নেহরু-লিয়াকত চুক্তির প্রতিবাদে শ্যামাপ্রসাদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেবার পর লোকসভায় তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার সম্পাদিত অংশ প্রকাশ করা হলো। স. স্ব.
বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ১৯৫০
সভা শুরু ১০.৪৫ ঘটিকা। স্যার, সংসদীয় রীতি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে আমার পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করে একটি বিবৃতি দেবার জন্য আমি আপনার সামনে দণ্ডায়মান। আমি এই সভাকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চাই যে আমি হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত নিইনি— গভীর ও দীর্ঘ। চিন্তার ফলেই নিয়েছি। বহু মানুষ, যাঁরা। আমাকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে অনুরোধ করেছেন এবং যাদের আমি অত্যন্ত। সম্মান করি, তাদের প্রতি আমি আমার দুঃখ ব্যক্ত করছি তাদের অনুরোধ রাখতে পারলাম বলে।…
…পাকিস্তানের প্রতি আমাদের যা মনোভাব তা নিয়ে আমি কখনোই সন্তুষ্ট ছিলাম না। এই মনোভাব দুর্বল, স্ববিরোধী এবং ক্রমাগত হোঁচট খেয়ে চলা। পাকিস্তান আমাদের এই ভালোমানুষিকে দুর্বলতা হিসাবে দেখেছে। তার ফলে পাকিস্তান আরও সমস্যা সৃষ্টি করতে তৎপর হয়েছে, আমাদেরকে আরো যন্ত্রণা দিয়েছে এবং আমাদের নিজেদের চোখে আমরা হেয় হয়েছি। প্রতিটি বিষয়ে আমরা রক্ষণাত্মক অবস্থানে থেকেছি এবং পাকিস্তানের কুমতলব মোকাবিলা করতে বা আবরণ সরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু আজকে আমার বিচার্য বিষয় সার্বিক ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নয়। আমাকে পদত্যাগ করতে যা বাধ্য করেছে তা হলো পাকিস্তানে, বিশেষত পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘুদের প্রতি পাকিস্তানি আচরণ। একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন—বাঙ্গলার এই সমস্যা কোনো প্রাদেশিক সমস্যা নয়। এই সমস্যার থেকে সর্বভারতীয় কিছু বিষয় উঠে এসেছে, যার সমাধানের উপর গোটা দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি, সবই নির্ভর করছে। এ দেশের বেশিরভাগ মুসলমান ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ। চেয়েছিলেন, যদিও একথা আমি আনন্দের সঙ্গে স্বীকার করি যে একটি ছোট্ট অংশ, যাঁরা। দেশপ্রেমিক এবং যারা দেশের মঙ্গলকামনা করেন তারা চাননি— এবং এজন্য তাদের কষ্টস্বীকারও করতে হয়েছিল। অপরপক্ষে হিন্দুরা কেউই দেশভাগ চাননি। যখন দেখা গেল দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী তখন আমি বাঙ্গলা ভাগ করার কাজে একটা বিশাল ভূমিকা পালন করেছিলাম। এর কারণ, তা না করলে গোটা বাঙ্গলা এবং সম্ভবত অসমও পাকিস্তানে চলে যেত। তখন আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে আমি কোনোদিন দেশের প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্য হতে পারি। (সেই সময়) আমি এবং অন্য অনেকে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের আশ্বাস দিয়েছিলাম যে যদি ভবিষ্যতে পাকিস্তান সরকার তাদের উপর অত্যাচার করে, যদি তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকার না দেওয়া হয়, যদি তাদের জীবন এবং মানসম্মান বিপর্যস্ত হয় বা তাদের উপরে আক্রমণ হয় তাহলে স্বাধীন ভারত চুপ করে বসে তা দেখবে না— ভারতের সরকার এবং জনসাধারণ তাদের ব্যাপারে সাহসের সঙ্গে তৎপর হবে। গত আড়াই বছরে তারা যে যন্ত্রণা পেয়েছে তা যথেষ্ট ভয়াবহ। এবং আজকে আমার স্বীকার না করে উপায় নেই যে তাদের যে আশ্বাস আমি দিয়েছিলাম তা আমি বহু চেষ্টা সত্ত্বেও রাখতে পারিনি—এবং শুধু এই জন্যই বর্তমান সরকারে থাকবার কোনো নৈতিক অধিকার আমার আর নেই। অতি সম্প্রতি পূর্ববঙ্গে যে সব ঘটনা ঘটেছে তা অবশ্য তাদের গত আড়াই বছরের অত্যাচার ও অপমানকে ম্লান করে দিয়েছে। আমরা যেন ভুলে না যাই যে পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের ভারতের কাছ থেকে সাহায্য পাবার যে অধিকার আছে। তা শুধু মানবিক কারণে নয়। তারা দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং বৌদ্ধিক প্রগতির জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে স্বার্থহীন ভাবে কাজ করে গেছেন। যে সব দেশনেতা আজ আমাদের মধ্যে নেই এবং যেসব যুবক দেশের স্বাধীনতার জন্য হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করেছেন তারা আজ সম্মিলিত কণ্ঠে ন্যায়বিচার চাইছেন।
যে চুক্তি সই হয়েছে (৮ এপ্রিলের নেহরু-লিয়াকত চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি) তা আমার মতে মৌলিক সমস্যাটির কোনো সমাধানই করতে পারবে না। এই অমঙ্গলের মূল আরও অনেক গভীরে নিহিত—তাপ্পি মেরে কখনো শান্তি আসবে না। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য এবং মূলনীতিই হচ্ছে একটি ইসলামি রাষ্ট্র তৈরি করা এবং সেখান থেকে সমস্ত হিন্দু ও শিখকে। বিতাড়িত বা হত্যা করা এবং তাদের সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎকরা। এই মূলনীতির ফলে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘বিপদসঙ্কুল, বীভৎস ও সংক্ষিপ্ত’ (‘nasty, brutish and short’)। ইতিহাস যেন আমরা ভুলে না যাই। ভুলে গেলে তা আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনবে। আমি প্রাচীনকালের কথা বলছিনা, কিন্তু যদি পাকিস্তান সৃষ্টির পরে সে দেশের হিন্দুদের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ নেই। সমস্যাটা কিন্তু সাম্প্রদায়িক নয়, সমস্যাটা রাজনৈতিক। যে চুক্তি করা হলো তাতে ইসলামীয় রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত স্বরূপটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু যদি কেউ পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন সভায় পাশ করা লক্ষ্য প্রস্তাবটি (Objectives Resolution) মন দিয়ে পড়েন এবং সেই সঙ্গে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতাও মাথায় রাখেন তাহলে দেখবেন যে এক জায়গায় যেমনি সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে তেমনি আর এক জায়গায় সতেজে ঘোষণা করা হয়েছে, “ইসলামে যে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সমতা, সহনশীলতা এবং ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে তাও পুর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।” পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এই প্রস্তাব উত্থাপনের সময় নিম্নলিখিত বক্তব্য রেখেছিলেন।
“আপনারা এও লক্ষ্য করবেন যে যখন মুসলমানরা নিজেদের ধর্মাচরণ ও ধর্মপালন করছেন তখন রাষ্ট্রের ভূমিকা কিন্তু এক নিরপেক্ষ দর্শকের মতো হবে না। তা যদি হতো তাহলে যেসব আদর্শের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান দাবি করা হয়েছিল প্রকারান্তরে সেসব আদর্শ নাকচ করে দেওয়া হতো। যে রাষ্ট্র আমরা তৈরি করতে চাইছি তার। ভিত্তি হবে সেই সব আদর্শ। রাষ্ট্র এমন একটা পরিবেশ তৈরি করবে যা এক প্রকৃত ইসলামি সমাজ গঠনে সহায়ক হবে— যার মানে হচ্ছে। রাষ্ট্র এই ব্যাপারে এক সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, কায়েদে আজম এবং মুসলিম লিগের অন্যান্য নেতারা। দ্ব্যর্থহীনভাবে একথা ঘোষণা করেছিলেন যে মুসলমানদের এই পাকিস্তান দাবির মূল কারণ, মুসলমানদের এক নিজস্ব জীবনশৈলী ও আচরণবিধি আছে। বাস্তবেই, ইসলাম সমাজিক আদানপ্রদানের জন্য একটি নিয়মাবলী বেঁধে দিয়েছে এবং সমাজ প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তাকে মোকাবিলা করার জন্য দিকনির্দেশও দিয়ে দিয়েছে। ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত আচরণ ও বিশ্বাসের ব্যাপার নয়”।
আমি প্রশ্ন রাখছি, এইরকম একটি সমাজে কি কোনো হিন্দু তার সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ব্যাপারে নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারে? আমাদের প্রধানমন্ত্রীই মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে এইসদনে দাঁড়িয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মূল পার্থক্যটি বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাঁর কথাগুলি পুনরাবৃত্তি করার যোগ্য :
“পাকিস্তানের মানুষ এবং আমরা একই জনগোষ্ঠীর। আমাদের দোষ ও গুণগুলিও এক। কিন্তু মূল সমস্যাটা হচ্ছে তারা যে ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক সরকার গঠন করেছে তার সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ। নিয়ে”।
যে মতাদর্শ পাকিস্তান প্রচার করেছে সেটই আমাদের উদ্বেগের একমাত্র কারণ নয়। তারা যে আচরণ করেছে তা এই মতাদর্শের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এর ফলে সে দেশের সংখ্যালঘুদের বহুবার ইসলামিরাষ্ট্রের স্বরূপ এবং আচরণ সম্বন্ধে খুব তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই চুক্তিটি এই মৌলিক সমস্যার কোনো সমাধান দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
সাধারণ মানুষের স্মৃতিশক্তি অনেকক্ষেত্রেই অত্যন্ত দুর্বল। কিছু মানুষের ধারণা এই চুক্তিটিই সাম্প্রতিককালে সংখ্যালঘুর সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথম বিরাট প্রচেষ্টা। আমি আপাতত পঞ্জাবে যে কাণ্ড হয়েছিল তার কথা তুলছি না যেখানে প্রশাসনের তরফে সবরকম আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও প্রশাসন সম্পূর্ণ মুখ থুবড়ে পড়েছিল এবং শেষপর্যন্ত সমস্যার সমাধান হয়েছিল এক পৈশাচিক উপায়ে। তারপর আমরা দেখেছি পূর্ববঙ্গের উত্তরাংশ থেকে হিন্দু বিতাড়ন। বর্তমানে পূর্ববঙ্গে এক কোটি ত্রিশ লক্ষ হিন্দু বসবাস করেন এবং এঁদের ভবিষ্যৎ ভারতে আমাদের সকলের কাছে এক মহা দুশ্চিন্তার বিষয়। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাস থেকে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের মধ্যে পাঁচ লক্ষ হিন্দু পূর্ববঙ্গ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। কোনো বড়োরকম ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে তারা পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাননি এবং আশ্রয়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে ভারতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। হয়ে এসেছে, কোনো মুসলমানকে ভারত ছেড়ে পাকিস্তান যেতে বাধ্য করা হয়নি, ভারতের তরফ থেকে কোনো প্ররোচনা দেবারও প্রশ্ন ওঠে না। ১৯৪৮ সালে প্রথম আন্তঃ-ডমিনিয়ন চুক্তি কলকাতায় স্বাক্ষরিত হয় যার বিষয় ছিল বিশেষ করে বাঙ্গলার সমস্যা। যদি কেউ সেই চুক্তি এবং বর্তমান চুক্তি তুলনা ও বিশ্লেষণ করে দেখেন তাহলে দেখবেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুটি চুক্তি প্রায় সমার্থকই। কিন্তু এই (১৯৪৮ সালের) চুক্তি ফলদায়ক হয়নি। ভারত সেই চুক্তি মেনে চলেছে, কিন্তু পূর্ববঙ্গ থেকে বহির্গমন অবারিত থেকেছে। প্রচুর আলাপ-আলোচনা হয়েছিল, আমলা এবং মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠক হয়েছিল, দুই ডমিনিয়নের মন্ত্রীদের মধ্যেও কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু ফলের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, পাকিস্তানের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এরপর ১৯৪৮-এর ডিসেম্বরে দিল্লিতে একটি দ্বিতীয় আন্তঃ-ডমিনিয়ন বৈঠক হয়, আরও একটি চুক্তি সই হয়। বিষয় একই ছিল— অর্থাৎ বাঙ্গলার সংখ্যালঘুদের অধিকার। এটি প্রথম চুক্তিটির একটি প্রতিলিপি ছিল বললেই হয়। এরপর ১৯৪৯ সালে আমরা দেখতে পাই পূর্ববঙ্গের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং আরও বেশি সংখ্যক অসহায় মানুষ তাদের ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত হয়ে অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় ভারতে এসে পৌঁছচ্ছে। অর্থাৎ অস্বীকার করার উপায় নেই যে দু-দুটি আন্তঃ -ডমিনিয়ন চুক্তি সত্ত্বেও ষোলো থেকে কুড়ি লক্ষ হিন্দু পূর্ববঙ্গ থেকে উৎখাত হয়ে ভারতে ঢুকেছে। আনুমানিক দশ লক্ষ হিন্দুকে পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশ থেকে ভারতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই সময় পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় বেশ কিছু মুসলমানও সেদেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি বড়োরকম ঘা খায় এবং আমাদের অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে এই বিয়োগান্ত নাটক দেখতে হয়।
আজকে লোকের মনে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ভারত এবং পকিস্তান, দুই দেশই নিজেদের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ঘটনা কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত। বিদেশি সংবাদপত্রে এ ধরনের বিরূপ প্রচার করা হয়েছে। এটি ভারতের পক্ষে মানহানিকর এবং যাঁরা সত্য জনতে চান তাদেরকে এ বিষয়ে অবহিত করা জরুরি। ভারত সরকার কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য— এই দুই পর্যায়েই শান্তি বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে— অবশ্যই পঞ্জাব এবং দিল্লির অবস্থা ঠাণ্ডা হবার পরে। এর মধ্যে। পাকিস্তান কিন্তু সিন্ধু এবং পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘুদের শান্তিতে থাকবার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে—এটি একটি গুরুতর এবং অবিরাম প্ররোচনাও বটে। এটা ভুললে চলবে না যে যাঁরা পূর্ববঙ্গ বা সিন্ধুপ্রদেশ থেকে চলে এলেন তারা কিন্তু দেশভাগের সময়কার কোনো কাল্পনিক ভয় থেকে এ কাজ করেননি। এঁরা পাকিস্তানে থেকে যেতে চেয়েছিলেন, শুধু যদি তাদের শান্তিতে এবং সুস্থিতিতে সে দেশে থাকতে দেওয়া হতো।
১৯৪৯ সালের শেষের দিকে নতুন করে পূর্ববঙ্গে নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করে। সে অঞ্চলে একটা লৌহ যবনিকা টাঙানো ছিল, যার ফলে এর খবর প্রথম প্রথম ভারতে পৌঁছয়নি। ১৯৫০-এর জানুয়ারি মাসে যখন ১৫,০০০ উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে এসে হাজির হয়। তখনই নির্যাতন ও ভয়াবহ অত্যাচারের কাহিনি জানা যায়। এবার আক্রমণ হয়েছিল যুগপৎ শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিরুদ্ধে এবং গ্রামের সেই সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে যারা সচল, চাঙ্গা এবং ঐক্যবদ্ধ। এদের বুকের অন্তস্তলে ভয় ধরিয়ে দেওয়াই ছিল পাকিস্তানের নীতি। এই ভয়ংকর খবরে পশ্চিমবঙ্গে তুলনামূলকভাবে কিছু ছোটোখাটো প্রতিক্রিয়া হয়। যদিও এসব অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এবং যথাযথভাবে দমন করা হয়েছিল, এই বিষয়ে মিথ্যা এবং অতিরঞ্জিত খবর পূর্ববঙ্গে প্রচার হতে থাকে। এই প্রচার পরিষ্কার সরকারি প্রচেষ্টায় হয়েছিল এবং এর উদ্দেশ্য ছিল ভয়াবহ। দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে পূর্ববঙ্গে নারী নির্যাতন, নারীধর্ষণ, অসহায় মানুষকে জোর করে ধর্মান্তরকরণ এবং প্রাণহানি ও সম্পত্তি ধ্বংসের এমন সব শোচনীয় ঘটনা সমস্ত দেশ জুড়ে ঘটতে আরম্ভ করে যা কোনো সভ্য সরকারের কখনো সহ্য করা উচিত নয়। আমাদের কাছে যা খবর পৌঁছেছে তার ভিত্তিতে একথা বলা যায় এগুলি কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক ঘটনা নয়। পূর্ববকে সংখ্যালঘুশূন্য করার এক ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পনারই অঙ্গ এগুলি; এই কথা অস্বীকার করা মানে কঠিন সত্য ভুলে যাওয়া। এই সময় আমাদের নিজেদের প্রচারযন্ত্র কী দেশে, কী বিদেশে একেবারেই দুর্বল এবং অকর্মক অবস্থায় ছিল। যাতে ভারতের ভিতরে প্রতিক্রিয়া না হয় সেটাই আংশিকভাবে এর কারণ। কিন্তু পাকিস্তান সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থান নিয়েছিল। এর ফল হলো, ভারত আক্রমণকারী হিসাবে চিহ্নিত হলো— যদিও বাস্তব তার ঠিক উল্টো। সেই কঠিন সময়ে যদিও কিছু উত্তেজিত মানুষ ছিলেন, বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু চাইছিলেন যে ভারত সরকার এই বিষয়ে যথযথ ব্যবস্থা নিক এবং পাকিস্তান পৈশাচিকতা বন্ধ করুক। সেই সময় কিন্তু আমরা তাদের হতাশ করলাম। যখন একদিন—এমনকী এক ঘণ্টা সময়ও গুরুত্বপূর্ণ, আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ নষ্ট করেছি অব্যবস্থিতচিত্ত অবস্থায়। পুরো দেশ যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, আমাদের কাছ থেকে কিছু কাজ আশা করছিল তখন আমরা শুধু বসে বসে সময় কাটিয়েছি, কী করতে হবে ঠিক করতে পারিনি। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের আরও কিছু জায়গায় মানুষ ধৈর্য হারাতে আরম্ভ করল এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেবার চেষ্টা করল। আমি এ কথা খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, পাকিস্তানে যে পৈশাচিকতা হচ্ছিল তার প্রতিবাদে ভারতে কিছু নির্দোষ মানুষকে হত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না। এর ফলে যে চক্র তৈরি হয় তা আরও ভয়ংকর; এতে মানুষের মনুষ্যত্ব বিলুপ্ত হয় এবং এমন সব অপশক্তির উদ্ভব ঘটে যাকে পরে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমরা একটি সভ্য রাষ্ট্র, আমাদের সেরকম আচরণই করতে হবে এবং রাষ্ট্রের সব নাগরিক যাঁরা রাষ্ট্রের। প্রতি আনুগত্য রাখেন তাঁদের সকলকে ধর্মনির্বিশেষে নিরাপত্তা দিতে হবে। এরকম সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হয় এবং সরকার যদি যথেষ্ট তৎপর হয় এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গত চাহিদা মাথায় রেখে এগোয় তবে নিঃসন্দেহে সব মানুষই সরকারের সপক্ষে এসে দাঁড়াবে। সরকার অবশ্য দেশের মধ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করার ব্যাপারে সফল। এর মধ্যে অনেকেই পূর্ববঙ্গের, যারা জীবিকার সন্ধানে ভারতে ঢুকেছিল। এইবার পাকিস্তান অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পারল, কারণ উদ্বাস্তু আগমনটা আর একমুখী থাকল না। গত জানুয়ারি মাস থেকে অন্তত দশ লক্ষ মানুষ পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। অনেকে ত্রিপুরা ও অসমেও গেছেন। যা খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাতে হাজার হাজার মানুষ ভারতে ঢুকবার জন্য পা বাড়িয়েছেন এবং এঁদের মধ্যে সব শ্রেণীর ও সব অবস্থার মানুষই আছেন।
অতএব আজকে সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানে কি সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাবোধ নিয়ে থাকতে পারবে? চুক্তি করে কোনো লাভ হলো কিনা সেটার পরিচয় ভারতে বা বিদেশে চুক্তির প্রতি প্রতিক্রিয়া নয়— সেটার পরিচয় পাকিস্তানের হতভাগ্য সংখ্যালঘুদের অথবা যারা এর মধ্যেই ভারতে চলে এসেছেন তাদের মানসিক অবস্থা। পাকিস্তানে কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি কী ভাবলেন বা কিছু করতে চাইলেন কিনা সেটা এক্ষেত্রে অবান্তর। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকারি কর্মচারীদের মানসিকতা, সাধারণ মানুষের মনোভাব এবং আনসার সদৃশ সংগঠনের কীর্তি, এসব মিলে সেদেশে হিন্দুদের বেঁচে থাকাকেই দুর্বিষহ করে তুলেছে। এমনও হতে পারে যে কয়েকমাস ধরে কোনো বড়োরকম অত্যাচারের ঘটনা ঘটল না। এর মধ্যে আমরা মহা উদার হয়ে পাকিস্তানের যা যা প্রয়োজন সব দিয়ে দিলাম, ফলে তাদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটল। পাকিস্তান এই কায়দা অবলম্বন করেই চলেছে। হয়তো পরবর্তী আক্রমণ আসবে বর্ষাকালে, যখন যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়।
এই চুক্তির অংশীদার হতে আমি রাজি নই। তার প্রধান কারণগুলি আমি এইবার বলছি।
প্রথমত দেশভাগ হবার পরে এরকম দুটি চুক্তি হয়েছে এবং পাকিস্তান দুটিরই খেলাপ করেছে, যার কোনো প্রতিকারের রাস্তা আমাদের কাছে ছিল না। যে চুক্তিতে এরকম ব্যবস্থা নেই তা করে। কোনো লাভ হবে না।
দ্বিতীয়ত সমস্যার মূল নিহিত আছে পাকিস্তানের ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণায় এবং তার উপর ভিত্তিকৃত এক প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক প্রশাসনের মধ্যে। চুক্তি এই বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে এবং ফলে আমরা চুক্তির আগে যেখানে ছিলাম সেইখানেই থেকে গেছি।
তৃতীয়ত— দেখে মনে হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান দুয়েরই সমান দোষ। বাস্তবে তো পাকিস্তানই আক্রমণকারী। চুক্তিতে লেখা আছে, দুই দেশের রাষ্ট্রীক নিরাপত্তা সম্বন্ধে কোনো প্রচার বরদাস্ত করা হবে না, এবং কেনো যুদ্ধে প্ররোচনাও দেওয়া হবে না। এটা হাস্যকর কারণ এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমাদের অঙ্গরাজ্য কাশ্মীরের একটা অংশ দখল করে আছে এবং সেখানে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি চালাচ্ছে।
চতুর্থত— ঘটনাপরম্পরায় প্রমাণ হয়ে গেছে যে পাকিস্তানের দেওয়া নিরাপত্তার আশ্বাসবাণীর ভিত্তিতে হিন্দুরা পূর্ববঙ্গে থাকতে পারবে না। এটাকে একটা মূল ভিত্তি হিসেবে মেনে নেওয় উচিত। অপরপক্ষে এই চুক্তিতে বলা হচ্ছে যে সংখ্যালঘুরা তাদের সম্মান ও নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সরকারের উপরেই নির্ভর করে থাকবে। এটা আঘাতের পর অপমানের মতো। অতীতে তাদের যা আশ্বাস আমরা দিয়েছি এটা তারও বিরোধী।
পঞ্চমত—যাদের ক্ষতি হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেবার কোনো কথা চুক্তিতে নেই। যারা দোষী তাদের কোনোদিন কোনো সাজাও হবে না, কারণ কোনো কথা চুক্তিতে নেই। যারা দোষী তাদের কোনোদিন কোনো সাজাও হবে না, কারণ কোনো পাকিস্তানি আদালতে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার সাহস কারুর হবে না। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতকা তাই-ই বলে।
ষষ্ঠত- হিন্দুরা পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসতেই থাকবে। যারা এর মধ্যেই চলে এসেছে তারাও ফিরে যাবে না। কিন্তু মুসলমান যারা ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল তার এইবার ফিরে আসবে, এবং আমাদের চুক্তি রূপায়ণ করার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা দেখে আর কোনো মুসলমান ভারত ছেড়ে যাবে না। এর ফলে আমাদের অর্থনীতি প্রচণ্ডরকম ঘা খাবে এবং দেশের ভিতরে সংঘাতের সম্ভাবনাও বাড়বে।
সপ্তমত— ভারতের মধ্যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেবার ছলে এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতে মুসলমান সংখ্যালঘুদের যে সমস্যা ছিল তাকে আবার মদত দেওয়া হলো। এর ফলে সেইসব রাষ্ট্ররোধী শক্তিকেই প্রশ্রয় দেওয়া হলো যাদের চেষ্টায় পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল। এই নীতি যদি শেষপর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে এর ফলে এমন সব সমস্যার উদ্ভব হবে যা আমাদের সংবিধানেরই বিরোধী।
বিকল্প কোনো উপায় বা ব্যবস্থার কথা আলোচনা করার সময় বা সুযোগ কোনোটই এখন নেই। সরকরের অনুসৃত নীতির ফলাফল। দেখেই সেসব সম্বন্ধে ভাবা যবে। যাঁরা এই চুক্তি করেছেন তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আমি কোনো প্রশ্ন তুলছি না। আমি কেবল আশা করব যে এই চুক্তি শুধু একতরফাভাবে পালিত হবে না। যদি এই চুক্তি সফলকাম হয় তা হলে আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউই হবে না। আর যদি চুক্তি ব্যর্থ হয় তাহলে এটি হবে একটি বিয়োগান্ত পরীক্ষা, যার জন্য দেশকে অনেক দাম দিতে হবে। শুধু আমি সবিনয়ে প্রার্থনা করব, যাঁরা এই চুক্তিতে বিশ্বাস করেন তারা যেন নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন এবং পূর্ববাঙ্গলা ভ্রমণ করেন। একা যাবেন না—নিজেদের স্ত্রী, বোন, মেয়েদের নিয়ে যাবেন এবং পূর্ববঙ্গের হতভাগ্য হিন্দু সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সাহসের সঙ্গে বাস করে দেখাবেন, তাদের সমব্যথী হবেন। সেটাই তাদের বিশ্বাসের সপক্ষে অকাট্য প্রমাণ হবে। এই সরকার এই আশ্বাস দিতে চাই যে এই মুহূর্তে ভারতের মধ্যে শান্তি, সুস্থিতি ও নিরাপত্তা বজায় রাখবার ব্যাপারে আমি একমত। সরকারের উপর যথাসম্ভব চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সরকর যথাযথভাবে এবং সময় থাকতে তোষণনীতির কুফলগুলি এড়াবার জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে এবং কেনোরকম অত্যাচর না হয় তা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু দেশের মধ্যে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা বা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির কোনো প্রচেষ্টাকেই উৎসাহ দেওয়া যাবে না। সরকার আর একবার চেষ্টা করতে চাইছে, এটিই চেষ্টা করার শেষ সুযোগ, করুক চেষ্টা। কিন্তু সরকারকে যারা সমালোচনা করবে তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য যেন কোনো চেষ্টা না হয়। আমদের দুর্ভাগ্য, চুক্তির একজন স্বাক্ষরকারী যারা বার বার চুক্তির খেলাপ করেছে, তারা যেন মুখে নয়, কাজে করে দেখায় যে তারা এই চুক্তি রূপায়ণ করতে পারে এবং তাদের প্রতিশ্রুতি পালন। করতে পারে। এই সতর্কবাণীতে সরকারের বিচলিত হওয়া উচিত নয়, কারণ এর ফলে সরকার আরও সচেষ্ট এবং আরও সতর্ক হয়ে ভারতের। স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে।
উদ্বাস্তু সমস্যার ব্যাপারে তাদের পুনর্বাসন— যা একটি বিরাট সমস্যা— তার কথাও ভাবতে হবে। ভাঙা বাঙ্গলায় পশ্চিমবঙ্গ একা এই ভার বহন করতে পারবে না। এটি এমন একটি সমস্যা যার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি সবরকম প্রচেষ্টা নিতে হবে। সরকার এবং সরকারের সমালোচক এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই সহযোগিতা রাখতে হবে। তার কারণ, এই সমস্যা বহু লক্ষ মানুষের সুখশান্তি প্রদানের সমস্যা, এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার সমস্যা।
(সৌজন্য : যা ছিল আমার দেশ—তথাগত রায়)
2019-08-09