পাকিস্তান বা বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামিক গোষ্ঠীগুলির গতিবিধি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হবে যে ভয়ংকরতম গণহত্যা সংগঠিত করে ওই দেশগুলিকে হিন্দুশূন্য করাই নয় অসম ও পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে বৃহত্তর ইসলামিক প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে তারা এখনো সক্রিয়। অনুপ্রবেশের মাধ্যমে জনসংখ্যার ভারসাম্য বিগড়ে দিয়ে কাশ্মীরের মতো পরিস্থিতি তৈরি করা তাদের রণনীতির অঙ্গ। ভূমিহীন হতদরিদ্র মুসলমান জনতার ভারতে অনুপ্রবেশের পেছনে অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে রয়েছে এই সমস্ত ইসলামিক গোষ্ঠীগুলির প্রত্যক্ষ সহায়তা। স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ নীতির আড়ালে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির লক্ষ্যে মুসলমান তোষণের রাজনীতি ইসলামিক জেহাদিদের স্বপ্ন পূরণের পথে সহায়ক। স্পষ্টতই স্বাধীনোত্তর ভারতে এই ভোটব্যাঙ্ক নীতির জন্য দেশভাগের পরও পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ থেকে অসমে ও পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। জিন্না সাহেবের প্রেতাত্মারা অসমকে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পরিণত করতে পরিকল্পনা করে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে।
৭১ সালে বাংলাদেশ গঠনের সময় প্রায় ৩ লক্ষ উদ্বাস্তু অসমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে সর্বস্ব হারানো বাঙ্গালি হিন্দুরাও রয়েছেন। মনে করা হয় বাংলাদেশ গঠনের পর এদের সিহভাগই ফিরে যাননি। সেই সঙ্গে অনুপ্রবেশও বন্ধ হয়নি। ১৯৫০ সাল থেকেই এই অনুপ্রবেশের অভিযোগ উঠে আসছে। কেন্দ্র সরকারের সম্মতিক্রমে তখন থেকেই নানা পদক্ষেপ নেওয়া হতে থাকে। অভিবাসী (অসম থেকে উৎখাত আইন) আইন ১৯৫০, আই এমডিটি অ্যাক্ট, সন্দেহজনক অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করণের জন্য ‘ডি’ ক্যাটেগরি ভোটার চিহ্নিতকরণ এই সমস্ত পদক্ষেপের অঙ্গ।
১৯৭৮ সালের ২৮ মার্চে লোকসভার সদস্য হীরালাল পাটোয়ারীর মৃত্যুর ফলে মঙ্গলদৈ লোকসভা কেন্দ্রে উপ-নির্বাচনের প্রয়োজন হয়। সেই শূন্য সংসদ আসন পূরণ করার জন্য ১৯৭৯ শেষের দিকে সেই আসনে উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় ভারতের নির্বাচন কমিশন। একই সঙ্গে ওই বছরের এপ্রিল মাস থেকে নতুন ভোটারদের ভোটার তালিকাতে নামভুক্তির কাজ আরম্ভ করে। মে মাস অব্দি এই ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ অব্যাহত ছিল। কিন্তু মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোটার তালিকাতে প্রচুর অবৈধ বিদেশির নাম ঢুকে গেছে বলে এক অভিযোগ উত্থাপিত হয়। বলা হয়, কংগ্রেস (আই) দল নিজের ভোটব্যাঙ্ক শক্তিশালী করতে কৌশলে সন্দেহজনক নাগরিকের নাম ভোটার তালিকাতে ঢুকিয়েছে। এই অভিযোগ উত্থাপন করে পুরো অসম কঁপিয়ে তোলে সারা অসম ছাত্র সংস্থা। এর আগে অসমে বিদেশি অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে সারা অসম ছাত্র সংস্থা, সংক্ষেপে ‘আসু’ বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচি রূপায়ণ করে আসছিল।
১৯৮০ সালের শেষের দিকে কেন্দ্রীয় সরকার এই আন্দোলনের প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন। এই সময়ে অসমের বিভিন্ন স্থানে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৯৮৩ সালে জনসাধারণের কঠোর বিরোধ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও নির্বাচনে হিতেশ্বর শইকিয়া মুখ্যমন্ত্রী হন। এই আন্দোলনে অসমের নগাঁওয়ের নেলী নামক স্থানে অবৈধ বাংলাদেশিদের হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড নেলীর হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। নেলীর হত্যাকাণ্ডে প্রায় ১৮০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল ও আন্দোলনের সময়ে ৮৫৫ জন ছাত্রের মৃত্যু হয়েছিল। অবশেষে ১৯৮৫ সনের ১৫ আগস্ট আন্দোলনকারী নেতা ও রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার অসম চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৮৫ সালে কেন্দ্র, অসম সরকার , আসু ও এএজিএসপি-র মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় অসম চুক্তি। কেন্দ্রে তখন রাজীব গান্ধী সরকার। এই চুক্তি অনুসারে অভিবাসীদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথমত, যারা ১.১.১৯৬৬ সালের আগে অসমে এসেছিল। দ্বিতীয়ত, যাঁরা ১.১.১৯৬৬ থেকে ২৪.৩.১৯৭১ সালের আগে অসমে এসেছে। তৃতীয়ত, যাঁরা ২৫.৩.১৯৭১ সালের পরে অসমে প্রবেশ করেছে। প্রথম ক্যাটেগরিতে থাকা ব্যক্তিরা নাগরিকত্ব পাবেন। পরের ক্যাটেগরির ব্যক্তিরা দশ বছর নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত থাকবেন। এবং তৃতীয় ক্যাটেগরিতে থাকা ব্যক্তিদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অটল বিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র সরকার, রাজ্য সরকার ও অল অসম স্টুডেন্স ইউনিয়নের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী নবীকরণের সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষ হতেই এই কাজের জন্য কেন্দ্রের তরফ থেকে ২০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকারকে ৫ লক্ষ টাকা দিয়েও দেওয়া হয়। এর পরেও এ ব্যাপারে রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের তরফ থেকে কোনো সক্রিয়তা দেখা যায়নি। ২০০৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের অসম সফরের সময় জাতীয় নাগরিক পঞ্জী নবীকরণের দাবিতে অল অসম স্টুডেন্স ইউনিয়ন বয়কটের ডাক দেয়। এই দাবি মেনে নিয়ে ২০০৫ সালের ৫ মে মনমোহন সিংহের উপস্থিতিতে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়। সিদ্ধান্ত হয় ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে এনআরসি আপডেটের কাজ শেষ করা হবে। কিন্তু সেবারও গৃহীত সিদ্ধান্ত হিমঘরে চলে যায়। ২০০৯ সালের ১২ জুলাই অসম পাবলিক ওয়ার্কস নামে একটি এনজিও সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা করে দাবি করে যে অসমের ভোটার তালিকায় ৪১ লক্ষ বিদেশির নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ২০১০ সালের ২২ এপ্রিল কেন্দ্রীয় গৃহসচিবের নেতৃত্বে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় বরপেটা ও নয়গাঁও রেভিনিউ সার্কেলে এনআরসি নবীকরণের পাইলট প্রজেক্ট শুরু করা হবে। নয়গাঁওয়ে এই পাইলট প্রজেক্ট নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলেও বরপেটায় অল অসম মুসলমান স্টুডেন্টস ইউনিয়নের বিক্ষোভ সামলাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে চার জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর এন আর সি নবীকরণের কাজ আবার হিমঘরে চলে যায়।
অবশেষ ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের মধ্যস্থতায় কেন্দ্র ও বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের উদ্যোগে রাজ্য জুড়ে এনআরসি নবীকরণের কাজ শুরু হয়। গত ৩০ জুলাই এনআরসির চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে ৩ কোটি ২৯ লক্ষ আবেদনকারীর মধ্যে ৪০ লক্ষ ৭ হাজার ৭০৭ জনের নাম খসড়াতে নেই। খসড়া প্রকাশের পর এই চল্লিশ লক্ষ মানুষের পরিচয় নিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উঠে আসছে। বাঙ্গালি সেন্টিমেন্ট উস্কে দেওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলছেন এরা সবাই বাঙ্গালি। মুসলমান ভোট ব্যাঙ্ক অটুট রাখার জন্য মুসলমান মহল্লাগুলিতে গিয়ে বলা হচ্ছে এই চল্লিশ লক্ষের সিংহভাগই মুসলমান। অর্থাৎ ভারতের স্থিতিশীলতা অখণ্ডতার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত এনআরসির মতো একটি গুরুতর বিষয় যেন সস্তা রাজনীতির উপাদানে পরিণত হয়েছে।
উগ্ৰ অসমিয়া সেন্টিমেন্ট কিংবা সস্তা বাঙ্গালি সেন্টিমেন্ট সরিয়ে রেখে যদি এন আর সি নবায়নের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে ধর্মের ভিত্তিতে আবার যেন দেশভাগের পরিস্থিতি তৈরি না হয় সেটি রোধ করাই এনআরসি-এর মূল উদ্দেশ্য। কেউ অসমিয়া ভাষায় কথা বললেই সে অসমিয়া হয়ে যাবে এই বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আবার বাংলা ভাষায় কথা বললেই সে বাঙ্গালি এই বিভ্রান্তি থেকেও মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। ভাষা যদি ঐক্যের ভিত্তি হতো তা হলে বাংলা এবং পঞ্জাব ভাগ করে দেশ ভাগ করতে হতো না। ভাষাগত পরিচয়ের আড়ালে নিজেদের স্বরূপ লুকিয়ে প্রভাব বিস্তার করা যে ইসলামিক জেহাদিদের পুরানো কৌশল এটা আজ প্রমাণিত সত্য। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা, নোয়াখালির দাঙ্গা, গ্রেটক্যালকাটা কিলিং, ১৯৪৭-এর দেশভাগ, লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালির উদ্বাস্তু হওয়ার ইতিহাস একথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে ভাষাগত নয় বাস্তবে হিন্দু মুসলমান ভারসাম্যই দেশের অখণ্ডতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, স্থিতিশিলতা রক্ষার সবচেয়ে বড়ো রক্ষাকবচ। হিন্দু মুসলমান ভারসাম্যের তত্ত্বকে অস্বীকার করে ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘু স্বার্থ রক্ষার মতো মহান আদর্শ আওড়ে যে কোনও এলাকার স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব নয় তা প্রত্যক্ষ অনুভব করতে হলে অসম ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলিতে যেতে হবে। ভাষাগত পরিচয়ের আড়ালে নিজেদের প্রকৃত অভিপ্রায় গোপন করে হিন্দুসংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে অনুপ্রবেশ, অনিয়ন্ত্রিত জন্মহারের সাহায্যে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিণত করে ইসলামিক গণরাজ্যে পরিণত করা ইসলামিক জেহাদিদের অতি পরিচিত রণকৌশল।
অসমের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলি থেকে অসমিয়া হিন্দুদের নিরন্তর পলায়ন জেহাদিদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সেই কৌশলকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। স্বাধীনোত্তর ভারতে এই ভাষাগত পরিচয়ের রণকৌশলের সঙ্গে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের রণকৌশল যুক্ত হওয়াতে দেশভাগের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের সাত দশক অতিবাহিত হয়ে গেলেও ভারতের চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা জেহাদিদের কৌশল মোকাবিলায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। সেই দিক থেকে এন আর সি জেহাদিদের কৌশল মোকাবিলায় একটি বড়ো সাহসী পদক্ষেপ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই এন আর সি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের কতটা চিহ্নিত করতে পারলো? ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসের অসমের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া বলেছিলেন অসমে ৩৩ লক্ষ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। ২০০৪ সালের ১৪ জুলাই কংগ্রেস সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ জয়সোওয়াল রাজ্যসভায় জানান যে ভারতে ১ কোটি ২০ লক্ষ, ৫৩ হাজার ৯৫০ জন অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। এদের মধ্যে অসমে রয়েছে ৫০ লক্ষ এবং পশ্চিমবঙ্গে ৫৭ লক্ষ। বিভিন্ন সূত্র থেকে আসা তথ্য বলছে অসমে এন আর সি থেকে বাদ পড়া চল্লিশ লক্ষের মধ্যে প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ২০ লক্ষ বাংলাদেশি মুসলমান যা কিনা হিতেশ্বর শইকিয়া কিংবা প্রকাশ জয়সোওয়ালের দেওয়া পরিসংখ্যান থেকে অনেকটাই কম হতে পারে। ২০১০-এর পাইলট প্রজেক্টের পর অনুপ্রবেশকারীরা সতর্ক হয়ে গিয়ে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহ করে রেখেছিল। বাকি অর্ধেকের মধ্যে অসমীয়া, বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তু -সহ বিভিন্ন ধরনের মানুষ আছেন। এই সংখ্যাতত্ত্ব থেকে এটা স্পষ্ট যে এনআরসি করেও অসমে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি মুসলমানদের সম্পূর্ণ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ এনআরসি করেও অসমের জনসংখ্যার বিগড়ে যাওয়া ভারসাম্য পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কংগ্রেস অসমে বিরোধিতা করার সাহস না পেলেও ত্রিপুরায় এনআরসি-র বিরুদ্ধে মিছিল করছে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ আইনে পরিণত করে এনআরসি থেকে বাদ পড়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিতে পারলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬-এ বাংলাদেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এই তিনটি দেশে অত্যাচারিত নিপীড়িত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, ক্রিস্টান, পার্শি এই ছয়টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কোনো মানুষ ভারতে প্রবেশ করলে তাকে উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করে নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের পর এই তিনটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অমুসলমানদের মানবাধিকার বলে কিছু নেই।
অমুসলমানদের বিতাড়নের উদ্দেশ্যে এই দেশগুলিতে বিভিন্ন সময়ে নারকীয় অত্যাচার চালানো হয়েছে, সংগঠিত হয়েছে গণহত্যা। পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রায় হিন্দু শূন্য। ১৯৫১ সালে বাংলাদেশের কমবেশি ২৪ শতাংশ হিন্দু ছিল বর্তমানে তা ১৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে যারা নির্যাতিত তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতেই পুনর্বাসন ও নাগরিকত্ব প্রদানের ভাবনা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত।তৃণমূল কংগ্রেসের মতো বেশ কিছু দল সংখ্যালঘু তোষণের লক্ষ্যে এই বিলে অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদেরও নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি তুলছেন। আবার অনেকে এই বিলে বাঙ্গালি আধিপত্যের প্রশ্ন তুলে অসমিয়দের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার কথা বলছেন। এই সমস্ত দাবির মধ্যে কোনওরকম ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবিকতা কিংবা অসমিয়া স্বার্থরক্ষার ভাবনা থাকতে পারে না। বরং বলা ভালো এই দাবির পেছনে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের মোড়কে লুকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ, অসম ও পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে মুঘলিস্থান গঠনের জন্য সক্রিয় ছদ্মবেশি ইসলামিক জেহাদিদের পরিকল্পিত রণনীতি। কারণ ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের ক্ষত এখনো শুকোয়নি। যে সমস্ত মুসলমান শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তান বুঝে নিয়ে সেখানে বসবাস করছে তাদের বা তাদের বংশধরদের আবার এখানে নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি তোলার অর্থ দেশভাগের ইতিহাসকে অস্বীকার করা।
তবে শুধু এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ রূপায়ণ করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। ধর্মমত নির্বিশেষে জন্মহার নিয়ন্ত্রণের বিধিও কঠোর ভাবে বলবৎ করতে হবে। ২০১৮-র ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল বলছে অসমের মানুষ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ইস্যুতে বিজেপির পাশেই আছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি সাময়িক ভাবে পিছু হটলেও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সভায় পাশ হওয়ার পর অপচারের ঝড় তুলে আবার সংগঠিত হওয়ার কোনো সুযোগই যে হাতছাড়া করছে না তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গণতান্ত্রিক উপায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ হয়ে গেছে এই ইস্যুতে মানুষ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বিরোধীদের পক্ষে নেই। সুতরাং উত্তরপূর্ব ভারতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা সংগঠনগুলির সামনে একটিই পথ তা হলো বনধ, অবরোধ, হুমকি, ধমকিও মতো নেতিবাচক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে নিজের শক্তি প্রদর্শন করা। শুধু অসম নয় এই ইস্যুতে সমস্ত উত্তরপূর্ব ভারতকে ক্ষেপিয়ে তুলে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করে তোলার প্রয়াস হচ্ছে। বনধ মিছিল মিটিং সংগঠিত হচ্ছে।
এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে অপপ্রচারের ঝড় তোলা হচ্ছে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ইতিমধ্যেই অসমের নেতাদের আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন যে কোনো মূল্যে নাগরিকত্ব বিলকে রাজ্যসভায় রুখে দেওয়া হবে। বিল বিরোধী মিছিলে ভারত বিরোধী স্লোগান দেওয়ার অভিযোগে ত্রিপুরায় তিন জনজাতি নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা পর্যন্ত করতে হয়েছে ত্রিপুরা পুলিশকে। পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার রাধাপুর থানায় দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়েছে ৩০ জানুয়ারি সভা করার সময় দেশ-বিরোধী ‘বাই বাই ইন্ডিয়া হ্যালো চায়না’ স্লোগান দেওয়া হয়। এদিকে ৮ ফেব্রুয়ারি শিলচরে মণিপুরি ইয়ুথ ফ্রন্ট অব অসম (মাইকা)-এর বাইক মিছিলে যোগ দিয়ে সুশান্ত রাজবংশী নামে এক যুবক ‘ওয়েলকাম চায়না, গোব্যাক ইন্ডিয়া’ স্লোগান দিয়েছিল। শিলচরেও পুলিশকে এই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করতে হয়েছে। উত্তরপূর্ব ভারতে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কংগ্রেস, বামপন্থী ও অগপর মতো আঞ্চলিক দলগুলির তাদের বক্তব্যে এই সমস্ত ভারত বিরোধী ক্রিয়াকলাপের নিন্দা না করে উল্টে বিজেপিকেই দায়ী করছে। ফলে এটা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে এই সমস্ত দলগুলি দেশবিরোধী শক্তিগুলির মদতে ক্ষমতা ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ঠিক একই রকম ভাবে মূলস্রোতের এই সমস্ত দলের প্রশ্রয়েই উত্তরপূর্ব ভারতে ভারত বিরোধী শক্তিগুলি আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এই প্রসঙ্গে গুয়াহাটির একটি জনসভায় দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে অসমের অর্থমন্ত্রী হিমস্ত বিশ্বশর্মা বলেন, “আমরা অসমকে কিছুতেই দ্বিতীয় কাশ্মীর হতে দিতে পারি না। সেটা যাতে না হয় তার জন্য অসম চুক্তির ৬ নম্বর ধারা-সহ এই বিলের প্রয়োগ প্রয়োজন।” বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারীদের জন্য অসমে হিন্দুদের জনসংখ্যা ১০শতাংশ কমে গিয়েছে বলে দাবি করেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। জানান, ১৯৭১ সালে অসমে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৭১ শতাংশ। ২০১১ সালে সেটি কমে হয়েছে ৬১ শতাংশ। আর বাংলাদেশ থেকে আসা ৮ লক্ষ হিন্দুকে বাদ দিলে সংখ্যাটা আরও কমবে। তখন হিন্দুদের জনসংখ্যা কমে মেরেকেটে দাঁড়াবে ৫২ শতাংশ। আর তখন বদরুদ্দিন আজমল অথবা সিরাজুদ্দিন আজমল হবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের একহাত নেন অর্থমন্ত্রী। তোপ দেগে বলেন, সংখ্যালঘুদের সংগঠন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই বিলের বিরোধিতা করার প্রচার করা হচ্ছে। যারা বিরোধিতা করছে তারা এই রাজ্যের অর্থনৈতিক উদ্বাস্তু। কাকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে আর কাকে দেওয়া হবে না সেটা বলার অধিকার এদের কে দিয়েছে? লোকসভা ভোটকে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছে হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেন, যাদের জন্য জম্মু ও কাশ্মীরের রক্ত ঝরেছে। তারা ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ পড়াচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না আত্মঘাতী বাঙ্গালি হিন্দু ঘুমিয়ে থাকলেও তাদের নাগরিকত্বের জন্য লড়ছে অসমিয়ারা। এই লড়াই যে নতুন ভোরের বার্তা বহন করছে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
সাধন কুমার পাল