বড়দিনকে হিন্দুয়ানায় বেঁধেছিলেন স্বামীজি, তুলসী-পূজনেও সে বাঁধন অটুট।

আপনার মনে কী কখনও প্রশ্ন জেগেছে, একটি খ্রীস্টীয় ক্যালেণ্ডারের প্রথম দিনেই ভারতবর্ষে ‘কল্পতরু’ উৎসবের ভাব-আয়োজন কেন হল? কেন কলোনিয়াল ফেস্টিভ্যালের মেজাজ প্রতিস্পর্ধী হিন্দুত্বের বাতাবরণ নিয়ে ভারতবর্ষীয় উৎসব হয়ে ধরা পড়লো? কেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতিধন্য হয়ে পয়লা জানুয়ারির মধ্যে হিন্দুয়ানীর ছোঁয়া?

মনে রাখতে হবে দেশীয় সংস্কৃতি ও শিক্ষার ধারা পরিবর্তন করে মেকলে সাহেব ১৮৩৫ সালে যে শিক্ষানীতি প্রচলন করতে চাইলেন, পরের বছরেই তা ভাঙ্গার আয়োজন হল। “তোমারে বধিবে যে/গোকুলে বাড়িছে সে।” কলোনিয়াল-কৌশল ভাবজগতে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য আবির্ভূত হলেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব। তিনি অপ্রকটের পূর্বে ঔপনিবেশিক ভাবধারাকে পরাজিত করে যাবেন, তা এক প্রকার নিশ্চিতই ছিল। তাই দেখা গেলো ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে খ্রীস্টীয় ক্যালেণ্ডারের পাতায় জ্বলজ্বল করছে এক অহৈতুকী কৃপালাভের আনন্দঘন দিন। কল্পতরু উৎসব। ভারতবর্ষ আপন সৌকর্যে অতিক্রম করেছে সাম্রাজ্যবাদের চিহ্নমাখা দিনগুলি।

স্বামীজি কী বলেছেন ঘটা করে বড়দিন উৎসব পালনের কথা? এদিন কী আমাদের বাইবেল পাঠ করে যীশুর জন্মদিন পালন করতে হবে? কেক পেস্ট্রি, নেটিভেটি এবং ক্রিসমাস ট্রি-র আলোকমালায় হিন্দুরা খানিক দিশেহারা। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনীয়া। শিকাগোতে তিনি হিন্দুধর্মের প্রচারের জন্যেই গিয়েছিলেন। তিনি খ্রিস্টান মিশনারীদের সুস্পষ্টভাবে জানিয়েও দেন, ভারতবর্ষ কখনই অধ্যাত্মসম্পদে দরিদ্র নয়, দরিদ্র অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানে। তাই ২০ শে সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ সালের শিকাগোতে এক ভাষণে বলেন, “তোমরা খ্রিস্টানেরা পৌত্তলিকদের আত্মাকে উদ্ধার করবার জন্য তাদের কাছে ধর্মপ্রচারক পাঠাতে খুবই উৎসাহী; কিন্তু বল দেখি অনাহার ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে দেহগুলো বাঁচানোর জন্য কোনো চেষ্টা কর না কেন? ভারতবর্ষে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের সময় হাজার হাজার মানুষ খিদেয় মৃত্যুমুখে পড়ে, কিন্তু তোমরা খ্রিস্টানেরা কিছুই করনি। তারা ভাত চাইছে আর আমরা তাদের পাথরের টুকরো তুলে দিচ্ছি। ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা শোনানো বা দর্শনশাস্ত্র পড়ানো হল তাকে অপমান করা।”

মনে রাখতে হবে স্বামীজি অন্য ধর্ম থেকে ভাব নেবার ব্যাপারে খুবই selective ছিলেন। যীশুর সামাজিক সাম্যনীতি তাঁর প্রাণ স্পর্শ করে থাকবে; জগতের কল্যাণের জন্য যে ত্যাগ দরকার হয়, তার রসদও যীশুখ্রীস্টের মধ্যে তিনি পেয়ে থাকবেন। এখন ঔপনিবেশিক শাসনে থাকবার পর মানুষ স্বভাবতই তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়, নতুবা নানান মত ও পথে তা অতিক্রম করতে মনস্থ হয়, কখনও ঔপনিবেশিক শক্তির মান্যধর্মকে তীব্রভাবে অস্বীকার করার মানসিকতা জন্মায়। ব্রিটিশ শাসনে থেকে স্বামীজিও হয়তো সেই ধর্মীয় পরিমণ্ডল অতিক্রম করার জন্য তাদের ধর্মীয় সেরা দিনটিকেই গ্রহণ করেছিলেন। আর সেই দিনটির মধ্যে হিন্দুধর্মের নবযুগের ইতিহাস রচনা করতে চাইলেন। তার এক দু’টি উদাহরণ দেওয়া যায়।

প্রথম, ১৮৮৬ সালের বড়দিনের পূর্বসন্ধ্যায় (১৩ ই পৌষ, ১২৯৩) নয়জন গুরুভাই হুগলীর আঁটপুর গ্রামে বাবুরাম ঘোষের (শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ, পরবর্তীকালে স্বামী প্রেমানন্দ) বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ভারতের অধ্যাত্মিক ও সামাজিক কল্যাণে সন্ন্যাস গ্রহণের সংকল্প করলেন। অন্যদিনও তো করতে পারতেন, কারণ আঁটপুরে তার বেশ কয়েকদিন আগেই পৌঁছেছিলেন। মনে রাখতে হবে ১৮৮৬ সালেই আগষ্ট মাসে ঠাকুরের শরীর যায়। সেদিন অশ্বত্থ তলায় ধুনি জ্বেলে তাঁরা বসলেন গভীর ধ্যানে, তারপর ঈশ্বর আলোচনা। জানা যায় স্বামী বিবেকানন্দ যীশুখ্রীস্টের কথা সেদিন বলেছিলেন। এখন প্রশ্ন এইভাবে দিনটি পালনের পরও পরবর্তীকালে পুরীতে গিয়ে সেই বাবুরাম মহারাজই কেন খ্রীস্টান পাদ্রীদের ধর্মপ্রচারের জনসমাগমকে বিভ্রান্ত করার জন্য এবং স্বধর্ম চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য ‘হরিবোল হরিবোল হরিবোল’ ধ্বনি দিয়ে উত্তাল করেছিলেন এবং উপস্থিত মানুষকে তাতে সামিল করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন? আর তাতে সফলও হয়েছিলেন। তারমানে স্বামী বিবেকানন্দ এমন কোনো দাগ তার মধ্যে রেখে যান নি, যাতে এটাকে সধর্ম প্রীতির বাইরে কিছু ভাবতে পারেন। যদিও এরপর তাঁর স্বপ্নে শ্রীরামকৃষ্ণ দেব এসে তার ভুল ভাঙ্গালেন এ রকম ব্যাখ্যা আছে।

দ্বিতীয় ঘটনা ১৮৯২ সালের ২৫,২৬,২৭ শে ডিসেম্বরের; স্থান কন্যাকুমারী। আবারও ২৫ ডিসেম্বরকে ব্যবহার করলেন স্বামীজি। স্বামীজি অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ডাইনে-বামে-পশ্চাতে ঢেউ আর ঢেউ, অগণিত অনন্য; মহাসাগরের বুকে মিশে যেতে চায় সাগর আর উপসাগর — অনাদি কাল থেকে তাদের অভিসার যাত্রা। ১৮৯২ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর; আকাশের এক তারা এসেছেন মত্যসাগরের ত্রিকোণ প্রেমের জলধারায় নীলকর দিয়ে। সুনীল জলধি থেকে সন্তানসম ভারতবর্ষের আবির্ভাব; মহাকালের সেই মহান অধ্যায় দেখতে এসেছেন সপ্তর্ষিমণ্ডলের এক আশ্চর্য নক্ষত্র; তার অতীত আর ভবিষ্যৎ মেলাবেন সমাধিতে বসে। পাশেই সমুদ্র-তনয়া কন্যাকুমারী। বড়দিন-ই বটে, তার প্রাক্কালে পায়ে হেঁটে কন্যাকুমারী পৌঁছেছেন স্বামী বিবেকানন্দ, তারপর মূল ভূখণ্ড থেকে সাগর-সঙ্গমে ৫০০ মিটার সাঁতরে ভারতীয় পাহাড়ের শেষ বিন্দুতে পৌঁছলেন তিনি; দেখলেন অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন, তারপর অতুল্য কিন্তু অভুক্ত ভারতের জন্য গ্রহণ করলেন এক অধ্যাত্মিক সংকল্প। ধ্যানের শঙ্খনাদে একাদিক্রমে তিনদিন কাটলো — ২৫,২৬,২৭ শে ডিসেম্বর।

যে খ্রীস্টান ধর্ম মানুষকে ‘পাপী’ বলে, সেই ধর্মের প্রতিবাদ কেবল স্বামীজিই করেন নি, করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণও। মানুষ দেবতা, মানুষ ব্রহ্ম; সে পাপী হবে কীভাবে? সে অমৃতের সন্তান, সে পবিত্র, সে পূর্ণ; পূর্ণতা প্রাপ্তির সব যোগই তার মধ্যে আছে। শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মসমাজের শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিন্দু বিধবা আশ্রমের জন্য তিনি বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে টাকা তুলে পাঠিয়েছেন কেবল খ্রিস্টান ধর্মান্তরিত ভারতীয় বিদূষী মহিলা রামাবাইয়ের তৈরি বিধবা আশ্রমকে ঔচিত্য দেখানোর জন্য। কারণ এই মহিলাসহ অন্যান্য খ্রীস্ট-ধর্মাবলম্বী ও মিশনারিরা গলা মিলিয়ে ভারতীয় বিধবাদের দুঃখের অতিরঞ্জন করতেন, স্বামীজির তা না-পসন্দ ছিল।
হিন্দু ধর্মের প্রচারে আনুকূল্য পাবার জন্য যতটুকু যীশু-ভজনা দরকার স্বামীজি তাই করেছেন, তিনি জানতেন একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ প্রচার ধারায় ভারতসহ প্লাবিত হবে বিশ্বের নানান অংশ, তাই বড়দিনের মত দিনটির মধ্যে হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনের বীজ বপন করে দিলেন তিনি। এটা কলোনিয়াল প্রভাবমুক্তিরই সাধনা, সাধনা ২৫ শে ডিসেম্বরকে অতিক্রমের।

এই দিনে বরং বেশী করে শ্রীরামকৃষ্ণের ও স্বামী বিবেকানন্দের স্মরণ-মনন ও পূজন জরুরী। জরুরী শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামীজি যুগলবন্দীর আরাধনা। খ্রীস্টের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে না দেখে শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই যীশুখ্রীস্টকে আবিষ্কার করার সাধনা হিন্দুদের শুরু করা উচিত। সম্প্রীতির বার্তা দিতে বরং খ্রীস্টানরা প্রভু যীশুর মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে খুঁজে নিক।

ভারতবাসীর অন্তরে প্রশ্ন জেগেছিল, সজ্জিত নির্জীব ‘ক্রিসমাস ট্রি’-র চাইতে জীবন্ত বীরুৎ-প্রাণ তুলসী কেন আমাদের আরাধ্য হবে না! তার সুবাস, তার নির্যাস, তার বাতাস কেবল অতি পবিত্র নয়, অতীব ভেষজগুণ-সম্পন্ন। করোনা পরিস্থিতিতে তুলসীর গুণ আমাদের বুঝিয়ে দিতে হয় নি, সারা দেশে এক ধাক্কায় তুলসীর ব্যবহার বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল, তা থেকে প্রস্তুত ক্বাথ, বটিকার বেচাকেনা হয়েছে বিস্তর। আজ তাই তুলসীর ভেষজ মূল্যকে ভারতবাসীর ধন্যবাদ জানানোর দিন। ভারতবাসী অন্যান্য বছরের তুলনায় আরও অধিক ঐশী সমারোহে তুলসী-পূজন দিবস পালন করবেন ২৫ শে ডিসেম্বর। কারণ ভারতবাসীর বৃক্ষপূজার ধারণা নতুন নয়, উদ্ভিদের মধ্যেকার চৈতন্যও নতুন নয়। শীতের ঝকমকে রোদে যখন তুলসীমঞ্চ আলো করে পুষ্পমঞ্জরী পেকে ওঠে, বীজ পুষ্ট হয়, তখন তার বীজ সংগ্রহ করে রাখতেন গৃহস্থ পরিবার। ক’দিন সুপ্তির পর বসন্ত এলেই তা থেকে বেরিয়ে আসতো নতুন চারা। মন্দিরের এক চিলতে জমিতে ‘তুলসীতে তুলসীতে বৃন্দাবন’ হয়ে যেতো। তারই শুভসূচনা ২৫ শে ডিসেম্বর। ভারতবাসীর কাছে তুলসী মাহাত্ম্যে ‘বড়দিন’-ই বটে। শরতের দিনে যে চারা বড় হয়ে উঠতো, মাটির মন্ডে শিকড় সমেত তা এদিন স্বজন-বান্ধব, প্রতিবেশীকে বিতরণ করা ছিল পবিত্র কর্তব্য। আর পরিবেশিত হত নলেন গুড়ে শালিধান্যে রাঁধা পরমান্ন। কোনো কেক-পেস্ট্রি স্বাদে গন্ধে তা অতিক্রম করতে পারে নি। অনতিক্রম্য এক দিবস – তুলসী-পূজন।

তুলসীপ্রনামমন্ত্র:-

ওঁ বৃন্দায়ৈ তুলসী দেবৈ প্রিয়ায়ৈ
কেশবশ্য চ ।
বিষ্ণুভক্তি প্রদে দেবী সত্যব ত্যৈ নমো
নম:
.

তুলসীপ্রদক্ষীনমন্ত্র:-

“যানি কানি চ পাপানি ব্রম্ভাহত্যাদিক
ানি চ ।
তানি তানি প্রনশ্যন্তি প্রদক্ষিণ পদে
পদে,,,
.

তুলসী_জলমন্ত্র:-

“(ওঁ)গোবিন্দবল্ল ভাং দেবীংভক্ত
চৈতন্যকারিনীম ।
স্নাপয়ামি জগদ্ধাত্রীং কৃষ্ণভক্তি
প্রদায়িনীম্”
.

তুলসী_চয়নমন্ত্র:-

“(ওঁ)তুলস্যমৃত জন্ মাসি সদা ত্বং কেশব
প্রিয়া ।
কেশবার্থে চিনোমি ত্বাং বরদা ভক
শোভবে”

ক্ষমা_প্রার্থনামন্ত্র:-

“চয়নোদ্ভব দুঃখং চ যদ্ হদদি তব বর্ততে ।
তত্ক্ষমস্ব জগন্মাতঃ বৃন্দাদেবী..

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.