শ্রীরাম ও শম্বক বধ

আজকের পবিত্র দিনে আশাকরি এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিকই হবে।

কেবল ভারতবর্ষে নয় ইরান থেকে শুরু করে জাপান সর্বত্রই শ্রীরামের চরিত্র একটি সুবিশাল মহীরুহের মত দণ্ডায়মান। রাম একটি আদর্শ মনুষ্য চরিত্র যিনি নিজ গুণে ঈশ্বরে রূপান্তরিত হয়েছেন।কিন্তু তবুও বাল্মীকিরচিত রামায়ণের কিছু ঘটনা শ্রীরামের মর্যদাপুরুষোত্তম সত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তার মধ্যে প্রধান ঘটনা হল শ্রীরাম দ্বারা সংগঠিত শম্বক বধ।

প্রথমেই আমরা রামায়ণের উল্লেখিত শম্বক বধ নিয়ে রামায়ণের প্রেক্ষাপট আলোচনা করবো।রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে চতুঃসপ্ততিতম সর্গ থেকে শুরু করে সপ্তসপ্ততিতম সর্গ মোট ৪ টি সর্গ আলোচনা করলেই শম্বক বধের প্রেক্ষাপট স্পষ্ট হয়ে যায়।

রাম রাজত্বে কোনপ্রকার অকাল মৃত্যু ছিল না, তবুও একদিন রামের রাজসভায় এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁর ১৫ বছরের মৃত পুত্রের দেহ নিয়ে এসে, রামের কাছে মৃত পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চান। রাম এই মৃত্যু কারণ অনুধাবন করবার জন্য বশিষ্ঠ মার্কণ্ডেয়,মৌদগল্য, বামদেব,কাশ্যপ,কাত্যায়ন, জাবালি, গৌতম এবং নারদকে আহ্বান করলেন এবং ব্রাহ্মণ পুত্রের মৃত্যু কারণ জিজ্ঞাসা করলে। তখন নারদ বললেন, ত্রেতাযুগে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের তপস্যার অধিকার আছে কিন্তু রামরাজত্বে কোথাও মনে হয় কোন শূদ্র নির্বুদ্ধিতাবশত তপস্যা করছে তাই রামরাজত্বে এইপ্রকার অকাল মৃত্যু( বৈশ্যরা দ্বাপরযুগে আর শূদ্ররা কলিযুগে তপস্যার অধিকারী,উত্তরকাণ্ড মতে) আর এই যদি চলতে থাকে রাজত্ব ধ্বংস হবে এবং রাজা নরকে যাবেন তাই রাজা হিসাবে রামের উচিৎ শূদ্র তাপসকে বধ করে রাজ্যের ধর্মবৃদ্ধি করা অকাল মৃত্যু রোধ করা, তবে মৃত ব্রাহ্মণ পুত্র জীবিত হবে।

রাম বহু সন্ধানের পরে রাজ্যের দক্ষিণ অংশে শৈবল পর্বতের উত্তরপাশে একটি সুপ্রশস্ত সরোবরের তীরে এক তাপস কে অতিকঠোর তপস্যা করতে দেখলেন।রাম তার পরিচয় জানতে চাইলে, সে বলে তাঁর নাম শন্বক তিনি শূদ্র, এই কথা শুনে রাম দিব্য খড়্গের সাহায্যে শম্বকের শিরচ্ছেদ করেন। এই কারণে দেবতারা রামের উপর তুষ্ট হয় এবং ব্রাহ্মণ পুত্রের প্রাণ ফিরে পায়।

এই হল শম্বক বধের প্রেক্ষাপট। এখানে যারা রামকে ঈশ্বর রূপে আরাধনা করেন তাদের এইনিয়ে কোনপ্রকার প্রশ্ন না থাকবারই কথা, কারণ তারা মনে করেন অবতার রূপে ঈশ্বর যখন জন্মগ্রহণ করেন তার প্রত্যেকটি কাজই কেবলমাত্র লীলা সেটা নিয়ে কোনপ্রকার বিতর্ক বা প্রশ্নের অবতারণা হয়না।

কিন্তু যারা রামকে একটি মানবিক আদর্শ চরিত্র রূপে বিশ্বাস করেন, যিনি আদর্শ রাজা, আদর্শ পুত্র এবং পুরুষোত্তম তিনি এতোটা কঠোর কিভাবে হন, যা রামায়ণের অন্য কাণ্ডের রামচরিত্রের সঙ্গে খাপ খায়না!!! যে রাম, বানর,রাক্ষস জাতির বন্ধু, নিষাদ গুহক যেই রামের প্রিয় বন্ধু হতে পারে। সেই রাম সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এইকারণে বিনা বিচারে এক শূদ্রকে তৎক্ষনাৎ হত্যা করে দিলেন? এমন কঠোর তিনি? হ্যাঁ সমগ্র উত্তরকাণ্ডতেই রামচরিত্রকে কঠোর ভাবে চিত্রিত করা হয়েছে রামকে অতিমানব রূপে প্রকাশিত করা হয়েছে, যা রামায়ণের অন্যান্য কাণ্ডের সঙ্গে বেমানান। বাস্তবে উত্তরকাণ্ড বাল্মীকিরচিত নয়, এই অংশ বিশেষ কোনপ্রকার উদ্দেশ্য নিয়ে পরবর্তী সময়ে রামায়ণের মধ্যে যুক্ত করা হয়ে।

উত্তরকাণ্ড যে প্রক্ষিপ্ত সেটা প্রমাণের জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে একদম রামায়ণের প্রথম কাণ্ডের প্রথম সর্গে।

রামায়ণের প্রথম সর্গে দেখা যাচ্ছে বাল্মীকি, দেবর্ষি নারদের কাছে একজন পৃথিবী শ্রেষ্ঠ গুণবান মানুষের সন্ধান করছেন এবং গুণবান বলতে ঠিক কি বোঝায় তা জানতে চাইছেন।

তখন নারদ বললেন তিনি মর্ত্যে সর্বগুণের অধিকারী একজন কে চেনেন, যিনি ইক্ষ্বাকুবংশজাত রাজা রাম।বিধাতা একত্র সর্বগুণের সমন্বয় বিরোধী হলেও রাম বিধাতার ব্যতিক্রম সৃষ্টি। রামের মত সত্যসন্ধ,প্রজাপ্রাণ,কৃতবিদ্য সর্বশুভ সর্বতোভদ্র মানুষ বর্তমান বিশ্বে দুটি নেই।

এরপর বাল্মীকির আগ্রহে নারদ রামে সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত বাল্মীকিকে জানান। রামের আকার আকৃতি,বীরত্ব, ভক্তের আশ্রয়দাতা,নীতিপরায়ণতা সব গুণের বিবরণ নারদ দেন।আরও বলেন এত গুণ থাকা সত্তেও পিতার আদেশ পালনের জন্য রাম,সীতা,লক্ষ্মণ বনগমন করে।সেখানে রাবনের দ্বারা সীতা হরণ করেন।সীতার সন্ধানে শবরীর সাহায্যে তাদের সঙ্গে হনুমানের পরিচয় হয় এবং হনুমানের সাহায্যে সুগ্রীবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।রাম বালী বধ করেন এবং সুগ্রীবকে রাজপদে অভিষিক্ত করেন।হনুমান সমুদ্র অতিক্রম করব লঙ্কাপুরীতে প্রবেশ করেন, সীতাকে রামের চিহ্ন দেখিয়ে বিশ্বাস লাভ করেন,নলের সাহায্যে সমুদ্রের উপর সেতু বানিয়ে লঙ্কা আক্রমণ করেন এবং রাবণকে বিনাশ করে জানকীকে উদ্ধার করেন।সীতাকে তাঁর মনবাঞ্ছা জিজ্ঞাস করে সীতাও সেই ভাষাতেই রামকে উত্তর দেয়।অগ্নি বাক্যে আশ্বস্ত হয়ে রাম নিষ্কলুষ সীতাকে গ্রহণ করে ও পুষ্পক রথযোগে ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে যান।তারপর সুগ্রীব প্রমুখ মিত্রদের সঙ্গে নন্দীগ্রাম এসে পৌঁছান।পরিশেষে নারদ বাল্মীকিকে শোনালেন পবিত্র রামচরিত্র আখ্যানের শ্রবণের ফলশ্রুতি।

তারপরে বাল্মীকি শিষ্য ভরদ্বাজকে নিয়ে তমসা নদীতে অবগাহনের করতে গেলেন।ঐ নদীর তীরের বনভূমিতে সংগীতমুখর ছিল একটি ক্রৌঞ্চমিথুন। হঠাৎ একটি ব্যাধ তীক্ষ্ণ তীরের আঘাতে বধ করলেন ক্রৌঞ্চটিকে।তার রক্তাক্ত দেহটি ঘিরে করুণ স্বরে বিলাপ করতে লাগল ক্রৌঞ্চী।ক্রৌঞ্চীর কাতর কান্নায় বাল্মীকির হৃদয়ে বিগলিত হল। তিনি ব্যাধের উদ্দেশ্যে অভিশাপবাণী দিলেন—
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমধীঃ কামমোহিতম।।”

রে নিষাদ, তুই কামমোহিত ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে বধ করেছিস,অতএব শাশ্বতকালেও মানুষের সমাজে যেন তোর প্রতিষ্ঠা না হয়”

তারপরই বাল্মীকি মুখে উচ্চারিত হল “কিমিদং ব্যাহৃতং ময়া” এ আমি কি বললাম।

যআইহোক এরপর বাল্মীকি আশ্রমে ফিরে যান এবং আশ্রমে ব্রহ্মা স্বয়ং তাকে দেখা দেন এবং রামচরিত্র লিখতে প্রেরণা প্রদান করেন ব্রহ্মার আদেশে বিরহব্যাথা নিয়ে বাল্মীকি যোগে নিবিষ্ট হন এবং নারদের মুখে রামচরিত্র শুনলেও প্রকৃত ইতিবৃত্ত জানবার জন্য বাল্মীকি ধ্যানমগ্ন হন।

এতখানি রামায়ণ কথা জানালাম তার প্রধান কারণ হল, এই রামায়ণের ঘটনা থেকেই আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ন ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হলাম , যেমন রামের সঙ্গে বাল্মীকির কোন পরিচয় ছিলনা, নারদ বাল্মীকির কাছে রামচরিত্র প্রকাশ করেন, নারদের কথিত রামকথাও সীতা ত্যাগ ও শম্বক বধের উল্লেখ নেই এবং বাল্মীকি ধ্যানমগ্ন হয়েও সবকিছু জানতে পারলেও শম্বক বধের ঘটনা জানতে পারেনি। এর থেকে প্রমাণ হয় রামায়ণের উত্তরখণ্ড প্রক্ষিপ্ত যা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে পরবর্তী কোনকালে মূল রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

তাছাড়াও সবথেকে বড় আরেকটি প্রমাণ আছে, প্রত্যেকটি কাব্য,পুরাণ ও বীরগাথার শেষে হিন্দু মত অনুসারে সেই কাব্য বা পুরাণ পাঠের ফলশ্রুতি শুনিয়ে কাব্য বা পুরাণ শেষ করা হয়। রামায়ণের ক্ষেত্রেও যুদ্ধকাণ্ডের পরেই সেই ফলশ্রুতি পাঠ মাহাত্ম্য দেখতে পাওয়া যায়। এর থেকে ধারণা হয় যে রামায়ণ যুদ্ধকাণ্ডতেই শেষ।

তাছাড়া রাম যে সকল ঋষির সঙ্গে পরামর্শ করে শম্বক বধ করতে যান নারদ,বামদেব, কাশ্যপ, গৌতম সবাই প্রাচীন বৈদিক ঋষি।

মহাভারতের রামোপাখ্যানে রামায়ণের যে সংক্ষিপ্ত কাহানী আছে তাতেও উত্তরকাণ্ডের ঘটনাবলী অনুপস্থিত।

বাল্মীকি রামায়ণে রামায়ণের ছয়টি কাণ্ডের কথা বলে উত্তরকাণ্ডের কথা আলাদাভাবে বলা হয়েছে, ষটকাণ্ডানি তথোত্তরম, এর থেকে বোঝায়ায় উত্তরকাণ্ডটি আলাদা ভাবে মূল কাব্যশরীরের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে।

উত্তরকাণ্ডের ভাষা ও গঠন কিছুটা আলাদা, বাল্মীকির কাব্য গুণ এখানে অনুপস্থিত।

রামকথা কিছু কিছু পুরাণে উল্লেখ আছে, হরিবংশ, রায়ুপুরাণ,বিষ্ণুপুরাণ, নৃসিংপুরাণে কিন্তু এখানে আবার সীতা পরিত্যাগের উল্লেখ নেই।

এইসকল দ্বারা উত্তরকাণ্ড যে প্রক্ষিপ্ত তা প্রমাণ হয়, উত্তরকাণ্ডে উল্লেখিত ঘটনা গুলি রাম চরিত্রের সঙ্গে কোনপ্রকার যোগাযোগ নেই কেবল কিছু উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এইসকল ঘটনা রামায়ণে যুক্ত করা হয়েছে। সীতা পরিত্যাগ বা শম্বক বধ উৎকৃষ্ট শ্রেণীর নিকৃষ্ট কল্পনা মাত্র।

এখন প্রশ্ন হল কারা এই প্রকার প্রক্ষেপণ করতে পারে? অবশ্যই কোন একক ব্যক্তির কাজ নয় সংগঠিত ভাবে এই কাজ করা হয়ে। তবে তারা কারা? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি দুটি দিক অনুমান করতে পারি কেবলি । ১) বর্ণবাদী ক্ষমতাবলম্বী সমাজের লোকেরা, যারা নিজেদের ক্ষমতার লোভে বর্ণবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল শ্রীরামের নাম করে২) হিন্দু বিরোধী কোন শক্তি,যারা রাম চরিত্রকে কলঙ্কিত করবার জন্য এই কাজ করেছিল, এই অনুমান অমূলক নয়।

তবে কেবল উত্তরকাণ্ড নয় বালকাণ্ডেরও বহু অংশ প্রক্ষিপ্ত বলে পণ্ডিতরা মনে করে।

এখানে শেষ করলাম যদি কোনপ্রকার প্রশ্ন থাকে করতে পারেন।অনুরোধ করবো নিজেদের সভ্যতা সংস্কৃতিকে জানতে হলে অবশ্যই বাল্মীকিরচিত রামায়ণ পাঠ করবেন মনোযোগ দিয়ে তাহলে সত্যি ইতিহাস বুঝতে পারবেন।

জয় শ্রীরাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.