জম্মু-কাশ্মীরের প্রসঙ্গ আলাদা রাখুন, শুধু দলের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রাখতে ভারতের চারটি রাজ্যে সংবিধান কি লঙ্ঘিত হচ্ছে না? দেশের চারটি বড়ো রাজ্যের সরকারগুলি সেখানকার কী সরকারি কী বেসরকারি ক্ষেত্রের দুই তৃতীয়াংশ চাকরি কেবলমাত্র সেই রাজ্যের মাতৃভাষীদের জন্য যদি সংরক্ষিত করে রাখে তাহলে তাকে কি সংবিধানানুগ বলা যায়?
অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং মহারাষ্ট্রে চাকরি পাওয়ার সময় সেখানে বসবাসকারী সকল নাগরিককে আদৌ স্থানীয় চাকরিপ্রার্থী বলে গণ্য করা হয় না বা হবে না। কেবলমাত্র সেই সমস্ত লোক যারা একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে সেই রাজ্যের সীমার মধ্যে বসবাস করছে তারাই যোগ্য বলে গণ্য হবে। উল্লেখিত চারটি রাজ্য ভারতের মোট ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০ শতাংশ। এখানকার সরকারগুলি চাকরির ক্ষেত্রে খানিকটা ঘেটো সিস্টেম চালু করেছে। বা চালু করার পথে চলেছে। সংবিধানের অন্যতম আবশ্যিক শর্ত জন্ম বা বসবাসের ভিত্তিতে দেশের নাগরিকদের কোনো সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম বৈষম্য করা চলবে না। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্তি ও ৩৫এ ধারার খারিজ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য সরকারের কে স্থায়ী বাসিন্দা আর কে নয় সেই চিহ্নিতকরণের অধিকার আর বলবৎ নয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে যে অধিকার কাশ্মীর হারিয়েছে এই চারটি রাজ্য সেই অধিকার নতুন করে অর্জন করেছে, অর্জনের পথে আইন প্রণয়ন করছে। তর্কের খাতিরে অনেকে বলতে পারেন ঐতিহাসিকভাবে কোনো কোনো রাজ্যের জনগণের মধ্যে বহুক্ষেত্রে সুযোগ পাওয়া নিয়ে ভারসাম্যের অভাব ও নানাবিধ বৈষম্য দূর করতে সংবিধানের ৩৭১ নং ধারায় এই বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির আছে। এ বিষয়ে। আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করা দরকার যে, স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও আমরা এই বিশেষ সুবিধের তালিকায় আর কত সংযোজন ঘটাবো।
এই বছর ১৫ আগস্ট লালকেল্লায় ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তলনের সময় প্রধানমন্ত্রী গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন যে, শেষমেষ দেশ এইবার এক জাতি, এক সংবিধানের অধিকারী। হলো। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর সংবিধানের আর কোনো ফারাক রইল না। সেই একই দিনে অন্তত তিনটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা তাদের রাজধানী শহরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর হয় চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যের পাকাপাকি বাসিন্দাদের বিশেষ অধিকারের স্বপক্ষে দাঁড়ালেন, নয়তো যত দ্রুত সম্ভব এমন আইন লাগু করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এমন ঘোষণার মাধ্যমে তারা যে অবলীলায় সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকারকে লঙ্ঘন করে গেলেন যে কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও খেয়ালই করল না।
অবশ্যই সদ্য নির্বাচিত হওয়ার পর অন্ধ্রপ্রদেশের টগবগে মুখ্যমন্ত্রী জগমোহন রেড্ডি তুমুল উৎসাহে গত ২২ জুলাই রাজ্যে শিল্প ও কলকারখানা আইনে জরুরি সংশোধন এনে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যবাসীকে বিশেষ অধিকার প্রদান করেছেন। বিধানসভায় আইনটি পাশ হয়ে গেছে। মধ্যপ্রদেশের ও কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রীরাও স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় এই একই ধরনের ভূমিপুত্র সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মহারাষ্ট্রের শিল্পমন্ত্রী সুভাষ দেশাই এই সূত্রে ১ আগস্ট এক বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করেছেন রাজ্যে তাদের সরকার ভূমিপুত্রদের জন্য ন্যূনতম ৮০ শতাংশ চাকুরি সংরক্ষণ চালু করবেন। তিনি জানান ১৯৬৮ সাল থেকেই রাজ্যে এই আইনটির অস্তিত্ব আছে এখন। তিনি সেটিকে কার্যকর করবেন। এক পা এগিয়ে গিয়ে তিনি বলেছেন, যে সমস্ত সংস্থা এই নিয়মের বিরুদ্ধে যাবে তাদের ক্ষেত্রে জিএসটি সংক্রান্ত সুবিধে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। এর মধ্যে কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্র বিজেপি শাসিত রাজ্য। মধ্যপ্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশ অন্য দল শাসিত। মনে রাখা দরকার, মুম্বাই ও বেঙ্গালুর বিশাল শহরাঞ্চল ভারতের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। আর এই ইঞ্জিনকে মূলত চালিয়ে নিয়ে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রতিভাবান অ-ভূমিপুত্রেরা।
বাইরে থেকে আসা চাকুরি সংক্রান্ত আইন পাশ করার আগে ইয়েদুরাপ্পা ও ফড়নবীশের কিন্তু গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত যে আজকের যে বেঙ্গালুরু বা চাকচিক্যময় মুম্বাই শহর দৃশ্যমান তা কি অভূমিপুত্রদের যোগদান ছাড়া সম্পূর্ণ হতো? তাছাড়া এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীরা কি বুক ঠুকে বলতে পারবেন তারা একনিষ্ঠ ভাবে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, কিন্তু চাকুরি প্রদানের ক্ষেত্রে তা ঠিক মানেন না? জগন রেড্ডি আবার সারা বিশ্ব থেকে বিনিয়োগ তার রাজ্যে আনতে চান। এ কারণে গত ১০ তারিখে মহা আড়ম্বরে তিনি ত্রিশটি দেশের প্রতিনিধিদের তার রাজ্যে আহ্বান করে এনেছিলেন। এর মধ্যে ১৬ জন বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতও আছেন। বিজয়ওয়াড়ায় এঁদের জন্য লালকার্পেট অভ্যর্থনা হয়। যাতে বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে দেশের বাইরে থেকে আসা অর্থের জন্য সাদর আমন্ত্রণ কিন্তু অন্ধ্র প্রদেশে দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিভাবান মানুষজন পরিতাজ্য। তাদের শুধুমাত্র অন্ধ্রের ভূমিপুত্রই হতে হবে। জগমোহন নিশ্চয় খবর রাখেন যে বর্তমানে অন্ধ্রের বহু কুশলী প্রয়োগবিদ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছেন। এবং তারা কাজের মাধ্যমে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। আর, ইয়েদুরাপ্পা যদি ভূমিপুত্র সংরক্ষণে এককাট্টা হয়ে বেঙ্গালুরুতে নিযুক্ত তাবৎ অন্ধ্রপ্রদেশের গুচ্ছ গুচ্ছ তথ্য প্রযুক্তিবিদদের তাড়িয়ে দিতে তৎপর হন সেক্ষেত্রে তিনি নিজ রাজ্যের মহা বিপদ ডেকে আনবেন।
অন্ধ্রের শিল্প সম্মেলনে উপস্থিত বিদেশি কূটনীতিকদের জগন যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেন যদি মার্কিন রাষ্ট্রপতি সে দেশে কর্মরত অনাবাসীদের চাকরি কেড়ে নিয়ে আমেরিকানদের অগ্রাধিকার দেন তিনিই বা তার রাজ্যের স্বার্থে তা করতে পারবেন না কেন? একটি দেশের অন্তর্গত একটি রাজ্যের সঙ্গে একটি ক্ষমতাশালী বড়োদেশের তুলনা টানাটাই অবাস্তব। অন্ধ্রপ্রদেশ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভারতবাসীকে কখনই বলতে পারবেন না তোমরাভিসা নিয়ে অন্ধ্রে ঢোক, কিন্তু আমেরিকা তা পারবে। এছাড়া ট্রাম্পের অধীনস্থ মার্কিনি প্রশাসনকে ইতিমধ্যেই অনেকে জাতি বিদ্বেষী আখ্যা দিয়েছেন। ট্রাম্পের অভিবাসন বিরোধী নীতিগুলি অধিকাংশই রাজনৈতিক চরিত্রের। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে ট্রাম্পের সাদা চামড়ার অনুগত মার্কিন ভোটদাতাদের তুষ্টিকরণ, অভিবাসন নীতির সঙ্গে বাস্তবে মার্কিনিদের চাকরি সংরক্ষণ করে রাখার কোনো বাস্তব সম্পর্কই নেই। এই বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি সূত্র ও স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান চালানো সংস্থাগুলির কাজ থেকে যে বিপুল সংখ্যক পরিসংখ্যান হাতে এসেছে তা থেকে এটাই প্রমাণ হয়েছে যে বহিরাগত বিদেশিরা তাদের কাজের মাধ্যমে সে দেশের চাকরির বাজারকে প্রসারিত করতে সাহায্যই করেছেন। নতুন চাকরি তৈরি করিয়েছেন।
অন্ধ্রপ্রদেশের ভূমিপুত্র সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে রাজনীতি করার একটা দীর্ঘ অতীত পরম্পরা আছে। সপ্তম নিজামের সময় Mulki Rule’নাম দিয়ে যে আন্দোলন চলে তার পরিণতিতে সংবিধানে ৩৭১ডি ধারার সংযোজন হয়। এর ফলে শিক্ষা ও সরকারিক্ষেত্রে স্থানীয়দের জন্য কোটা’ ব্যবস্থা চালু হয়। জগমোহনের চালু করা নতুন চাকুরি সংরক্ষণ আইন বেসরকারি ক্ষেত্রগুলিতেও ভূমিপুত্রদের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ধারায় নবতম সংযোজন মাত্র।
পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে গোটা বিষয়টাই রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা অটুট রাখা প্রাথমিক কর্তব্য না সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা তারই লড়াই। ভেবে দেখুন। এই ধরনের কেবলমাত্র জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টাকে বাধা দিয়ে কোনো রাজনৈতিক নেতা কিংবা দল কি আদৌ সংবিধানের নির্দেশ রক্ষা করার হিম্মত দেখাতে এগিয়ে আসবে? প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী ১ মাস আগে বিধানসভায় এই সংরক্ষণ আইন পাশ হয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত কেউই এটিকে চ্যালেঞ্জ করেনি বা আদালতে যায়নি।
রবিন ডেভিড
(লেখক টাইমস অব ইন্ডিয়ার হায়দরাবাদ সংস্করণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক)
2019-09-15