সিন্ধুর হিন্দু রাজা দাহির

পরিচিতি:
●●●●●●●
পুরো নাম দাহির সেন। অন্য নাম দাহার সেন।
পিতা হলেন #ছাচ আর মাতার নাম #সুহান্দি।
আজ থেকে প্রায় 1300 বছর আগে, 700 খ্রিস্টাব্দের দিকে বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের রাজা ছিলেন দাহির।
তিনিই ছিলেন সিন্ধের শেষ হিন্দু রাজা।

ভারতবর্ষের অবস্থা ও সিন্ধুর:
◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆
তখন ভারতবর্ষ ছিল land of gold অর্থাৎ সোনার দেশ।
এই দেশের মশলা, মুক্তো, ইস্পাতের অস্ত্র এবং বস্ত্র ছিল সেরা উৎপাদন। সারা পৃথিবীর কাছে উৎকৃষ্ট এইসব জিনিসের কদর রয়েছে।
শিক্ষা, দীক্ষা, শিল্প সংস্কৃতির উন্নতির চরমে দৌড়চ্ছে এক উন্নত দেশ। ভারতের বাণিজ্যিক আর্থিক সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থান তখন সারা পৃথিবীর কাছে আদর্শ। লোভনীয় এক দেশ।
সারা পৃথিবী স্বপ্ন দেখত হিন্দের মত হয়ে উঠার।
এই ভারতবর্ষে
সিন্ধ ছিল তখন স্বচ্ছল এক প্রদেশ, ধর্ম বলতে ছিল হিন্দু ছাড়া মূলতঃ বৌদ্ধ আর জৈন।
সারা সিন্ধ জুড়ে ছিল বৌদ্ধ আর হিন্দুদের তৈরি সুবিশাল মনাস্তারি আর মন্দির। ধর্ম তাত্বিক দিক দিয়ে আলাদা হলেও মানসিক দিক দিয়ে প্রজারা মিলে মিশেই থাকতো।
“ধর্ম যার যার উৎসব সবার” এই ছিল তখনের সিন্ধের মানুষের চিন্তাভাবনা।
তখন ভারতবর্ষের অন্য নাম ছিল সিন্ধু নদের দেশ। অর্থাৎ হিন্দুর দেশ। সিন্ধুর এদিকে থাকতো হিন্দুরা।
সিন্ধ > হিন্দ আর সিন্ধু > হিন্দু।

মুহাম্মদের স্বপ্ন:
■■■■■■■■■
মুসলমানদের profet #হজরত_মুহাম্মদ এর এক স্ত্রী ছিল, যিনি জন্মসূত্রে ছিলেন হিন্দের বাসিন্দা।
তার মুখ থেকে শোনা তখনের ভারতের অবস্থা শুনে ভারতবর্ষে ইসলামের জয় পতাকা উত্তোলনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মুহম্মদ।
এছাড়া বণিকদের মুখে বর্ণনা তো ছিলই ভারতবর্ষ এক স্বপ্নের দেশ। শিক্ষা সংস্কার শিল্পে রীতিনীতিতে উন্নত এক অভূতপূর্ব দেশ।
সবে মিলে ভারতবর্ষ দখলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকত মহম্মদ।

এই হিন্দুদের দেশ দখল করতে গেলে সিন্ধ দখল করতে হবে কারন সিন্ধ ছিল প্ৰৱেশদ্বার।

মহম্মদের জীবদ্দশায় সেই স্বপ্ন আর সফল হয় নি।

তবে তার মৃত্যুর পরে
প্রফেটের সেই স্বপ্ন সফল করতে 638 থেকে 711 খ্রিস্টাব্দ অব্দি পর পর আক্রমন করে যায় মুসলমান খলিফার দল।
সব মিলিয়ে পনেরবার তারা আক্রমন চালায়।
তবে উল্লেখযোগ্য আক্রমনের সংখ্যা ছিল 6 বার।
প্রতিবারই তারা বিধ্বংসী আক্রমনের মুখোমুখি হয়ে লুটেরার দল পালিয়ে বাঁচে।
খলিফার দল ক্রমশঃ হতাশ হতে থাকে।

সিন্ধে প্রথম(উল্লেখযোগ্য) আক্রমন:
●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●
খলিফা #মুবাইয়া পাঠায় এক বিশাল বর্বর লুটেরার দল। এটাই ছিল উল্লেখযোগ্য প্রথম মুসলমান আক্রমন সিন্ধ প্রদেশে। তবে আক্রমনের পরে শোচনীয় পরাজয় স্বীকার করে পালিয়ে বাঁচে লুটেরার দল।
যাবার সময় কিছু গ্রাম লুট করে পালায়।
তবে এই শোচনীয় পরাজয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়ে খলিফা।

পরবর্তী উলেখযোগ্য আক্রমন:
◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆

সিনান নামে একজনের নেতৃত্বে। অন্য পরিচয় ছিল ‘সালমাহর পুত্র’।

কথিত রয়েছে সিনানের জন্মের সময় হজরত মহম্মদ তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ দিয়েছিল।
সিন্ধে যুদ্ধযাত্রার আগে সিনান স্বপ্ন দেখে- বিজয়ী হবার আশীর্বাদ দিচ্ছে হজরত মুহম্মদ আল্লার কাছে দোয়া পড়ে।
পরেরদিন সিনানের মুখে এই ঘটনা শুনে সিনানের বাহিনী খুব উৎসাহিত হয়েছিল।
এলাকার লোকজন ধরে নেয় সিনান যখন আশীর্বাদ পেয়েছে, সে ফিরছেই জয় করে…

বলাই বাহুল্য সিনানের এই অভিযানে আরবি মুসলমানের দল খুব আশায় ছিল…
কিন্তু
সমস্ত দোয়া / আশীর্বাদ বিফলে গিয়ে সিন্ধের #বুধিয়া নামে এক জায়গায় সিনান তার দলবল সমেত কচুকাটা হয়। মারা যায় সিনান।

এরপরে অনেকবার আক্রমন হয়। সবে মিলে পরপর চৌদ্দবার।

রাজা দাহিরের সাথে যুদ্ধ:
■■■■■■■■■■■■■■
শেষে পনেরতম আক্রমন হয় ইরাকের জেনারেল #হাজ্জাজের সময়ে আর মুহম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে। #কাসিম সহ তার বাহিনীর নাম দেওয়া হয়
army of islam।

আরবি মুসলমানের দল সিন্ধু নদীর ধারে পৌঁছলে
রাজা দাহির পড়শী দেশ আর বন্ধু রাজাদের সাথে একটি আলোচনায় বসেন। তারা সহায়তা করার আশ্বাস দিলেন। সাথে তারা এটাও প্রস্তাব দেন-
রাজা দাহিরের সুন্দরী তিন কন্যা আর রানী যেন তাদের রাজ্যে চলে আসেন।
তখন দাহির সেই প্রস্তাব অস্বীকার করেন, বলেন এতে তার প্রজাদের মনোবল ভেঙে পড়বে।
প্রজারা যদি সপরিবারে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে পারে তাহলে রাজার পরিবারও হবে মুখোমুখি এই যুদ্ধের।

দাহিরের ঘোষণা:
●●●●●●●●●●●●
যুদ্ধে যাবার আগে ঘোষণা করেছিলেন-
“I am going to meet the Arabs in the open battle, and fight them as best as I can. If I crush them, my kingdom will then be put on a firm footing. But if I am killed honourably, the event will be recorded in the books of Arabia and India and will be talked about by great men. It will be heard by other kings in the world, and it will be said that Raja Dahir of Sindh sacrificed his precious life for the sake of his country, in fighting with the enemy.”
অর্থাৎ
“যাচ্ছি আরবিদের সাথে খোলা যুদ্ধক্ষেত্রে। সর্বশেষ শক্তি দিয়ে লড়াই করব। যদি ওদের ধ্বংস করে জিতে ফিরতে পারি তাহলে আমার রাজ্য সিন্ধকে শক্ত ভিতের উপরে দাঁড় করিয়ে দেব…
আর যদি না ফিরি তাহলে এমন যুদ্ধ করব ভারতবর্ষের ইতিহাসের সাথে আরবি ইতিহাসও মনে রাখবে রাজা দাহির আর তার সিন্ধ প্রদেশের বীরত্বের কথা, তাদের প্রাণ বলিদানের কথা”

পুত্র জিশানের মৃত্যু:
◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆
সিন্ধু নদের তীরে #জিলার নামে এক জায়গায় রাজা দাহিরের বীর সন্তান রাজকুমার #জিশান নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর। সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় কিন্তু তিনি মারা যান।
জিশানের মাথা কেটে নিয়ে যাওয়া হয় আরবে যুদ্ধ জয়ের স্মারক হিসেবে।
মাথা কেটে নিয়ে যাবার আরেকটা কারন অবশ্য ছিল সেটা হল হিন্দু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যাতে না করা যায় জিশানের।
এই ঘটনা দাহির রাজার পরিবারকে মনঃকষ্টে ফেলে দেয়।
ইরানের কাছে দূত পাঠানো হয় যাতে পুত্র জিশানের মাথা ফেরৎ পাওয়া যায়।
কিন্তু সেই আবেদন অমান্য করে হাজ্জাজের নির্দেশ আসে- কাফিরদের খুন কর, কেউ যেন না বাঁচতে পারে।

রাজা দাহিরের যুদ্ধ:
■■■■■■■■■■■
তবে পুত্র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া না করতে পারার সেই কষ্ট জয় করে উঠে দাঁড়ান রাজা দাহির।
এরপরে
নেতৃত্ব দেন রাজা দাহির নিজে।
সিন্ধের #আরোর নামক এক জায়গায় যুদ্ধ চলে এগার দিন ধরে। তার আক্রমনে প্রতিদিন মারা যেতে থাকে অনেক আরবি লুটেরা।
ক্রমশঃ দুর্বল হতে হতে এগারতম দিনে মুসলমান লুটেরার দল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
প্রায় যখন তারা পরাজয় স্বীকার করে পালিয়ে যাবার মত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, সেই সময়ে হঠাৎ করে এক ঘটনা ঘটে যা যুদ্ধের গতি প্রকৃতি পাল্টে দেয়।

রাজা দাহির তখন হাতির পিঠে হাওদায় বসে যুদ্ধ করছেন।
অকস্মাৎ
রাজা দাহিরের হাওদায় জ্বলন্ত তির লাগলে দাহির নেমে আসার জন্য তোড়জোড় করেন, সেই সুযোগে দাহিরের দিকে তির ছোঁড়া হলে লাগে বুকে। মারা যান দাহির।
যথারীতি দাহিরের মৃত্যুর পরে তার মাথাও কেটে আরব নিয়ে যাওয়া হয়।
একই উদ্দেশ্য- অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হতে না দেওয়া।

রাজা দাহিরের কন্যাদের প্রতিশোধ:
●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●
দাহির রাজার রানীরা সবাই জোহর ব্রত পালন করে আগুনে নিজেদের জ্বালিয়ে নেন।
কিন্তু ধরা পড়ে তার দুই কন্যা। তাদের নাম #সূর্য্যা আর #পারিমল। দুই কন্যাকে পাঠানো হয় খলিফার হারেমে।
পথে দুইকন্যা একটি পরিকল্পনা করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী
দামাস্কাসে পৌঁছে দুই কন্যা খলিফাকে বিশ্বাস করায় তারা আসলে বিষকন্যা। খলিফাকে খুন করার জন্য কাসিম তাদের পাঠিয়েছে।
শুনে ক্ষিপ্ত খলিফা কাসিমকে বেঁধে আনার হুকুম দেয় গরুর চামড়ার ব্যাগে ঢুকিয়ে। সেই অনুযায়ী কাসিমকে আনা হলে পথে দমবন্ধ হয়ে মরে সে।
এরপরে
কোনভাবে খলিফা বুঝতে পারে দুই কন্যা তার সাথে এই ছল করেছে, তখন নির্দেশ দেয় দুই কন্যাকে জীবন্ত বালিতে পুঁতে ফেলার মতান্তরে দেওয়ালে গেঁথে ফেলার কিন্তু দুই কন্যা বিষ খেয়ে করে আত্মহত্যা।
অন্য আরেকটি মতে
দুই কন্যাকে ঘোড়ার সাথে বেঁধে মাটি পাথরের সাথে ঘষে ঘষে মেরে ফেলা হয়।
যাইহোক
দুই কন্যা নিজেদের জীবন দিয়ে এভাবেই তার পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেয়।
তবে বাঁচাতে পারেনি তাদের মাতৃভূমি সিন্ধকে।

সিন্ধে মুসলমানের আগমন:
■■■■■■■■■■■■■■
রাজা দাহিরের মৃত্যুর সাথে সাথে চলল সারা সিন্ধু জুড়ে আক্রমন লুঠ আর ধর্ষণ, হত্যা করা হল পুরুষদের আর মহিলাদের ধর্ষণ। বাচ্ছাদের বিক্রি চলতে লাগলো দাস বাজারে।
খুব তাড়াতাড়ি সিন্ধ প্রদেশের হিন্দু আর বৌদ্ধদের পরিণত করা চলতে লাগলো মুসলমানে।
বৌদ্ধ মনাস্তারি আর হিন্দু মন্দির ভেঙে বানানো হতে থাকে মসজিদ।
ভারতবর্ষের আকাশে অশান্তির কালোছায়া নেমে এল বরাবরের মতো।

.

ইতিহাসের দাবী:
●◆■◆●■●◆■●◆
কিন্তু ভুল ছিলেন দাহির, না ইতিহাস তাকে মনে রাখেনি। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনি উপেক্ষিত রয়ে গেলেন।
আমরা তো তার নামই শুনিনি ইতিহাসের পাতায়।
তবে সম্পূর্ণ ভুলও অবশ্য তিনি নন।
আজ তিনি আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে সিন্ধের বাসিন্দারা তাকে আবার মনে করতে চাইছেন।
রাজা দাহির ছিলেন তাদের পূর্বপুরুষের কর্মভূমি সিন্ধের শেষ হিন্দু রাজা। সিন্ধুর শেষ হিন্দু রাজা হয়েই তিনি আজও রয়ে গেলেন।
কোনভাবেই তিনি এই আরবিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি। বরঞ্চ বীরের মত লড়াই করে বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
সেই বীরত্ব গাথা মাথায় রেখে আজ সিন্ধনিবাসীরা চাইছে বানানো হোক রাজা দাহিরের মূর্তি।
যতই হোক তাদের রাজা ছিলেন দাহির, বর্তমান সিন্ধবাসীর পূর্বপুরুষ তো রাজা দাহিরের জন্যেই লড়াই করে প্রাণ দিয়েছিলেন।

রাজা দাহিরের জয়গান আবার গাইবে সিন্ধ।
সিন্ধ তার রাজাকে স্মরণ করবে যোগ্য সম্মানের মধ্যে দিয়ে।
শুধু সময়ের অপেক্ষা।

.

Note
সিন্ধের সেই আরোর আজকে পরিচিতি পেয়েছে রোহরি নামে। তবে আরোর নামটাও যথেষ্ট পরিচিত। এখানে এখনো রাজা দাহিরের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।
এছাড়াও রয়েছে কলকা দেবী মন্দির। এই মন্দির ছিল রাজা দাহিরের কুলদেবী।
মন্দিরের পুজো আর দেখভাল এখন সিন্ধনিবাসীদের হাতে।

Reference:

চাচানামা

ভারত ও সিঁধের ইতিহাস এখানে লেখা রয়েছে

Prithwis Sen✍️

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.