এডভোকেট প্রকাশচন্দ্র সরকার তাঁর রচিত #শ্রীগোবর্দ্ধনকৃত বৃহৎ_মাহিষ্যকারিকা গ্রন্থে নারায়ণী সেনা নিয়ে যে মাহিষ্য- সন্তান নিয়ে গঠিত সে কথা উল্লেখ করে গিয়েছেন। এক্ষেত্রে বলে রাখি গোবর্ধন আচার্য ছিলেন লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি। সুতরাং , শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে মাহিষ্যগণকে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতে হয়েছিল।
পূর্ব পর্বেই আমি নারায়ণী সেনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম আলোচ্য প্রবন্ধের নিমিত্ত। কাশীদাসী মহাভারতে সাতকোটি নারায়ণী সেনার কথা বলা হয়েছে। সাতকোটি শব্দটি বহু অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কারণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে উভয় পক্ষে সর্বমোট ১৮ অক্ষৌহিণী সৈন্যের যোগদান হয়েছি।
১ অক্ষৌহিণী সমান ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৭০০ জন।
অপর একটি হিসাব এইভাবে দেওয়া হয়েছে অক্ষৌহিণীর:
এক রথ, এক হাতি,পাঁচ পদাতিক এবং তিনটি অশ্বারোহী নিয়ে একটি পত্তি হুয়।
তিন পত্তি = এক সেনামুখ
তিন সোনামুখ = এক গুল্ম,
তিন গুল্ম = এক গণ ,
তিন গণ = এক বাহিনী,
তিন বাহিনী = এক পৃতনা,
তিন পৃতনা = এক চমূ,
তিন চমূ = এক অনিকিনী,
দশ অনিকিনী = এক অক্ষৌহিণী।
অর্থাৎ, এক অক্ষৌহিণী রয়েছে ১ লক্ষ ৯ হাজার ৩৫০ জন পদাতিক সৈন্য। ৬৫ হাজার ৬১০ জন অশ্বারোহী। ২১ হাজার ৮৭০ জন গজারোহী এবং ২১ হাজার ৮৭০ জন রথারোহী।
সুতরাং, হিসাবে আসে এক অক্ষৌহিণী সমান ২,১৮, ৮৭০ জন।
কিছু লেখক তো আবার মাহিষ্য জাতিকে ভারতের বহিরাগত জাতি বলে উল্লেখ করার চেষ্টা করেছেন। যেমন – কেদারনাথ মিশির। কেদারনাথ মিশির তাঁর “The Mahishyas and Their Bhahmins” নামক প্রবন্ধে বলেছেন –
The Mahishyas, a community of nomadic traders and warriors, still more ancient and antique , whose mention is found even in the Vedas, long before the advent the of the Ambastas towards the east , settled along the banks of the Kabul and Soni rivers in Mahisik Country in ancient Afganistan, the country in ancient Afganistan, the country of the Aps and North Western Aratta country in upper Amoor tracks. When they were pushed forth towards the east by fresh hordes of Aryan settlers from behind , they bifurcated – one branch colonized the tract of the country in the palhabi ( palhavi) regions or Southern Balkh and thence entered India India through Southern Beluchistan ( Baluchistan) to settle in Guzerat , Sindh and Northern Rajputana along the forts and passes of the desert country. From there they settled in and about Omkar and the Western limits of the kingdom Ratnavatipur, which had its capital under the Rajas of Tamluk , bordering the eastern seas.
কেদারনাথ বাবু এই বক্তব্যকে ডক্টর শিশুতোষ সামন্ত পুরোপুরি মেনে নেন নি। মাহিষ্যজাতি অনুপ্রবেশ করেছে ? এ কেমন কথা ! মাহিষ্য জাতির ভারতভূমিতে প্রবেশকে লেখক কোনভাবেই অনুপ্রবেশ বলে বলতে চান না। এটি তাঁদের স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন বলা যেতে পারে । মাহিষ্যজাতির সূচনা হয়েছিল মাহেষ্মতীপুরে সে কথা পূর্বেই বলেছি। তাঁরা কার্তবীর্যের ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষের বংশধর। এই মাহেষ্মতীপুর বর্তমান ওঙ্কারনাথধাম। এই স্থান হতেই উত্থান, অর্থনৈতিক , কৃষি , রাজনৈতিক , সামাজিক বিস্তার…..যুদ্ধ জয়ের গর্বে গর্বিত মাহিষ্যগণ বসুন্ধরাকে জয় করতে করতে গেছিলেন ভারতের বাহিরে। পরশুরামের একুশবার নিঃক্ষত্রিয়করণের ফলে তাঁরা আপন রাজ্য ত্যাগ করে উত্তর পশ্চিমের মরু অঞ্চলে রাজ্য গঠন করেন। মরু অঞ্চলকে শস্যশ্যামলা করে পরবর্তীকালে পুনশ্চঃ প্রাচীন মাহেষ্মতীপুরে বসতি স্থাপন করেন।
“….the Western limits of the kingdom Ratnavatipur…” বলে যে অংশটি কেদারনাথ মিশির উল্লেখ করেছেন সেটি সম্ভবত আসল #রত্নাবতীপুর রাজ্যের সীমার বাইরে অথচ তমলুক রাজ্যের মধ্যে শাসনের অধীন কোন অংশ হবে। কারণ এই অংশটি কেদারনাথ মহাশয়ের মতে, ওঙ্কারনাথধামের নিকটবর্তী।
দেখা যাবে, তাম্রলিপ্ত রাজ্য বা প্রাচীন রত্নগড়ের বা রত্নাবতীপুরের সীমা অখন্ড বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা এবং তার নিকটবর্তী অঞ্চলগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেদিনকার এবং বর্তমান বাংলার প্রাকৃতিক সীমান্ত বললে বোঝায় উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে চিলকা, পশ্চিমে শোন – গণ্ডক, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র। দীপেন্দ্রনারায়ণ তাম্রলিপ্ত রাজ্যের যে , মানচিত্র প্রকাশ করেছিলেন সেই প্রাকৃতিক সীমান্তের মধ্যেই সেটির সীমা বিহারের ভাগলপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে অনুমান করা হয়।
বর্তমানে কেউ আর তমলুককে রত্নপুর বা রত্নগড় বা রত্নাবতীপুর বলে উল্লেখ করেন না। কিন্তু উক্ত দূরের অংশটি এখনো রত্নাবতীপুর নামেই রয়ে গেছে।
এসকল আলোচনা থেকে তাম্রলিপ্ত রাজ্যের মহারাজ ময়ূরধ্বজকে যাদব অর্থাৎ যদু বংশীয় বলেই প্রতীত হয়। অর্থাৎ , তিনি যযাতির নিম্নতন পুরুষ ছিলেন। মহারাজ যযাতির প্রথম পুত্র যদু। যদুর চার পুত্র-সহস্রজিৎ, ক্রোষ্টা, নল ও রঘু[মৎস্যপুরাণে বলা হয়েছে যদুর পাঁচ পুত্র- সহস্রজি, ক্রোষ্টু, নীল, অস্তিক, লঘু]। সহস্রজিতের পুত্র শতজিৎ। শতজিতের তিন পুত্র-হৈহয়, হেহয়, বেণুহয়। হৈহয় এর পুত্র ধর্মনেত্র, ধর্মনেত্র-র পুত্র কুন্তি, কুন্তি-র পুত্র সাহজি(সংহত)। সাহজি-র পুত্র মহিষ্মান। মহিষ্মান-র পুত্র ভদ্রশ্রেণ্য(রুদ্রশ্রেণ্য)।ভদ্রশ্রেণ্য-র পুত্র দুর্দম। দুর্দম-র পুত্র ধনক(কনক)।ধনকের চারজন বিখ্যাত পুত্র ছিলেন-কৃতবীর্য, কৃতাগ্নি, কৃতবর্মা, কৃতৌজাঃ। এই কৃতবীর্যের পুত্র হলেন কার্তবীর্যার্জুন।
কার্তবীর্যার্জুন নর্মদা নদীর তীরে মাহিষ্মতী নগরে রাজত্ব করতেন। ঋষি দত্তাত্রেয়-র আশীর্বাদে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সহস্রবাহু হওয়ার বরলাভ করেন,তাই তাঁর অপর নাম সহস্রবাহু। তাঁর সম্পর্কে একটি শ্লোক গীত হয়ে থাকে যথা-”বহুতর যজ্ঞ, বহুতর দান,অনন্ত তপস্যা,বিনয় বা ইন্দ্রিয় সংযম দ্বারা কেউ তাঁর সমকক্ষ হতে পারবে না।”
নূনং ন কার্তবীর্যস্য গতিং যাস্যন্তি পার্থিবাঃ।
যজ্ঞৈর্দানৈস্তপোর্ভিবা প্রশ্রয়েণ দমেন চ।।
অনষ্টদ্রব্যতা চ তস্য রাজ্য’ভবেৎ।।
অনুর বংশজ রাজা বলির নিম্নতন পুরুষ ছিলেন সমুদ্রসেন। উভয় বংশধররা নিজেদের মাহিষ্য বলে পরিচয় দেন। সমগ্র বংশ জুড়ে এরূপ একঝাঁক রাজবংশ রাজত্ব করে গিয়েছিলেন।
পরিশেষে একটি কথা বলি, হয়তো এই প্রবন্ধ – উক্ত বহু যযাতির নিম্নতন রাজবংশীয়দের কোনো একটি ধারার মধ্যেই জন্ম গ্রহণ করেন বঙ্গরাজ শশাঙ্ক। সমুদ্রসেন পুত্র চন্দ্রসেনের নিম্নতন পুরুষগণ নিজেদের মাহিষ্য বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সুতরাং , এনাদের ভ্রাতাদের এমনকি #শ্রীগুপ্তকেও মাহিষ্য অনুমান করা যেতেই পারে। করতেই হবে এমন নয়। করার নিমিত্ত বহু প্রমাণ যদিও আছে। সেসব আলোচনা ভবিষ্যতে কখনো হবে।
সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. কাশীদাসী মহাভারত
২. চন্দ্রবংশের ধারায় মহারাজ শশাঙ্কের অনুসন্ধান