কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা যুক্তরাষ্ট্রীয় রীতির বিরোধী

আমাদের সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুচ্ছেদটা নিয়ে সম্প্রতি বেশ একটা বিতর্ক ও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টা যেমন জটিল, তেমনি বিভ্রান্তিকর। বলা বাহুল্য, দেশের কিছু নেতার ভ্রান্তি, অদূরদর্শিতা এবং দুর্বলতার কারণে এই ব্যাপারে একটা দীর্ঘকালীন অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের শেষ পর্বে যখন ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের ব্যাপারটা অনিবার্য হয়ে উঠেছে, তখন রাজনৈতিক দিক থেকে দেশের দুটো অংশ ছিল ব্রিটিশ ভারত’ ও ‘প্রিন্সলি স্টেটস্। ব্রিটিশ ভারত ছিল ইংরেজদের প্রত্যক্ষ শাসনে।কিন্তু তখন দেশে ৫৬২টা বিভিন্ন আকারের দেশীয় রাজ্য ছিল সাধারণত ব্রিটিশ শাসকরা ওই সব রাজ্যের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন না। স্বাধীনতার বিষয়ে যখন বৈঠকি রাজনীতি চলছে, তখন প্রশ্ন উঠল—ব্রিটিশ শাসকদের অবর্তমানে ওই সব দেশীয় রাজ্যগুলোর অবস্থান কেমন হবে, কারণ বিদেশি প্যারামাউন্টলি’আর থাকবে না।
১৯৪৭ সালের ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট’ এর সমাধানের পথ দেখিয়েছে। বলা হয়েছে— দেশীয় রাজ্যগুলোর শাসকরা ‘ইনস্ট্রমেন্ট অব অ্যাকসেশন’-এ স্বাক্ষর দিয়ে ভারত বা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন— তবে ইচ্ছে করলে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবেও থাকতে বাধা নেই। সেই অনুসারে অধিকাংশ দেশীয় রাজ্য ভারতে যোগ দিয়েছে, কোনো কোনোটা আবার গেছে পাকিস্তানে। কাশ্মীরের অবস্থাটা ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। রাজা হরি সিংহ ছিলেন হিন্দু, কিন্তু প্রজাদের অধিকাংশই মুসলমান। সম্ভবত গরিষ্ঠরা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু রাজা হরি সিংহ কোনও ডোমিনিয়নে যোগ না দিয়ে স্বাধীন ভাবে থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু ইতিহাসের লিখন অন্য রকম। ২২ অক্টোবর (১৯৪৭) পাকিস্তানের কিছু সৈন্য হানাদারের ছদ্মবেশে হঠাৎ কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে এবং দ্রুত রাজধানী শ্রীনগরের দিকে এগিয়ে যায়। হানাদারদের এই অতর্কিত আক্রমণে কাশ্মীরের সৈন্যরা ক্রমে পিছু হটে যাওয়ায় রাজা হরি সিংহ তার প্রধান মন্ত্রী মেহেরচঁাদ মহাজনকে দিল্লিতে পাঠান ভারতের সাহায্য লাভের জন্য। কিন্তু সরকারের তরফে জানানো হলো যে, রাজা ইনস্ট্রমেন্টে ভারতভুক্তির ব্যাপারে স্বাক্ষর না দিলে ভারতের পক্ষে এই ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা আদৌ সম্ভব নয়। তখন মেহেরচঁাদ মহাজন তড়িঘড়ি কাশ্মীরে যান এবং ইনস্ট্রমেন্টে রাজার স্বাক্ষর নিয়ে ফিরে আসেন। ড. বিদ্যাধর মহাজন লিখেছেন, মেহেরচাঁদ ভি.পি. মেমনকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। ‘and after getting the Instrument of Aecesstion signed from the Maharaja & he flow back to Delhi- (দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৩৪৩)। হরি সিংহ সেই ইন্স্ট্রমেন্টের সঙ্গে একটা চিঠিও জুড়ে দিয়েছিলেন ভারতের বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেনের জন্য। তাতে তিনি লিখেছিলেন, তাঁর রাজ্যকে পাক-আগ্রাসন থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি ভারতে যোগ দিতে চাইছেন।
অতঃপর ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীর অভিযান শুরু করে এবং দ্রুত গতিতে তার অনেকটাই পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু যখন এই দুর্বার আক্রমণে পাক-হানাদাররা বিধ্বস্ত, তখন নেহরু হঠাৎ যুদ্ধ বন্ধ করে বিষয়টা রাষ্ট্রসঙ্ঘে (UNO) নিয়ে যান এবং তার ফলে সেটা একটা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ব্যাপার হয়ে পড়ে। সর্দার প্যাটেলের লেখা থেকে জানা যায় নেহরু সেই যুদ্ধটাই চাননি— (আই. জে. প্যাটেল— সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, পৃ. ৯৩৮)।
কিন্তু কাশ্মীরের রাজার স্বাক্ষরদানের সঙ্গে সঙ্গে সেই রাজ্যের ভারতভুক্তি একটা বাস্তব, বৈধ ও ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হয়েছে। কে. বি. কেশওয়ালির ভাষায়—‘thus, the state became an integral part of India (ইন্টারন্যাশনাল রিলেসান্স, পৃ. ৫৬৬)।
কাশ্মীরের ভারতীয় অংশের মানুষ ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণপরিষদ গঠন করেছেন এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের ভিত্তিতে সরকার তৈরি করেছেন। ১৯ নভেম্বর (১৯৫৬) সরকার জানিয়েছে যে, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ভি. এন. শুক্লা—ফরেন পলিসি অব ইন্ডিয়া, (পৃ. ৭৩)। কিন্তু বিশ্রী ব্যাপার হলো এই ব্যাপারে ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ রাখা হয়েছে। এতে আছে—
(১) ২৩৮ নং অনুচ্ছেদ কাশ্মীরের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে না।
(২) ৩৭০ ধারায় সংবিধানের বহু আইন কাশ্মীরে প্রযোজ্য হবে না।
(৩) এই দুই তালিকার অন্তর্ভুক্ত ইনস্ট্রমেন্ট বহির্ভুত বিষয়ে রাষ্ট্রপতি রাজ্য সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করবেন।
(4) সংবিধারে অন্য কিছু বিষয় নিয়েও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিতে হবে।
(৫) জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ঘোষণার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা থাকবে।
(৬) রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উক্ত অনুচ্ছেদ বাতিল করতে পারেন।
তবে তার জন্য কাশ্মীর গণপরিষদের সম্মতি নিতে হবে। জি. এস. পাণ্ডে লিখেছেন, ওই অনুচ্ছেদটা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক-বিভেদ হয়েছে— “there has been a lot of controversy regarding the repeal of thas Article’— (কনস্টিটিউশনাল, পৃ. ৪৩৯)। সবচেয়ে বড়ো কথা—এটা একটা অস্থায়ী অনুচ্ছেদ—Art. 370 is a temporary provision. It is not intended to be permanent- (a)
কিন্তু কয়েক দশক অতিক্রান্ত হলেও ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ এখনও আছে এবং হয়তো থেকেও যাবে, কারণ সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসুর ভাষায়—Art. 370 is a special provision(কস্টিটিউশনাল ল অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৪৬৬)। একটা রাজ্যের গরিষ্ঠ সম্পদায়ের মন পাওয়ার জন্য ওই অনুচ্ছেদটা রাখা হয়েছিল, কাশ্মীরকে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ মর্যাদা। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এখনও ওটা রেখে দেওয়ার কি দরকার আছে ?
সবচেয়ে বড়ো কথা— অন্য যে-সব দেশীয় রাজ্য ভারতে যোগ দিয়েছে, তারা যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল, কাশ্মীরও সেটা নিয়েছিল। অর্থাৎ ইনস্ট্রমেন্টে স্বাক্ষর দিয়ে তাদের রাজা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। দুর্গাদাস বসু লিখেছেন, ‘the Instrument of Accession signed by Hari singh on the 30th October, 1947, was in the same form as was executed by the rulers of the numarous other states which had acceded to India following the enrolment of the Indian Independence Art… jote ‘Kashmir cannot be in any way different from those arising from the same fact in the can of the other Indian states’— (6ūlutpatay টু দ্য কনস্টিটিউশান অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২২৯)। এই কারণেই বলা যায় অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে কাশ্মীরের কোনও পার্থক্য নেই আর সেই জন্যই তার পৃথক বা বিশেষ অধিকার থাকতে পারে না।
বিশেষ করে, আমাদের সংবিধান যদিও ১নং অনুচ্ছেদে Union of states’কথাটা ব্যবহার করেছে, আসলে দেশটা যুক্তরাষ্ট্রীয়। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক রাজ্যই একই স্তরের ও একচ মর্যাদার। জি. এন. যোশী মন্তব্য করেছেন, ‘The state of Jammu and Kashmir has been treat in the constitution separately and differently form other states—(দ্য কস্টিটিউশান অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৩৩৪)। ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ যদিও একটা অস্থায়ী অনুচ্ছেদ, এটা বাস্তবে চিরন্তন ধারায় পরিণত হয়েছে। সহদেব গুপ্তার মতে, Hence, the state still enjoys a special position in the framework of the Indian constitution. It has entoiled a lot of critisism— (TS ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউশান, পৃ. ২১৯)।
এই কারণে বলা যায়- এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধী। কোনও কারণেই একটা অঙ্গরাজ্যকে এই ধরণের বিশেষ সুযোগ বা মর্যাদা দেওয়া যায় না। ড. এস. সি. কাশ্যপ তাই মন্তব্য করেছেন, ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ হলো politically perhaps the most controversial provision’ (আওয়ার কস্টিটিউশান, পৃ. ২৭৫)। তাঁর মতে, এর দ্বারা ওই রাজ্যে পার্লামেন্টের আইন-প্রণয়ন ক্ষমতা বিশেষ ভাবে ক্ষুন্ন করা হয়েছে, কিন্তু অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। এটা মুখ্যমন্ত্রীর আদর্শ বা নীতির সঙ্গে আদৌ মানানসই হয়নি। পার্লামেন্ট রচিত আইন প্রচলনের ক্ষেত্রে রাজ্যের অনুমোদন লাগবে কেন? তাহলে সেটা অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হোক।
বলা বাহুল্য, ৩৭০ ধারায় আমাদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সীমিত রয়েছে। বিশেষ করে, পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা এই ক্ষেত্রে বেশ ক্ষুন্ন হয়েছে। কাশ্মীর ভারতের অংশ এবং ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ধারিত করেছে এইটুকুই স্পষ্ট—বাকিটা আলোচনা ও সম্মতির ব্যাপার— (ও. জি. নুরানি-ইন্ডিয়ান কস্টিটিউশান অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ৫৪৯)। আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকর করার জন্য পার্লামেন্ট আইন রচনা করতে পারলেও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সেইরাজ্যের সম্মতি নিতে হবে। এমনকী, রাজ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষেত্রেও ওই রাজ্যের সংবিধান রক্ষাকবচ দিয়েছে তার সংবিধানই ঠিক করবে সংবিধানিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে কিনা। সেখানে রাষ্ট্রপতি আর্থিক জরুরি অবস্থাও (‘Financial Emergency’) ঘোষণা করতে পারেন না।
এভাবেই বিভিন্ন দিক থেকে কাশ্মীরকে একটা বিশেষ ও পৃথক ধরনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধী। আগেই। বলেছি প্রথম দিকে রাজ্যবাসীর মন জয় করার জন্য ওই সব ব্যবস্থা নেওয়ার হয়তো দরকার ছিল— তার পৃথক সংবিধান ছিল, গণপরিষদ ছিল, মুখ্যমন্ত্রীকে বলা হতো প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল পদের নাম ছিল সদর-ই-রিয়াসত। কিন্তু এত বছরে এত কিছু পরিবর্তন ঘটানো হলেও ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ থেকে গেছে। এটাকে ‘temporary provision বলা হলেও এটা কি চিরন্তন হয়ে থাকবে?
ড. নির্মলেন্দু বিকাশ রক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.