শ্যামা মায়ের শ্যামাপ্রসাদ

শ্যামাপ্রসাদ নিজেকে বলিদান দিয়েছিলেন দেশ-মাতৃকার চরণে, ২৩ জুন, ১৯৫৩ সালে । নেহেরু যখন কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দিলেন যে সে প্রায়ই একটি স্বশাসিত রাজ্য হয়ে গেলো, তখন শ্যামাপ্রসাদ তার প্রতিবাদে কাশ্মীর গেলেন নেহেরুর আদেশ উপেক্ষা করে। সেখানেই রহস্যজনক ভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু বাঙালির যে অপূরণীয় ক্ষতি করলো, তা কিন্তু কংগ্রেস ও বামপন্থী ঐতিহাসিকরা ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। সেই জন্য আধুনিক প্রজন্ম , বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায় , জানে না শ্যামাপ্রসাদ আসলে কে ছিলেন, তিনি ঠিক কি কাজ করেছিলেন যার জন্য তাঁকে সশ্রদ্ধায় স্মরণ করতে হয় বাঙালিদের বিশেষ করে । কেউ কেউ বলতে পারবে যে তিনি জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন — অর্থাৎ শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ ভিন্ন যেন তাঁর অন্য কোনো পরিচয় নেই। তাদের মধ্যে বেশি আঁতেল যারা তারা বলে তিনি সাম্প্রাদয়িক ছিলেন, তাই তাঁকে ঘৃণা করা উচিত। এদিকে মজাটা হলো তারা যে নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল বলার সুযোগ পাচ্ছে এ কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের অবদান।


যখন প্রথম দেশভাগের কথা হয়, তখন জিন্নাহের স্বপ্ন ছিল যে সমস্ত বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে । যেটাকে আমরা আগে পূর্ব পাকিস্তান বলতাম আর এখন বাংলাদেশ শুধু সেটা নয়: কলকাতা সমেত সমস্ত বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ। উর্বর জমি, খনিজ সম্পদ, কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিচিতি এইগুলোর উপর তো লোলুপ দৃষ্টি ছিলই — তার উপরে অবিভক্ত বাংলায় মুসলমান সংখ্যা ছিল ৫৮%। সুতরাং জিন্নাহ ধরেই নিলেন যে বাংলা পাকিস্তানের হবে। ( অবশ্য কলকাতার যে বৈভব ও সংস্কৃতি দেখে জিন্নাহ লোভ করেছিলেন তা বামপন্থীরা সফল ভাবে নষ্ট করে দিয়েছে ). যারা প্রকৃত ইতিহাস জানে না তারা ভাবতেই পারে যে কি ক্ষতি হত। কিন্তু যে বাঙালি হিন্দুরা কোনো কারণে এপার বাংলায় চলে আসতে পারেন নি, অথবা ভেবেছিলেন যে তারা নিরাপদে থাকবেন তাদের উপর যে কি নারকীয় অত্যাচার হয়েছিল তার নথিপত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে যে এই বর্তমান যুগের বাঙালির কি হাল হতো।


দেশের স্বাধীনতা আসার আগেই হলো গ্রেট কলিকাতা কিলিং ও নোয়ালখালী দাঙ্গা। তা থেকেই বোঝা গেলো যে স্বঘোষিত মুসলিম পার্টি, যারা ইসলামিক রাষ্ট্র চায় তারা মোটেই বিশ্বাস করে না যে হিন্দু-মুসলিম একই বৃন্তে দুটি কুসুম। শ্যামাপ্রসাদ চাক্ষুষ প্রমান দেখে সম্প্রীতির মিথ্যা বাণীতে মজতে সম্মত হলেন না। তিনি স্থির করলেন যে হিন্দুদের নিজের ভূমি লাগবে । তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কঠিন সংগ্রাম করলেন, গ্রামে গ্রামে গিয়ে বোঝালেন। তখনকার বাঙালি ছলনাময় ইতিহাসের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়নি; তাদের মনে ছিল অন্নদামঙ্গল, কৃত্তিবাসী রামায়ন ও কাশীরামি মহাভারত। তাই তারাও গর্জে উঠলো যে তাদের নিজস্ব আশ্রয়স্থল চাই, যেখানে তারা নিরাপদে বাস করতে পারবে। বাঙালি হিন্দুর জন্য তৈরি হলো পশ্চিমবঙ্গ। তাই এতদিন ধরে বাঙালি হিন্দুরা নিশ্চিন্ত মনে , সম্মানের সঙ্গে বাস করতে পেরেছ। শ্যামাপ্রসাদ না থাকলে কালীঘাটের কালিমা থাকতেন না; ঢাকার রমনা মন্দির যেন ধংস করা হয়েছো এখানেও তাই হত। আবারো বলা প্রয়োজন , পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ বাঙালি হিন্দুদের রক্ষা করার জন্যে। সেটা ভুলে গেলে জাতিটাই নষ্ট হয়ে যাবে।


হিন্দু-মুসলিম একই বৃন্তে দুটি কুসুম ওই স্লোগানটা ছিল নেহাতই ধোঁকা তার অকাট্য প্রমান আছে। । বাঙালি নমঃশূদ্রের নেতা যোগেন মণ্ডল বিশ্বাস করেছিলেন যে ইসলামী রাজ্যের সঙ্গে তিনি সুখে ঘর করতে পারবেন, কারণ বর্ণহিন্দুরাই আসল শত্রু। কিন্তু দেশ ভাগের পরে অচিরেই মোহ ভাঙলো। তিনি নিজে আইন মন্ত্রী , কিন্তু পাকিস্তানী দুর্বৃত্ত, পুলিশ, সেনা তাঁকে অনায়েসে অবজ্ঞা করে হিন্দু নমঃশূদ্রদের উপর অত্যাচার করে যাচ্ছে — বেশির ভাগ হয় মরল, নয়তো ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হল। যে স্বপ্ন ফেরি করে নমঃশূদ্রদের পাকিস্তানে আসতে রাজি করিয়েছিলেন সেই স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে, আইন মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে পালিয়ে এলেন — সেই বর্ণহিন্দু পশ্চিমবঙ্গে।
২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ জন্মদিবস। কিন্তু এই তারিখের আরেকটি তাৎপর্য রয়েছে। বিশ্বমঞ্চে ২০ জুন , রেফিউজি ডে অথবা উদ্বাস্তু দিবস বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং ২০০১ সাল থেকেই ইউনাইটেড নেশনস জেনারেল অ্যাসেম্বলি সেইভাবে এই দিনটি পালন করে আসছে। আগে দিনটি আফ্রিকান উদ্বাস্তু দিবস বলে পরিচিত ছিল, তারপর ওই দিনটি বেছে নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু দিবস বলে। এখানেই আমি এক মেলবন্ধন খুঁজে পাচ্ছি — শ্যামাপ্রসাদ যদি পশ্চিমবঙ্গ ছিনিয়ে না আনতেন পাকিস্তানের করাল গ্রাস থেকে , তাহলে বাঙালি হিন্দুরা সম্পূর্ণরূপে উদ্বাস্তু হত। যারা ভিটেমাটি ত্যাগ করে চাইতো না তারা হয় খুন হতো নয়তো মুসলমান হতে বাধ্য হত। বাকিরা গৃহ হীন হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতো ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে, তারপর প্রায় বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী হত। আমরা যারা এই মুহূর্তে পশ্চিমবাংলায় বাস করি, তাই শ্যামাপ্রসাদের কাছে আমাদের ঋন পিতৃ-মাতৃ ঋণের সমান। তাই কোনো বাঙালির পক্ষে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুদিনকে ভোলা যায় না

পাপিয়া মিত্র (Papia Mitra)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.