যোগ সংন্যাস্ত কর্মনাম জ্ঞান সংছিন্ন সংশয়ম ।
আত্মবন্তম ন কর্মনি নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয় ।।
তস্মাত্ অজ্ঞান সম্ভূতম্ হৃত্স্তম জ্ঞান অসিনা আত্মনঃ ।
ছিত্ত্বা এনম্ সংশয়ম যোগম্ অতিষ্ঠ উতিষ্ঠ ভারত ।।
অতএব হে ধনঞ্জয় যিনি নিস্কাম কর্ম যোগের দ্বারা কর্মত্যাগ করেন,জ্ঞনের দ্বারা সংশয় নাশ করেন এবং আত্মার চিন্ময় সরুপ অবগত হন তাকে কোন কর্মে আবদ্ধ করতে পারে না।
হে ভারত তোমার হৃদয় যে অজ্ঞান প্রসুত সংশয়ের উদয় হয়েছে তা জ্ঞানরুপ
খড়গের দ্বারা ছিন্ন কর। যোগাশ্রয় করে যুদ্ধ করার জন্য উঠে দাড়াও।
বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী একজন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক প্রবাদ প্রতিম যুগপুরুষ। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে আত্মোন্নতি ও অনুশীলন একই দেহে বিলীন হলেও বা পরবর্তী সময় যুগান্তরের উত্থান হলেও একজন অমর ,অবিনশ্বর থেকে গিয়েছেন আজও। তিনি হলেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী। তিনি আদর্শ ছিলেন। তাঁর নামে আত্মোন্নতির ছেলেদের বোঝানো হত। সরকারের গুপ্ত নথি সেখানেও লেখা ছিল #The_gang_of_Bipinbihari… এই গ্যাং ই ছিল আত্মোন্নতির সদস্যবৃন্দ।
এই মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়কের জন্ম হয় ১৮৮৭ সালের ৫ ই নভেম্বর। জগতব্ল্ল্ভপুরের মাতুলালয় তাঁর জন্মে পবিত্র হয়ে ওঠে। তাঁর পিতা অক্ষয়নাথ গাঙ্গুলী। তাঁর পিতৃভূমি গঙ্গার পূর্বতীরে হালিশহরে। পিতা কলকাতার ইনকাম ট্যাক্স অফিসে কাজ সুবাদে কলকাতায় থাকতেন। কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে ৪ নম্বর দুর্গা পিতুরী লেনে তাঁর বাস ছিল। ১৮৯৫ -৯৬ খ্রিস্টাব্দে বিপিনবিহারী ওয়েলিংটন স্কোয়ারের উত্তরপূর্ব কোণে খেলাৎচন্দ্র ইনস্টিটিউটশনে ভর্তি হন। সেখানের সিনিয়র ছাত্রদের সংস্পর্শে আসেন ও আত্মোন্নতি সমিতিতে যোগদান করেন।হরিশচন্দ্র শিকদার এবং ইন্দ্রানাথ নন্দী তাঁর বিপ্লবী গুরু। এরপর তিনি রিপন কলেজে ভর্তি হন।আজীবন ব্রহ্মচারী ও বিদ্রোহী বিপিনবিহারী জীবনে পাঁচবার গ্রেপ্তার হন এবং আঠাশ বছর জেল খাটেন।
বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর সঙ্গে কেবলমাত্র আত্মোন্নতি সমিতির সদস্যদেরই সুসম্পর্ক ছিল তা নয় বরং তাঁর স9ঙে নানান বিপ্লবী গোষ্ঠীর বন্ধুত্ব ছিল। যেমন – যুগান্তর পত্রিকার সম্পর্কে এবং স্বামী বিবেকানন্দের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু।
আত্মোন্নতি সমিতি সমাজসেবা ও ব্যায়াম চর্চা ছাড়াও বিপ্লবী মন্ত্রে কর্মকান্ড শুরু করেন ১৯০১ সালের পর থেকে। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের সঙ্গে ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, বারিন ঘোষ, যতীন বন্দোপাধ্যায় প্রমুখের যোগাযোগ ঘটে। তখনই প্রথম গুপ্তসমিতিটি অনুশীলনে মিশে যায়।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের সময় জাতীয় কংগ্রেসের যে কলকাতা অধিবেশন হয়, তার উদ্যোগী ছিলেন প্রমথনাথ মিত্র, সুবোধচন্দ্র মল্লিক….সেখানে আত্মোন্নতির পক্ষে ছিলেন ইন্দ্রানাথ নন্দী। এর পূর্বেই অনুশীলন থেকে যুগান্তর নানা বিপ্লবী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে।তবে যুগান্তর ভিন্ন দল না যেমন নয় আত্মোন্নতি।
বস্তুত বৃহত্তর অনুশীলনের অংশ সকলেই। তবে নিশ্চয় উপদল বা গোষ্ঠী বলা যেতে পারে।আবার অনুশীলনের মধ্যে যুগান্তর গোষ্ঠীর আত্মোন্নতির নৈকট্য ও সহযোগীতা অধিক।
এই আত্মোন্নতি সমিতির পক্ষেই ইন্দ্রানাথ নন্দী, হরিশ শিকদার, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, সুধীর সরকার, নরেন বসু, প্রভাস দে এবং শিশির ঘোষ ময়মনসিংহের জামালপুরে যান দাঙ্গার সময়। সেখানে গ্রেপ্তার হন ইন্দ্রানাথ নন্দী ও বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী।
পরবর্তী সময়ে আত্মোন্নতি সমিতির গোষ্ঠীতে যুক্ত হন ধরানাথ ভট্টাচার্য , আশু দাস, অবিনাশ চক্রবর্তী , বিভূতি চক্রবর্তী, রাখালদাস চট্টোপাধ্যায়, যতীন্ন্দ্রনাথ হালদার, বীরেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ। প্রসঙ্গত রাখালদাসের ভ্রাতাই হলেন বক্সার বলাই চ্যাটার্জী এবং মোহনবাগানের খেলোয়াড় ছিলেন। বীরেন্দ্রনাথ সেনের ভ্রাতা ছিলেন সুশীল সেন। এই ছোট্ট সুশীলকেই বেত মারা হয়েছিল।
এই আত্মোন্নতি সমিতির সদস্যরায় বাংলায় প্রথম স্বদেশী বোমা তৈরি করেন।
১৯০২ সালের ২৪ শে মার্চ দোল পূর্ণিমার দিন অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় । বঙ্গীয় বৈপ্লবিক সমিতি এবং অনুশীলন সমিতি একত্রে মিলিত হয়ে যায়। অনুশীলন সমিতি নামটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে…. এবং এর সঙ্গে আত্মোন্নতি সমিতির মিলিত হয়।
পরবর্তীকালে অনুশীলন সমিতি স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছিল ৪৯ নম্বর কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে। ওই বছরই ঢাকাতে পুলিনবিহারী দাস এর নেতৃত্বে ও কলকাতার নেতাদের সক্রিয়তার ঢাকা অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ১২ তারিখে প্রকাশিত হতে শুরু করে যুগান্তর সাপ্তাহিক পত্রিকা। তাকে কেন্দ্র করেও একটি বিপ্লবী গোষ্ঠী দানা বাঁধতে শুরু করে।
১৯০৯ সালে জানুয়ারি মাসে অনুশীলন সমিতি বেআইনি ঘোষিত হয়। এর আগে পর্যন্ত অনুশীলন সমিতি বৈধ ভাবে ও প্রকাশ্যে কিছু কাজ করত। যেমন : আখড়ায় ব্যায়াম চর্চা, লাঠিখেলা, ছুরি খেলা, নৈশ স্কুল পরিচালনা, রোগীর সেবা, নানা বিষয় ক্লাস ও বক্তৃতা, পল্লী সেবা। স্বভাবতই এসব কাজ অনেকেই ,বিশেষ করে বিশিষ্ট ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন।
অন্যদিকে তাঁদের অন্তরঙ্গ এবং গুপ্ত বিপ্লবী দিক ছিল কার্যকলাপ ,বোমা বন্দুক অস্ত্র চর্চা এবং প্রয়োজনে সেগুলি ব্যবহার করা।এই কাজে মানিক তলার বাগানবাড়ি অর্থাৎ মুরারীপুকুরে চলত কার্যতৎপরতা ।- যা কিংসফোর্ডকে মারার চেষ্টা ,মেদিনীপুর বা নারায়ণগড়, চন্দননগর, পূর্ববঙ্গে বোমা মারার চেষ্টা ,ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলার চেষ্টা , বিদেশ প্রত্যাগতদের হেমচন্দ্র কানুনগো বা প্রেসিডেন্সির রসায়নের উল্লাসকর দত্তের বোমার ফর্মুলা, দেওঘরের পাহাড়ে বোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রফুল্ল চক্রবর্তী আত্মাহুতি, ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর মজঃফরপুর কাজ, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, এবং শেষপর্যন্ত আলিপুর বোমা মামলায় গিয়ে উপনীত হয় ।
পরিশেষে একটি কথা বলি- আত্মোন্নতি ,যুগান্তর, ঢাকা অনুশীলন সমিতি যেটাই হোক না কেন…একথা সত্য যে তৎকালীন চরমপন্থী বিপ্লবীদের মধ্যে অনেক গোষ্ঠী, দল উপদল ছিল । তাঁরা বিভিন্নভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেছেন। তাঁদের আভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যও ছিল। তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে যে তাঁরা জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য, ভাবনাহীন ভাবে, সর্বত্যাগী হয়ে , দুর্জয় ইচ্ছাশক্তির জোরে আত্ম বলিদান দিতে অগ্রসর হয়েছিলেন। যাঁদের জ্বলন্ত দেশপ্রেম দেশবাসীকে ভিক্ষা বৃত্তি ত্যাগ করে সংগ্রাম করতে শিখিয়েছিল, যাঁদের নিকট #স্বরাজ অর্থ ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা। তাঁদের ক্ষয় নেই। তাঁরা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
সমাপ্ত
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ বাংলার প্রথম বিপ্লবী গুপ্তসমিতি “আত্মোন্নতি সমিতি”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি
হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত