সেদিন তাঁর ঠিকানা ছিল ওয়েস্ট লন্ডনের ১১২ গাওয়ার স্ট্রিট। ভারতীয় ছাত্রাবাসের একটি ঘরে এসেছেন বছর পঁচিশের এক তরুণ। সময়টা ১৯২৬ সালের এপ্রিল মাস। লিঙ্কনস ইন-এ আইন পড়তে এসেছেন তিনি। উদ্দেশ্য যতটা না আইন পড়া, তার থেকে বেশি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়কে একদম সামনে থেকে দেখা। সেদিনের সেই তরুণ ছিলেন ভারতমাতার বীর সন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়। লিঙ্কনস ইন-এর আর্কাইভিস্ট মেগান ডানমেল আমাকে একটি নথি ইমেল করে পাঠান। সেখানে দেখি, লিঙ্কনস্ ইন-এ শ্যামাপ্রসাদের ছাত্র হিসাবে নাম নথিভুক্ত করার দিন তারিখ। আমি তাঁকে অনুরােধ করি, যাতে শ্যামাপ্রসাদের নাম তাঁদের বিখ্যাত অ্যালামনি লিস্টে ঢােকানাে হয়। পরবর্তী ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্টের সময় তা নিশ্চয় করা হবে বলে কথাও দেন আর্কাইভিস্ট মেগান ডানমেল।
এই ঠিকানায় তখন আসতেন অগুনতি কৃতী মানুষ। এই বাড়িতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গান্ধীজী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, লালা লাজপত রাই, সরােজিনী নাইডু, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। গান্ধীজী ১৯৩১ সালে গােলটেবিল বৈঠকে এসে এখানে একটি সর্বধর্ম সমন্বয় আলােচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এসে এখানকার ভারতীয় ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এই কবিতাটি উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন, যেটি এখনও এখানে বাঁধানাে রয়েছে—
‘Be not ashamed, My brothers, to stand
Before the Proud and powerful with your
White Robes of Simpleness.
Let your Crown of Humility, Your Freedom,
Build God’s Throne daily upon the ample
Bareness of your proverty
And knowing what is Huge is not Great, and
Pride is not everlasting.’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এই বাড়িটি বােমার আঘাতে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়, তাই এখন মানচিত্র থেকে মুছে গেছে এই ঠিকানার তদানীন্তন বাড়িটি। তাই ইংলিশ হেরিটেজের প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও বসানাে যায়নি শ্যামাপ্রসাদের স্মারকসূচক নীল ফলক। আবেদনপত্রের উত্তরে ইংলিশ হেরিটেজের ঐতিহাসিক হাওয়ার্ড স্পেন্সার আমাকে লেখেন, শ্যামাপ্রসাদ লন্ডনে যে আরেকটি ঠিকানায় ছিলেন, সেটি খুঁজে বের করার জন্য। সুরেন্দ্রনাথ সেনের লেখা স্মৃতিচারণায় বেশ একটি মজার ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। উনি লেখেন, শ্যামাপ্রসাদ লন্ডনে এসে ওঠেন গাওয়ার স্ট্রিটে, কিন্তু কিছুদিন পর আরেকটি বাের্ডিং হাউজে উঠে যান। সেখানে ছিলেন তাঁর বন্ধু গুরুসদয় দত্ত (যদিও বয়সে তিনি শ্যামাপ্রসাদের থেকে কিছুটা বড়ই ছিলেন), সুরেন্দ্রনাথ সেন এবং যতীন্দ্রমােহন মজুমদার। তিন বন্ধু মিলে খুব আনন্দ করে থাকতেন। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল লন্ডনে একটি স্পিরিট ফোটোগ্রাফির ইন্সটিটিউট চালাতেন। এঁরা তিনজনেই খুব আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুপরবর্তী আত্মা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষায় যােগদান করেন। স্পিরিট ফোটোগ্রাফিতে ধরা পড়ে শ্যামাপ্রসাদের মৃতা বােনের ছবি। গুরুসদয় দত্ত সদ্য তাঁর স্ত্রী সরােজনলিনীকে হারিয়েছিলেন, ছবিতে ভেসে ওঠে গুরুসদয় দত্তের স্ত্রীর ছবি। তাই জন্য এই তিন তরুণ আরও বেশি যেন বিশ্বাসী হয়ে পড়েন। যাই হােক, এইসব ঘটনাই ঘটে সেই বাের্ডিং হাউজে থাকার সময়। সেই ঠিকানা বের করতে আবার দ্বারস্থ হই ব্রিটিশ অ্যানসেস্ট্রির সংগ্রহশালায়।
ডেটাবেস অনুসন্ধান করে যতীন্দ্রমােহন মজুমদারের ব্রিটেন ছেড়ে যাওয়ার দিনটির জাহাজযাত্রার বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে যে ঠিকানা দেওয়া ছিল, সেই অনুযায়ী শ্যামাপ্রসাদের সেই ঠিকানায়ই থাকার কথা। সেই ১২ নং আপার বেডফোর্ড প্লেসটিরও আর অস্তিত্ব নেই আজ। তার বদলে সেখানে আজ ইন্সটিটিউট অব এডুকেশানের বিশাল বাড়িটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাই ইংলিশ হেরিটেজের তরফ থেকে ব্লু প্ল্যাকের সম্ভাবনা আর রইল না বটে, কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ যে সব রাস্তা দিয়ে হেঁটেছিলেন সেই রাস্তাগুলাে তাে চেনা হলাে। লন্ডনে ১৯২৬ সালে লিঙ্কনস্ ইন কেমন ছিল সেই ছবি আর রাস্তাগুলি মিলিয়ে নিলে মােটামুটি একজন পঁচিশ বছরের ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত আইনের ছাত্রকে দেখতে পাই আমরা, যিনি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়কে কাছ থেকে দেখছেন খুঁটিয়ে। এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই তাঁর কাজে লেগেছিল পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার হিসেবে।
শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে ব্রিটিশ নিউজপেপার আর্কাইভে কী কী লেখা হয়েছে সেই নিয়ে একটু খুঁজে দেখা যেতেই পারে। চলুন না, একটু উঁকি দিয়ে দেখি সেই ইতিহাসের ইবাদৎখানায়। প্রথমেই বলে নিই—ব্রিটিশ সংবাদপত্রের পাতায় সেইসব ভারতীয়রাই গুরুত্ব পেয়েছেন, যাঁদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্ব ভারতে ছিল অপরিসীম। সেদিক দিয়ে দেখলে নেতাজী সুভাষচন্দ্র, নেহরু, গান্ধীজীর পাশাপাশি শ্যামাপ্রসাদ ব্রিটিশদের কাছে সেই গুরুত্ব পেয়েছিলেন।
মহাকালের কোনও টাইমলাইন হয় না, তাই আমরা এলােমেলাে ঘুরে বেড়াব। ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৫৩–এই এগারাে বছর মাত্র সময় দিয়েছে আমাদের ইতিহাস। সংক্ষিপ্ত জীবন ছিল তাঁর, ততােধিক সংক্ষিপ্ত তাঁর রাজনৈতিক জীবন। সংবাদের শিরােনামে তিনি উঠে এসেছেন বারেবারে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের জন্যই।
প্রথম যে খবরটি আমাকে দুর্দান্তভাবে টানে, তা হল ১৯৫২ সালের পয়লা জানুয়ারি কভেন্ট্রি ইভিনিং টেলিগ্রাফ-এ বেরােনাে কয়েকটি লাইন। তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেহরুর শাসনকাল। ব্রিটিশ মিডিয়া সবসময়ই গান্ধীজী অথবা নেহরুজীকে খুব সমীহ করে সম্মান জানিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে। ভাবটা এই যে, এঁরা আমাদের লােক, অথচ সুভাষ বােস বা চন্দ্র বােস অথবা বােস কিংবা সুভাষচন্দ্রের সব খবরগুলিই কেমন যেন নির্লিপ্তভাবে বলা। ঠিক ঋণাত্মক নয়, কেমন যেন দায়সারাভাবে লেখা। যারা ব্রিটিশ শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচিত তারা বুঝবেন বিটুইন দ্য লাইন–এর মানে কী হয়। এই খবরগুলাে লিখতে তাদের কত বিরক্তি হয়েছে। নেতাজীর খবরগুলাে দেখে এটাই মনে হয়েছে, যদি সেইসময়ে ‘মােস্ট হেটেড ইন্ডিয়ান’ তক্মা ব্রিটিশ কাউকে দিত তাহলে তা বুঝি নেতাজীর পাওনা ছিল। শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদ ব্রিটিশ মিডিয়ায় তেমন স্থান না পেলেও রাজনীতিক শ্যামাপ্রসাদ স্বাভাবিকভাবে শিরােনামে উঠে এসেছেন এবং নেতাজীর স্টাইলে সমান দায়সারায় এইখবরগুলােও ব্রিটিশ মাধ্যম লিখে গেছে। ব্রিটিশ তখন ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গেছে বা যাবে বলে মনস্থ করেইনিয়েছে, তাই হয়তাে নেতাজীর তুলনায় ঝাঁঝটা কিছুটা কম। এইভাবে সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমেই ব্রিটিশ বুঝিয়ে দিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকের কাছে নেহরু-গান্ধী মিত্র হলেও, সুভাষচন্দ্র এবং শ্যামাপ্রসাদ মােটেই তা ছিলেন না।
খবরে লেখা হয়েছিল ‘নেহরু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ যুদ্ধঘােষণা করবেন এমন হুমকি দিয়েছেন। নির্বাচনী সভা করতে এসে কলকাতায় নেহরু বলেন, যদি পাকিস্তান কাশ্মীরে আক্রমণ করে তাহলে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পুরােপুরি যুদ্ধে নামবে। সেই সঙ্গে তিনি প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়ের আনা অভিযােগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। শ্যামাপ্রসাদ অভিযােগ এনেছিলেন যে নেহরু কাশ্মীর প্রসঙ্গে ‘গােপন বােঝাপড়া’ করে নিয়েছেন। এটুকুই খবর—কিন্তু ভাবছি সেই সময়কার নেহরু, যখন ভারতবর্ষে তাঁর কথাই শেষ কথা, সেই সময়কার ব্রিটিশ রাজতন্ত্র তখনও সদ্য মধ্যাহ্নভােজন শেষ করে ঢেকুর তােলার আবহে বাস করছে, সেই সময় ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, যাঁর পাকিস্তানপ্রেম এবং হিন্দুবিদ্বেষ কোনও কল্পকথা নয়, সেই অবস্থান থেকে নেহরুকে অভিযােগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়াটা সহজ কথা ছিল না বৈকি। দেখুন, কভেন্ট্রি ইভিনিং টেলিগ্রাফ সেটা অস্বীকার করতে পারেনি।
পরের সংবাদটি অনেকগুলি কাগজে প্রকাশিত হয়েছে নিতান্ত নিরপেক্ষ উদাসীনতায়। কিন্তু ব্রিটিশ ভদ্রতায় হুমড়ি খেয়ে নিন্দে করার কালচার নেই—যারা জানে তা জানে, এই নিরাসক্ত ভাবেই তারা তাদের মনােভাব বুঝিয়ে দেয়। ১৯৪২ সালে গান্ধীজী তখন জেলে, ভারত ছাড়াে আন্দোলন তখন তুঙ্গে, ‘হিন্দু চিফ’ অর্থাৎ শ্যামাপ্রসাদ গান্ধীর সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। কিন্তু কেন? আসুন ব্রিটিশ দৈনিক ‘ডেইলি মিরর’-এর সাংবাদিকের মুখে খবরটা শুনি।
‘হিন্দু মহাসভার (হিন্দু জনমতের দক্ষিণপন্থী শাখা, লক্ষ্য করুন পুরাে হিন্দু জনমত নয় কিন্তু শুধু হিন্দুদের মধ্যেকার দক্ষিণপন্থী ভাগের কথাই বলা হয়েছে) প্রধান ড: মুখার্জি ভাইসরয়ের কাছে আবেদন জানিয়েছেন গান্ধীর সঙ্গে ভারতবর্ষের সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানের ব্যাপারে আলােচনার জন্য তিনি দেখা করতে চান। তিনি মুসলমান নেতা মি: জিন্নাহর সঙ্গে আলােচনা সেরে নিয়েছেন। এবং দিল্লি থেকে রিপাের্ট বেরিয়েছে যে, ড: মুখার্জি ব্রিটিশ সরকারকে ভারতবর্ষের জন্য স্বাধীনতা এবং অন্তর্বর্তীকালীন স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র ভারতীয় সরকার গঠনের উদ্যোগ নিতে বলেছেন। ব্রিটিশ ইউনাইটেড প্রেসের মতে, এরকম করা গেলে হিন্দু-মুসলিম বােঝাপড়া হতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। অন্যদিকে ভাইসরয় কাউন্সিলের ডিফেন্স মিনিস্টার, মুসলিম নেতা স্যার ফিরােজ খান নুন বলেছেন, কংগ্রেসের এই ধরনের রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। কারণ তারা দেশের শত্রু অর্থাৎ হিন্দু সংগঠন এবং শত্রুপক্ষের (অর্থাৎ শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে গান্ধীর আলােচনায় বসা) এবং শত্রুপক্ষের (ফিফথ্ কলামিস্ট) কাজে গােপনে সাহায্য করে। মিস্টার চার্চিল হাউস অফ কমন্স-এ যা বলেছেন সেগুলাে ভারতের বেশিরভাগ মানুষ পছন্দ না করলেও সেটাই সত্যি। তিনি কোনওরকম রাখঢাক না রেখে বলেছেন হয়তাে, কিন্তু যা বলেছেন সেটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।’
ডেইলি মিরর-এর খবরটি পরিবেশনের স্টাইলটা এমনই যে দেখে মনে হয় যেন চার্চিলের হিন্দু এবং ভারতবিরােধী জঘন্য বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ফিরােজ খান নুনের বক্তব্যটা বড় করে লেখা জরুরি ছিল। শ্যামাপ্রসাদের উদ্যোগ, ব্রিটিশ ইউনাইটেড প্রেসের বক্তব্য সবই যেন অত্যন্ত মামুলি, নেহাতই নিরাসক্ত ভাবে বলা। যেন না বললেও চলে, অথচ উপেক্ষাও করা যাচ্ছে না। তাই এভাবে বলতে হয় যে হিন্দু চিফ গান্ধীজীর সঙ্গে কথা বলতে চান। মানে গান্ধীর কোনও দোষ নেই, কিন্তু কংগ্রেস দূষিত হচ্ছে এই সব ‘ফিফথ কলামিস্টদের’ পাল্লায় পড়ে। ‘ফিফথ কলামিস্ট’ মানে যারা দেশের শত্রুদের সঙ্গে গােপনে যােগাযােগ রাখে এবং সমর্থন করে। এখানে তাহলে ‘ফিফথ কলামিস্ট’ কারা? বুঝতে অসুবিধা হয় না, ব্রিটিশ সংবাদপত্র এবং ফিরােজ খান নুনের মতাে মুসলিম নেতার মতে এই দক্ষিণপন্থী হিন্দুরাই দেশের শত্রু। এই খবরটিই প্রমাণ করছে স্বাধীনতার প্রাক্ লগ্নেই ব্রিটিশ এবং মুসলিম লিগ–উভয়েরই একটি জাতক্রোধ ছিল শ্যামাপ্রসাদের প্রতি।
এই দিনের খবর অন্য একটি কাগজে বেরােয় ‘বেলফাস্ট নিউজ লেটার’ বলে।
লেখাটি সরাসরি তুলে দিলাম এখানে। লেখাটির প্রথম অংশ খুব মন ছুঁয়ে যাওয়া। ইতিহাস বইতে হয়তাে এঁদের নাম নেই, কিন্তু এই বৈষ্ণবে পট্টনায়ক আর পবিত্রমােহন প্রধানকে আমরা জানতে পারলাম এই কাগজের মাধ্যমেই। স্বাধীনতা সংগ্রামী এই দুই ভারতীয়কে ধরিয়ে দিলে যথাক্রমে ১৫০ পাউন্ড এবং ১১০ পাউন্ড দেওয়া হবে বলে ঘােষণা করেছিল ব্রিটিশ সরকার। তখনকার হিসেবে সে বড় কম টাকা নয়। ২৬ আগস্ট পট্টনায়ক প্রায় ১৬ জন বিপ্লবীর সঙ্গে বােমা বন্দুক, তির-ধনুক নিয়ে পুলিশ চৌকি আক্রমণ করেছিলেন। আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন সরকারি নথিপত্রে। শুধু তাই নয়, পরের বার প্রায় ৮০০ জন গ্রামবাসী নিয়ে আবার ৪ সেপ্টেম্বর আরেক জায়গায় হানা দিয়েছিলেন। যেসব গ্রাম তাদের মদত দিয়েছে তাদের প্রত্যেককে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট বিশাল জরিমানা দিতে বাধ্য করেছে। পবিত্রমােহন প্রধানের কথা এই স্বল্প পরিসরে আর বেশি লেখা হয়নি। কিন্তু ওড়িশা সরকারের সরকারি নথিতে তাঁদের অসীম বীরত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।
এখানে আরও লেখা হয়েছে যে, মুসলিম লিগ নেতা মৌলবি মহম্মদ আবদুল ঘানি খান দাবি করেছেন, ব্রিটিশ সরকারের আইন অমান্য করলে যে সাধারণ নাগরিকদের অত্যধিক জরিমানা করা হচ্ছে তার থেকে মুসলমানদের ছাড় দেওয়া হােক। এখানেও প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, মুসলিম লিগ স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলিতে অবশিষ্ট ভারতবাসীর থেকে মুসলমান সম্প্রদায়কে আলাদা করে রাখতেই চেয়েছে।
যখন সাধারণ দরিদ্র গ্রামবাসীরা কেউই রেহাই পাচ্ছে না, স্বাধীনতা আন্দোলনে সামিল হবার জন্য, তখন মুসলিম লিগ নেতার এহেন আচরণ মনে সন্দেহ আনে বৈকি! এখানে শুধুমাত্র লেখা হয়েছে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি গান্ধীজী এবং কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে বসে ঠিক করতে চান, স্বাধীনতার রূপরেখা কী হবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই বা কীরকম হবে। সেখানে মহম্মদ আলি জিন্নাহ বলেছেন, পাকিস্তানের দাবি না মানা অবধি মুসলিমরা কোনও সরকারে অংশ নেবেনা। জিন্নাহের বক্তব্য যে, ভারতের
তিন-চতুর্থাংশ তাে হিন্দুরা নিয়েই নিয়েছে, মাত্র এক চতুর্থাংশ ভাগ মুসলমানদের। তাতেও কি খুশি নয়! মুসলমানদের স্বার্থে তিনি আরও বৃহত্তর আন্দোলনে নামতে পারেন যেটা কংগ্রেসের চেয়ে আরও অনেক বেশি মাত্রায় ভয়ঙ্কর হবে সে কথা যেন ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট মনে রাখে। এর কয়েক বছর পরই ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ভিতর দিয়ে তা করেও দেখিয়েছিলেন জিন্নাহ। প্রকাশিত খবরটি হুবহু তুলে দিচ্ছি।
TERRORISTS Reward for Arrest of Leaders Bombay, Sunday—- The state of Orissa to-day announced rewards of 150 and 119 respectively for the arrest of the leaders, Vaishnave Patnaik and Pabitramohan, for two attacks on a police station. Villages which gave assistance to Patnaik’s gang have been fined. An official said to-day that Patnaik, with 16 others, armed with guns, arrows and other weapons, raided the police station on August 26 and burned the records of the court and other public institutions. Patnaik led nearly 800 men in a later attack on September 4, said the official. The situation was now completely normal. Four effigies of Mr. Churchill were burnt in various parts of Bombay today. At one incident 12 people were arrested.
–Reuter. Maulvi Muhammed Abdulghani, of the Moslem League, has resolution down exempt Moslem British India from the payment of collective fines imposed under the Defence of India rules in connection with the civil disobedience movement.’ The Hindu Mahasabha Committee, it is understood, has applied for permission to interview Gandhi and other Congress leaders now in detention. Dr. S.P. Mookherjee, working President of the Mahasabha, and others of the committee stated; We feel that our efforts have reached a stage which Commons demands immediate consultation with Mr. Gandhi and the leaders of the Indian National Congress.’ Pakistan Mr. Jinnah, the Moslem leader, said today that the Moslems would unprepared to enter a provisional Government unless their demand for Pakistan were met. With this provision in favour of any amount of transfer of power,’ he said. According to our latest resolution on Pakistan it means that three quarters of India goes to the Hindus and one quarter to the Moslems, but even then the Hindus want to diddle us. Any provisions outside the framework of the present constitution must necessarily involve radical and fundamental constitutiional changes, and once the changes have been made it would be diffcult for us to attain after the war the guarantee on which we are insisting.’ Mr. Jinnah said it was in the power of the Moslems to cause the British Governmenrt far greater embrrassment that the Congress Party, but they were not disposed to take such action however they might deplore Brithsh policy in India during the past three years. Blunt, but true Firoz Khan Noon, defence Minister, said today that the continuation of the status quo regard to the political situation will not make any difference to defence, the situation was under control’।
১৯৪২ সালে অনেক কাগজে শ্যামাপ্রসাদের নাম পাওয়া যায়। এই বছর ২১ নভেম্বর একটি খবর আসে হিন্দু মহাসভার ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বাংলার মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন। দু-লাইনের এই খবর আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হতে পারে কীইবা দরকার ছিল এই খবর ছাপানাের। কিন্তু শিরােনাম থেকে সব স্পষ্ট হয়ে যায় ‘হিন্দু রিজাইনস্’— যেন একটাই পরিচয় ছিল তাঁর।
পরের খবরটিও বেলফাস্ট নিউজ লেটারের। ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন মঙ্গলবার ওয়েভেল প্ল্যান চলছে সিমলায়। রাজগােপালাচারী গান্ধীজীকে বলেছেন অতিথি হিসেবে আসতে, কিন্তু মিটিংয়ে যেন তিনি যােগদান না করেন। সারা ভারত থেকে এসেছেন নেতারা, মিটিংও বেশ ভালাে চলছে। ভাইসরয় মাঝেমাঝে গলফ খেলছেন। এবার একটা না একটা সেটেলমেন্টের রাস্তা বেরিয়ে যাবেই। শেষ দুটি লাইনে লেখা হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি পুণায় হিন্দুদের একটা মিটিং ডেকেছেন। আর সেখানে তিনি বলেছেন, ওয়েভেল প্ল্যান যাতে কার্যকর না হয়, তার জন্য আরও অনেক বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এমনকী ১৯৪২ সালের আন্দোলনও যাতে ম্লান হয়ে যায় এরকম। ব্রিটিশ মিডিয়ায় এই ধরনের খবর বারবার এসেছে। যেন চার্চিলই বিভিন্ন কাগজের মাধ্যমে কথা বলছেন। বােঝাই যাচ্ছে, ‘হিন্দু নেতা’ শ্যামাপ্রসাদকে একেবার অস্বীকার করতে পারছে না ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম।
১৯৪৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর প্রয়াণের পর, অনেক কাগজে এসেছে শ্যামাপ্রসাদের নাম, আর এস এসের নাম। হার্টলেপুল নার্দার্ন ডেইলি মেল লিখছে ‘আজ মহাত্মা গান্ধীর অস্থিভস্ম গঙ্গায় বিসর্জন করে পণ্ডিত নেহরু লােকসভায় ভাষণ দিয়েছেন ভারতীয় হিসেবে এবং হিন্দু হিসেবে তিনি লজ্জিত যে আমরা আমাদের ভারতীয়দের মূল্যবান রত্ন গান্ধীজীকে রক্ষা করতে পারিনি। আরও লজ্জার বিষয় যে, একজন হিন্দু এই জঘন্য কাজ করেছে আর যাকে হত্যা করা হয়েছে তিনি শুধু একজন প্রকৃত ভারতীয় নয়, একজন প্রকৃত হিন্দুও বটে। সংসদের বাইরে যখন স্লোগান উঠছিল আর এস এস মুর্দাবাদ, কারণ গান্ধীর হত্যাকারী একজন আর এস এস সদস্য, তখন নেহরু বলেন, এই ঘৃণার বাতাবরণ সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। ভারতীয় পুলিশ দেশের নানা জায়গা থেকে হিন্দু উগ্রবাদীদের অ্যারেস্ট করেছে, তেমন আবার পাল্টা আক্রমণেরও খবর পাওয়া গিয়েছে। উন্মত্ত জনতা বম্বেতে হিন্দু মহাসভার সদস্যদের বাড়িতে পাথর ছুঁড়েছে, আর তার মােকাবিলা করতে পুলিশ ২ রাউণ্ড ওপেন ফায়ার করেছে। কলকাতায় ক্ষুব্ধ জনগণ ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির বাড়িতে ঝড়ের মতাে পাথর ছুঁড়েছে।’
উপরের লেখাটি মােটামুটি আক্ষরিক অনুবাদ করে দেওয়া। এইদিনের আরও কয়েকটি কাগজে একই ঘটনার কথা বেরিয়েছে। এখানে লক্ষণীয় যে, গান্ধী হত্যার সঙ্গে আর এস এস কোনওভাবে জড়িত না হলেও, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম প্রথম থেকেই তাতে আর এস এসের নাম জড়িয়ে দিতে চেয়েছে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের শেখানাে অভিযােগই করেছে কংগ্রেস।
ডার্বি ডেইলি নিউজ কাগজেও একই কথা–প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী এবং হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্টের কলকাতার বাড়িতে ভাঙচুর করেছে উন্মত্ত জনতা। পুলিশ এসে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে তাদের এবং দুজনকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। বাড়ির সামনে সশস্ত্র পাহারা বসানাে হয়েছে। হায়দরাবাদে বিজয় কেস্কার নামের হিন্দুমহাসভার (হিন্দু জঙ্গি সংগঠন) একজন নেতার বাড়িতে একদল কংগ্রেস কর্মী চড়াও হয়। মহাসভার এই জঙ্গি নেতার হাতে বন্দুক ছিল এবং তার বাড়ির ছাদের ওপর মহাসভার পতাকা অর্ধনমিত করা ছিল না। তার হাতের বন্দুক কেড়ে নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠে পতাকা নামিয়ে দেয় কংগ্রেসের কর্মীরা।
ব্যাঙ্গালােরে মহাসভার কর্মী জি ভি আমাচারের বাড়ির সামনে বােম ফাটালে তার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইসব হিন্দু নেতাদের সাধারণ মানুষের ক্ষোভের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য পুলিশ যথেষ্ট সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছে। নাগপুরে যথেচ্ছ লুঠতরাজ চলেছে এইসব হিন্দু নেতাদের উপর এবং এইসব নেতাদের বাড়ির সামনে সাধারণ মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে এমনভাবে খবরগুলি সাজিয়েছে, যাতে মনে হয়, সামগ্রিকভাবে হিন্দু সমাজ এবং হিন্দু নেতৃত্বই গান্ধী হত্যার জন্য দায়ী। বলে না দিলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভারতের হিন্দু নেতাদের হেয় করার একটি লক্ষ্য ব্রিটিশদের ছিল। পরে ব্রিটিশদের স্থির করে দেওয়া এই লক্ষ্যেই কমিউনিস্টরা এদেশে হিন্দু নেতৃত্বকে বারবার আক্রমণ করেছে।
গান্ধী হত্যার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার খবরটি দেখে ১৯৮৪ সালের ইন্দিরা গন্ধী হত্যার পর দেশজুড়ে শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষের ওপর যা অত্যাচার হয়েছে সেকথা মনে করিয়ে দেয়। ব্রিটিশ কাগজে লিখছে, হিন্দুদের ওপর যথেচ্ছ লুঠতরাজের কথা, তার মানে সেই নির্মমতার আসল রূপ না জানি কেমন ছিল। বারবার জঙ্গি সংগঠন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে হিন্দু মহাসভাকে। যেমন, আজকেও হিন্দু সংগঠনগুলিকে জঙ্গি আখ্যায় দেগে দিতে পছন্দ করেন নেহরুবাদী সেকুলার ও বামপন্থীরা। আজকের জমানায় বসে আমরা বুঝি আসল জঙ্গিপনা কাকে বলে, সেদিন ব্রিটিশরাও তা জানত। তবু তারা বারবার অতিরঞ্জিত করে লিখেছে এই শব্দবন্ধটি শুধু নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য। গান্ধীহত্যা খুব খারাপ, কিন্তু হিন্দু মহাসভাও তাে কোনও নিষিদ্ধ সংগঠন ছিল না। গান্ধী হত্যার প্রেক্ষিতটা বিচার করার প্রয়ােজন নেই? আবার এইশ্যামাপ্রসাদের প্রয়াণেই যে কলকাতা শােকে আকুল হয়ে উঠেছিল, তাঁর শেষযাত্রায় যে নেমেছিল লক্ষ মানুষের ঢল, তাও ব্রিটিশ সংবাদপত্র অস্বীকার করতে পারেনি। সে প্রসঙ্গ শেষে আসছি।
১৯৪৭-এর এই খবরটিতে এসে থমকে দাঁড়াই আমরা। ব্রিটিশরা এমন নগ্নভাবে কাউকে আক্রমণ করে সাংবাদিকতা করে এমনটা বড় একটা দেখা যায় না। ভারতীয়দের এরা ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না— কেবলমাত্র কটূক্তি শােনা গেছে নেতাজির বিরুদ্ধে, বাকি সবাই যেন সত্যি এলেবেলে। জিন্না যেমন এদের গুড বয়, তাঁর সাত খুন মাফ, নেহরুকে এরা ঠিক তেমন একটা বিপদ বলে মনে করেনি কখনও। গান্ধীজী যেন এদের শিখণ্ডী। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসের লেখা এই খবরটি বেরিয়েছিল দ্য স্কটসম্যান কাগজে। শিরােনাম ছিল—
‘Influence of the Mahasabha’ Threat to Permanent Peace in India, Hatred of Moslems, by O. M. Green. “In the tension and fever of India today, one of the most dangerous elements is the Mahasabha (Great Society), quintessence of extreme Hinduism and hatred of Moslems. Its numbers are comparatively small, its political influence uncertain. But its ability to excite the passions of the Hindu mob by inflammatory slogans (just as Moslems may be roused by the cry ‘Islam in danger’) is justly feared. Its leaders have been conspicuous for their violence and pugnacity — the once famous Dr. S. P. Mookherjee, formerly ‘Vice-Chancellor of Calcutta University; the late, still more militant Dr. Moonje, founder of two particularly aggressive movements, suddhi and sangathan. (roughly ‘purification’ and ‘self-fortification’); and Mr. V. D. Savarkar, born in 1883, a barrister of London, is the typical aggressive Hindu. He was transported in 1909 for 14 years for abetting a murderous communal crime, and has since known the inside of an internment camp. He is not only anti-Moslem but anti-Congress, accusing it of ‘a pro-Moslem mentality’ and of having ‘betrayed Hindu interests a hundred times’. The Mahasabha was born in 1906, in answer to the formation of the Moslem League at Dacca the year before. At that time, and for some years afterwards, the Mahasabha’s aims were mainly religious. The Brahmins were alarmed by the numbers of Hindus who were being converted either to Christianity or Islam. Hinduism, it was said, was becoming lukewarm: intersive work was begun for the rescue and reconversion of backsliders.”
India for Hinduism : “But religion in India soon merges into politics. By 1923 the Mahasabha had definitely ‘put itself on the map’ in its annual session at the sacred city of Benares, and a number of vigorous provincial branches were formed. By 1931 it was imperial enough to have its own representatives at the Round Table Conference in London. A few yeas later it was represented in the enlarged Council of the Viceroy. From the Benares session onwards the Mahasabha became more and more anti-Congress. Its watchword was ‘India for Hinduism’ and it has always violently opposed Mr. Ramsay MacDonald’s ‘Communal award’ in 1932, by which separate communal electorates were secured in the provincial elections for Moslems, Sikhs, Christians, British Indians and Europeans. Congress was bitterly attacked for accepting the award which, said the Mahasabha ‘flouts the unanimous opinion of the Hindus.’ With the election of Mr. Savarkar as President in 1937, the energies of the Mahasahba took a pronounced military turn. The formation of Hindu gymnasiums, rifle clubs and volunteer militia corps was preached. On the outbreak of the Second World War in 1919, the Mahasabha (like the Moslems, but unlike Congress) pledged its support to Britain. But, said Mr. Savarkar at the 1940 session at Madura in South India’ we must study how the war can best be used to promote the cause of pan-Hinduism. We should participate in the Government a war effort in order to bring about the militarisation of our people. “Partition Threat’ : And in 1942 the Mahasabha called upon its followers to give no support to the Congress’s rebellion and Gandhi’s ‘Quit India’ slogan. Leading members of the Mahasabha openly declared (though needless to say this will not be found in official documents) that Hindus must assist in the war in order to become proficient in the use of arms against the day. When they would have to fight the Moslems. For 20 years past the Mahasabha has stood for the independence of India, but an India uncompromisingly dominated by Hinduism; and for unyielding opposition to any party which agreed to concessions to the Moslems. When the partition of Bengal ‘between Pakistan and Hindustan was decided upon, the Mahasabha proclaimed that unless Calcutta; was awarded to Hindustan, it would bring out every worker, from dockers to mill hands on strike. The peaceful acceptance of the partition by the Moslems (though it lost them Calcutta) has hitherto averted any distrubances in Bengal. How far the Mahasabha’s influence may have contributed to the Punjab massacres it is impossible to say though some fiery words by its leaders have been reported, but the peace which Mr. Nehru’s Government is striving to restore, will hardly be secure until the fieriness of the Mahasabha has somehow been quenched.
উপরের লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় সেটা আজকের দিনের তথাকথিত সেকুলার বিদ্বজ্জনের ভাষণ বলে মনে হয়। তাহলে কি ব্রিটিশরাই এই হিন্দু বিদ্বেষটা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল? এবং এতাে সুন্দর করে মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করে দিয়ে গিয়েছিল যে সেই ভূত আজও মাথা থেকে নামলাে না! বীর সাভারকরের সম্বন্ধে কত কুৎসা রটনাই যে শােনা যায় এদের মুখে। এই খবরের কাগজগুলাে পড়লে কিন্তু মনে হয় না কোথাও কখনও এক মুহূর্তের জন্যও সাভারকর আপােশ করেছিলেন। বরং, এই সংবাদটি পড়লে বােঝা যায়, সাভারকর ব্রিটিশদের রণকৌশল শেখার জন্যই যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। সাভারকর আপােশ করলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে এত নিন্দামন্দ তাঁর জন্য বরাদ্দ থাকতাে না। উল্টে থাকতাে নেহরুর মতাে একটা ফিল গুড অনুভূতি। ভাবটা এই যে, আহা নেহরু এত কষ্ট করে শান্তি আনতে চাইছে আর এই হিন্দু মহাসভার উগ্রপন্থী হিন্দুগুলাে তাদের মুসলমানদের প্রতি হিংসা দিয়ে সব বানচাল করে দিচ্ছে। সত্যি কি তাই ছিল সেদিনের আবহাওয়া? একদিকে ব্রিটিশের উস্কানি, জিন্না এবং নেহরু দুজনেরই জাতির পিতা হবার উগ্র বাসনা, সাধারণ দরিদ্র হিন্দু-মুসলমানকে লড়িয়ে দিয়ে দেশভাগ করে নেওয়া আর তার সমস্ত রকম দায় হিন্দুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া।
আজ ব্রিটিশ নেই, ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কিন্তু সেই ভাবনা তারা আমাদের মনে গেঁথে দিয়ে গেছে। সব দোষ হিন্দুদের? সব দোষ একদা বিখ্যাত কলকাতা ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর শ্যামাপ্রসাদের? ততােধিক ব্রিটিশের চোখে জঙ্গি হিসাবে চিহ্নিত মুঞ্জের (ড. মুঞ্জে আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতা ডা: কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের রাজনৈতিক অভিভাবক ছিলেন), অথবা সাভারকরের মতাে বিপ্লবীর, যাঁকে অমানুষিক অত্যাচার করেও ব্রিটিশদের সখ মেটেনি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই লড়াইটা তারা চালিয়ে দিল মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুদের লড়াই বলে। এই ঢালের আড়ালে বসে কুচক্রী সাম্রাজ্যবাদী এই ব্রিটিশ জাত ছুরি চালিয়ে গেছে সন্তর্পণে। অখণ্ড স্বাধীন ভারতমাতাকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। আর তার সঙ্গে জুটেছে কিছু স্বার্থপর লােভী রাজনীতিকরা। সব দেশে সবকালে এরা ঘৃণ্য ভূমিকা। পালন করে থাকে। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি।
১৯৫১ সালের ২২ অক্টোবর ডান্ডি ক্যুরিয়র রিপাের্ট করছে ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার কথা। কংগ্রেসের মুসলমান তােষণের বিরােধিতা করেই এই পার্টির সৃষ্টি হয়েছে। যদি ব্রিটেন এবং অন্যান্য কমনওয়েলথ দেশগুলি ইউনাইটেড নেশনস এবং অন্যান্য জায়গায় পাকিস্তানকে সবসময় সমর্থন করা এবং ভারতের বিরােধিতা করা বন্ধ না করে, তাহলে এই পার্টি ভারতকেও কমনওয়েলথ থেকে বের করে আনবে বলেছে। কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ইউ এন এ আর কোনও কথা হতে পারে না। কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ–একথাও জনসঙ্ঘ বলেছে।
১৯৫৩ সালের ১২ মার্চের কভেন্ট্রি ইভিনিং টেলিগ্রাফে বলা হয়, আইন অমান্যকারী হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ-সহ আরও তিনজন হিন্দু মহাসভার নেতাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে একজন লােকসভার সদস্য, বাকি তিনজন হিন্দু মহাসভার মেম্বার। সাধারণ জনসভায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এঁরা মিটিং মিছিল করছিলেন, তাই এঁদের আটক করা হলেও পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ছেড়ে দেওয়া হয়।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নির্ভীক শ্যামাপ্রসাদকে আমরা এখানেও দেখি। আপােশহীন নিরলস সংগ্রামের জন্য তাঁকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমও অস্বীকার করতে পারেনি। তিনি হয়তাে ভালােবাসা পাননি এদের কাছ থেকে, পাবার কথাও নয়, উল্টে ঘৃণাই পেয়েছেন। কিন্তু তারা তাঁর ঐকান্তিক প্রয়াসকে অস্বীকার করতে পারেনি কখনও। তাই স্বাধীনতার পরেও ব্রিটেনের স্থানীয় সংবাদপত্রে তিনি এসেছেন নিয়মিত নেগেটিভ নিউজ হিসেবে।
নিচের এই খবরটি দেখে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের অনেকেরই পূর্বপুরুষের দেশভাগের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ঠাকুমা দিদিমার কাছে এই গল্প শুনে আমরা অনেকেই বড় হয়েছি। গল্প শুনেছি রাতারাতি ঘরবাড়ি সব ফেলে প্রাণটুকু নিয়ে পালিয়ে আসার করুণ কাহিনি। কলকাতায় একজন আত্মীয়ের বাড়ি পুরাে গ্রাম উজাড় করে উঠে আসা, শিয়ালদহ স্টেশনে হিন্দু বাঙালির মমান্তিক কষ্ট। এসব কি তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল? নাহলে উনি শ্যামাপ্রসাদের ওপর এত রেগে গেলেন কেন?
মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি এই হতভাগ্য হিন্দু বাঙালিদের জন্য একজন মাত্র মানুষ লড়ে যাচ্ছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে। জোর গলায় বলছেন, তিনটি মাত্র পথ আছে। এক নম্বরে দেশভাগকে অস্বীকার করা হােক। ‘নালিফাই’ যাকে ইংরাজিতে বলে। দুই নম্বরে হিন্দুদের জন্য আলাদা টেরিটোরি অর্থাৎ অঞ্চল ভাগ করে দেওয়া হােক, আর তিন নম্বরে পুরােপুরি সংখ্যালঘু বিনিময় করা হােক। নেহরু তখন কী বলছেন? দৃশ্যত রেগে যাচ্ছেন (মার্কেডলি অ্যাংগ্রি)। কতটা রাগ হলে ব্রিটিশ মিডিয়া লিখতে পারে এই কথা। নেহরুজী বলছেন তবে কি যুদ্ধ করতে চাও? এই হতভাগ্য বাঙালিগুলাে কি এতটা ইম্পর্টেন্ট যে তাদের জন্য যুদ্ধ করতে হবে? প্রথম দুটো অপশান মানে তাে যুদ্ধই। আর তিন নম্বর অপশান কি সম্ভব, পাগলের প্রলাপবলছ? আমার সাধের সেকুলার ভারতবর্ষ থেকে পুরাে মুসলমান পপুলেশানকে চলে যেতে বলব? তাতে আমার দেশের ধর্ম নষ্ট হবে না? নেহরুজী তখন কি একবারও ভেবেছিলেন সেইসব হিন্দু পরিবারের কথা, যারা হপ্তাভর রেল লাইন ধরে হাঁটছে এপারে আসবে বলে অথবা যেসব মেয়েরা আসার পথে ধর্ষিতা হয়েছে বা খুন হয়েছে, যেসব শিশু পথশ্রমের ক্লান্তি সইতে না পেরে মারা গেছে তারা কেন নিজের দেশে বাড়িভিটে ছেড়ে পালিয়ে আসছে দলে দলে লাখে লাখে? পপুলেশান ক্লিন্সিং শুধু একতরফা হবে? শ্যামাপ্রসাদ বলছেন দু-তরফের বিনিময়ের কথা।
এই হিন্দু বাঙালি যারা এখনও পূর্ব পাকিস্তানে রয়ে গেল তাদের মনােবল তলানিতে এসে ঠেকেছে। সরকার রিফিউজিদের সামলে উঠতে পারছে না। তাদের কথা ভেবে সরকারের কি কিছু করার নেই? এখানেই শ্যামাপ্রসাদ অদ্বিতীয়, প্রকৃত অর্থেই চ্যাম্পিয়ন। তাই সভায় উপস্থিত কংগ্রেসের অন্যান্যদেরও মনে হয় যে, ‘চ্যাম্পিয়ন অব রিফিউজি’ অর্থাৎ শ্যামাপ্রসাদের কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। এই কথাগুলাে যখন ব্রিটিশ লােকাল নিউজপেপারে বেরােয় নির্লিপ্তভাবে অথচ না বললে নয়— শ্যামাপ্রসাদ তাে তাঁর একার জন্য কিছু বলেননি, ব্যক্তিগত লাভের জন্যও নয়। এর সঙ্গে যে একটা বৃহত্তর জনজীবন জড়িত। তাই শ্যামাপ্রসাদের কথা সেদিন শুনতে বাধ্য হয়েছিল শুধু ব্রিটিশ মিডিয়া নয়, এমনকি পরমভট্টারক নেহরুজিও। খবরটা হুবহু তুলে দেওয়া হলাে।
Few Living on Dole
Such figures are impressive. The Indian Government states that excepting recent migrants from East Pakistan and 90,000 other who are all without means of support, no Indian Refugee is now living on the dole. Excepting migrants from East Pakistan; there’s the rub. More than two million have fled into West Bengal and Assam since last January. And though the central Government has allowed a grant of three and three quarter million pounds for their rehabilitation, the refugees keep coming and the money spreads thinner and 1 India thinner. In Parliament this week, Pandit Nehru, Indian Prime Minister, spoke twice in support of his April agreement with Liauqat Ali Khan, Prime Minister of Pakistan. On the second occasion he grew markedly angry with Dr Shyamaprasad Mookherjee, the Bengal refugees champion who spoke sombrely of the minority’s utter lack of confidence in East Bengal. Dr Mookherjee demanded either the annulment of partition, the cession of territory by Pakistan, or a total exchange of populations. Mr. Nehru reported that the first two meant war and the last was both impracticable and also denied India’s belief in the secular state. Nevertheless, it seemed in the lobbies that the majority of Congressmen felt that Dr Mookherjee had a case, felt that it was impossible to treat any further with such a recalcitrant as Pakistan. Against this was the certain knowledge that they could not do without Nehru.
শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর আবহে চলে এসেছি আমরা। বীরগতি প্রাপ্ত এই বিপ্লবীর মৃত্যু স্বাভাবিক যে ছিল না তা নিয়ে ব্রিটিশ মিডিয়ারও খুব একটা সন্দেহ ছিল না।
১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ সালে সাণ্ডারল্যাণ্ড ডেইলি ইকো অ্যান্ড শিপিং গ্যাজেটে এই খবরটা বেরােয়। কৈলাসনাথ কাটজু পুরােপুরি উড়িয়ে দিচ্ছেন কথাটা, এমনকী বলছেন এটা মনগড়া কথা। বেআইনিভাবে বন্দি করা আর তার পরে চিকিৎসায় অবহেলা করা দুটি অত্যন্ত গুরুতর অভিযােগের উত্তরে খোঁজখবর করার বালাই নেই, উল্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, আরে মশাই এসব কিছু নয়। আমি কাশ্মীরি গভর্নমেন্টের কাছে কৃতজ্ঞ যে তারা শ্যামাপ্রসাদের সম্পূর্ণ দেখভাল করেছিল।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে এভাবে শেষ না করে দিতে পারলে তাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে সেকথা বুঝতে দেরি হয়নি এইসব অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের। এখন মনে হয়, আজকের এই যে রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিক অবক্ষয় দেখি দলমত নির্বিশেষে, সেই সময় থেকেই তার বীজ বপন শুরু হয়েছিল। স্বাধীন ভারত তাে পেলাম আমরা অজস্র রক্তক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে, তারপরেও নিজেদের গদির সুরক্ষা করতে যা সব অনৈতিক কাজকর্ম শুরু হয়েছিল তার চরম অবস্থা বােধকরি আজ আমরা দেখি রাজনীতির লােকজনের মধ্যে। তাই বুঝি সাধারণ আম আদমি যারা তারা সক্রিয় রাজনীতির লােক দেখলে সন্দেহ করি, দূরে সরে যাই, এমনকী স্থান বিশেষে ঘৃণাও করি। ইতিহাস তাে শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতেরও পূর্বাভাস দেয়। অস্বাভাবিক মৃত্যুকে আইনসিদ্ধ করে দেওয়ার শুরু কি তখন থেকে? শ্যামাপ্রসাদই কি স্বাধীন ভারতে প্রথম রাজনৈতিক হত্যা? সম্ভবত তাই।
Hindu Was ‘Liquidated’
The Indian Government today rejected a demand for an open inquiry into the death Dr. S. P. Mookherjee who died in Srinagar last June while under detention—for entering Kashmir without a permit. Dr Mookherjee was leader of the Right-Wing Hindu Jan Sangh party and a former Minister in the Indian Government. Dr Khare, a leader of the Hindu Mahasabha Party, today pressed a demand in the house of the people (Lower house) for an inquiry. He accused the Indian and Kashmiri Governments of the ‘liquidating’ Dr Mookherjee and described his death as a medical and political liquidation of an inconvenient political opponent. For the medical part, Srinagar was responsible’, alleged.
Mr Chatterjee president Mahasabha said Dr Mookherjee had been illegally detained with the Indian Government’s Connivance and Conspiracy. The minister of home affairs of sates Dr Katju replied that it was a ‘figment of imagination’. To suggest there had been any conspiracy.
He was satisfied that Kashmiri Government had done everything it could to provide medical aid for Dr Mookherjee and there was no need for enquiry. The house then adjourned.
২৩ জুন কভেন্ট্রি ইভিনিং টেলিগ্রাফের পাতায় এলাে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর খবর। শীর্ষনাম এল ‘রাজনৈতিক নেতার মৃত্যু রাজনৈতিক বন্দী হয়ে।
“আজ শ্রীনগরে হিন্দু দক্ষিণপন্থী বিরােধী (জনসঙ্ঘ) নেতার জীবনাবসান হয়েছে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদরােগ বলা হয় এবং তখন তাঁর বয়স মাত্র ৫২ বছর। মে মাসের ১১ তারিখ থেকে তিনি বন্দি আছেন শ্রীনগরের জেলে। প্লুরিসি রােগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁকে গতকাল শ্রীনগরের একটি নার্সিংহােমে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ড. মুখার্জি এবং তাঁর দুই সঙ্গীকে কাশ্মীরে উপযুক্ত নথিপত্র ছাড়া প্রবেশ করার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ভারতীয় পাr/লামেন্টের সদস্য, বাঙ্গালি, একজন বড় মাপের নেতা শ্যামাপ্রসাদ, নেহরুর খুব বড় সমলােচক ছিলেন। স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম ক্যাবিনেটে তিনি শিল্পমন্ত্রী ছিলেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ অবধি। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতি নেহরুর নীতি অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৫১ সালে সাধারণ নির্বাচনের কিছু আগে তিনি নিজের রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সেই জনসঙ্ঘ দিল্লি সহ উত্তরভারতে যেখানেই পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তু জনগণ রয়েছে সেইসব জায়গায় যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।”
এতাে গেল শুধু খবর। কিন্তু ব্রিটিশ মিডিয়া এইটুকু বুঝতে পেরেছিল যে, উদ্বাস্তু জনগণের মাঝে শ্যামাপ্রসাদের অপরিসীম জনপ্রিয়তার কথা। তাই একটি কাগজে তাঁকে রিফিউজিদের চ্যাম্পিয়ন বলা হয়েছে। প্রশ্নটা হলাে, যাদের উচ্চাশার কারণে হিন্দুদের রিফিউজি হতে হল, সেসব রাজনীতিবিদ সেদিন কি করছিলেন? অসহায় মানুষদের দুঃখ-কষ্ট সেদিন জাতির পিতাও বােঝেননি বা বুঝেও কিছু করেননি। আর চাচা তাে নিজে প্রধানমন্ত্রী হবার উচ্চাশা পূরণের জন্য ব্রিটিশের হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিলেন। নাহলে এই লক্ষ লক্ষ গৃহহারা মানুষগুলাের কথা তিনি ভেবে উঠতে পারলেন না কেন? বাঙ্গালি হিন্দু যারা দলে দলে এলাে সেদিন তাদের কথা নেহরুর মনে সেভাবে স্থান পেল না কেন?
এভাবেই শ্যামাপ্রসাদ হিন্দুর হৃদয়সম্রাট হয়ে উঠেছিলেন—শিল্ড ডেইলি নিউজে এই খবরটি পড়লে বােঝা যায়—
Crowds salute dead leader
“Crowds packed the streets of Calcutta early this morning to salute the body of Dr Shyama Prasad Mookherjee, leader of India’s Right-wing, opposition. On the last stages of its journey to his ancestral home at Bhowanipore, near Calcutta. The body of the 52 year old Hindu politician, who died yesterday from a heart attack following pleurisy contracted in the Kashmir gaol where he had been detained since May 11, had been flown from Srinagar, Kashmir. The car bearing the body could move only at walking pace because of the thousands who formed a solemn procession in front of it. – Reuter.
শ্যামাপ্রসাদের শববাহী গাড়ি সেদিন মানুষের ভিড়ে চলতে পারছিল না। হাজার হাজার মানুষ সেদিন পথে নেমেছিল তাদের প্রাণের প্রিয় নেতাকে চোখের জলে বিদায় দিতে। সেদিন যারা শ্যামাপ্রসাদকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। মানুষের আদালতে নাই বা হােক ঈশ্বরের বিচারসভায় তার শাস্তি হবেই। আমরা অনেকেই বড় হয়েছি বাম শাসনকালে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙ্গালি আমরা প্রগতিশীল, সেকুলার– বেশিরভাগই আবার কোনও না কোনওভাবে বর্তমান বাংলাদেশ থেকে আসা উৎখাত হওয়া হিন্দু বাঙ্গালিই। শ্যামাপ্রসাদের অবদানের কথা জানানাে হয়নি আমাদের প্রজন্মকে, কলকাতা শহরকে আজ আমরা ‘টেকন ফর গ্রান্টেড’ নিয়ে নিয়েছি, এই কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ আমাদের নিজেদের, আমাদের মাতৃভূমি, কত কবিতা গান বেঁধেছি, ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু’ কিন্তু কোথাও উল্লেখ করিনি শ্যামাপ্রসাদের। শুধু ভবানীপুরের রাস্তার নামটুকু ছাড়া আমাদের এই প্রজন্ম শ্যামাপ্রসাদের কথা কিছুই জানে না।
নিজের বলে ধরে নেওয়া শহরটার প্রতিটি ধূলিকণার পিছনে শ্যামাপ্রসাদের যে এত বড় লড়াইটা ছিল তা বাঙ্গালিদের সুকৌশলে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইংল্যান্ডে নয় নয় করে আজ প্রায় পঁচিশ বছর আছি, এখানে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে রয়েছি— এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি স্কুলশিক্ষায় ব্রিটিশরা ইতিহাস বিকৃত করেনি কোথাও। ফ্রান্স সহ সারা ইউরােপে যুদ্ধবিগ্রহ কম হয়নি, ধর্মসংক্রান্ত যুদ্ধই তার মধ্যে বেশি, কিন্তু আজকের সেকুলার ব্রিটেন খুবই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রয়েছে। তবে তাই বলে ইতিহাসকে বিকৃত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শেখায়নি কখনও। শ্যামাপ্রসাদের সেদিনের লড়াইকে অস্বীকার করে আজকের কলকাতাকে সাজানাে অকৃতজ্ঞতা। আত্মবিস্মৃত বাঙ্গালি, আত্মঘাতী বাঙ্গালি যতই লিবারেল বা সেকুলার হােক, তার প্রকৃত ইতিহাসটা জানা অত্যন্ত জরুরি।
ব্রিটিশ আর্কাইভে ব্রিটিশ জার্নালিস্টদের লেখা বিবরণ বা মূল্যায়ন দেখে অবাক হয়েছি। তাদের নির্লিপ্ততা, কারণে অকারণে জঙ্গি বা টেররিস্ট আখ্যা দেওয়া, হিন্দু এক্সট্রিমিস্ট আখ্যা দেওয়া মনে করিয়েছে বর্তমান সেকুলার প্রােগ্রেসিভ বাঙ্গালির কথা। মনে হয়েছে ব্রিটিশরা যা শিখিয়ে দিয়ে গেছে সেটাই আমরা আউড়ে চলেছি ৭০ বছর ধরে। মনে হয়েছে নেহরু যেন ব্রিটিশদের নিজেদের সন্তান, নেহরুর বিরােধিতা করা আর ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানান একই ব্যাপার। দুজন বাঙ্গালি ব্রিটিশদের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়েছেন, একজন নেতাজী, অন্যজন শ্যামাপ্রসাদ। মুগ্ধ হয়েছি শ্যামাপ্রসাদের বীরত্বে। খবরগুলাে পড়ে চোখের সামনে দেখতে পেলাম যেন পার্লামেন্টারিয়ান শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়কে, আয়ত দুটি চোখে যেন আগুন ঝরে পড়ছে, গলার শিরা ফুলে উঠছে, হাতের মুঠিতে প্রতিজ্ঞা। উল্টোদিকে চরম শক্তিমান রাজাধিরাজ জওহরলাল নেহরু।
লড়াইটা তাঁর নিজের জন্য নয়, লড়াইটা ছিল আমাদেরই জন্য। চোখে ভেসে উঠল একটি দৃশ্য—অধুনা বাংলাদেশের বরিশালের প্রত্যন্ত একটি পাড়াগাঁ ঝালােকাঠির সরাই গ্রাম থেকে আমার জন্মদাত্রী মা তখন তিনবছরের ক্ষুধার্ত শিশু, হপ্তাভর চড়াই উতরাই ভেঙে, স্টিমার, হাঁটা পথ, রেললাইন সবকিছু পেরিয়ে কাকার হাত ধরে কলকাতায় পা রাখছে— ভাগ্যিস! কলকাতাটা আমাদেরই ছিল।