মানুষের ধর্মবিশ্বাসে স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যে যোগাযোগ রাখে যে বস্তুটি, তার নাম—দড়ি। মানুষ মারা গেলে বাঁশের অস্থায়ী খাটিয়ায় শ্মশানে নিয়ে যাবার জন্য দড়ি পাকানো হয় মৃতের বাড়িতেই।
বোধিজ্ঞান লাভ করে গৌতম বুদ্ধ যখন প্রথমবার জন্মভূমি কপিলাবস্তুতে এলেন, তখন আত্মীয়-স্বজনের অনুরোধে কিছু অলৌকিক শক্তি দেখিয়েছিলেন বলে অশ্বঘোষ তাঁর “বুদ্ধচরিত” গ্রন্থে জানিয়েছেন। তিনি প্রথমে আকাশে উঠেছিলেন এবং তারপর নিজের দেহকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেলেন। তাঁর হাত-পা-মাথা মাটিতে পড়ে গেল। পরে সেগুলি ফের দেহের সঙ্গে যথাযথভাবে জুড়ে গেল।
ভারতের ইতিহাসে এই দড়ির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দড়ি নিয়ে চলে দড়ির খেলা। এর সঙ্গে যোগ রয়েছে শ্যামা ধর্মের। দানবের সাহায্যে শ্যামার নিজের শরীর থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করতে উৎসাহিত করা এবং এরপর আকাশে আরোহণ করা। এটি শ্যামা সাধনার মধ্যে পড়ে।
ভারতে আসা মরক্কোর পর্যটক ইবন বতুতা খ্রিস্টিয় চতুর্দশ শতকে চিন ও ভারতে এই দড়ির খেলা দেখেছিলেন। ভারতের যাদুকররা দড়ির খেলায় তাঁদের সহকারির দেহ টুকরো টুকরো টুকরো করে আবার জোড়া দিতে পারেন।
এখন প্রশ্ন, দড়ির সঙ্গে ধর্মের কি সম্পর্ক?
সম্পর্ক অবশ্যই আছে এবং তা শ্যামা সাধনার অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। ভারত ও তিব্বতে দড়ি, মই কিংবা আঙুর লতা, সেতু, তিরের শেকল বেয়ে দেবতারা স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে আসেন। ভারতের ভারহুত, সাঁচি এবং তিব্বতের বিভিন্ন চিত্রকলায় এই ধরণের অলৌকিক সিঁড়ি পথের উল্লেখ রয়েছে। আমরা জানি, লঙ্কাধিপতি রাবণ স্বর্গের সিঁড়ি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এ ধারণাটিও দড়ি বা শেকলের তৈরি সিঁড়িপথের কাল্পনিক চিত্রের মতোই।
তিব্বতের প্রাক্-বৌদ্ধ ঐতিহ্যে দড়ি ব্যবহারের একটি ধর্মীয় গুরুত্ব আছে। রাজা যাতে স্বর্গে যেতে পারেন, সেজন্য সেখানে তাঁর কবরে একটি দড়ি দেওয়া হয়। এর মূলেও রয়েছে শ্যামাধর্মের প্রভাব। তাহলে দেখা যাচ্ছে, একসময় সারা পৃথিবী জুড়েই শ্যামা ধর্ম প্রচলিত ছিল। শ্যামা বা শাঁমা তথা শ্রমণ বা শমন অর্থাৎ যম ধর্মের প্রচলন ছিল সারা পৃথিবী ব্যাপী।
আদিম মানুষের পুরুষ দেবতা যদি হোন ধর্মঠাকুর, তবে স্ত্রী দেবতাটি হলেন শ্যামা বা শ্যামারূপা। পরে শ্যামা যুক্ত হয়ে যান ধর্মঠাকুরের পুজোর সঙ্গে। ধর্মমঙ্গলের আদি কবি রূপরামের মতে, লাউসেনের শামুলা মাসি অথর্ববেদের অনুসরণে মাথায় আগুন জ্বালিয়ে বা মাথা কেটে তেকাটা বা ত্রিকূট মণ্ডলের ওপর রেখে তাঁকে হাকণ্ড্যে বা আনন্দ-স্কন্ধে পশ্চিম দিকে সূর্য উঠানোর উদ্দেশ্যে ধর্মঠাকুরের পুজো করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই গোটা বিশ্ব জুড়ে শ্যামা বা শাঁমাধর্ম প্রচলিত রয়েছে। গবেষকদের মতে, এই শ্যামা বা শাঁমাধর্ম হলো “শ্রমণ” বা “শমন” অর্থাৎ সোজা কথায় “যমধর্ম।” গবেষকরা বিভিন্নভাবে এই শ্যামা বা শাঁমা শব্দের বুৎপত্তি নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মতে, সংস্কৃত “শ্রমণ”, পালি ও অর্ধ মাগধীতে “সমন”, চিনা “শ-মেন।” পালি শব্দ “সমন” চিনা ভাষায় হয়েছে “শ-মেন।” আবার তুর্কিতে হয়েছে “সমন” বা “সামান।”
তবে এ নিয়ে ডব্লিউ স্কট, দোর্জি বাঞ্জারোভ, জে নেমেথ, বি লুফার, মিরচিয়া এলিদ, জি জি রামস্টেড প্রভৃতি গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ধীরে ধীরে বহু ধর্মের নামাবলী পরে ধর্মঠাকুর ও শ্যামাধর্মের বিবর্তন ঘটেছে। প্রায় খ্রিস্ট পূর্ব দেড় হাজার বছর আগে থেকেই এই পরিবর্তন ঘটে এসেছে।
আগেই বলেছি, শ্যামা বা শাঁমা আসলে যম-যমী ধর্ম। যম মানে ধর্ম ঠাকুর আর শ্যামা বা শ্যামারূপা হলেন যমী। প্রথম স্ত্রী দেবতা হলেন এই শ্যামা। ঋগ্বেদের যম-যমী কি তাহলে পরবর্তী সময়ে শ্যামাতত্ত্বকে ঢেকে রেখেছে?
হাড়-মুণ্ডের মালা পরে দেবী শ্যামা আসন করে বসে গেলেন পূর্ব ভারতের গ্রামে গ্রামে। খ্রিস্টিয় সপ্তদশ শতকে ধর্মমঙ্গলের আদি কবি রূপরামকে অটক অর্থাৎ শ্রমণ ধর্মঠাকুর নিজে কালামন বিলে গলায় হাড়ের মালা পরিয়ে দীক্ষিত করেন শ্যামাধর্মে। এরপর তাঁকে তিনদিন উপবাসী রেখে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিলেন পথে-প্রান্তরে। আবার যমধর্মে দীক্ষা নিয়ে নচিকেতা যম রাজ্যে গিয়েছিলেন।
নরকংকাল ও মুণ্ডু দিয়ে সাজানো আসনে শ্যামাপুজো পদ্ধতি হচ্ছে আদিম মানুষের প্রধান আচরিত পুজো বিধি। গোটা বিশ্ব জুড়েই এই শ্যামাপুজোর নিদর্শন রয়েছে। আমাদের ভারতবর্ষে ৫১ পীঠের ভাবনা এই শ্যামাপুজোর বিশিষ্ট কেন্দ্রগুলিকে আশ্রয় করেই বিকশিত হয়েছে।
তুঙ্গু, মাঞ্চু, ইয়াকুত, সাময়, ওষ্টায়ক, বুরাত, এস্কিমো, অষ্ট্রেলিয় প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্যামা দীক্ষার প্রচলন আছে। আবার কারিব জাতীয় শ্যামাগণের মধ্যে রামধনুতে চড়ে স্বর্গে যাওয়ার বিবরণ রয়েছে। সাইবেরিয়া ও উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে শ্যামা দীক্ষা প্রচলিত আছে। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওসিয়েনিয়া, সেমান, বোর্ণিও, মেলানেশিয়া, পলিনেশিয়া প্রভৃতি স্থানের সব জাতির মধ্যেই শ্যামাধর্মের প্রচলন দেখা যায়। অনেক জায়গায় কুকুর, ঘোড়া, মৃত ব্যক্তির স্বর্গে যাওয়ার জন্য সেতু, সিঁড়ি ও দুর্গম পথ শ্যামাপুজোর প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বৈদিক ভারতের ঋষিরা ধ্যানের সাহায্যে শূন্যতত্ত্বে লীন হয়ে যাবার কৌশল জানতেন। ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করার এটি একটি পথ। ঋগ্বেদে স্তোত্রে ঋষিরা ঐশ্বরিক বিভূতিতে ভূষিত। তাঁরা স্বচ্ছন্দে সমুদ্র, অরণ্য, অপ্সরা ও গন্ধর্বলোকে বিচরণ করতে পারেন। অথর্ব বেদে তপস্যাসিদ্ধ শিষ্যের প্রশংসা করা হয়েছে। তিনি দ্রুত পূর্ব থেকে উত্তর সমুদ্রে যেতে পারেন। এটি এক ধরণের শ্যামা সমাধি, যার উল্লেখ রয়েছে যোগতন্ত্র ও বৌদ্ধ তন্ত্রধর্মে।
সাধনার সঙ্গে মিশে আছে যাদু বিশ্বাস। অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, আকাশে উড়ে বেড়ানো কিংবা পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর মধ্যে রয়েছে একটি জনপ্রিয় বিশ্বাসের রহস্যময় রীতি। ঋষি পতঞ্জলি লঘিমা অর্থাৎ বাতাসের মধ্যে উড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। আবার মহাভারতে দেখি, ঢেঁকি বাহন নারদ আকাশ পথে পৃথিবীর কেন্দ্র মেরু পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করছেন। এভাবেই যোগীরা ইচ্ছে মতো যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারেন।
অন্যদিকে, তন্ত্রধর্মে ডাকিনী, যোগিনী ও পরীদের কথা আছে, যাঁদের মধ্যেও এই ধরণের অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে বলে প্রচলিত লোককথায় জানা যায়। মোঙ্গলদের মধ্যে এঁরা বাতাসে হেঁটে যান, আর তিব্বতীদের মতে, এঁরা মই কিংবা দড়ির সাহায্যে আকাশে ওড়েন।
ভারতের ঈশ্বর সাধনার মূলত দুটি ধারা রয়েছে—একটি প্রকৃত ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া এবং দ্বিতীয়টি ভরের মাধ্যমে। আজও বিভিন্ন দেবতার থানে (স্থান) “ভর” লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন ভারতের ঋষিরা জেনেছিলেন, আত্মা অবিনশ্বর। ঋগ্বেদের ৭ম থেকে ১১ ঋকে সুবন্ধুর মৃত্যুর কথা আছে।”শতপথ ব্রাহ্মণ”-এ বলা হয়েছে, কোনো ঘুমন্ত ব্যক্তিকে হঠাৎ করে জাগাতে নেই। কারণ, তখন তার আত্মা দেহে ফিরে আসার আগেই সেই ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে। আবার বলা হয়, স্বপ্ন দেখার সময়েও মানুষের আত্মা বহুদূরে চলে যায়।
ঋগ্বেদে মুমূর্ষু ব্যক্তিকে বলা হচ্ছে:
“যত্তে যমং বৈবস্বতং মনোজগাম্ দূরকম্।
তত্ত্ব আ বর্তয়া মসীহ ক্ষয়ায় জীবসে। ।
যত্তে দিবং যৎ পৃথিবীম্ মনো জগাম দূরকম্।
তত্ত্ব আ…..জীবসে। ।
যত্তে ভূমিং চতুর্ভূষ্টিং মনোজগাম দূরকম্।
তত্ত্ব আ ….জীবসে। ।
যত্তে চতুস্র প্রদিশো মনোজগাম দূরকম্।
তত্ত্ব আ ….জীবসে। ।”
অর্থাৎ, ফিরে আসুক তোমার আত্মা, ধর্মকর্ম করুক, বল প্রয়োগ করুক, বেঁচে থাকুক এবং দীর্ঘদিন ধরে সূর্যের মুখ দেখুক। আমাদের পূর্বপুরুষরা, দেবদূতরা ফিরিয়ে দিক তোমার আত্মা। তুমি জীবনচর্যায় জড়িয়ে থাকো।
ঋগ্বেদের ভাষ্যকার সায়নাচার্যের মতে, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৮ সূক্তে ১০, ১১ ও ১২ ঋকে রয়েছে হাড় বা অস্থি সংগ্রহের কথা। শ্যামা সাধনাও হচ্ছে এই হাড়মালার সাধনা। ব্রাহ্মণ্যধর্মের নামাবলী গায়ে দিয়ে শাঁমা হয়েছেন শ্যামা, যিনি বাঙালির কালী।”শ্যামা”-র তৎসম রূপের মধ্যেই লুকিয়ে আছেন দেবী শাঁমা, ঠিক যেভাবে গোর্খনাথ হয়েছেন গোরক্ষনাথ। জৈন, বৌদ্ধ থেকে শুরু করে সবেতেই এ জগৎ শ্যামাময়। তাই স্বর্গে যাওয়ার জন্য দড়িতেও রয়েছেন শ্যামা।
তথ্যসূত্র:
1) Shamanism Archaic Techniques of Ecstasy: Mircea Eliade.
2) ঋগ্বেদ: রমেশচন্দ্র দত্ত (অনুবাদ)।
3) বিভিন্ন ধর্মদর্শনের আভ্যন্তরীণ ঐক্য: স্বামী জগদীশ্বরানন্দ।
4) বাঙ্গালীর ধর্ম ও দর্শন চিন্তা: ড: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।