অসম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ এবং মিজোরাম এই সেভেন সিস্টারসকে এখন যেন চেনাই যায় না। সন্ত্রাসবাদের কলঙ্কে কলঙ্কিত এই সাত বোনের এখন যেন নতুন রূপ। স্বাধীনতার পর এই সাত রাজ্য এখন কংগ্রেস মুক্ত। সেই সঙ্গে শক্তি হারিয়ে সন্ত্রাসবাদী বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও এখন যেন নখদন্তহীন। স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেস জমানায় টেররিস্টহাব, ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী দেশি বিদেশি শক্তির প্রয়োগশালা বলে চিহ্নিত উত্তরপূর্ব ভারতকে দেশের মূলস্রোতের অংশ বলে গণ্য করা হতো না। বহু ভাষা, জাতি, গোষ্ঠীতে বিভক্ত উত্তরপূর্ব ভারতে শান্তির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা অসম্ভব এমনটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৯ সাল থেকে সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপে উত্তরপূর্ব ভারতে চল্লিশ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছিল অগণিত বিচ্ছিন্নতাবাদী/সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। এদের কারো দাবি সার্বভৌমত্ব আবার কারো স্বায়ত্তশাসন। এদের মধ্যে কিছু সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তো সমান্তরাল আন্ডারগ্রাউন্ডসরকার গঠন করে সরকারি করব্যবস্থার মতো কর আদায় করতো। কেউ এই কর দিতে রাজি না হলে তার জন্য অপেক্ষা করতো মৃত্যুদণ্ড।
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এই সমস্ত রাজ্যগুলির ভূমিপুত্ররা দিল্লি ব্যাঙ্গালোরের মতো শহরে আশ্রয় নিয়েছেন এমন নজির প্রচুর। দেখা যাচ্ছে বিগত চার বছর ধরে উত্তরপূর্ব ভারতে কংগ্রেস যত দুর্বল হয়েছে ততই শক্তি হারিয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি। সার্বভৌমত্ব স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের জন্য যে সমস্ত দোকান খোলা হয়েছিল সেগুলির ঝাঁপ বন্ধের মুখে। একই অবস্থা বিদেশি শক্তির মদতপৃষ্ঠ টেরোরিস্ট কনসালটেন্সিগুলিরও। ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার সময় উত্তরপূর্বের পাঁচটি রাজ্য-সহ সমগ্র ভারতে ১৩টি রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। এরপর গত চার বছরে উত্তরপুর্বের পাঁচটি রাজ্য থেকেই কংগ্রেস সমূলে উৎপাটিত। ২০১৬ সালে অসমে বিজেপির কাছে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক পতনের শুরু। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মিজোরামে পরাজয়ের মাধ্যমে উত্তরপূর্ব ভারতে কংগ্রেসের উৎপাটিত হওয়ার কাজটি সম্পূর্ণ হয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবিরোধী শক্তিগুলির ক্রিয়াশীলতার তারতম্য নতুন করে সবাইকে ভাবাচ্ছে। উত্তরপূর্ব ভারতে এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভয়মুক্ত সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশে জীবনধারণের গুণগত মানের যে পরিবর্তন এসেছে তা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বিজেপি সরকারের ঘোষিত ‘লুক ইস্ট নীতির’ সৌজন্যে উত্তরপূর্ব ভারত দেশের মূলস্রোতের অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। একটি উদাহরণ দিলেই নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার উত্তরপূর্ব ভারতের ব্যাপারে কতটা সংবেদনশীল তা স্পষ্ট হবে। চীন ভারত যুদ্ধের ৫৬ বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকার সেনাবাহিনীর অধিগৃহীত জমির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩৮ কোটি টাকা অরুণাচল প্রদেশের বাসিন্দা জমির মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছে। এরকম সংবেদনশীলতার অসংখ্য উদাহরণ আছে। ফলে এই সাত রাজ্যের মানুষ দেশের মূলস্রোতের সঙ্গে যতই একাত্ম বোধ করছে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি ততই শক্তি হারাচ্ছে।
ইতিহাস বলছে ব্রিটিশ শাসকদের হাত ধরেই ধর্মান্তরকরণ ও অনুপ্রবেশের মাধ্যমে উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির জনসংখ্যার ভারসাম্য পরিবর্তনের অশুভ প্রয়াস শুরু হয়েছিল। ফলে স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকেই বিদেশি ইস্যুতে বারে বারে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলি। এই নিয়ে প্রচুর দাঙ্গাহাঙ্গামা রক্তক্ষয়ও হয়েছে। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে অসম চুক্তি স্বাক্ষর হলেও ওই চুক্তি কার্যকর করার মতো ক্ষমতা বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা কোনোটাই কংগ্রেস দলে ছিল না। অসমকে কাশ্মীর বানানোর চক্রান্ত থেকে রক্ষা করতে বিজেপি ক্ষমতায় এসেই ভোটব্যাঙ্কের দিকে না তাকিয়ে ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন্স (এন আর সি) নবায়নের মাধ্যমে অসম চুক্তি রূপায়ণের কাজে হাত দিয়েছে।
গত ৩০ জুলাই ২০১৮ এন আর সি-র চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হয়েছে। সেদিন অসমের সংবাদপত্রগুলির শিরোনামগুলিতে চোখ বুলিয়ে অসমবাসীর মনটি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। এন আর সি-র চুড়ান্ত খসড়ায় বাদ পড়া ৪০,০০,৭০৭ জন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে সনাক্তকরণের সংবাদ নানা ভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। কোনো কোনো কাগজে ছাপা হয়েছিল এই উপলক্ষে মিষ্টি বিতরণের ছবিও। সব মিলে সেদিনের সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় অসম জুড়ে এক উচ্ছ্বাস ও উৎসবের চিত্র ফুটে উঠেছিল। পরিবেশিত সংবাদগুলির ভাষা থেকে প্রকৃত ভাবটি অনুভব করার প্রয়াস করে মনে হলো এদের প্রত্যেকটিতে রয়েছে এক সুদীর্ঘ যন্ত্রণা উপশমের বার্তা। এই উৎসবের বার্তাবাহী সংবাদ প্রতিবেদনগুলির পাশাপাশি চূড়ান্ত খসড়ায় বাদ পড়ে যাদের ঘাড়ের উপর নাগরিকত্ব হারানোর খাড়া ঝুলছিল ছাপা হয়েছিল তাদের প্রতিক্রিয়াও। নাগরিকত্ব হারানোর মতো চরম পরিস্থিতিতেও ওই মানুষগুলি যে চলমান ব্যবস্থা ও অসম সরকারের উপর আস্থা হারিয়ে অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং তা থেকে উত্তেজনার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে এমন সংবাদ চোখে পড়েনি। সবমিলে এন আর সি-র চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশের পর অসমের মানুষের প্রতিক্রিয়াতে এক অদ্ভুত ধৈৰ্য্য, বিশ্বাস ও ভারসাম্য প্রতিফলিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ‘অতিসংবেদনশীল’ হয়ে গৃহযুদ্ধ বা রক্তপাতের হুমকি দিয়ে বিদ্রোহ উস্কে দেওয়ার নিষ্ফল প্রয়াস করে অসমের মানুষের কাছে নিন্দিত হলেন। নেত্রীর এই ধরণের অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়ার ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের অসম রাজ্য সভাপতি -সহ অন্যান্যরা পদত্যাগ করলেন। ওই রাজ্য থেকে দলটিই অস্তিত্ব শূন্য হয়ে পড়ল।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভায় বক্তব্য রাখার সময় পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়েছে অসমে নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বাঙ্গালিদের রাষ্ট্রহীন করে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় যে শুধু দেশের ভিতরে নয় কিছু বিদেশি শক্তিও অসমকে অশান্ত করার ষড়যন্ত্রে শামিল হয়েছে। বছরের পর ধরে অশান্ত অসমকে এন আর সি-পরবর্তী পরিস্থিতিতেও শান্ত দেখে মরিয়া হয়ে উঠছিল উত্তরপূর্বের অশান্তির কারিগররা। গত ১ নভেম্বর হঠাৎ করেই যেন ছন্দপতন হলো। অসমের তিনসুকিয়া জেলার খেরবাড়ি এলাকায় অজ্ঞাত পরিচয় বন্দুকধারীর গুলিতে প্রাণ হারালেন পাঁচজন নির্দোষ বঙ্গভাষী মানুষ। ক্রমশই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া প্রাদেশিকতার বিষাক্ত ভাবনায় জারিত বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিগুলি যেন আরেকবার মাথা তোলার সুযোগ পেয়ে গেল। বাঙ্গালির স্বঘোষিত ত্রাতা হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পেলেন মমতা ব্যানার্জিও।
ঘড় পোড়া গোরুর মতো উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা সর্বক্ষণ হিন্দু বাঙ্গালি সেন্টিমেন্টকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আবার নিজের কৃষ্টি সংস্কৃতি হারিয়ে নিজভূমে পরবাসী হওয়ার আশঙ্কা তাড়িয়ে বেড়ায় অসমীয়া সেন্টিমেন্টকে। বর্তমানে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন (এন আর সি) ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ নিয়ে উদ্বুদ্ধ জটিল পরিস্থিতিতে অসমে ‘অসমীয়া সেন্টিমেন্টকে’ ও পশ্চিমবঙ্গে ‘বাঙ্গালি সেন্টিমেন্ট’ উস্কে দিয়ে সমস্ত প্রক্রিয়াটি ভেস্তে দিতে দেশ বিরোধী শক্তি সক্রিয় হবে না কল্পনা করাও যায় না। আবার ঘোলা জলে মাছ ধরতে রাজনীতির কারবারিরা মাঠে নামবেন না এটাও ভাবা যায় না। বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হবে যে স্বাধীনোত্তর ভারতে যদি সস্তা সেন্টিমেন্ট ও তোষণের রাজনীতি না হতো তাহলে আজ এন আর সি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের কোনো প্রয়োজনই থাকতো না। অসমের অস্থিরতা রাজনৈতিক কলহ-জাত এরকম ভাবলে ভুল হবে। অসমকে নিয়ে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে শাসক ইংরেজ ও মুসলিম লিগের পরিকল্পনা এবং স্বাধীনোত্তর ভারতে ক্ষমতালোভী কংগ্রেসের আত্মঘাতী নীতির উপর আলোকপাত করতে হবে।
ইংরেজ শাসনের সময় থেকে ধরলে অসম সমস্যার সূত্রপাত দু’শো বছর আগে। ১৮২৬ সাল থেকে অসমে ঔপনিবেশিক শাসনের পত্তন হয়। সুবিধের জন্য ইংরেজরা এই সমস্ত এলাকার প্রশাসনিক প্রয়োজনে বরাবরই ইংরেজি জানা বাংলাভাষীদেরই প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। শাসন ও শোষণই ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের মূলমন্ত্র। রাজস্ব আদায় ছাড়া স্থানীয় ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে এলাকার উন্নয়নের দায় ইংরেজ শাসকদের ছিল না। ইংরেজ জামানায় সমগ্র উত্তরপূর্বে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত স্থাপিত হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই ঔপনিবেশিক শাসনের মুখ হিসেবে বঙ্গভাষীদের সঙ্গে অসমের স্থানীয় মানুষদের বৈরীতার সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। ইতিহাস বলছে এভাবেই দানা বাধতে থাকে ‘অসম সেন্টিমেন্ট’ নামক স্পর্শকাতর ইস্যু। ১৮৩৭ সালে অসমিয়া ভাষাকে সরিয়ে বাংলাকে অসমের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অসমিয়াকে চিহ্নিত করা হয় বাংলার একটি উপভাষা হিসেবে। সে সময় অসমের জনসংখ্যা কম হওয়ার জন্য রাজস্ব আদায় হতো খুবই কম। এই যুক্তিতে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের অঙ্গ হিসেবে ছিল ১৮৭৪ সালে শ্রীহট্ট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া এই তিনটি বাংলাভাষী জেলাকে ঢাকা ডিভিশন থেকে কেটে, অসমের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হলো। ফলে অসম একটি বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে পরিণত হয়।
ব্রিটিশ সরকার বাংলার দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকার চাষিদের অসমের পতিত জমিতে পূর্বাসন নীতি চালু করলে ভূমিহীন মুসলমানরা ব্যাপক হারে অসমমুখী হতে থাকে। অসমীয়া মানুষের প্রতিরোধ সত্ত্বেও বাংলাভাষী মুসলমানরা দলে দলে বসতি স্থাপন করতে থাকে। যে রাজ্যে মুসলমান জনসংখ্যা হিসেবের মধ্যে আসতো না সেখানে মুসলমান জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠতে লাগলো। ১৯০১ সালে এডু ফ্রেজার বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন। ১৯০৩ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গের খসড়া তৈরি করেন। এই খসড়ায় পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম বিভাগ এবং ঢাকা, ময়মনসিংহকে অসমের সঙ্গে যুক্ত করে বাংলা প্রেসিডেন্সির আয়তন হ্রাস করার প্রস্তাব দেন। লর্ড কার্জনের অনুমোদন পাওয়ার পর লন্ডনে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে বলা হয় শাসনতান্ত্রিক সুবিধার জন্য বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব এবং এই নবগঠিত প্রদেশটির নাম হবে পূর্ববঙ্গ অসম। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধুমায়িত হচ্ছে দেখে লর্ড কার্জন জনমত সংগ্রহের জন্য পূর্ববঙ্গ সফরে গিয়ে ঢাকার নবাব সলিমুল্লার অতিথি হলেন। শলাপরামর্শ করে ঠিক হলো পদ্মাপারে একটি মুসলমান প্রধান প্রদেশ গঠন করা হবে। যার রাজধানী হবে ঢাকা। এই সময় ঢাকায় আয়োজিত বিশাল মুসলমান জনসভায় কার্জন তার ভাষণে বলেছিলেন, “পূর্ববঙ্গের মুসলমান জাগরণ, প্রাচীন সুলতান ও সুবেদারদের আমল থেকেই রাজনৈতিক ঐক্য বঞ্চিত, সে জন্য তাদের ঐক্য ফিরিয়ে দিতে হবে।
গর্ভমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৫ অনুসারে ১৯৩৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে অসমে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। এই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয়ী হয়েও কংগ্রেস সরকার গঠনে অস্বীকার করে। এরপর অসমের গভর্নর মহম্মদ সৈদুল্লার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লিগকে মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য ডাকেন। ১ এপ্রিল ১৯৩৭ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৮, ১৭ নভেম্বর ১৯৩৯ থেকে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪১ এবং ২৪ আগস্ট ১৯৪২ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ সৈদুল্লা অসমের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৯ সালে সৈদুল্লা সরকার অসমের পতিত জমিতে বাংলাভাষী মুসলমানদের পুনর্বাসন দেওয়ার নীতি ঘোষণা করেন। সে সময় যুক্তি দেওয়া হয়েছিল কম জনসংখ্যা বিশিষ্ট অসমে পতিত জমিতে আরও বেশি করে খাদশস্য উৎপাদনের জন্যই এই পুনর্বাসন নীতি নেওয়া হয়েছে। ভাইসরয় খোদ লর্ড ওয়াভেল এই ‘গ্রো মোর ফুড’ স্লোগানকে ‘গ্রো মোর মুসলিম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের কার্যকরী সদস্য হিসেবে মহম্মদ সৈদুল্লা ১৯৪০ সালে লিগের লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাবের খসড়া তৈরিতে অংশ নিয়েছিলেন। এহেন সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন সৈদুল্লা ১৯৪৭-এ ভারতের সংবিধান পরিষদের সদস্য হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৪০ সালে লাহোর চুক্তিতে পাকিস্তান প্রস্তাবে অসমকেও পাকিস্তানের অঙ্গ করে নেওয়ার প্রস্তাব উঠল। এই সমস্ত ঘটনাক্রম থেকে এটা স্পষ্ট যে মুসলমানদের শক্তিশালী এবং খুশি করার জন্য অসমকে মুসলমান বহুল রাজ্যে পরিণত করার বিষয়টি ছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির অঙ্গ। অসম পাকিস্তানে গেলে অসমিয়াদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষাগত বৈশিষ্ট রক্ষা সম্ভব নয়। এই আতঙ্কে অসমিয়াদের মধ্যে ভাসতে থাকে ইসলামিক আগ্রাসন নিয়ে আতঙ্ক সেই সঙ্গে ক্ষোভও। এই ক্ষোভ ও আতঙ্ক যে এক সময় বাঙ্গালি বিদ্বেষের রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে থাকে।
দেশভাগের সময় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিতে কোনো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা থাকলে তার ভাগ্য নির্ধারণের জন্য গণ ভোটের দাবি উঠেনি। একমাত্র ব্যাতিক্রম সিলেট জেলা। জিন্নাপন্থীরা দাবি তুললেন সিলেটের ভাগ্য নির্ধারণে গণভোট নিতে হবে। অসমের তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই দাবি মেনে নিলেন। ঠিক হয় ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই গণভোট হবে। এই ভোট কেন্দ্র করে মুসলিম লিগের গুণ্ডরা দাঙ্গা বাধিয়ে এমন ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করল যে ভারতের পক্ষের ভোটদাতারা পোলিং স্টেশনেই পোঁছতেই পারলেন না। ভোটের দুই দিন সমগ্র সিলেট জুড়ে মুসলমান গুণ্ডারা অবাধ রাজত্ব চাললেও কংগ্রেস নেতা গোপীনাথ বরদলুইয়ের নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসন ছিল নির্বাক দর্শক। সিলেটের দুই লক্ষ চা শ্রমিকরা অসম বিধান পরিষদের নির্বাচনে ভোট দিয়েছে মুসলিম লিগের পক্ষ থেকে তাদের ভোট দান থেকে বঞ্চিত রাখার দাবিও মেনে নেওয়া হলো। এক্ষেত্রে মুসলিম লিগের যুক্তি ছিল যে চা শ্রমিকরা ভাসমান নাগরিক সিলেটের ভাগ্য নির্ধারণে তাদের ভূমিকা থাকতে পারে না। সেদিনের সেই প্রহসনের গণভোটে ৫৫,৫৭৮ ভোটের ব্যবধানে সিলেট পাকিস্তানে চলে গেল। সিলেটের পার্শ্ববর্তী জেলা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ কাছারে তখন মুসলমান গুণ্ডাদের বলতে শোনা যেত ‘সিলেট নিলাম গণভোটে, কাছাড় নিমু লাঠির চোটে’।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে অসমবাসীর মন রাখতে অসমকে বাঙ্গালি আগ্রাসনের (পড়ুন ইসলামিক আগ্রাসনের) হাত থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যেই কংগ্রেস নেতারা বর্তমান ত্রিপুরার চেয়ে আয়তনে বড়ো সিলেট জেলাকে পাকিস্তানের দিকে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্তে সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু যে কংগ্রেস নেতরা গণভোটে সায় দিয়ে প্রহসনের ভোটে সিলেটকে পাকিস্তানে ঠেলে দিতে মদত জুগিয়ে ছিলেন দেশভাগের পর ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে সেই কংগ্রেস নেতাদের বঙ্গভাষী মুসলমানদের অসমমুখী করার নীতি প্রমাণ করে যে অসমকে বঙ্গভাষীদের প্রভাব মুক্ত করতে নয় মুসলিম লিগের আবদার মেনে ইংরেজ শাসকদের শক্তিশালী ইসলামিস্থান অর্থাৎ পাকিস্তান গড়ার পরিকল্পনায় মদত জোগাতেই সিলেটকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়ার সংক্রান্তে শামিল হয়েছিলেন। সেই সময় সিলেটে হিন্দু মুসলমান সমান সমান ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই সিলেট পাকিস্তানে যাওয়র পর আবার উদ্বাস্তুর ঢল নামে। কংগ্রেস নেতাদের এই ভুলের জন্য ভারতকে ভূমিও হারাতে হলো আবার উদ্বাস্তুর বোঝাও বইতে হলো। এত বড়ো ঐতিহাসিক ভুল সত্ত্বেও স্বাধীনোত্তর ভারতে অসমের ক্ষমতার রাশ কংগ্রেসের হাতেই থেকে যায়। ফলে আবার ঘটতে থাকে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের অসমে আশ্রয় দেওয়ার মতো ঐতিহাসিক ভুলের পুনরাবৃত্তি, সেই সঙ্গে চলতে থাকে ইসলামিক ও খ্রিস্টান মিশনারীদের পোষিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয়ের হীন রাজনীতিও। ২০১৬ সালে অসমে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর স্বাধীনতার সাতদশক পর প্রথমবার কংগ্রেস ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি এখন প্রবল প্রতিরোধের মুখে।
সাধন কুমার পাল