দিক। শোনা যায় ভাগ্যান্বেষী ড্যানিশরা হুগলি নদীর তীরবর্তী একটি জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় এসে পৌঁছোয়। ব্যাবসায়ী দূরদর্শীতার কারণে তারা দেখতে পায় এই ছোট্ট জনপদটি তার মা-নদীকে কাজে লাগিয়ে অনায়াসে বন্দর হয়ে উঠতে পারে। বাংলার তৎকালীন নবাব আলিবর্দী খাঁ-এর কাছে ট্রেডিং লাইসেন্স জোগাড় করে থিতু হল তারা। গভর্নর কর্নেল ওলে বি-এর শাসনাধীনে একটা সুপরিকল্পিত সুসজ্জিত শহর গড়ে ওঠে, নাম হয় ফ্রেড্রিকসনগর। এই ফ্রেডরিক্সনগরই এখন শ্রীরামপুর, তবে এর গড়ে ওঠার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ এবং তাতে শ্রীরামপুরের গোস্বামীদের নাম চলে আসা অবশ্যম্ভাবী। শ্রীরামপুর রাজবাড়ি আসলে এই গোস্বামীদেরই বাড়ি।
কারা ছিল এই গোস্বামী বা গোঁসাইরা? কীভাবে শ্রীরামপুর রাজবাড়ির পুজো শুরু হল এবং দাপুটে জমিদার-বাড়ি বা রাজবাড়ির পুজোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? এই গোঁসাইরা আসলে জমিদার বা রাজা কোনোটাই ছিলেন না। এঁরা মূলত গৌড়ের রাজা আদিসূর কর্তৃক আমন্ত্রিত পাঁচ ঘর ব্রাহ্মণ পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার। রাজা এই দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারগুলিকে জায়গা জমি অর্থসম্পদ দিয়ে নিজের রাজ্যে রেখেছিলেন জ্ঞান-বিদ্যা চর্চার উদ্দেশ্যে। এই পরিবারেরই একজন বংশধর লক্ষণ চক্রবর্তী। এদিকে তার আগেই বাংলা প্লাবিত হয়ে উঠেছে শ্রীচৈতন্যের প্রেমরসে। হুগলির ধারে শ্রীরামপুর মাহেশে, ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী স্বপ্নাহত হয়ে দারুব্রহ্মের কাঠে বানিয়ে ফেলেছেন জগন্নাথ বলরাম শুভদ্রার মূর্তি। চৈতন্য মহাপ্রভু উড়িষ্যা যাওয়ার পথে এই মাহেশ গ্রামের মন্দির দেখে ভাবে মূর্ছিত- নাম দিলেন নব-নীলাচল বা নতুন পুরী। বঙ্গে বৈষ্ণব-প্লাবনের এই মহাক্ষণে লক্ষণ চক্রবর্তী বিবাহ করেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের বিখ্যাত শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত ভীম তর্কপঞ্চাননের কন্যাকে। তাঁর পুত্র রামগোবিন্দ গোস্বামী তাঁর মাতামহ তথা ভীম তর্কপঞ্চাননের কাছে বড়ো হন। শুরু করেন ভাগবত পাঠ, শিষ্যদের দীক্ষাদান করেন এবং ‘গোস্বামী’ উপাধি নেন। এই রামগোবিন্দ গোস্বামী একবার স্ত্রীকে নিয়ে শান্তিপুর থেকে কলকাতা যাচ্ছিলেন, শ্রীরামপুরের কাছে এসে স্ত্রীয়ের প্রসব বেদনা উঠলে সেখানেই নৌকা ভেড়ানো হয় এবং পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।
সেই সময়ে শ্যাওড়াফুলি রাজের অধীনে ছিল শ্রীরামপুর। আবার ঘটনাচক্রে শ্যাওড়াফুলি ছিল পাটুলি রাজের কাছারি বাড়ি। শ্যাওড়াফুলি রাজ দান-ধ্যানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন- তাঁর রাজত্বে পরমভাগবত রামগোবিন্দ গোস্বামীর পুত্র জন্ম নিয়েছেন শুনে তৎকালীন রাজা মনোহর রায় ঐ সম্পত্তি রামগোপাল গোস্বামীকে দান করতে চান কিন্তু তিনি দান নিতে অস্বীকৃত হন। পরে একটি কড়ির বিনিময়ে মনোহর রায়ের থেকে সেই সম্পত্তি কিনে নেন। এইভাবেই পুত্রের কল্যাণে লক্ষণ চক্রবর্তীর আগমন শ্রীরামপুরে।
এই গোঁসাইরা মূলত বেনিয়া ছিলেন, মার্সেনারির ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। এই বংশের উত্তরাধিকার রঘুরাম গোস্বামী। ১৮৪৫ সালে যখন ড্যানিশ সরকার প্যাটার হ্যানসেন শ্রীরামপুরের উপনিবেশ বিক্রয় করতে চান তখন রঘুরাম গোস্বামী তাঁর প্রবাদ-প্রতীম এই অর্থসম্পদ নিয়ে এগারো লক্ষ টাকা দিয়ে শ্রীরামপুর কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মত রেস্তের জোর এবং প্রিয় শহরের প্রতি ভালোবাসা (অথবা এই শহরে থেকে উন্নতির সম্ভাবনা আঁচ করা) ছাড়া এই সাহস কেউ দেখাতে পারেননা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শেষ পর্যন্ত বারো লক্ষ টাকায় এই শ্রীরামপুর কিনে নেয়। তৈরী হয় প্রচুর শিল্প-কারখানা। আদ্যন্ত কমার্শিয়াল যে শহরে শয়ে শয়ে জাহাজ একসময়ে ব্যবসা করত, তা পরিণত হল ইন্ডাস্ট্রিয়াল একটি শহরে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার থেকে পরিযায়ী শ্রমিকেরা শ্রীরামপুরে এসে ছড়িয়ে পড়লেন, বাসা বাঁধলেন টিন বাজার ও সংলগ্ন এলাকায়।
বর্তমানে যেটি শ্রীরামপুরের গোস্বামী পাড়া, সেখানে তাঁদের এত শরিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন, যে সব পরিবারকে একত্রিত করে ছত্রছায়ায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্যেই মূলত প্রাসাদোপম শ্রীরামপুর রাজবাড়ির জন্ম। রঘুরাম গোস্বামীর পৌত্র কিশোরীলাল কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন এবং সেখান থেকেই ‘রায়বাহাদূর’ উপাধি পান, তিনিই বাংলা গভর্নরের শাসন পরিষদের প্রথম সদস্য এবং সম্ভবত এই কারণেই ‘রাজা’ উপাধিও লাভ করেন। এরপর থেকেই রঘুরাম নির্মিত প্রাসাদ ‘রাজবাড়ি’ নামে খ্যাত হল।এই রাজবাড়ির সদস্যরা বৈষ্ণব এবং প্রাচীন গ্রামীণ সংস্কৃতি আর গঙ্গার স্নেহ-মৃত্তিকায় লালিত হয়ে এঁরা মূলত যাত্রাপালা, কবিগান হোলিখেলাতেই মেতে উঠতেন, বিখ্যাত নাটমন্দিরে বসত বিরাট সঙ্গীতের আসর। শোনা যায় এই নাটমন্দিরেই অ্যান্টনী ফিরিঙ্গী ও ভোলা ময়রার কবিগান হয়েছিল। বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষীর দলও এসেছিল এই গোঁসাইবাড়িতে। আনুমানিক অষ্টাদশ শতকের মাঝে রামগোবিন্দ গোস্বামী এই উৎসব প্রধান গোঁসাইবাড়ির সংলগ্ন ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজো শুরু করেন। বাঙালি ধনী ব্যবসায়ীদের ঐশ্বর্য প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম ছিল দুর্গাপুজো। দুর্গাপ্রতিমার সামনে ছিল উন্মুক্ত নাটমন্দির। যেখানে একসাথে পাঁচশো লোককে ভোগ খাওয়ানো যেত। এই নাটমন্দির কেমন একটু দেখে নেওয়া যাক।
১২০ ফুটের এই নাটমন্দির আগে ছিল জমা জলের একটা ট্যাঙ্ক। শোনা যায় রঘুরামের ছেলে আত্মারাম, পাঁচ বছরের শিশু, সে ডুবে যায় এই ট্যাঙ্কে। তারপর থেকে এই জল জমানো জায়গা বুজিয়ে দেওয়া হয় এবং তৈরী হয় নাটমন্দির বা চাঁদনী। বর্তমানে এই নাটমন্দিরে চব্বিশটা করিন্থিয়ান স্তম্ভ আছে, যাদের উচ্চতা বত্রিশ ফুট এবং ডায়ামিটার পাঁচ ফুট। এই স্তম্ভগুলো এবং নেপাল থেকে আনা শালকাঠের কড়ি-বরগার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এর ছাদ। মেঝে তৈরী চুনার পাথরে, প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যে যে বাফ কালার অথবা লালচে পাথর ব্যবহার হত, তবে এই রাজবাড়ির গঠনে ভারতীয় ও ইউরোপীয় দু’ধরণের স্থাপত্যেরই মিশ্রণ দেখা যায়।
দুর্গাপুজো সবথেকে জনপ্রিয় হলেও এঁদের প্রধান উপাস্য হলেন রাধা-গোবিন্দ জিউ-এর যুগল মূর্তি, যাঁরা ঠাকুরদালানের একপাশে স্থির ভাগ্যদেবতার মত এখনো জ্বলজ্বল করেন। রাজবাড়ির বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক জানালেন এই যুগল মূর্তি নাকি আসামের বড়োজোড়া নদী থেকে উদ্ধার করেন এই পরিবারেরই কোনো সদস্য। ২০২০ সালে নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে এই পরিবারের বর্তমান সদস্য শ্রাবণী গোস্বামী নিজের পরিচয় দেন, “এই বাড়ির পাঁচ কর্তা, ছোট কর্তার সেজো ছেলের ছোট বউ আমি। আগে বারো মাসে তেরো পার্বণ হত, এখন দেখভাল করার লোক কমে গেছে, জমিদারির আয়ও কমে গেছে”। তাঁর কথা থেকেই জানা যায় দেশবন্ধু, নেতাজি, গান্ধিজি প্রমুখ মহাপুরুষেরা এসেছিলেন এই বাড়িতে। আনন্দময়ী মা-ও এসেছিলেন একবার। চিত্তরঞ্জন দাশের সহকর্মী ছিলেন তুলসীচন্দ্র গোস্বামী, যিনি সম্পর্কে শ্রাবণী দেবীর জ্যাঠামশাই।দুর্গাপুজোর দশমীতে বাড়ির এয়োস্ত্রী-রা ইলিশ মাছ, পান্তা ভাত ও পান খেয়ে প্রতিমাকে বরণ করে বিসর্জনে পাঠায়। পুজোর দিনগুলিতে সকালে অথবা ভোরে বাল্যভোগ হয়, তারপর মাঝে একটি ভোগ, আর শেষে মূল ভোগ দেওয়া হয় এবং চন্ডীপাঠ হয়।বর্তমানে পুজোর সেই জৌলুস নেই, কমেছে গভর্নমেন্টের অনুদান। বাড়ির একদিকে একটি বিদ্যালয়, একদিকে ওয়েডিং ভেন্যু এবং আরেক অংশ ডিস্ট্রিক্ট এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ অফিস। এইসব থেকে ভাড়া উঠেই বর্তমানে বাড়ির মেরামত বা আনুসঙ্গিক খাতে ব্যয় মেটানো হয়। বৃদ্ধ তত্ত্বাবধায়কের কাছে শোনা যায় যে এই পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম নাকি এই পুজো এইবছরে বন্ধই করে দিতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁর তাড়নায় সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত হন।সময়ের পলি পড়ে, হুগলির পলি পড়ে। গোঁসাইবাড়ি তার ইতিহাস মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অহোরাত্র। কবে কোন কালে ড্যানিশ বাঙালি ও ইংরেজ তিন জাতির ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তৈরী হওয়া প্লিজিন তার মৌলিক গাম্ভীর্য নিয়ে এখন শ্রীরামপুরের প্রাচীরে অক্ষর লেখে। হাওয়া এসে মুছে দেয়, মৃত্যুভয়ে ঘোলাটে চোখে কেয়ারটেকার বলেন এই বাড়ির নাটমন্দিরেই নাকি তাঁর আগের কেয়ারটেকার মারা গিয়েছিলেন। সন্ধের নীলে তাঁর কথার প্রতিধ্বনী করে ওঠে নাটমন্দিরের রক্ষক সব ঐতিহাসিক পায়রারা
।