তুলসীদাসের কাব্যের নাম ‘শ্রীরামচরিতমানস’।
এই কাব্যনামের রূপকার্থ বিশ্লেষণ করে কবি স্বয়ং বলেছেন- এই অপূর্ব মানসসরোবরের অবস্থানভূমিটি হলো ভক্তজনের অগাধ হৃদয়- “থল হৃদয় অগাধু”, এবং এই সরোবর সীতারামের কীর্তিরূপ অমৃতোপম জলে পূর্ণ- “রাম সীয় যশ সলিল সুধাসম”। অর্থাৎ তিনি যে রামকথা উপস্থাপন করছেন তা কোনও নির্দিষ্ট গ্রন্থের সীমায় আবদ্ধ নয়, তার অবস্থান অসংখ্য মানুষের মনোভূমিতে, জনচিত্তলোকে। এবার, মানবচিত্ত যেমন অসংখ্য, এই মানস-সরোবরও তেমনই অনন্ত, এবং, এক একটি মানবচিত্তও যেমন পরিস্থিতি অনুসারে পরিবর্তনশীল, এই অনন্ত মানস-সরোবরের প্রকাশও তেমনই, একটি ব্যক্তিমানুষের চিত্তেও, স্থির নয়, সদা পরিবর্তনশীল৷ তাত্ত্বিক বলবেন, পরস্পর-সংযুক্ত এই অসংখ্য ব্যষ্টি-মানসের রাশি মিলিয়ে একটি সমষ্টি-মানস তো থাকবেই। হ্যাঁ, তা তো থাকবেই, তবে মানববুদ্ধির নিরিখে তা একটি তাত্ত্বিক ধারণা। সেই পূর্ণ-মানসকে মানববুদ্ধিপথে সামগ্রিকভাবে ধরা-ছোঁয়া যায় না, যতটুকু ধরা দেয়, তা খণ্ডিত হতে বাধ্য৷
এই রূপককে আরও দৃঢ়ীভূত করেছে সীতারামকীর্তিকথার সঙ্গে জলরাশির উপমা। জল যেমন স্থিতিস্থাপক, আধারভেদে তার আকারভেদ, এই চরিতকথাও তাই। চিত্তভেদে তাতেও রূপভেদ।
আর জলীয় ধর্ম অনুসারেই সেই চরিতকথার উষ্ণতা, স্বচ্ছতা, বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ প্রভৃতিও পাত্র ও পরিস্থিতি নির্বিশেষে বিভিন্ন ও বিচিত্র। তাই, এর মধ্যে বাস্তব কিংবা অ-বাস্তব, মূল কিংবা প্রক্ষেপ, ভালো কিংবা মন্দ এইরকম চিরন্তন দ্বন্দ্বগুলির মধ্যে কখনওই যে কোনও একটি বিকল্প সর্বজনীন হতে পারে কি? যার মানস-পরিস্থিতি যখন যেমন, তার কাছে এই জলরাশির আবেদনও তখন তদনুরূপ।
এই প্রসঙ্গে নিশ্চয়ই আমাদের মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতার সেই অমোঘ কয়েকটি শব্দ- “সেই সত্য যা রচিবে তুমি/ ঘটে যা, তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি/ রামের জনমস্থান- অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।”
এবার, কাব্যনাম থেকে কাব্যকথনরীতির দিকে যদি তাকাই, তাহলে এই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণা আরও স্পষ্ট হবে। এই মহাকাব্যে, কথন বা narration-এর কতকগুলি স্তর আছে। গরুড়ের মোহনাশের জন্য যে রামকথা কাক ভূষণ্ডি বলেছিলেন, তা পার্বতীকে শোনাচ্ছেন মহাদেব, আবার এই হরপার্বতী-সম্বাদ ভরদ্বাজ মুনিকে শোনাচ্ছেন যাজ্ঞবল্ক্য মুনি। যাজ্ঞবল্ক্য-ভরদ্বাজ সম্বাদটি, আমাদের কাছে শোনাচ্ছেন কবি তুলসীদাস। এই যে চতুস্তরীয় কথন- এটি ঠিক যেন চারটি সমকেন্দ্রিক বৃত্ত, যারা ক্রমশ একে অপরকে আত্তীকৃত করে, কিন্তু কেউ কারোকে ছেদ করে না। এখন, প্রশ্ন উঠবে, এই কথনস্তরগুলির মধ্যে আদিকবি কই? বাল্মীকিই তো মৌখিক ঐতিহ্যে প্রচলিত রামকথার প্রথম লিখিত সংস্করণের স্রষ্টা, তিনি কই? ভক্ত ভবিষ্যোত্তর পুরাণ প্রমাণে উত্তর দেবেন, রামচরিতমানস যেমন রামায়ণের রূপান্তর, তেমনই তুলসীদাস বাল্মীকির দেহান্তর। তাই, তিনিই বাল্মীকি, অথবা, তিনিও বাল্মীকি।
এবার, এই কথনবৃত্তগুলির মধ্যে হর-পার্বতী সম্বাদের দিকে যদি তাকানো যায়, দেখা যাবে, শিব বলছেন, রামকথার অজস্র রূপভেদ, অজস্র বৈচিত্র্য। কেন এই বিভিন্নতা? কল্পভেদে। এক একটি সুবৃহৎ কালপর্যায়ে রামের লীলা এক একরকমভাবে ঘটে, তাই সেই লীলাকাহিনীর মধ্যে ভেদ তো থাকবেই। আবার, অন্তর্লীন অভেদত্বের একটি সম্বন্ধসূত্র দিয়ে এই সব কয়টি কথারূপ পরস্পর-সংলগ্ন। এই অজস্র কথারূপের বিমিশ্র উপস্থাপনই তুলসীদাসের রামচরিতমানস। উপমা দিয়ে বলতে পারি, এ যেন পরস্পর-সংলগ্ন অজস্র স্বচ্ছ সমতলে অঙ্কিত বিভিন্ন ব্যাসার্ধের অসংখ্য নানা রঙের সমকেন্দ্রিক বৃত্ত, বিহঙ্গদৃষ্টিতে যাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক আশ্চর্য আলপনা।
তুলসীদাসের লেখা- যে যেন এক রামায়ণের মধ্যে মিশে যাওয়া অজস্র রামায়ণের রঙ আর রেখা৷
উৎসব চৌধুরী