শেফালী বৈদ্য
১৭ তম লোকসভা নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। ডিজিটাল মিডিয়াতে এই নির্বাচনের প্রচার অভিযানের তোড়জোড় চোখে পড়ছে। ভারতে এখন ইন্টারনেট পরিষেবা অভাবনীয় রকমের দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে প্রায় ৯০ কোটি ভোটার রয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৫০ কোটি মানুষের কাছে ইন্টারনেট পরিষেবা রয়েছে।
খুব সস্তায় ডেটা প্ল্যান পাওয়ার সুবিধা এবং স্মার্ট ফোনের আধিক্যের কারণে ভারতীয় ভোটাররা ইন্টারনেটে প্রাপ্ত নানা রকম খবর এবং মতামতের একনিষ্ঠ ক্রেতা হয়ে উঠেছে। ফিকি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, স্রেফ মার্চ ২০১৬ থেকে মার্চ ২০১৭, মানে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক সাবস্ক্রাইবারের গড় ডেটা ব্যবহার ১৪৭ এম বি থেকে বেড়ে ১ জি বি-তে এসে দাঁড়িয়েছে। স্মার্টফোনের দৌলতে ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের ব্যবহার এখন অনেকটাই কমে গেছে। মানুষ স্মার্ট ফোনেই ইন্টারনেট পরিষেবার সুবিধা নিচ্ছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২০-র মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ৭০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং টুইটারের মতো সোস্যাল প্ল্যাটফর্ম এখন আর শুধুমাত্র পারিবারিক আনন্দের ছবি শেয়ার করে বন্ধুদের সঙ্গে মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে আটকে নেই। এগুলি রাজনৈতিক মত আদান প্রদান করা এবং মত গঠন করার আদর্শ মঞ্চ হয়ে উঠেছে। ভারতেই প্রায় ৩০ কোটির কাছাকাছি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন। প্রায় ২০ কোটি হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন। লাখ লাখ মানুষ, এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও টুইটার এবং ইন্সটাগ্রামের সাহায্যে নিজের অনুগামীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।
২০১৪ সালে ভারতীয় রাজনীতিবিদরা এবং সাধারণ মানুষ যখন প্রথম সোস্যাল নেটওয়ার্কের সাইটগুলি ব্যবহার করা শুরু করলেন, তখন তাঁরা অনেকাংশেই একটি নিরপেক্ষ মঞ্চ পেয়েছিলেন। শশী থারুর বা নরেন্দ্র মোদির মতো দুঁদে রাজনীতিবিদরা এই জন্যই তখন অন্যদের থেকে এগিয়ে ছিলেন, কারণ তাঁরা ছিলেন সেই প্রথম কয়েকজনের মধ্যে যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ার অসীম সম্ভাবনার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল।
ভারতবর্ষে প্রথাগত মিডিয়া চিরকালই বাম ঘেঁষা চিন্তাভাবনা এবং লেখনিতে অভ্যস্ত। সাংবাদিকরা খবর পরিবেশন করতেন এই বাম মোড়কে। প্রথাগত লেখা বা আলোচনাতে কংগ্রেস ছিল তাদের সবচেয়ে পছন্দের দল এবং বিজেপি বা তার সমর্থকদের তারা সাম্প্রদায়িক, উচ্ছ্ঙ্খল এক গুচ্ছ অভদ্র লোক হিসেবে খারিজই করে দিত। এই প্রতিনিধিত্বহীন মানুষগুলি যাদের প্রথাগত মিডিয়াতে কোনও রকমের গলা ছিল না, তারাই কিন্তু সোস্যাল মিডিয়াতে নিজেদের উপস্থাপিত করার সু্যোগ পেল। আমার মতো প্রচুর সাধারণ নাগরিক বুঝলেন যে, নিজেদের মতামত তুলে ধরার জন্য ফেসবুক বা টুইটার জাতীয় সোস্যাল মিডিয়া খুব কার্যকর এবং সেইসব মতামত যদি বাকি সমমনস্ক মানুষজন শেয়ার করেন তাদের ওয়ালে, তাহলে তো কথাই নেই। অথচ প্রথাগত মিডিয়াতে এই সব মতামতের কোনও স্থান নেই।
এই প্রথম, সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষজন বিনকাটা ছেঁড়ায় নিজেদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা পেল। সম্পাদকের কাঁচিতে কাটা বা বাদ পড়ার কোনও ভয় রইল না। গোটা বিশ্ব তার মতামত জানতে পারল কোনও রকমের বাধা বিপত্তি ছাড়া এবং সোস্যাল মিডিয়াই প্রকৃতপক্ষে হয়ে উঠল মানুষের সাংবাদিকতা, কোনও ব্যবসায়িক লাভ ক্ষতির প্রশ্ন নেই । শুধুমাত্র লেখকের পক্ষপাতিত্ব ছাড়া কোনও রকম পক্ষপাতিত্বও এর মধ্যে প্রবেশ করে না।
এভাবেই জন্ম হল একটি বিশেষ ঘটনার, আবির্ভাব হল সোস্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার বা সোস্যাল মিডিয়া প্রভাবকারীর। এই ইনফ্লুয়েন্সারদের লক্ষ লক্ষ মানুষ অবধি পৌঁছনোর ক্ষমতা তৈরি হল এবং প্রায়ই তাদের পাঠক পাঠিকার সংখ্যা প্রথাগত মিডিয়া, যেমন এন ডি টি ভি-র দর্শক সংখ্যাকে অনেকটাই ছাপিয়ে যায়। ৫০,০০০ বা তার বেশি অনুসারী পাঠক-পাঠিকা যার আছে, সেই ব্যক্তি নিজেই একটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন।
কিছুদিন মনে হচ্ছিল যে প্রথাগত মিডিয়া একটা বেশ বড়সড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে চলেছে, কেননা কিছু নতুন কণ্ঠস্বর সোস্যাল মিডিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বেশ কিছু মিডিয়া অ্যানালিস্ট এই উত্থানের পেছনে ২০১৪-য় বিজেপি’র নির্বাচন জেতাকে কারণ হিসেবে তুলে ধরছে ।
তবে আর নয়।
২০১৪-র পর থেকে এই ভারতীয় ডিজিটাল মিডিয়ার চিত্র সম্পূর্ণ রূপে পালটে গেছে। প্রথাগত মিডিয়া, যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল, ২০১৪-র নির্বাচনের পরে তারা নিজেরা একত্রিত হয়ে নতুন দল বানিয়ে এই সোস্যাল মিডিয়াকেই ব্যবহার করছে তাদের বাম ঘেঁষা মতবাদ তুলে ধরার জন্য। এ যেন পুরনো মদ নতুন বোতলে ঢেলে পরিবেশন।
স্ক্রোল, কুইন্ট,ওয়ায়ার,ক্যারাভান,নিউজ মিনিট এবং ক্যাচ নিউজ-এর মতো কিছু বামপন্থী ডিজিটাল মিডিয়া সংস্থা আপাতত ডিজিটাল খবরের জগতে রাজত্ব করছে। তাদের অর্থ সাহায্য করছে কিছু সন্দেহজনক নেটওয়ার্ক। যেমন, দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং পাব্লিক স্পিরিটেড মিডিয়া ফাউন্ডেশন,যাদের যৌথ তহবিলের পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি। চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এবং শিল্পপতিরা এই তহবিলে টাকা দান করছেন। দ্য ফাউন্ডেশন চালান রামচন্দ্র গুহ, এন নাইনান এবং আশিস দেওয়ানের মতো চরম বাম্পন্থীরা। ই বে-র প্রতিষ্ঠাতা পিয়ের ওমেদেয়ার হলেন ওমেদেয়ার নেটওয়ার্কেরও প্রতিষ্ঠাতা। এই নেটওয়ার্কও অর্থ যোগানোর একটি বড়সড় মঞ্চ যেটা নিউজ লন্ড্রি এবং স্ক্রোলের মতো ডিজিটাল মিডিয়াকে অর্থ সাহায্য করে। এর পাশাপাশি যদি ডানপন্থী মিডিয়ার কথা ভাবা হয়, তাহলে দেখা যাবে, তাদের খুব অল্প সংখ্যকই ভরসা করার মতো ডিজিটাল মিডিয়ার মঞ্চ রয়েছে, যেমন, স্বরাজ্য ম্যাগ, ওপ ইন্ডিয়া এবং মাই নেশান। ওয়ারা এবং স্ক্রোলের মতো এত অর্থবল না থাকায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর ক্ষমতাও তাই তাদের সীমিত।
এরই মধ্যে আবার ফেসবুক এবং টুইটারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা নাকি পক্ষপাতদুষ্ট। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইটারের সমালোচনা করেছেন যে, টুইটার নাকি কনজার্ভেটিভ পার্টির কন্ঠস্বর দাবিয়ে রাখার এবং পরোক্ষ ভাবে তাদের নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। এমনকি টুইটারের সি ই ও, জ্যাক ডর্সি পর্যন্ত সি এন এন-এর একটি চ্যানেলের ইন্টারভিউতে মেনেও নিয়েছেন যে, টুইটারের বেশির ভাগ কর্মীই বাম ঘেঁষা। ফেসবুকের শেরিল স্যান্ডবার্গ এবং টুইটারের জ্যাক ডর্সি মার্কিন কংগ্রেসের এক শুনানিতে এই বাম পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ মেনে নিয়েছেন।
এমনকি ভারতবর্ষেও টুইটার-এর কিছু আধিকারিককে ভারতীয় পার্লামেন্টারি কমিটিতে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। কারণ বহু টুইটার ব্যবহারকারীর মনে হয়েছিল যে, টুইটার খুব চোখে পড়ার মতো বাম ঘেঁষা এবং হিন্দু-বিরোধী হ্যান্ডেলকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে এবং কিছু হ্যান্ডেলকে জনসমক্ষে পৌঁছনোয় বাধা দিচ্ছে। কীভাবে টুইটার কিছু বিশেষ বিশেষ হ্যান্ডেলকে টার্গেট করছে তার একটি পরিষ্কার ছক এর থেকে বের করা যায়।
কিছু জনপ্রিয় হিন্দুত্ববাদী হ্যান্ডেল এবং নরেন্দ্র মোদীকে সমর্থন করে এমন কিছু হ্যান্ডেলকে বিনা কারণেই সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়েছিল এবং কিছু জাতপাত বিভাজনকারী এবং হিন্দু-বিরোধী হ্যান্ডেল যেমন @AmbedkarsCaravanকে ছাড় দিয়ে রাখা হয়েছিল, অথচ টুইটারে এইসব হ্যান্ডেল একাধিকবার ‘রিপোর্টেড’ হয়েছে। ফেসবুকেও সমান ভাবে, কিছু বিশেষ চিন্তাধারাকে সমর্থন করা অ্যাকাউন্ট কিছুদিনের জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যত গরম হয়ে উঠবে, ততই এই ধরনের অভিযোগগুলি মান্যতা পেতে থাকবে। দিনের শেষে, সোস্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কগুলি হল মাল্টিন্যাশানাল সংস্থা, যারা শুধুমাত্র লাভের জন্যই এই ব্যবসায় নেমেছে, সুতরাং তাদের থেকে নিরপেক্ষতা বা লোকহিতৈষণা আশা করাটা নিতান্ত বোকামোই হবে। যেটা ডানপন্থি ভারতীয়দের দরকার সেটা হল নিজেদের কিছু বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প তৈরি করা, যাতে করে তাদের মতামত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। সোস্যাল নেটওয়ার্কের এই সমবেত নীরব ষড়যন্ত্রকে একমাত্র তখনই পরাস্ত করা যেতে পারে যদি একটি প্ল্যান বি তৈরি থাকে।
“ঋতম” (RITAM) নামক অ্যাপটি এমনই এক প্ল্যান বি, যেটা আমি বেছে নিয়েছি। ঋতম হল একটি খবর পাওয়ার অ্যাপ যেটি সতর্কতার সঙ্গে বাছাই করা খবর আপনার মোবাইলের স্ক্রিনে পাঠায়। এটি একটি সুপার প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চ, ডানপন্থীদের জন্য যা সব ধরনের লেখা প্রকাশ করে, সে রাজনীতিই হোক কি শিল্প, খেলাধুলো হোক কি সংস্কৃতি, বিনোদনই হোক কি ভ্রমণ কিংবা ফ্যাশন। ঋতম-এর একটি বড় সুবিধা হল এটি বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় পাওয়া যায় এবং একাধারে বিভিন্ন লেখা অন্য ভাষায় অনুবাদ করার ক্ষমতা রাখে। এর মধ্যে কিছু নিজস্ব জিনিসও থাকবে, যেমন ইনফোগ্রাফিক্স বা ভিডিও। যদিও ঋতম ডানপন্থীদের জন্য একমাত্র অ্যাপ নয়, তবুও এখন অবধি এর প্রায় ৫০,০০০ ডাউনলোড হওয়ার ফলে মেনে নিতে হবে যে, দেশীয় অ্যাপগুলির মধ্যে এটি সবচেয়ে দ্রুত গতিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ।
ঋতম আমাকে সেই সব তথ্য পরিবেশন করে যা টুইটারই হোক কি ফেসবুক, আর কেউ পরিবেশন করতে সক্ষম নয় এবং এটি একটি সুরক্ষিত মঞ্চ আমার মতো ডানপন্থীদের জন্য যারা নির্দ্বিধায় নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন যা বহু মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে, সে তাদের মাতৃভাষা যাই হোক না কেন।