্য করতেন না। অর্থাৎ অকাল মৃত্যু সমাজের চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারেনি।

সর্বং মুদিতম্ এব আসীৎ, সর্বঃ ধর্মপরঃ অভবৎ, ন অভ্যহিংসন্ পরস্পরম্ – সকলে আনন্দে ছিলেন, সকলেই ধর্মপরায়ণ ছিলেন। একে অপরকে হিংসা করতেন না। পারস্পরিক হিংসাশূন্য একটি সুন্দর সুষম ধর্মনিষ্ঠ সমাজ ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। সমাজে পরস্পর ভ্রাতৃভাব প্রতিষ্ঠিত ছিল। সকলেই সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ এই মন্ত্রকে সফল করার প্রয়াসে ব্রতী ছিলেন। সেজন্যই সকলে আনন্দে ছিলেন। সকলে আনন্দে ছিলেন তার কারণ সকলে ধর্মপরায়ণ ছিলেন। সকলে ধর্মপরায়ণ ছিলেন এবং আনন্দে ছিলেন বলেই পারস্পরিক হিংসার ভাব উৎপন্ন হত না।

বর্ষসহস্রাণি পুত্রসহস্রিণঃ – সহস্র পুত্রের সহিত মানুষ সহস্র বৎসর জীবন যাপন করত। সহস্র শব্দটি বহুত্বের প্রতীক। তাৎপর্য হল মানুষ দীর্ঘায়ু ছিল। বহু প্রজা অর্থাৎ সন্ততির জন্ম দিয়ে তাদের লালন, পালন, শিক্ষা ও সংস্কারের মাধ্যমে সমাজকে প্রচুর সৎ নাগরিক সরবরাহ করার মত প্রাচুর্য সমাজে ছিল। অস্বাভাবিক উপায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এর অর্থ হল, মানুষ কেবল নিজের কামনা চরিতার্থ করার জন্য যথেচ্ছ সন্তানের জন্ম দিত না। বরং, ইন্দ্রিয় ও মনের সংযম পালন করত। অস্বাভাবিক উপায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এবং সেই সংক্রান্ত বিধিনিষেধ জারী করার প্রয়োজনীয়তাও ছিল না।

নিরাময়া বিশোকাশ্চ – মানুষ নিরাময় অর্থাৎ সুস্থ এবং বিশোক অর্থাৎ শোকরহিত হয়ে জীবন যাপন করত। নাগরিকদের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা ছিল।

নিত্যপুষ্পাঃ নিত্যফলাঃ তরবঃ – সর্বদাই বৃক্ষে পুষ্প ও ফল থাকত। বিভিন্ন ধরণের বিভিন্ন ঋতুতে ফল ও পুষ্প প্রদানকারী বিবিধ বৃক্ষে রাজ্য সুসজ্জিত ছিল। প্রকৃতিও অত্যন্ত প্রফুল্ল ছিল। পরিবেশ যথাযথ ভাবে রক্ষিত হওয়ার কারণেই প্রকৃতি সুখপ্রদ হয়ে উঠেছিল।

কামবর্ষী চ পর্জন্যঃ সুখস্পর্শশ্চ মারুতঃ – মেঘ সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে বৃষ্টি দিত। বৃক্ষ ও অরণ্য সুসংরক্ষিত থাকার দরুন অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টি জনিত কোন সমস্যা ছিল না। সুখপ্রদ বায়ু প্রবাহিত হত।

স্বকর্মণি প্রবর্তন্তে তুষ্টাঃ স্বৈরেব কর্মভিঃ, আসন্ প্রজাঃ ধর্মপরাঃ – প্রজারা সকলে নিজ নিজ কর্মে সন্তুষ্ট ছিলেন এবং সেজন্য সকলে নিজ নিজ কর্মে লিপ্ত থাকতেন। সকলেই ধর্মপরায়ণ ছিলেন। অর্থাৎ, সমাজে সমস্ত কর্মের সঠিক মূল্যায়ন হত। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল না বলেই সকলে নিজ কর্মে সন্তুষ্ট ছিলেন। এই বৈষম্যের অভাবে, সামাজিক সমৃদ্ধির কারণে এবং সামাজিক ব্যবস্থা ও ন্যায়ের প্রতি সকলের আস্থা থাকার কারণে সমাজে অধর্মের প্রাদুর্ভাব ঘটত না।

অর্থাৎ সার্বিক ভাবে রামরাজ্যের বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংকলিত করতে হলে বলা চলে রামরাজ্যের বৈশিষ্ট্য এইগুলি – সুস্থ প্রশাসন, উন্নততম স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা, আর্থিক সমৃদ্ধি, সমরস সমাজ, সাধারণ মানুষের সমুচ্চ নৈতিকতা, পরিবেশ রক্ষার সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী ও ব্যবস্থা।


“a living tradition and a living faith”


প্রশাসক রূপে রাজা রাম সর্বস্তরের মানুষ ছাড়াও বৃক্ষ, পশু, পক্ষী, অরণ্য, বন্য প্রাণী – সকলের প্রতি সমুচিত দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে রাজ্য শাসন করেছিলেন যার একমাত্র ভিত্তি ছিল ধর্ম। এই ধরণের শাসনব্যবস্থা জগতে ভারতবর্ষ ছাড়া কোথাও সম্ভব নয়। এই শাসন ব্যবস্থা ধর্ম আধারিত শাসন ব্যবস্থা। ধর্ম হল স্থিতপ্রজ্ঞতা, ক্ষমা, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, চৌর্যহীনতা, পবিত্রতা, মনঃসংযম, জ্ঞান, বিদ্যা, সত্য অক্রোধ প্রভৃতি দৈবী সম্পদের মিলিত রূপ। রাজার ভূমিকা নিজে ধর্মপরায়ণ হয়ে অন্য সকলকে ধর্মে প্রতিষ্ঠিত রাখা। হিন্দু শাস্ত্র বলছেন, সর্বে ধর্মাঃ রাজধর্মে প্রতিষ্ঠিতাঃ ।গান্ধীজীর শব্দে “Ramrajya i.e. sovereignty of the people based on pure moral authority” (রামরাজ্য হল বিশুদ্ধ নৈতিকতার আধারে জনতার সার্বভৌমত্ব) ।


রাষ্ট্রপিতা মহাত্মা গান্ধী তার ইপ্সিত সমাজের পরিচয় দিতে গিয়ে রামরাজ্যের কথা বলেছেন । গান্ধীজি রামরাজ্য বলতে এক আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন যেখানে অসাম্য, বঞ্চনা, অন্যায় ও শোষণ নেই। গান্ধীজীকে অনুপ্রাণিত করেছিল সেগুলি হল সতা, স্বারজ ও অহিংসা। মহাত্মাজীর মূল লক্ষ্য ছিল সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা – গুরু রবীন্দ্রনাথের কথায় ” আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে “
গান্ধীজীর শব্দে ” I mean by Ramarajya Divine Raj, the Kingdom of God. ” রাজনৈতিক পেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ১৮৮৯-এর লক্ষ সমাবেশের আগেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বেশ হিন্দু ভক্তি ছিল।
‘a living tradition and a living faith-
তারপর সি. রাজাগোপালাচারীও এক অনুবাদ করেন এবং বলেন ভারত এবং হিন্দুত্ব জানতে হলে রাম এবং রামায়ণের কোনও বিকল্প হয় না। তিনি বলেন, thorough familiarity with our ancient heritage is necessary if we desire to preserve our individuality as a nation and serve the world through dharma which alone can save mankind from error and extinction” হিন্দু শব্দ সেদিন যে কংগ্রেস গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করতো , আজ তারাই কত ঢোক গিলে উচ্চারণ করে । বিশেষ করে দেশভাগের পর , কংগ্রেসের মূল উদ্দেশ্য হয়, মুসলিমদের আশ্বস্ত করা তারা পাকিস্তানের থেকে ভারতে বেশি সুরক্ষিত । এই পদস্খলনের কান্ডারী নিশ্চিতভাবে নেহেরু ।
ড. রামমনোহর লোহিয়ার পরিবার রামভক্ত ছিল। তিনি রামরাজ্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন , ১৯৪৬-এর ডাইরেক্ট অ্যাকশান ডে-তে তিনিই কংগ্রেসের মুসলিম তোষণের বিরোধিতা করেন। কংগ্রেস ড. রামমনোহর লোহিয়ার মতো মানুষের মর্যাদা দেয়নি বলেই, মুলায়ম সিং যাদবের দল তাঁর অপব্যবহার করতে পেরেছে। যোগেন্দ্র যাদব রামমনোহর লোহিয়ার মূল্যায়ন করতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন — decent living rather than prosperity- এটাইতো বোধহয় রামরাজ্যর প্রাথমিক ধারণা। রামমনোহর যে চৌকম্ব রাজের তত্ত্ব দিয়েছিলেন অর্থাৎ গ্রাম, জেলা, রাজ্য এবং কেন্দ্র এবং তাঁর নেহেরুভিয়ান পলিশি থেকে বেরিয়ে এসে যে small is beautiful তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন তা তো রামরাজ্যের ব্লুপ্রিন্ট ছিল।


বৈদিক সাম্যবাদ সব ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে এক এমন সমাজ গঠনের মন্ত্র দেয় যেখানে সব জাতিগোষ্ঠী যেন শাশ্বত প্রেরণায় জীবনবোধে, সহিষ্ণুতার আবদ্ধ থাকার শিক্ষা পায়। অনেক সামাজিক উত্থান-পতন আমাদের এই মাটিতে হয়েছে। জাতপাত ভেদাভেদ এসেছে। তাই যদি প্রকৃত ভেদহীন ভারত পরিকল্পনা করতে হয় তখনও আদর্শ হবেন রামচন্দ্র এবং তাঁর সাম্যবাদী দৃষ্টিকোণ। অরণ্যকাণ্ডে রামচন্দ্র বলেছেন – ধর্মাদর্থঃ প্রভবতি ধর্মাৎ প্রভবতে সুখম্ । ধর্মেণ লভতে সর্বং ধর্মসারমিদং জগৎ।।
“অর্থাৎ ধর্ম পালনেই সব সুখ আসে। তার দ্বারাই সব অভিষ্ট বস্তুর সন্ধান মেলে ।

* 1937 এর পরবর্তীতে বাঙালি মুসলিম লীগের বারবারুন্তিতে হিন্দুর উপর বঞ্চনা শুরু হলে মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ লাহিড়ী ও ভারত সেবাশ্রম সংঘ প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দজী — শ্যামাপ্রসাদকে অনুরোধ করলেন এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি হিন্দুদের নেতৃত্ব দিতে। শ্যামাপ্রসাদ সম্মত হলেন, অখিল ভারত হিন্দু মহাসভায় যোগ দিলেন এবং এক বছরের মধ্যে দলের সর্বভারতীয় কার্যকরী সভাপতি মনোনীত হলেন, কারণ সভাপতি সাভারকারের শরীর ভাল যাচ্ছিল না। এরপর এল দেশের স্বাধীনতা, দেশভাগ ও শ্যামাপ্রসাদের জীবনের মহত্তম কীর্তি, পশ্চিমবঙ্গের সৃষ্টি। হিন্দু মহাসভা থেকে স্বয়ংসেবক সংঘের সহযোগিতায় তৈরি জনসংঘ জনসংঘ থেকে জনতা পার্টি এবং জনতা পার্টি থেকে বিজেপি এবং রাম মন্দির আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বিজেপির ক্ষমতায়ন সম্পূর্ণরূপে রাম এবং রাম রাজ্যের উপর ভিত্তি করেই ।

L K Advani শব্দে-
“Ram Rajya’ along with the temple at Ayodhya.”The objective is to construct a temple,besides also to establish an ideal state conceptualised in the name of Lord Ram,”

5 আগস্ট ভূমি পূজার মধ্য দিয়ে অযোধ্যায় রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী , তিনি বলেন ‘এতগুলো বছর ভগবান রাম তাঁবুর নিচে বসবাস করছিলেন। এবার তাঁর স্থান হবে ভব্য মন্দিরে , বৈচিত্র্যময় ভারতকে এক সূত্রে গেঁথেছেন রামচন্দ্র। বিবিধের মাঝে তিনিই মিলনের প্রতীক। দেশের মতো বিদেশেও আজ তাই রামের নামে জয়ধ্বনি শোনা যায়।’

প্রায় ৫০০ বছরের প্রতীক্ষা শেষ হয় বুধবার। সেই সঙ্গে শেষ হয় ১৩০ বছরেরও বেশি দীর্ঘ আইনি লড়াই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য বহু মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁদের বলিদান আজ সার্থকতার রূপ নিতে চলেছে। আজকের দিনটি ত্যাগ, সংঘর্ষ ও সংকল্পের প্রতীক হয়ে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘সারা দেশ আজ রামময়। সর্বত্র রামনাম ধ্বনি। এই মন্দির হবে ভারতীয় সংস্কৃতির আধুনিকতম প্রতীক। রাষ্ট্রীয় ভাবনার প্রতিফলন মধ্য দিয়ে গঠিত হবে রাম রাজ্য ” ।


রাম সকল গুণের আধার যিনি তিনিই হলেন মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র। তাই আমরা ভারতবাসী যখনই রূপে, গুণে, চরিত্রে, আদর্শের সন্ধান করি উপমা দিই, তখনই রাম উপস্থিত। রামচন্দ্র লঙ্কাদহন করলেন– কোথাও গিয়ে মনে হয় এ ছিল অর্ধমের দহন এ নিছক বাহুযুদ্ধ নয়। এবং ভারত আজকে যে ভাবে তার বিচারবোধ এবং মনস্তাত্ত্বিক সামাজিক ঐতিহ্যের প্রভাব সর্বত্র বিস্তার করছে রামচন্দ্র তার প্রণেতা। সেই সফট পাওয়ারের স্রষ্টা রামচন্দ্র। যিনি সমুদ্র টপকে লঙ্কায় বিস্তার করেন। কিন্তু থাকলেন না তো লঙ্কাতে। তখন রামচন্দ্রের থেকে আমাদের জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেম শিখতে হয়। লক্ষ্মণ জয় করা লঙ্কায় দাদাকে থাকতে বললে, রাম হীরকময় দীপ্তিতে

“অপি স্বর্ণময়ী লঙ্কা ন মে লক্ষ্মণ রোচতে।

জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।।’ তাই যদি শুভশক্তির আধারনা করতে হয়, এদেশে রামরাজত্ব স্থাপন করতে হয় তবে ভারতের প্রতিটি মৃত্তিকায় রামচরিতমানস রচনা করতে হবে।
রামচন্দ্র ও ভারতীয়ত একরৈখিক ও অবিচ্ছিন্ন এবং উভয়েই বহুত্ববোধের প্রতীক। ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল ও কর্তব্যপরায়ণ ভারত মানে তা রামচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ ব্যতীত আর কিছুই না।
” সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত,ওম শান্তি শান্তি শান্তি “।

পল্লব মন্ডল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.