একটা গল্প বলি। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ভালো মতো গেড়ে বসেছে। প্রথমে তারা ধর্মপ্রচারের বিপক্ষে ছিলেন। যে রাজকীয় সনদের বলে ইংরেজ বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে বানিজ্য করবার অধিকার পেয়েছিল ,তাতে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল যে তারা ভারতে কোন রকম ভাবে মিশনারী পাঠাতে পারবে না।
এত বাধা সত্বেও উইলিয়াম কেরি নামে একজন ইংরেজ পাদ্রী ডেন দেশীয় জাহাজে 1793 সনে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে কলকাতায় উপস্থিত হন। এই উইলিয়াম কেরি একজন দরিদ্র মুচির পুত্র ছিলেন এবং যথেষ্ট উৎসাহ ও অধ্যবসায় স্বত্বও ধর্ম প্রচারে সম্পূর্ণ বিফল হলেন। কিছুদিন পরে তাঁর আহবানে আরো চারজন ইংরেজ এক অ্যামেরিকান জাহাজে কলকাতায় পৌঁছলেন।।কিন্তু ইংরেজ গভর্নর তাদের কলকাতায় নামতে না দেওয়ায় তারা ডেন জাতি অধিকৃত শ্রীরামপুর অঞ্চলে চলে গেলেন এবং কেরি ও সেখানে তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন ।এই রূপে কলকাতার নিকটবর্তী শ্রীরামপুরে প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান মিশনারীদের একটি কেন্দ্র স্থাপিত হলো।
1800 সনে কৃষ্ণ চন্দ্র পাল নামে এক ছুতার মিস্ত্রির হাত ভেঙে গেলে টমাস নামে এক মিশনারি ডাক্তারের চিকিৎসায় সে আরোগ্য লাভ করে। সেই সর্বপ্রথম খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। এর পূর্বে সাত বছরের মধ্যেও একটি বাঙালি হিন্দু কেও কেউ খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারেনি ।সুতরাং এই ঘটনায় সমস্ত মিশনারীরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে এবং টমাস উন্মাদের মত আচরণ করতে শুরু করে। ফলে তাকে পাগল বলে আটক করে রাখা হয়।
বিলেতে একদল লোকের চেষ্টায় ভারতে ইংরেজ মিশনারীদের ধর্ম প্রচারে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল 1814 রহিত করা হয়। সুতরাং শ্রীরামপুরের প্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিদের ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্র বাংলায় এবং বাংলার বাইরে বিস্তার লাভ করে। 1818 সনে 126 টি দেশীয় ভাষা শিক্ষার বিদ্যালয়ের প্রায় 10 হাজার ছাত্র পড়ত। তারা সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্ট ধর্ম শিক্ষা লাভ করত । 1821 শ্রীরামপুর কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়।
1814 সনের পর থেকে ব্যাপক হারে missionary এই বঙ্গে আসতে শুরু করে ।কলকাতায় একজন পাদ্রী নিযুক্ত হলেন । এর ফলে প্র এবং প্রধানত বিদ্যালয় , হাসপাতাল এগুলির দ্বারা দরিদ্র শ্রেণীর হিন্দুরা প্রলুব্ধ হয়ে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করল। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুব বেশি হয়নি।
1817 হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা হয় এবং 1835 সরকারি নতুন ব্যবস্থা ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি আশক্তি বৃদ্ধি পায় । মধুসূদন দত্ত , কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে।
পূর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এ দেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের বিরোধী ছিলেন ক্রমে ক্রমে তাদের মত সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইল a company দেওয়া হলো তাতে মিশনারীদের এদেশে বসবাস ও ধর্ম প্রচারের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হলো এ দেশে আসতে শুরু করল ও কর্মচারীগণ পরোক্ষভাবে হিন্দু ধর্মের সমর্থন করে আসছিল তার বিরুদ্ধে তারা বিরোধিতা করতে শুরু করল ।
এক্ষেত্রে বলে রাখি এর পূর্বে ইংরেজ সরকার পক্ষ থেকে, কিন্তু হিন্দু মন্দিরের ভার গ্রহণ করা ,অনাবৃষ্টি হলে তার নিবারনের জন্য ব্রাহ্মণদের দ্বারা পুজো করানো ,সরকারী দলিলপত্র শ্রী লেখা ,গনেশ নাম উচ্চারণ করা ,হিন্দুদের নানা ধর্মউৎসবে সরকারি কর্মচারীদের যোগদান দেওয়া এবং সেই উপলক্ষে শোভাযাত্রা সামরিক বাদ্য বাজানো, হিন্দু উৎসব উপলক্ষে কামান দাগা ইত্যাদি কার্যাবলী গুলো হতো।
মিশনারি গনের আন্দোলনের ফলে বিলেতের কর্তৃপক্ষ আদেশ দিলেন যে সরকারি কর্মচারীরা হিন্দু ধর্মের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ রাখতে পারবেন না । সরকারের নির্দেশ ছিল যে সরকারি কর্মচারীরা ধর্ম বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবে। কিন্তু কার্যত এই সরকারি কর্মচারীরা খ্রিস্টান ধর্মের জন্য নানাভাবে মিশনারীদের সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে ।
এ বিষয়ে উদার মতাবলম্বী রাজা রামমোহন রায় যা লিখেছিলেন তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য :
“গত 20 বছর যাবত ইংরেজ মিশনারিরা প্রকাশ্যে নানাভাবে হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে চেষ্টা করছে। “
যাক, আমার গল্প এই সময়ের। রথের সময়। হুগলী নদীর পাড়ে কোনো এক অখ্যাত গাঁয়ে জমিদারের রথ বেরিয়েছে। রথে বসে আছেন দারুব্রহ্ম জগন্নাথ, সুভদ্রা এবং বলরাম। তাঁদের সামনে একটি বৃহৎ রামতুলসী গাছ। রথ চলেছে গাঁয়ের পথে , গন্তব্য গোপীনাথ জিউয়ের মন্দির। রথের সঙ্গে চলেছেন জমিদার বাড়ির কুলপুরোহিত, জমিদার, জমিদারের স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, পুত্রবধূ, দাসদাসী, নাম সংকীর্তনের দল, গাঁয়ের লোকজন, জমিদারের লেঠেল এবং গাঁয়ের কিছু ছেলে ছোকরা ( যাদের বুড়োরা বখাটে বলে) । রথের দড়িতে টান পড়ছে একবার করে। সকলে হই হই করে বলে উঠছে জয় জগন্নাথ, হরে কৃষ্ণ , হরে কৃষ্ণ। নাম সংকীর্তনের দল খোল , করতাল বাজিয়ে নেচে নেচে হরিনাম করে মহামন্ত্র জপ করছেন। ছেলে ছোকরারা হরিনাম, রথের দড়ি ইত্যাদির থেকে হরি লুঠের বাতাসা , গাছের ফল এসবের প্রতি অধিক মনোযোগী।
এমন সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক লালমুখো সাহেব ও তার কিছু ওঁচা সাগরেদ ঘোড়ায় করে এসে রথের পথ রোধ করে দাঁড়াল। উদ্দেশ্য তাঁদের বিরক্ত করাও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা। তো সেই সাহেব পথ রোধ করে জিজ্ঞাসা করল , ” এ টুমাদের খি জাইটেছে? ইহাকে খি বলে? ” জমিদার ভদ্রভাষায় বললেন , ” রথ যাচ্ছে। পথ ছাড়ুন। ” সাহেব শুধোলে, ” রথ খি জিনিশ আছে? ” এখন রথ খি জিনিস তার ব্যাখ্যা লালমুখোকে দিতে গেলে দুযুগ কেটে যাবে। জমিদারের লেঠেলরা মালিকের হুকুমের অপেক্ষায়। মালিক বললেই আরকি ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমন সময় এক ছোকরা পিছন থেকে বলে উঠল, ” সাহেব, ইওর বাড়ি , তার উপর মাই বাড়ি , তার উপর মাই বাবার বাড়ি, হল রথ…”।
সাহেবের এক সাগরেদ জিজ্ঞাসা করল, ” টুমাদের রথে উহা খে বসিয়া আছে? ” ছোকরার দল এবার এগিয়ে গিয়ে বলল, ” জগন্নাথ , আমাদের ভগবান , মানে গড।” আরেক লালমুখো জিজ্ঞাসা করল, ” টুমাদের গডের হাত পা খথায়? ” বলে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে লাগল।ছেলে ছোকরার দল বলল, ” আমাদের গডের হাত এত বড় যে তোমাদের মাথার উপর দিয়ে যাবে, তোমাদের গডের মতো ঝুলে পচে গলে নাই। বুঝলে সাহেব। ” সাহেবরা এবার খুব রেগে গেল। গিয়ে বলল, ” টুমাদের গডের সামনে উহা খি বসানো আছে? ” ছেলেরা বলল, ” তুলসী মা। আমাদের পবিত্র গাছ। ওটাও আমাদের ভগবান। ওই কি বল যেন, হলি টি।”
সাহেব শুনে বলল, ” টুমরা নেটিভ কালা আদমী, হামাদের গডকে নিয়ে হাঁসচ? হামি টুমাদের পানিশ কর্বে। টুমাদের ভগবান গাছকে হামি পোঁদে ঘসিবে। “
ছেলেরা বলল , ” হাঁ সাহেব, আপনারা আমাদের মালিক, ঘষুন যত খুশি। সবাই মিলে ঘষুন। ওই দেখুন কত হয়ে রয়েছে পথের ধারে। সবাই তুলে নিয়ে ঘষুন। জল দিয়ে ঘষুন সাহেব। ওই যে পুকুর পাড়। “
পথের পাশে অজস্র বিছুটি গাছ হয়েছিল। গাঁয়ের ছেলে ছোকরাদের কথায় সেগুলো তুলে পুকুর পাড়ে গিয়ে উলঙ্গ হয়ে জল দিয়ে রগড়ে ঘষতে লাগল। রথের পথ এদিকে ফাঁকা হয়ে গেল। ছেলেরা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। জমিদার ও গাঁয়ের লোকজন রথ নিয়ে চলে গেল। এদিকে সাহেবরা জল ও বিছুটি নিয়ে পিছনে এবং বিশেষ জায়গায় ঘষে ফেলেছে। বিছুটি জলের সঙ্গে মিলিত হয়ে তার কর্ম সম্পাদন করতে শুরু করে দিল। সাহেবরা সমস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল, ” ইহা টুমারা হামাদের খি লাগাইতে দিলে ? টুমাদের ভগবান যে হামাদের পোনগে খামরাইতেছে! …উহু হুহ আহা আহা…!”
ছেলের দল বললে , “কেন সাহেব তোমরাই তো আমাদের ভগবানকে ঘষতে চেয়েছিলে। দেখ আমাদের ভগবান বড়। না থেকেও কামড়ে দিচ্ছে। যাও যাও সাহেব তোমাদের গডের কাছে যাও। দেখ সে যদি সারাতে পারে।”
সেদিন সাহেবরা বিছুটির জ্বালায় উলঙ্গ হয়ে দৌড় দিয়েছিল। প্রতি বছর কোথাও রথ দেখলেই সাহেবদের সেই বিছুটির জ্বালা মনে পড়ত। মনে মনে নেটিভ নিতান্তই গেঁয়ো ছোকরাগুলোকে বাপবাপান্ত , শাপশাপান্ত করত এবং নেটিভ হিন্দুদের গডের শক্তির কথা ভেবে মাথা ব্যাথা করত। ঠিক #6ই ডিসেম্বর এলে সেকুলার ,ভণ্ড যেমন এখনও করে।
আজ 6 ডিসেম্বর। আজ শৌর্য্য দিবস।
প্রভু শ্রীরামের জন্মস্থান পুনরুদ্ধারে মহান সংগ্রামের দিন। 500 বছরের এই সংগ্রামে আত্মাহুতি দেওয়া সহস্র সনাতনী যোদ্ধার চরণ কমলে শতকোটি নমন।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গের কোঠারি ভাতৃযুগলের
রাম জন্মভূমি আন্দোলনে কর সেবক হিসেবে পুলিশের গুলিতে প্রভু শ্রীরামের জন্য আত্মউৎসর্গ আমরা ভুলি নি, ভুলবোও না । এই বীরত্বের এবং শৌর্যৈর দিনে যুগলবীরকে জানাই শতকোটি প্রণাম।
সীতাপতি রামচন্দ্রের জয়।
জয় শ্রীরাম।।
জয়কারা বীর বজরঙ্গী
হর হর মহাদেব।।
আমার কথা এবং নটে গাছ কেউই ফুরোবে না ও মুড়োবে না। নমস্কার।
© দুর্গেশনন্দিনী