অমর্ত্যর মর্ত্যকথা

ভারতবর্ষে ইদানীং মুড়ি-মিছরির একদর ধার্য করবার প্রবণতার বিষয়ে মানুষের বিরক্তি এমন একটি পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, ক্ষোভ একালের দেহাতি কথোপকথনে রীতিমতো অশিষ্ট এক বাগধারার তুলনামূলক ভদ্র ভাষান্তর ‘নেতাজীতেও জি, পেঁয়াজিতেও জি–জাতীয় প্রতিক্রিয়ার আশ্রয় নিতে চায়— নেহাত রুচিতে বাধে, তাই বলা যায় না। পাগড়ির দৈর্ঘ্য দেখে মাথার ওজন নির্ধারণ করবার চেষ্টা এখন আর অজ্ঞ -মূখের একচেটিয়া নয়, কখনো কখনো তা দুষ্টুবুদ্ধি বুদ্ধিব্যবসায়ীদেরও উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায়।
রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এ পুরস্কারের প্রাপক আরও কেউ কেউ, কাজেই তুল্যমূল্য—এমন ভাবনায় ভাবিতের সংখ্যা তাই নিতান্ত সামান্য নয়। এই বিভ্রমের। বশবর্তী হয়েই নোবেলপুরস্কার প্রাপকরা কেউ কেউ মনে করেন প্রভূত অভিজ্ঞতা ও সহজাত প্রজ্ঞার সাহায্যে যথার্থ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রবীন্দ্রনাথ যেমন মানুষকে পরামর্শ-উপদেশ দেওয়ার অধিকারী ছিলেন, ঠিক তেমনভাবেই তাদেরও উদ্দেশ্যমূলক ও পক্ষপাতিত্বপূর্ণ উপদেশ মানুষ শুনবেন। তাছাড়া ‘Myriad Mind Man’ ‘অসংখ্য । বিষয়ে মনোনিবেশক্ষম মানুষ’ এমন যে অভিধা বিশ্ববাসী রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছেন, তা যাবতীয় নোবেল পুরস্কৃতের সম্পর্কে প্রযোজ্য হতে পারে না। কেউ যদি স্বয়ং নিজেকে সেরকম ভাবেন তাহলে তার সম্পর্কে প্রযোজ্য বিশেষণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য নিজেকে সর্বজ্ঞ ভাবতেন না। সহজাত প্রজ্ঞায় বিভিন্ন বিষয়ে মতামত জানালেও নোবেল পুরস্কারের। মাধ্যমে বিশ্বখ্যাতি অর্জনের অন্তত বছর দু’য়েক পরেও রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা তাকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন ‘শেষ নাহি। যে, শেষ কথা কে বলবে।
নোবেল পুরস্কারকে রবীন্দ্রনাথ কিছু পরিমাণে বিড়ম্বনা বলেই মনে করেছেন। উইলিয়াম রদেনস্টাইন সাহেবের অভিনন্দনবাহী পত্রের উত্তরে লিখেছেন যে, লেজে কানেস্তারা বেঁধে দেওয়া কুকুরের পক্ষে যেমন শব্দের মাধ্যমে চারপাশে ভিড় না জমিয়ে চলাফেরা করা অসম্ভব। ঠিক তেমনভাবেই নোবেল-প্রাপ্তি মানুষের ভিড়ের সম্মুখীন না হয়ে তার চলাফেরা দুঃসাধ্য করে। তুলেছে।
কিছুদিন যাবৎ চিঠি ও টেলিগ্রামে তাঁকে চেপে ধরেছে এবং এ বিষয়ে সেই সকল মানুষের আনন্দের অভিব্যক্তিই বেশি, যারা তাঁর রচনার একটি লাইনও কখনো পড়ে দেখেননি।
(It is almost as bad as tying a tin can at dog’s tail making it impossible for him to move without creating noise and collecting crowds all along.
I am being smothered with telegrams and letters for the last few days and the people who never read a line of my works are loudest in their protestation of joy.)
তাকে ঘিরে মানুষের উৎসাহ দেখে রবীন্দ্রনাথ কৌতুক করে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (ব্রহ্মবান্ধব। উ পাধ্যায়ের ভ্রাতুস্পুত্র)-কে এক পত্রে লিখেছেন—“..শুনেছে আমি নোবেল প্রাইজ পেয়েচি, মনে ভাবে সত্যিই বুঝি-বা মানুষটা কেষ্ট বিষ্ট্রর মধ্যে একটা কিছু হবে।”
১৯১৩-তে যখন রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান, তখন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসা তথা শরীরবিজ্ঞান, বিশ্বশান্তি এবং সাহিত্যকৃতির জন্য এই পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। পুরস্কারটি আদৌ হেলাফেলার না হলেও পুরস্কার পেয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষের মাথা ঘুরে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
যা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে অসম্ভব, তা আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়— তেমন বলা যাবে না। মাথা যে কারো কারো ঘুরে যায়, ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের অনুবর্তন করলে তা প্রমাণিত হতে পারে।
আপাতত সংবাদে প্রকাশিত ব্যক্তির নাম ও পরিচয় উহ্য রেখে ‘মূছার গল্পে ক্ষুব্ধ শিরোনামে পরিবেশিত সংবাদটি একবার পড়ে নেওয়া যাক—
বিশেষ সংবাদদাতা, বর্ধমান : মুছা যাননি। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বুধবার বর্ধমানে নিজেই বললেন— বিরক্ত—বলেই ফেললেন।“ঢাকায় একজন আমাকে শুইয়ে দিতে গিয়েছিলেন। আমি তাতে প্রচণ্ড রেগে যাই। শরীরে তেমন জোর থাকলে লোকটার দু’টো দাঁত খুলে নিতাম। দুর্ভাগ্য সেই ক্ষমতা আমার নেই।”
বড়োদিনের রাতে ঢাকায়— মুছা যান বলে সবাই জেনে যান। এদিন বর্ধমানের সংস্কৃতি মঞ্চে অনুষ্ঠানে নিজেই প্রসঙ্গটি তোলেন। তিনি বলেন, “আপনারা দেখছেন তো আমি সুস্থ। সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। ভুলেও ভাববেন না, আমি অসুস্থ।” অসুস্থতার খবর চাউর হতেই দেশ-বিদেশ থেকে ফোন আসতে থাকে। বলেন, “সবাইকে ভালো আছি বলতে বলতে আমি বিরক্ত।”কী ঘটেছিল সেই রাতে? জানান, একগুচছ বৈঠক, সভায় হাজির থাকতে থাকতে শরীরে ক্লান্তি ভর করে। তাই ডিনার বাতিল করেন।
বিশ্রামের কথা শুনেই উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ বেশি বিচলিত হয়ে পড়েন।
অতিথি বিশ্রামের ইচ্ছা জানিয়ে ‘ডিনার বাতিল করছেন জেনে আতিথ্যদাতা বিচলিত হয়ে অতিথির জন্য শুয়ে বিশ্রাম করবার ব্যবস্থা করতে চাইলে অতিথির যদি আতিথ্যদাতার দাঁত ফেলে দেবার ইচ্ছে হয় তাহলে অতিথি শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে যে অসুস্থ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অসুস্থতার সংবাদ প্রচারিত হলে রাজনৈতিক নেতার আশঙ্কার কারণ ঘটে, পাছেমুঘল সম্রাট শাহজাহানের মতো অবস্থা হয়, চলচ্চিত্র অভিনেতাদের গ্ল্যামার নষ্ট হবার ভয় থাকে—সংবাদে উল্লেখিত ব্যক্তি তেমনই কেউ নন। তিনি বিখ্যাত মানুষ বিদ্যাবত্তার আকর্ষণে মানুষ তাকে ঘিরে ভিড় জমান, প্রকৃতপক্ষে তার কৃতিত্ব কী, তা না জেনেই। ভিড় তাড়ানোর জন্য রক্ষীও তাঁর আছে।
যাইহোক প্রকাশিত সংবাদটির শূন্যস্থানে যদি অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের নাম কেউ বসিয়ে দেন, তাহলে রে-রে করে ছুটে আসা দাঁত-নখসম্পন্ন বহু মানুষ পাওয়া যাবেই।
সংবাদটির প্রতিবাদ কোথাও বের হয়নি— অন্তত বর্তমান লেখকের চোখে পড়েনি বলে সংবাদটি সত্য বলে ধরে নিতে অসুবিধা নেই।
রবীন্দ্রনাথ তো বলেইছেন— “সত্য যে কঠিন।”
প্রসঙ্গত, নোবেল পুরস্কারের সূচনালগ্নে অর্থনীতি বিষয়ে কোনো পুরস্কার প্রদানের পরিকল্পনা ছিল না। ১৯০১-এ নোবেল পুরস্কারের সূচনা হবার ৬৮বছর পর অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে এই পুরস্কার প্রবর্তিত হয়। স্বভাবতই পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য বহু পুরস্কারের তুলনায় অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার যথার্থই অর্বাচীন— ভুইফোড়। তবু নোবেলের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলেই এর ভার যথেষ্ট।
অর্থনীতি বিষয়টি বর্তমান লেখকের অধিগম্য নয়। দেশের অর্থনীতি বিষয়ে অর্মত্যবাবু কিছু বললে সে বিষয়ে কোনো প্রবন্ধ রচনা না করে বক্ষ্যমান লেখকের ‘অধিকারীভেদ’ মেনে নেওয়াই সঙ্গত হতো।
অমর্তবাবু অর্থনীতি বিষয়ে সভা-সমিতিতে কিছু বললে তা অবশ্যই শুনতে বাধ্য হতো দেশের মানুষ। যদি যুক্তি দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক নেই বলেই তাদের তিনি কোনো পরামর্শ দিতে চান না, তা হলেও প্রশ্ন উঠে আসবে যে সকল রাজ্যসরকারকে তিনি পছন্দ করেন তাদের তিনি কোনো পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা যায় কি ? অমর্তবাবুর অর্থনীতি-বিষয়ক ভাবনার সঞ্চয়ে দেশকে। দেবার মতো কিছুই নেই, এমনটা ভাবাই যায় না।
অপিচ কোনো অজ্ঞাত কারণে অমর্তবাবু দেশের রাজনীতি নিয়ে বেশি কথা বলেন এবং সমালোচনার লক্ষ্য দেখে কেউ কেউ বলেন। যে তা যথার্থই আশ্চর্যজনক। একটি বিশেষ দলের বিরুদ্ধেই নিজের সমালোচনার অস্ত্রকে শান দিয়ে সামান্য সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেও অমর্ত্যবাবুর কোনো ভুল হয় না অথচ মুসলমান মহিলাদের জীবনের অন্যতম প্রধান বিড়ম্বনা ‘তালাক’নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যে আলোচনা চলেছে, তার জন্য একটি কথাও খরচ করবার সময় পান না। কোন মহিলা মঙ্গলসূত্র কিংবা সিঁদুর পরবেন, তা ঠিক করে দেবার বিষয়ে ধর্মান্ধদের ফতোয়া, রাজ্যে যে-কোনো সরকারি কাজে ঘুষ-প্রদান ব্যবস্থাকে একেবারে অলিখিত আইন করে তোলা ইত্যাদি বিষয়েও অমর্তবাবু কোনো । কথা কখনো বলেছেন বলে জানা যায়নি। নিজেকে গণতন্ত্রের বড়ো প্রবক্তা হিসেবে জাহির করতে উৎসাহী অমর্তবাবু পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গণতন্ত্রের জবাই প্রত্যক্ষ করেছেন— প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল তো বটেই, আদালতসমূহ ক্ষোভ প্রকাশ করলেও অমর্তবাবু মৌনব্রত অবলম্বন করছেন। অমর্তবাবুর বিবেক কখন। জেগে উঠবে তা সে যথার্থই লাখ টাকার প্রশ্ন। দেশের জরুরি অবস্থার সময় অমর্তবাবুর কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। শাহবানু মামলা, তসলিমার বিতাড়ন-পর্ব, মরিচঝাপির অত্যাচার, আনন্দমার্গী হত্যা ইত্যাদি অজস্র বিষয়ের কোনোটিতেই অমর্ত্যবাবুর বিবেক। জাগ্রত হয় না—দু-একটি বাক্যও খরচ করছেন। বলে জানা যায়নি।
বস্তুত সেই কারণেই অমর্ত্য সেনের যাবতীয় কাজ উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে মনে হয়। অমর্তবাবু কিছু বললে মানুষ বুঝে নিতে চান যে আসল কারণটা কী? প্রতিভাবান হলেই বাণী বিতরণ করা যায় না। নিরপেক্ষতা এবং নিজের আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া প্রয়োজন তিনি যে বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, সে-বিষয়ে তিনি সৎ।
সম্প্রতি ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনিটিকে বঙ্গ সংস্কৃতি বিরোধী বিজাতীয় বলে মন্তব্য করেছেন অমর্ত্য সেন। ধ্বনিটি পূর্বে কম শোনা যেত, এখন বেশি শোনা যাচ্ছে ঠিক কথা। কিন্তু ধ্বনিটি বিজাতীয় হলো কীভাবে বোঝা গেল না।শব্দ তিনটির মধ্যে এমন কিছু নেই যা বঙ্গ সংস্কৃতির বিরোধী। বাংলার প্রাচীনতম গ্রন্থসমূহের অন্যতম কৃত্তিবাসী রামায়ণ কি তাহলে বঙ্গ সংস্কৃতির বিরোধী ? কোনো নতুন বিষয় এলেই তা সংস্কৃতির বিরোধী হবে কেমন করে? সংস্কৃতি কী অচলঅটল-স্থানু কোনো বিষয়—প্রথমাবধি একই চেহারায় থেকে গেছে? নদীপ্রবাহের মতো সংস্কৃতি চতুর্দিক থেকে আহরণ করে, সঞ্চয় করে চিরকাল করে আসছে। বঙ্গ সংস্কৃতি তার ব্যতিক্রম হবে কেমন করে?
অমর্ত্যবাবু উচ্চশিক্ষিত, কাজেই তিনি ইতিহাস-সচেতন নয়, এমন কথা অতি নিন্দুকও বলতে পারবেন না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমাদের দেশে শিক্ষিত আর অশিক্ষিতেরমধ্যে যে জ্ঞানের বৈষম্য সবচেয়ে বেশি করিয়া অনুভব করা যায়, তাহা ইতিহাস জ্ঞান।”অমর্ত্যবাবুর মুশকিল হলো অমর্তবাবু সম্ভবত তাঁর পূর্বগামী কয়েকটি যুগকেই ইতিহাসের সর্বস্ব বলে মেনে নিয়েছেন। তা না হলে নিশ্চয়ই নিজের কাছেই প্রশ্ন তুলতেন ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক নদীয়া এবং লক্ষ্মণাবতী তথা গৌড় জয়ের পূর্বেবঙ্গদেশের কোথাও ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি শোনা গিয়েছে কি ? দীর্ঘকাল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ধবনি দাপিয়ে বেড়িয়েছে তা ১৯২০/২২-এর আগে ভারতবর্ষে শোনা গিয়েছে বলে মনে হয় না। কোনো কোনো লেখকের রচনায় খুঁজে পাওয়া গেলেও দেওয়ালে দেওয়ালে কমরেড শব্দটি অমর্তবাবুর্তার ছেলেবেলায় দেখেছেন কি?
বাঙ্গালির জীবনে কেন, প্রত্যেকটি জাতির জীবনেই নতুন নতুন বিষয় কালের প্রয়োজনে চলে আসে। কথাবার্তায় আসে নতুন নতুন শব্দ।
ইতালীয় রেনেসাঁর ইতিহাস প্রণেতা Burkhart বিশ্বমানবের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন—“When the impulse to the highest individual development was combined with a powerful and varried nature, which has mastered all elments of colture of the age, then arose the all sided “L’umo Universale.’ সংক্ষেপে মর্মকথাটি এই যে প্রকৃত বিশ্বমানব তাকেই বলা হবে যিনি জগতের সকল সংস্কৃতিকেই আপন করে নিতে পারেন।
রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, “ভৌগোলিক বেষ্টন যতদিন সত্য ছিল ততদিন সেই বেষ্টনের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের জাতির সকলের সঙ্গে মিলনে নিজেকে সত্য বলে অনুভব করেছে। আজ সেই ভূগোলের বেড়া ক্ষীণ হয়ে মানুষ পরস্পরের কাছে এসে। দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এত বড়ো সত্যটা আজও বাহিরের সত্য হয়েই রইল, মনের ভিতরে এ সত্য স্থান পেলেন।” অমর্ত্যবাবুর মনে যে স্থান পায়নি তা তো দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে।
অমর্ত্য সেন তো নিশ্চিতভাবেই একজন আন্তর্জাতিক মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় প্রদান করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন— নিজের দেশের উত্তর-অংশের সংস্কৃতিই তার বিজাতীয় মনে হলো।
রবীন্দ্রনাথ কবিতায় ‘ভঙ্গী দিয়ে চোখ ভোলোনোর কথা বলেছিলেন, অনেক তথাকথিত আন্তর্জাতিক মানুষের আন্তর্জাতিকতা কী সেইরকম?উল্লেখ্য অমর্ত্য সেনের মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন ভারতসংস্কৃতির একজন যথার্থ অনুরাগী। বঙ্গের মানুষের কাছে ভারতীয় সংস্কৃতির নানা বিষয় তুলে ধরেছেন ক্ষিতিমোহন সেন সারা জীবন ধরে। প্রমাণ করেছিলেন মানুষের সঙ্গে সংশ্রব আছে এমন কোনো কিছুই বিশেষ জাতির নয়, সমস্ত মানবজাতির।
অমর্তবাবু ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির সূত্রে মানুষ খুনের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। রাজনৈতিক সংঘর্ষে খুন-রক্তপাতবঙ্গে কয়েক দশককাল ধরেই সহজলভ্য—ইদানীং তো তা যথেষ্টই বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু উত্তেজনার মুহূর্তে খুন নয়, ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করে গাছে বা বিদ্যুতের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে বিরুদ্ধ দলকে ভয় দেখাবার জন্য। সংঘর্ষে লিপ্ত রাজনৈতিক দলের সদস্যরা স্ব স্ব দলের প্রিয় ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে সময়ে সময়ে আঘাত করে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সদস্যের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠেন না— এমন মিথ্যা বিশ্বাস কারো নেই।
কিন্তু কেউ যদি বলেন কোনো বিশেষ ধ্বনি, অমর্ত্যবাবুর কথা অনুযায়ী ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলেই খুন করা হয়, এ-বিষয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি প্রদানকারীরা একচেটিয়া, তাহলে সেই দাবি যিনি করেন তাকে মিথ্যাচারী বললেও কম বলা হয়। অমর্ত্যবাবু তেমন দাবিই করছেন, বিশ্বাস করতে কষ্টহয়।
সম্প্রতি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের সমালোচনা করেছেন অমর্ত্য সেন। বলেছেন সবকিছু নির্ভর করবে গণতন্ত্র ফিরে আসবে কিনা, তার উপর। সমালোচনাটি তার ব্যক্তিগত প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কিছু গণতন্ত্র ফিরে আসবে কিনা তার উপর সবটা নির্ভর করবে, এ কথা তো সবাই স্বীকার করবেন– এতে নতুনত্বই বা কোথায় ? অমর্তবাবুর মুখে একথা সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর মছলিবাবা চরিত্রটিকে মনে করিয়ে দেয়। মছলিবাবা আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলছেন—‘এক সূর্য, এক চন্দ্র এবং ইত্যাদি’, আর তা শুনে ভক্তবৃন্দ উচ্ছ্বসিত— যেন নতুন এক কথা শোনা গেল। অমর্তবাবুর ভক্তবৃন্দও উচ্ছ্বসিত হবেন তাতে আর সন্দেহ কি?
কিন্তু এবিষয়ে একটি কথা বলবার অবকাশ থেকেই যায় যে, হাজার লোক ৩৭০ ধারা অপসারণকে সমর্থন করলেও মাত্র দশ-বিশজন লোক অস্ত্রহাতে তাণ্ডব-নৃত্য করলেই হাজার জনের মতামতকে পদদলিত করতে পারা যায়। প্রচার পাওয়া যায়। কারণ প্রচার করবার জন্য বুদ্ধিব্যবসায়ীরা তো রয়েইছেন, রয়েছে জে.এন.ইউ-র হিরের টুকরো কয়েকটি ছেলেও। সত্য কাশ্মীর সরকারের বড়ো চ্যালেঞ্জ— ভারতীয় গণতন্ত্রের বড়ো পরীক্ষা, কিন্তু অমর্তবাবু যাদের হয়ে ওকালতি করে থাকেন, সত্তর বছর ধরে পরীক্ষা করেও তারা সাফল্য পাননি বলেই তো নতুন করে পরীক্ষার অবকাশ তৈরি হয়েছে— এতবড়ো সত্যটিকে অমর্ত্যবাবু অস্বীকার করবেন কীভাবে? সাক্ষী তো একশো তিরিশ কোটি ভারতবাসী।
‘অ্যালবার্ট পিন্টো কা গু কিউ আতা হ্যায়’— এমন বাক্যবন্ধটির অনুকরণেই জানতে ইচ্ছা হয় অমর্ত্যবাবুর বিশেষ একটি দলের প্রতি ক্রোধের কারণ কী? কোনো এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উচ্চপদকে জড়িয়ে নিন্দুকেরা অনেক কথা বলেন, যদিও তা সত্য কি না জানা নেই। সন্দেহ দেখা দেয় কারণ কোনো একটি রাজনৈতিক দলের সবই। খারাপ হতে পারে এমন কথা সামান্যতম বিবেচক মানুষও মানতে পারেন না। তবে একথা সত্য যে অমর্ত্যবাবু মাঝে মাঝে রেগে যান এবং রেগে গেলে মানুষের দাঁত ফেলে দেবার ইচ্ছাও তার হয়। সেক্ষেত্রে কোনো দলের সম্পর্কে উদ্দেশ্য প্রণোদিত নিন্দা কিংবা বিষোদগার তো তুলনামূলকভাবে সামান্যই।
অমিত দাশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.