স্বস্তিকার পাঠকদের একটা প্রশ্ন করতে চাই, আপনাদের মধ্যে কেউ সোনি রাজদান বলে কারও নাম শুনেছেন? খুব বেশি হাত ওঠার কথা নয়। কারণ সোনি এক সময়ে হিন্দি সিরিয়ালে (এবং গুটিকয়েক ছবিতে) অভিনয় করলেও বড়ো অভিনেত্রী কোনওকালেই ছিলেন না। আবার যাদের নামে একশো-দু’শো কোটি টাকার সার্কিট বিক্রি হয়, সেরকম বড়ো স্টারও ছিলেন না। সোনি বলিউডের বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মহেশ ভাটের স্ত্রী, আলিয়া ভাটের মা এবং অত্যন্ত সুযোগসন্ধানী একজন মহিলা।
পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে সোনি রাজদানকে নিয়ে ফিচার লেখার দরকার হয়ে পড়ল কেন? কারণ সম্প্রতি নবভারত টাইমস পত্রিকায় তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি কিছুটা উপযাচক হয়েই তাঁর পাকিস্তান-প্রীতির কথা স্বীকার করেছেন। উপযাচক শব্দটা ব্যবহার করতে হলো কারণ সাক্ষাৎকার যিনি নিচ্ছিলেন তিনি পাকিস্তান নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেননি। এতৎসত্ত্বেও, তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় পাকিস্তানে চলে যাই। ওখানে গেলে আমি এখানকার থেকে ভালো থাকব।’ না, এখানেই থামেননি অভিনেত্রী। তিনি বলেন, ‘এসব কথা যখন আমি বলি তখন কিছু লোক আমায় দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে পাকিস্তানে চলে যেতে বলে। আমিও ভাবি, আমার বোধহয় পাকিস্তানে চলে যাওয়াই উচিত। ওখানকার খাবার দারুণ। ওখানে থাকলে আমি বেশ ভালো থাকব।’ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হবার পর স্বাভাবিক ভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে গেছে। নেটিজেনদের বক্তব্য, সোনির যদি মনে হয় পাকিস্তানে থাকলে ভালো থাকবেন তা হলে বরং পাকিস্তানেই চলে যান। লাগাতার আক্রমণে কোণঠাসা সোনি বলতে বাধ্য হন, তিনি পাকাপাকিভাবে পাকিস্তানে যাবার কথা বলেননি। বেড়াতে যাবার কথা বলেছেন।
সোনি রাজদান যে কারণেই পাকিস্তানে যাওয়ার কথা বলুন, পাকিস্তান যে তার অত্যন্ত ভালোলাগার দেশ সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ করা চলে না। এর আগেও তিনি তার পাকিস্তানপ্রীতির কথা বলেছেন। শুধু তিনিই নন বলিউডের বহু তারকা, যারা উপাসনা পদ্ধতির নিরিখে মুসলমান, প্রায়শই পাকিস্তানের প্রশংসা করে থাকেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন? কারণ এদেশের মুসলমানদের একটা বড়ো অংশ পাকিস্তানের ভক্ত। অন্ধ ভক্ত বললেও অত্যুক্তি হয় না। বলা বাহুল্য, চিত্রতারকারাও। তার ব্যতিক্রম নন। ভারত তাদের অর্থ দেবে, মর্যাদা দেবে, তারকা হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি দেবে কিন্তু তারা গুণ গাইবেন পাকিস্তানের। শাহরুখ খান, সলমন খান, আমির খান, সইফ আলি খান, শাবানা আজমি, জাভেদ আখতার—সবাই এই গোত্রের। কিছুদিন আগে আমির বলেছিলেন, আমার স্ত্রী এ দেশে থাকতে আজকাল ভয় পান। হয়তো একদিন এ দেশ ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হবে। নাসিরুদ্দিন শাহের মুখেও আমরা একই ধরনের কথা শুনেছি। পুলওয়ামায় সিআরপিএফ জওয়ানেরা জঙ্গিদের হাতে খুন হবার পর বলিউড যখন পাকিস্তানের অভিনেতা-কলাকুশলীদের ব্যান করল তখন তার প্রতিবাদ করেছিলেন সলমন খান। কারণ পাকিস্তানের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সব থেকে বেশি সুযোগ পান সলমনের ছবিতেই। এদের পাকিস্তান প্রীতির প্রেক্ষাপটে রয়েছে পাকিস্তানের বাজার। এদের সকলের ছবিই একযোগে ভারত-পাকিস্তানে মুক্তি পায়। তাই, পাকিস্তান ভারতের যত বড়ো ক্ষতিই করুক না কেন, পাকিস্তানের বাজারের লোভ ত্যাগ করতে এরা নারাজ। ভারতে এদের ছবির বাজার যত সঙ্কুচিত হচ্ছে ততই বাড়ছে ইসলামিক দেশগুলির, বিশেষ করে পাকিস্তানের বাজারের প্রতি আগ্রহ। কারণ ভারতীয়ত্বের পরিচয় মুছে ফেলে নিজেদের মুসলমান পরিচয় ভাঙিয়ে পাকিস্তানে দিব্যি করে খাওয়া যায়।
সোনি রাজদান পাসপোর্ট-সূত্রে ভারতীয়, অন্তরের টানে নন। সুতরাং দেশের প্রতি তার আবেগ না থাকা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পাকিস্তানের গুণ গাইবার পর ইতিমধ্যেই তিনি ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টদের সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন। তাদের যুক্তি, শিল্পের কোনও দেশ হয় না। কথাটা ঠিক। আবার ভুলও। শিল্পের দেশ হয় না কিন্তু শিল্পীর হয়। ভারতীয়ত্ব বাদ দিয়ে কি আমরা সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনকে ভাবতে পারি ? নাকি বিশ শতকের আমেরিকাকে বাদ দিয়ে চ্যাপলিনকে ভাবা যায়? শিল্পী থাকলে তার দেশও থাকবে। শিল্পীর শিল্পভাবনায় এবং প্রকরণে থাকবে তার দেশজ উপাদানও। নয়তো তার শিল্প সুকুমার রায়ের ভাষায় বকচ্ছপ (বক + কচ্ছপ) হয়ে দাঁড়াবে।
কিন্তু সোনি রাজদানরা এই সহজ কথাটা মানেন না। কারণ তারা আগে মানুষ নন, মুসলমান। তারা যে দেশের নাগরিক হোন, দেশটি যদি ইসলামিক দেশ না হয়, তাহলে তারা আরবের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ঠিক যেমন ভারতের নাগরিক হলে মুসলমানরা দিনরাত পাকিস্তানের কথা ভাবেন।
চন্দ্রভানু ঘোষাল
2019-05-10